মৃত্যুর মিছিল
৬
পাশের কামারাটাও রবিনের শোবার ঘরের মতো এক সাইজের হলেও বেশ অগোছাল। দেয়ালে হালকা নীল এবং গোলাপি রংয়ের ছোপ। এক কোণে একটা দোলনা আর বেসিনেট, দুটো ক্ষুদে প্লাস্টিকের পাখি এবং হাতির পিঠে একজোড়া মোবাইল রাখা ফোন জর্জিয়ার কড়া রোদে চক্কর মারছে।
তারিকের চেহারায় বিভ্রান্তির ছাপ লক্ষ করে রেবেকা বলল, 'গত সফরের পর রবিনের সাথে এই জর্জিয়াতেই ট্রেনিং কমান্ডের ওয়াদা করা হয়েছিল । তারপর কথা ছিল আমরা... যাকগে, অনেক লম্বা সময় অপেক্ষা করেছি আমরা।'
একটা কাউচে কম্বল আর বালিশের ঢিবি। তারিক বুঝতে পারল সময় ও সুযোগ পেলে এখানেই কিঞ্চিৎ ঘুমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে কঠিন কিন্তু রূপসী এই মেয়েটা। পাশের ঘর থেকে ক্ষীণ নড়াচড়া কি গোঙানির শব্দ কানে যাওয়ামাত্র ঝটপট উঠে ছুটে যায়। দেয়াল ঘেঁষে একটা বুকশেল্ফ, বইয়ে ঠাসাঠাসি অবস্থা। মেঝেয় হাজারো ম্যাগাজিন স্তূপ হয়ে আছে। একটা হালকা বাদামী ফ্রিজ, আর একটা ওয়াইড স্ক্রিন টেলিভিশন। কয়েকটা কম্বল ঠেলে একপাশে সরিয়ে কাউচে বসল রেবেকা। ওর সঙ্গে যোগ দিল আনিকা।
বসার মতো আর কোনো জায়গা নেই এ ঘরে।
বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তারিক।
রিমোট তুলে বাটন চাপার ফাঁকে রেবেকা বলল, 'দেখ।'
সজীব হয়ে উঠল টেলিভিশনের পর্দা। খুবই পরিচিত টেলিভিশন সাংবাদিক জ্যাক মিল্টনের কাঁপা কাঁপা ছবিতে ভরে উঠল ওটা। তারিকের চেয়ে বয়সে বছর বিশেক বড় হবে লোকটা, ঘন পাকা দাড়িঅলা শাদামাটা চেহারা। ঠিকমতো আলো পড়লে জুৎসই কোণ থেকে জ্যাকের মুখের আদলটা ওর খ্যাপা, নির্বোধ সমসাময়িকদের চোখে হুবহু আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো লাগে।
এই ব্যাপারটা জ্যাক কখনও অস্বীকার করেনি।
পর্দায় ফিসফিস করে কথা বলছে সে। 'অমি বিশেষ সংবাদদাতা জ্যাক মিল্টন। অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে এই সংবাদ পাঠাচ্ছি।' এরপর আমেরিকার সদিচ্ছার ভয়ানক বিপজ্জনক আউটপোস্ট...নিত্যকার মর্টার আক্রমণ...বিপজ্জনক এলাকা...সন্ত্রাসের সুতিকাগার...পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে ঘৃণার আতুরঘর...ইত্যাদি বকবক করে চলল। কথায় কান না দিয়ে স্রেফ তার চেহারা জরিপ করতে লাগল তারিক।
মাথায় নীল হেলমেট চাপিয়েছে লোকটা, পরনে শাদা হরফে সংবাদপত্র লেখা গাঢ় নীল কেভলার জ্যাকেট। ভাবখানা স্থানীয় পশতুন গোত্রের লোকেরা ওই কথাটার মানে জানে কিংবা জানলেও থোড়াই পরোয়া করে। পরনের ক্যামোফ্লাজ জ্যাকেটটা আর্মি ইস্যু নয়। সে কথা চালিয়ে যাওয়ার সময়ই ক্যামরা এফওবি'র -- ফরোয়ার্ড অপারেটিং বেস-ফুটেজ দেখাতে লাগল। ওখানেই সে এবং তার হাতে গোনা ক্রুরা অবস্থান করছে।
লোকটার পেশাগত জীবনের উত্থান-পতনের কথা মনে পড়ল তারিকের। নিউ ইয়র্কের একটা স্থানীয় টিভির সাংবাদিক হিসাবে ক্যারিয়ার শুরু করে সে, পরে পুলিস এবং দুর্বৃত্তদের নিয়ে বেশ কিছু আলোড়ন তোলা রিপোর্ট করেছে; এরপর তিনটা প্রধান নিউজ নেটওয়ার্কের একটায় লম্বা সময় কাজ করেছে। সেই থেকে দুনিয়ার এমাথা থেকে ওমাথায় চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে।
