মৃত্যুর মিছিল
তারিকের শেষ গোপন মিশন, কিন্তু বিশ্বাসঘাকতা কঠিন বিপদে নিয়ে ফেলল তাকে। বেঁচে ফিরতে হলে জীবন বাজি রাখা ছাড়া কোনো উপায় নাই। কিন্তু চারিদিকে শত্রু কাকে বিশ্বাস করবে...
তিন
কিছুই বলল না তারিক। বলার আছেই বা কি? ওরা পেশাদার। এইমাত্র ওদের চারজন বন্ধুকে পোড়া হাড়-মাংসে পরিণত হতে দেখা সৈন্যরাও তাই। তো ফের কাজের দিকে মন দিল ওরা। দুজন ক্রু চিফ বসতে সাহায্য করল ওদের। হেলমেট খুলে হেডসেট পরে সুইচ অন করল তারিক। সামনে অতিরিক্ত বড় আকারের হেলমেট মাথায় পাইলট এবং কো-পাইলটকে শুকনো পোকার মতো লাগছে। 'দিস ইজ ওয়ালেবি ওয়ান,' বলল ও, 'ওয়ালেবি স্ট্রাইক।'
করকর আওয়াজের ভেতর লীড পাইলটের শান্ত পেশাদারী কণ্ঠস্বর কানে এলো ওর। 'ওয়ালেবি ওয়ান, রিড ইউ ফাইভ বাই ফাইভ।'
একটু বিরতি, তারপর আবার কথা বলল সে। 'আপাত যান্ত্রিক গোলযোগের কারণেই আমাদের অন্য হক-টা খুইয়েছি বলে জানাচ্ছে টাওয়ার। কেউ বেঁচে আছে কিনা খবর মেলেনি।'
ভালো খবর পাওয়ার আশা নেই, ভাবল তারিক, কিন্তু মুখে বলতে ইচ্ছা হলো না। তর্কসাপেক্ষে ইনভিজিবল হক আকাশে ওড়ার পক্ষে কুৎসিতদর্শন যন্ত্র। ভি-২২ অসপ্রের প্রথম দুই-এক বছরের মতো, পাইলটদের আনকোরা নতুন এবং জটিল ধরনের কিছু ওড়ানোর কায়দাকানুনের সাথে পরিচিত হয়ে উঠতে হয়েছিল বলে যথেষ্ট দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে ওগুলোও।
গলা খাঁকারি দিল পাইলট। 'তো, তোমরা জানো, ওয়য়লেবি ওয়ান, অন্য একমাত্র হক-টা এখন এনএএস সিগোনেলায় রয়েছে।'
সিগোনেলা। সিসিলিতে, যত দূরে থাকা সম্ভব আরকি, ওখানে ওরা আবার ইতালিয় ভাষায় কথা বলে। তারমানে ওদের সাহায্য করার মতো দ্বিতীয় কেনো স্টিলথ আসছে না। অর্থাৎ করণীয় সম্পর্কে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে ওকে।
দ্রুত মনস্থির করল ও। 'হক, আমরা যাচ্ছি।'
'রজার দ্যাট, ওয়ালেবি ওয়ান, আমরা যাচ্ছি।'
'ঠিকাছে তাহলে।' চুপ রইল ও, নাইটস্টকারের ক্রুদের যার যার কাজ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিল। বিভিন্ন বিপজ্জনক জায়গায় লোকজন আনানেয়া করে ওরা। গোলমেলে বালকান্স এবং ওদের এখনকার গন্তব্য বেলগ্রেডের দক্ষিণ পশ্চিমের সার্বিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম নিশ্চিতভাবেই এই সংজ্ঞায় পড়ে।
চুপচাপ বসে আছে ওর সঙ্গীরা। ওদেরও যে যার মতো থাকতে দিল ও। যেকোনো বিপজ্জনক ওই এলাকায় যাওয়ার নিজস্ব কায়দা আছে ওদের। বাজে কথা বলে সাহস যোগানোর দরকার পড়ে না। মিশনের ওয়ালেবি স্ট্রাইক নাম বাছাইয়ের পেছনে এটাও একটা কারণ ছিল। কেন নয়? বহু মিশনের ডেজার্ট স্টর্ম, ডেজার্ট স্যাবর, নেপচুন স্পিয়ার, ডেজার্ট শিল্ড টাইপের চটজলদি পাওয়া নাম রাখা হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়ালেবিই পছন্দ তারিকের।