রেডিও টক শো, টেলিভিশন টক শো, গোটা কতক রিয়েলিটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান, তার নিজের ঝগড়াঝাটি আর বিয়ে নিয়ে অসংখ্য রটনার সাথে পেজ সিক্স এবং পিপল-এ চলতি বিষয়ে লেখা নিবন্ধও বেরিয়েছে তার। এখন একটা নতুন অগোছাল কেবল নিউজ নেটওয়ার্কের ভ্রাম্যমাণ সংবাদাতার কাজ করছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, নিজেই ভিডিও তৈরি করে কাউকে গছানোর সিদ্ধান্ত নেয় সে। কেন যেন তারিকের মনে হচ্ছে, এই ভিডিওটা আদৌ কোনও সংবাদমাধ্যমে যায়নি।
এফওবি অধিনায়ক এবং মাঠের কয়েকজন লোকের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে জ্যাক। যথেষ্ট ঠেলাঠেলি আর পিঠ চাপড়ানির পর অবশেষে মাত্র পাঁচ সেকেন্ডের শটে রবিন রায়হানকে দেখা গেল। পুরোদস্তুর যুদ্ধসাজে সেজেছে। চলমান সার্কাস দেখছে।
'ওই যে আমার রবিন,' ফিসফিস করে বলল রেবেকা। 'দেখতে দারুণ না?'
তারপরই এফওবি সীমানার বাইরে দুটো মর্টার বিস্ফোরিত হওয়ায় কয়েকটা সেকেন্ড কাঁপল ক্যামেরা। এরপর দ্রুত আমেরিকান বি-৫২ বিমান থেকে বোমা বর্ষণের কিছু দৃশ্য চিত্রায়িত হলো। এবং বালির বস্তায় ঢাকা দালানের দরজার সামনে ওড়ানো আমেরিকান পতাকার সামনে শেষ দফা জাঁকালো শট নেওয়া হলো। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে অর্থহীন বকবক করছে জ্যাক।
পর্দার বুকে অ্যাকশন স্থির করে দিল রেবেকা। এবার তারিকের কাছে খোলাসা হলো ব্যাপারটা।
'জ্যাক মিল্টন,' বলল ও। 'তার করার কথা নয় এমন কিছু বলেছে বা রিপোর্ট করেছে। গোপন অপারেশনের পরিকল্পনা। ওই তথ্যের কারণেই তালিবানরা হামলা করার সুযোগ পেয়েছে, তাতে রবিন এবং অন্যরা আহত হয়েছে, ঠিক বলেছি?'
আনিকাকে দেখে মনে হলো অস্বস্তি বোধ করছে ও। রেবেকার চোখেমুখে ক্রোধ আর হিংস্রতা আরো জোরালো হয়ে উঠল।
'না, তারিক,' বলল সে। 'ভুল হয়েছে তোমার।'
'তাহলে ওটা আমাকে দেখালে কেন?'
আবার রিমোটে ফিরে গেল রেবেকার হাত। 'তোমাকেই সেটা জানতে হবে। তোমার কল্পনার চেয়েও খারাপ এটা। অনেক বেশি খারাপ।'
৭
আবার জীবন্ত হলো বিশাল টেলিভিশন পর্দার ইমেজটা। বাটন টিপে একই ধরনের কিছু ছবি পেছনে ফেলে গেল রেবেকা।
তারিকের হাত আর ঘাড়ের পেছনে কেমন যেন ধকধক করছে।
জ্যাক মিল্টন ফিরে এলো পর্দায়। আবারও অর্থহীন কথাবার্তা। তবে ফিসফিস করে কথা বলছে সে, কারণ এখন ওর বন্ধু আর্মিও লোকজন এবং রবিনের সঙ্গে অবস্থান করছে না সে।
একদল তালিবান যোদ্ধার সঙ্গে দেখা যাচ্ছে তাকে, পাহাড়ের ফাকে-ফোকরে ওদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে আর তার ক্যামেরাম্যান রাশিয়ান ৮২ মিমি পডনোস মর্টার নিক্ষেপের দৃশ্য রেকর্ড করছে। তিনটা ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করল ওরা। ক্যামেরাম্যানের উদ্দেশ্যে ফিসফিস করে কিছু বলল জ্যাক। ওগুলোর গতিপথ অনুসরণ করল তার ক্যামেরা...
...ঠিক এফওবি বরাবর, জ্যাককে একটু আগে ওখানেই দেখা গেছে।
'হায় খোদা,' ফিসফিস করে বলে উঠল তারিক।
পরপর দুটো গোলা সরাসরি এফওবির চৌহদ্দীতে আছড়ে পড়ল। চোখের পলকে মর্টার ক্রু, অন্যান্য তালিবান এবং জ্যাক মিল্টন আছাড়িপাছাড়ি করে সটকে পড়ল।
সময় রাত। ভৌতিক সবুজ নাইট ভিশনে শুটিং করা হয়েছে।
রাস্তার পাশে পড়ে আছে ওরা।
জ্যাক মিল্টনের কণ্ঠে আবারও ফিসফিস রিপোর্টিং। তিনজন তালিবান আর্টিলারি শেলের মতো একটা কিছু বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে পুতে রাখছে ওটা।
হায় খোদা।
কাজ শেষে সরে গেল লোকগুলো। ওদের অনুসরণ করছে জ্যাক।
এখন একটা গালিতে এসে হাজির হয়েছে ওরা। উঁকি দিয়ে রাস্তা জরিপ করছে।
দূরে আলো দেখা যাচ্ছে।
ছোটখাটো একটা কনভয় এগিয়ে আসছে।
ফিসফিস করে কথা বলে উঠল রবিনের স্ত্রী। 'ওদের ওখানে থাকার কথা নয়। কিন্তু ওখানে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ওদের...অ্যাম্বুশে পড়ার নির্দেশ।'
এখুনি বমি করে ফেলবে বলে মনে হলো তারিকের।
গাড়িগুলো এগিয়ে আসার সাথে সাথে আরো উত্তেজনা যোগ হলো জ্যাকের ফিসফিসানিতে। আপ-আর্মার্ড হামভী এবং দুটো ট্রাক। হায় খোদা, ভাবল তারিক, ওদের কেউ সতর্ক করতে পারছে না, ওদের পথের আইইডি পুতে রাখা হয়েছে, দেখতে পাচ্ছে না ওরা, জ্যাক কি কিছু করবে না-
চোখ ধাঁধা লাগানো প্রচণ্ড বিস্ফোরণ, আলোর গোলক নাইটভিশন গ্লাসকে ধাঁধিয়ে দিল। প্রবলভাবে কেঁপে উঠল ক্যামেরা। তালিবানদের কণ্ঠে উল্লাস ধ্বনি। গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল, উল্টে পড়া জ্বলন্ত গাড়ির কয়েকটা ক্ষিপ্র ছবি দেখা গেল।
এবার কথা বলে উঠল আনিকা। 'আমার মনে হয় যথেষ্ট দেখা হয়েছে।'
রেবেকা বলল, 'না, দেখা হয়নি।' তো নীরবে লড়াই দেখতে লাগল ওরা তিনজন। মানুষের হতাহতের দৃশ্য চলতে লাগল। আমেরিকান সৈন্যরা লুটিয়ে পড়ছে। অথচ একজন আমেরিকান সাংবাদিকই চেয়ে চেয়ে দেখছে সে ভয়াবহ দৃশ্য।
৮
রেবেকা টেলিভিশন অফ করলে তারিক জানতে চাইল, 'কবেকার ঘটনা এটা?'
'ছয় মাস আগের,' জানাল আনিকা। 'কিছুই শোনোনি তুমি?'
ছয় মাস আগে তারিক তখন ওর চিরদিনের স্বপ্নের হ্রদ-তীরের বাড়ি গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিল। 'নাহ,' বলল ও, 'তখন টেলিভিশনের খবর দেখা বা খবরকাগজ পড়া হয়ে ওঠেনি,' বলল ও।
আস্তে করে রিমোট কন্ট্রোলটা টেবিলে নামিয়ে রাখল রেবেকা। 'জ্যাক কুটোটিও নাড়েনি,' বলল সে। 'লোকটা আমেরিকান, তার উপর রবিনের ইউনিটের সঙ্গেই ছিল। ওদের নিয়ে বেশ কিছু খবর বানিয়েছে, এমন ভাব করেছে যেন সে ওদের বন্ধু...অথচ এক সপ্তাহ পরেই তালিকবানদের শিবিরে গিয়ে হাজির হয়ে আপন লোকদের হতাহত হতে দেখেছে।'
'ঘটনাটা ঘটার সময় নিশ্চয়ই অনেক শোরাগোল হয়েছে?' জানতে চাইল তারিক।
দুহাত এক করল রেবেকা। 'তা ঠিক। কিন্তু জ্যাক মিল্টন যে ওখানে ছিল, সে কতটুকু কি জানে, কেউই বলতে পারেনি। সে যে ঘটনাটা ঠেকাতে পারত, এটা কারো জানা ছিল না...এখন সারাক্ষণ আমার রবিন বেচারা মরে বেঁচে আছে, বেডপ্যানে পেশাব পায়খানা করছে, রাতভর পুরোনো স্মৃতির কথা ভেবে চিৎকার করে কাঁদে ও। ওর দুজন বন্ধু মারা গেছে ওখানে, তিনজন আহত হয়েছে। ওদের ইউনিটের ওর কথা, বাকি সবার কথা বেমালুম ভুলে গেছে সবাই।'
এতক্ষণে ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ খোলাসা হলো তারিকের কাছে।
'আমি কি করতে পারি, বলো?' জানতে চাইল ও।
রেবেকার কণ্ঠস্বর চাঁছাছোলো, পরিষ্কার। 'জ্যাক মিল্টনকে খুঁজে বের করোÑআমার স্বামী এবং অন্যদের সে যে অবস্থা করেছে...আমি চাই সমান আঘাত পাক সে, আমি চাই সে ধ্বংস হোক। তার শেষ দেখতে চাই আমি!'
এরপর আর কিছু বলার থাকতে পারে না। পাশের কামরা থেকে গোঙানির আওয়াজ আসতেই পলকে অদৃশ্য হলো রেবেকা।
'তো?' জানতে চাইল আনিকা।
'আমি...আসলে ব্যাপারটা কি?' জানতে চাইল তারিক।
কিছু বলল না আনিকা।
'তো,' ফের বলল তারিক, 'লম্বা পথ পেরিয়ে পুরোনো বন্ধুকে দেখাতে জর্জিয়ায় নিয়ে এলে আমাকে, কি কারণে?'
'তোমাকে আমি জানি,' বলল আনিকা। 'আগেও দরকারের সময় তোমাকে পেয়েছি। তোমার অ্যাসাইনমেন্ট শেষে দেওয়া সমস্ত রিপোর্ট পড়েছি। তোমার অন্যান্য কর্মকাণ্ডের বয়ানও শুনেছি, যদিও সেসবের কোনও অফিসিয়াল রেকর্ড নেই। তো সেকারণেই তুমি এখন এখানে।'
'সত্যি?' বলে উঠল তারিক। 'তোমার ধারণা আমাকে এতটাই চেন তুমি, ধরে নিয়েছ নিজের মাথাটা আগে বাড়িয়ে দিয়ে যেকোনো বেআইনি কাজে রাজি হয়ে যাব? তোমাকে মনে করিয়ে দিই, আমি কিন্তু অবসরে গেছি।'
'সেটা আমি জানি, কিন্তু --'
'তোমাকে এও মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, নিউ হ্যাম্পশায়ারে, আমার শহরে গতরাতের ছোট দুর্ঘটনার কারণে পুলিসি নজরদারিতে আছি আমি। তোমার ধারণা, এখন প্রতিশোধ নিতে বেরিয়ে পড়াটা আমার জন্যে ঠিক কাজ হবে?'
দুটুকরো টিস্যু পেপারে হাত মুছতে মুছতে আবার ফিরে এলো রেবেকা। 'রবিন সারাক্ষণ তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তারিক। সবসময়। ওরা ওর কি অবস্থা করেছে দেখেছ তুমি। অথচ জ্যাক মিল্টনের গায়ে ফুলের টোকাও লাগেনি। কে জানি না, আমার চিঠির বাক্সে ওই ভিডিওটা ফেলে গেছে, নইলে আমিও বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানতাম না। তুমি এমনি এমনি ছেড়ে দেবে?'
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে রেবেকা আর আনিকা, লক্ষ করল ও। 'তখন ছিল একরকম, এখন অবস্থা ভিন্ন,' বলল ও। 'তোমরা দুজনই ধরে নিয়েছ আমি এখুনি ব্যক্তিগত বদলা নিতে বেরিয়ে পড়ব...তাই না? তাই তো ভাবছ তোমরা? আমাকে সেইরকম লোক ভেবেছ?'
পাশের কামরা থেকে ফের গোঙানির শব্দ এলো। কিন্তু রেবেকা ও আনিকা নড়ল না। সাড়াও দিল না।
ওদের দুজনের উদ্দেশে আশ্বাসের হাসি দিল তারিক।
'হ্যাঁ, ঠিকই ভেবেছ তোমরা,' বলল ও। 'ঠিক তাই করতে যাচ্ছি আমি।'
৯
অন্য একটা দিন। ভিন্ন এক জায়গা।
নিউ হ্যাম্পশায়ারের জমাট বাঁধা লেক মেরি বা জর্জিয়ার উষ্ণ প্রীতিকর বার্নসের বদলে এখন ম্যানহাটানের শহুরে অরণ্যে রয়েছে ও।
অবশ্য, নিঃসঙ্গ নয়।
একটা গাঢ় নীল রংয়ের জিএমসি ইউকোনে বসে আছে ও। ড্রাইভিং সিটে রয়েছে আনিকা। এর আগে অভাসে গাড়ি চালানোর ইঙ্গিত দিয়েছিল তারিক, কিন্তু এমনভাবে ওর দিকে তাকিয়েছে আনিকা, ভাবখানা, 'নাহে, চিন্তাও করো না।' তারপর পিছলে উঠে বসেছে চালকের আসনে। আটলান্টা-হার্টসফিল্ড এয়ারপোর্টের একটা মামুলি হোটেলে রাত কাটিয়েছে ওরা। জেএফকে-তে নামার পর বেশ কয়েকটা ওয়াকওয়ে এবং ফাঁকা করিডর পার করে অবশেষে একটা ঘেরাও করা পার্কিং এরিয়ায় নিয়ে আসে ওকে আনিকা। ওখানে চামড়ার ওয়ালেটের চকিত ঝলকই অ্যাটেন্ডেন্টকে ইউকোনে ঢোকার সুযোগ দিতে প্ররোচিত করে।
'তোমার মতো ছিপছিপে মেয়ের বিচারে গাড়িটা বেশ বড়,' মন্তব্য করেছিল তারিক।
'তোমার অহঙ্কার আর শরীর রাখার মতো যথেষ্ট জায়গা থাকা নিশ্চিত করতে চেয়েছি,' বলেছে আনিকা। 'দয়া করে উঠে বসো।'
এখন সেইন্ট প্যাট্রিক ক্যাথিড্রাল থেকে এক ব্লক উত্তরে রকেফেলার প্লাযার কাছে ফিফথ অ্যাভিনিউতে বেআইনিভাবে পার্ক করে বসে আছে ওরা। অপেক্ষা করছে। হালকা কুয়াশা ঝরছে, নিচু হয়ে ভাসমান মেঘের দল আশপাশের দালানগুলোর উপরের অংশগুলো আড়াল করে দিয়েছে। ড্যাশবোর্ডের ঘড়ি দেখল তারিক। এখনো সময় হয়নি। একটা স্যুট পরেছে ও, চত্রিশ ঘণ্টা আগেও একটা র্যাকে ঝুলছিল ওটা। সামনের সিটের নিচে হোলস্টারে ঠাসা রয়েছে ওর সিগ সওয়ার পিস্তলটা। আগামী একটি ঘণ্টায় ওটা কাজে লাগানোর দরকার হবে না বলেই আশা করছে।
আনিকাকে মোটামুটি শান্ত দেখাচ্ছে। হর্ন বাজিয়ে ঝড়ের বেগে চলন্ত গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে যেতে দিচ্ছে ও। কিন্তু কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে আছে তারিক। গাড়িঘোড়ার সংখ্যা বড্ড বেশি, প্রচুর লোকজন, অনেক বেশি চলাচল।
বারবার উইন্ডশিল্ড থেকে জানালা, সেখান থেকে সাইড ভিউ মিরর হয়ে ফের উইন্ডশিল্ডের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে ওর। আজ সকালে এই তৃতীয় দফা এনওয়াইপিডি পুলিস বাতির ঝলক তুলে ওদের গাড়ির পেছনে এসে থামল।
তৃতীয় দফা অগ্রাহ্য করল আনিকা।
'এভাবেই করতে চাইছ, ঠিক?' জানতে চাইল ও।
এখনো পুলিসের গাড়ি দেখছে তারিক। মাইক্রোফোনে কথা বলছে প্যাসেঞ্জার সিটের পুলিসটা, লক্ষ করল ও। নির্ঘাৎ ওপাশের কাউকে লাইসেন্স নাম্বার জানাচ্ছে।
'অনেকসময় সরাসরি কায়দাই বেশি কাজ দেয়। মানুষ চমকে যায়, তাল হারায়।'
'সরাসরি কায়দা অনেক সময় আত্মহত্যার মতোও হতে পারে,' বলল ও। 'আগের দিনে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশদের সরাসরি হামলা করত গোত্রীয় যোদ্ধারা। একদম সরাসরি, সাহসের সঙ্গে, কিন্তু ব্রিটদের ম্যাক্সিম গানের সামনে পড়লেই নৈবচ নৈবচ। ওদের জন্যে সুখকর পরিণতি ছিল না।'
'লাল উর্দি দেখলেই সোজা উল্টো পথে হাঁটা ধরব,' বলল তারিক।
'তা তো বটেই।'
'তখন না হয় মৃত্যুর কত কাছ থেকে ফিরে এসেছি বলে সান্ত¦না দিতে পারবে।'
'অমন কিছু ভাবতেও যেয়ো না।'
এনওয়াইপিডি ক্রুজার বাতি নেভাল। পিছিয়ে গিয়ে ট্রাফিকের সঙ্গে মিশে গেল ওটা। আরো একবার ঘড়ি দেখল তারিক। আরও ছয় মিনিট।
চুপচাপ বসে রইল ওরা।
'বিচ্ছিরি দিন,' বলল তারিক।
সামনে ঝুঁকে পাশের জানালা দিয়ে নজর চালাল আনিকা। 'এই আবহাওয়া আমার ভালো লাগে।'
'কেন?'
আবার হেলান দিয়ে বসল আনিকা। 'আকাশ এভাবে মেঘে ঢাকা থাকার মানে এয়ারলাইনগুলো স্কাইস্ক্র্যাপারের সঙ্গে টক্কর খেতে পারবে না।' আঙুলে তাল ঠুকল ও, তারপর আবার বলল, 'ঠিকাছে। সময় হয়েছে।'
দরজার দিকে হাত বাড়িয়েও থেমে গেল তারিক। ওর কব্জি ধরে রেখেছে আনিকা।
এই প্রথম এভাবে ওকে স্পর্শ করেছে সে, যেখানে হুমকি দেয়ার বা প্রশিক্ষণের সময় ওকে ছুঁড়ে ফেলার মতো কিছু নেই।
'তারিক।'
'এখনো আছি।'
'প্লিজ... আলীয়া আর অন্যদের সঙ্গে তোমার শেষ অপারেশনটা... । আমাকে বলতে পারো --'
যারপরনাই আলগোছে কব্জির উপর থেকে অনিকার হাত সরাল তারিক। 'তুমি ভালো করেই জানো, আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব না।'
'তাহলে অফিসিয়াল বয়ানই ধরে নিতে হবে?' জানতে চাইল আনিকা।
ওর হাতে আস্তে করে চাপ দিল তারিক। ওর কোলে নামিয়ে রাখল হাতটা। 'তুমি জানো, সবসময়ই অফিসিয়াল বয়ান।'
১০
মাত্র দুপুর গড়িয়েছে, তার মানে খাওয়ার সময়। দালানের লবিতে ব্যস্ততা। লোকজন শশব্যস্ত হয়ে যাওয়া-আসা করছে। আত্মবিশ্বাসের সাথে ভীড়ের ভেতর পথ করে আগে বাড়ল তারিক। যেন এখানেই কাজ করে, যেন গন্তব্য সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল।
হাঁটু সমান উঁচু কিয়স্কে কর্মচারী কিংবা ভেন্ডররা চটপট স্বয়ংক্রিয় রীডারে পরিচয়পত্র ছুঁইয়ে দ্রুত ভেতরে ঢুকে পড়ছে। এক লোককে চারটে কফি ক্যান্ডির বাক্স নিয়ে দ্রুত পায়ে এগোতে দেখে তার পিছু নিল ও।
লোকটা আইডি কার্ড বাড়িয়ে দিতেই পলকের জন্যে বীপধ্বনি উঠল, তারপরই পলকে একটা এলিভেটরে উঠে পড়ল তারিক। উপরে উঠছে ওটা। ভেতরে অসংখ্য লোকজন: এশিয়, হিস্পানিক, আফ্রিকান-আমেরিকান। আরোও নানা পদের লোকজনও আছে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে।
আজকাল এই ব্যাপারটা বাইরের দুনিয়ায় আর দেখা যায় না, ভাবল ও।
উনত্রিশ নম্বর ফ্লোরে একবার থামল এলিভেটর, পিছলে খুলে গেল দরজাটা। চট করে বেরিয়ে এলো ও।
কার্পেটমোড়া প্রশস্ত, বিলাসবহুল লবি। রিসিপশনিস্টের মাথার উপর দেয়ালে ঝলমলে হরফে বড় বড় করে লেখা রয়েছে: ন্যাশনাল নিউজ নেটওয়ার্ক (এনএনএন)। ছাদ থেকে তিনটা পেল্লায় সাইজের টিভি ঝুলছে, সবকটাতেই এনএনএন-এর হালনাগাদ খবর দেখাচ্ছে। বৃত্তাকার দেয়াল জুড়ে সাঁটানো এনএনএন সাংবাদিকদের সাতটা পোস্টার সাইজ ছবি, সেগুলোর ভেতর তিনটায় জ্যাক মিল্টনকে রণক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। ঘন শাদা দাড়ি এবং আপাত প্রফুল্ল নীল চোখে দেখছে সে।
ওই চোখজোড়া ফুলে ঢোল হবে, নীল হয়ে যাবে, মনে মনে ভাবল তারিক।
রিসিপশনের ডেস্কটা বাঁকানো। ওটার পেছনে সোনালি চুল আকর্ষণীয়া চেহারার একটা মেয়ে বসে আছে। মাথায় হেডসেট। ওর দিকে এগিয়ে গেল তারিক, শীতল নৈপুণ্য নিয়ে হাসিমুখে ওর দিকে তাকাল মেয়েটা। 'কোনো সাহায্য করতে পারি?' জানতে চাইল সে।
জবাবে মধুর হাসি উপহার দিল ও। সামান্য পদাতিক সৈন্য ও, ওকে আঘাত না দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টাই করবে তারিক। মেয়েটার পরনে উজ্জ্বল লাল রংয়ের পোশাক, ডান হাতের উল্টোপিঠে ছোট হলদে সূর্যমূখী ফলের টাট্টু।
'নিশ্চয়ই,' বলল ও।
এটুকু বলেই চুপ করে থাকল ও। কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত দেখাল মেয়েটাকে। 'তা কিভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি, স্যার?'
'জ্যাক মিল্টনের সঙ্গে দেখা করতে চাই।'
'ও, আচ্ছা,' একটা কম্পিউটারের কীবোর্ডের উপর স্থিও হলো ওর আঙুলগুলো। 'অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?'
'নাহ।'
'আমি...মানে...'
হাসি অম্লান রেখেই সামনে ঝুঁকল তারিক। 'কি জানো, বিদেশে জ্যাকের সঙ্গে আলাপপরিচয়। আমি চাকরি করার সময়। কিঞ্চিৎ বিশ্রী পরিস্থিতি ছিল সেটা।'
'অ।'
মাথা ঝাঁকাল তারিক। 'অবস্থা খতরনাক হয়ে উঠছিল, কাজটা শেষ হওয়ার পর জ্যাক বলেছিল, "দোস্ত, শহরে এলেই আমার ওখানে যাবে কিন্তু, দেখা করবে।"'
লবি এলাকা জরিপ করার একটা ভাব করল তারিক। 'খাসা জায়গা। মরুভূমি আর পাহাড়পর্বতের চেয়ে হাজারগুন ভালো। তো, ওর সঙ্গে দেখা করা যাবে?'
'ওকে কি নাম বলব?' জানতে চাইল মেয়েটা।
'ধন্যবাদ,' প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল তারিক। তারপর একটা আরমাদায়ক কাউচে বসে পড়ল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল তরুণী রিসিপশনিস্ট। ওকে কারো সঙ্গে কথা বলতে দেখল ও। ওর ডেস্কের দুপাশে দুটো ভারী কাঁচের দরজা দেখা যাচ্ছে। এনএনএন-এর লোকজন ভেতরে আসছে, তারপর একটা কী-কার্ড ব্যবহার করে ওপাশে যাচ্ছে।
ওর কাছে কোনো কী-কার্ড নেই।
চিন্তারও কিছু নেই।
নিউ ইয়র্ক টাইমস -এর একটা কপি তুলে নিয়ে পড়ার ভান করতে লাগল ও।
কয়েক মিনিট কেটে গেল। তরুণী বলে উঠল, 'স্যার?'
'হ্যাঁ, বলো?'
'জ্যাক মিল্টন এখানে নেই।'
'ওহ, কোথায় গেছে বলতে পারো?'
'মনে হয় না,' ওর প্রতি সহানুভূতির একটা ভাব করে বলল সে। ও উঠে বিদায় হয়ে যাবে বলেই মনে মনে আশা করছে মেয়েটা, বুঝতে পারল তারিক।
দুঃখিত, ওটি হওয়ার নয়, ভাবল ও।
'কুছ পরোয়া নেহি,' টাইমস রেখে বলল ও। 'ও ফিরে আসা অবধি অপেক্ষা করব আমি।'
'আজকে সে আসবে কিনা নিশ্চিত নই।'
'কোনো সমস্যা নেই। আমি অপেক্ষা করছি।'
'কিন্তু...তোমাকে তো চলে যেতে হবে।'
'তোমার উদ্বেগের জন্যে ধর্যবাদ,' বলল ও। 'কিন্তু এখানেই ভালো লাগছে আমার। কারণ কি, জানো?'
মাথা নাড়ল মেয়েটা।
'এখানে হতচ্ছাড়া মরুভূমির ডাঁশ মাছি নেই,' বলে একটু দম নিল ও। 'ম্যা'ম।'
সময় কেটে যেতে লাগল। লোকজন আসছে, যাচ্ছে। ওদের সবাইকে একই কথা বলছে তারিক, 'মাফ করবে, জ্যাককে আমার কথা একটু বলবে? বলবে, আমি এখানে অপেক্ষা করছি?'
এনএনএন-এর কিছু লোক ওকে অগ্রাহ্য করে যাচেছ, অন্যরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রিসিপশনিস্টের দিকে তাকাচ্ছে। অবশেষে ব্যাপারটা ঘটল।
ভারী গুঞ্জন তুলে খুলে গেল বাম দিকের দরজাটা। দুজন বিশালদেহী লোক বেরিয়ে এলো ওপাশ থেকে। ওদের দুজনের পায়ে কালো জুতো, পরনে গাঢ় নীল স্ল্যাক্স, শাদা শার্ট এবং গাঢ় নীল ব্লেযার। দুজনের কানে ইয়ারপীস গোজা। দুজনই বয়সে ওর চেয়ে বছর দুই ছোট হবে।
লাল উর্দি নেই। এটা ভালো লক্ষণ, ভাবল তারিক।
পত্রিকাটা ধীরে সুস্থে ভাজ করে কফি টেবিলে রাখল ও।
উঠে দাঁড়াল।
'হায় খোদা, তোমাদের কাউকেই তো জ্যাক মিল্টনের মতো লাগছে না,' বলল ও।
'হ্যাঁ, প্রায়ই কথা শুনতে হয় আমাদের,' বামপাশের জন বলল কথাটা। 'তুমি ব্যাপারটা আমাদের জন্যে সহজ করে দেবে কিনা?'
'সহজ মানেটা যদি বলতে।'
'তুমি ঘুরে দাঁড়িয়ে সোজা কেটে পড়বে।'
রিসিপশনিস্টের উদ্দেশে হাসল তারিক। জবাবে দুর্বল হাসি দিল মেয়েটা।
'সহজ কিছু কখনোই পছন্দ না আমার,' বলল ও। 'তো এখন কেন সেটা করতে যাব?'
- [চলবে]