অন্ধকারে চোখ রেখে অপারেশনের পরিকল্পনা, কাজের ধারা, ব্যর্থ হলে বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে লাগল ও। পরিকল্পনা যত ভেবেচিন্তেই করা হোক, কেঁচে যাবেই। তবে আরো হাজারো ভাবনাও ঠেলাঠেলি করে জায়গা নিতে চাচ্ছে। এটাই ওর শেষ মিশন হওয়ার কথা, কোনো একদিন নিউ হ্যাম্পশায়ারে একটা নির্দিষ্ট নিরিবিলি হ্রদের ধারে বসতি করার কথা।
দূরে, নিরিবিলি কোনো জায়গা, যেখানে ওকে বিরক্ত করতে যাবে না কেউ।
দুই ঘণ্টা পর চিন্তায় বাদ সাধল লিড পাইলট, তখনও এইসব ভাবনাই ঘুরপাক খাচ্ছিল ওর মাথায়। 'ওয়ালেবি ওয়ান, সময় হয়ে আসছে। ড্রপ যোনের আন্দাজ চল্লিশ মিনিট দূরে আছি আমরা।'
'রজার দ্যাট,' বলে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে প্রত্যেকেই নেম ব্যাজ ছিঁড়ে মেঝেয় ফেলল। রুটিন কাজ এটা। ওগুলো তুলে একটা জালি ব্যাগে ঢোকাল তারিক, তারপর চপারের সবচেয়ে কাছের বাল্কহেডে ঝুলিয়ে দিল। পরে আবার যোগাড় করে নেবে।
নিমেষে তৈরি হয়ে গেল ওরা। যান্ত্রিক পুতুলের মতো যার যার কাজে সুপ্রশিক্ষিত ওরা। সমস্ত গিয়ার জায়গামতো রয়েছে কিনা, প্যারাশূটগুলো ঠিকঠাক সাঁটা হলো কিনা, অস্ত্রশস্ত্র ঠিকমতো আছে কিনা, নিশ্চিত হয়ে নিল। নিরস্ত্র অবস্থায় হুট করে ফ্রি ফায়ার যোনে নেমে পড়লে বেকায়দা অবস্থা সৃষ্টি হবে। একাধিক অস্ত্র বহন করছে ওর দলের সবাই। ওরা উদার হলেও নিজের অস্ত্র ঠিকমতো থাকার ব্যাপারটা কেউ নিশ্চিত না করলে সেই নির্বোধকে নিজের অস্ত্র ধার দেয়ার বেলায় দ্বিতীয় চিন্তা করবে।
ইনভিজিবল হকের জনাকীর্ণ মেইন কেবিনে আলীয়া বোরোযোনের সাথে খানিকটা সময় কাটাল ও, দরকারের চেয়ে একটু বেশি সময় নিয়েই ওর বেল্ট আর স্ট্র্যাপ টেনেটুনে পরখ করল। ওর কাÐ দেখে মৃদু হাসি দেখা দিল বারোযানের ঠোঁটে। রীতিমতো অপেশাদারীত্বের লক্ষণ, কিন্তু একে উদারতার সাথে নিয়ে উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল ও।
'ওয়ালেবি ওয়ান, নব্বই সেকেন্ড।'
'রজার দ্যাট।'
ইন্টারকম সিস্টেম খুলে হেলমেট নিয়ে নাইট ভিশন গগলসের (ওগুলোকে অবশ্য এনভিজি বলে) সুইচ অন করে করল, মাথায় চাপাল ওটা। মূল দরজার দিকে এগিয়ে গেল এক ক্রু চিফ। এক লাইনে দাঁড়াল ওরা। অপেক্ষা করতে লাগল। চপারের ভেতরটা-নাইট ভিশন ঠিক রাখতে লাল বাতিতে স্বল্পালোকিত-অন্ধকার হয়ে গেল। খুবই অভ্যস্ত কায়দায় দরজা মেলে ধরল ক্রু চিফ, হিমশীতল হাওয়া ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইল ওদের।
অপেক্ষা করছে ওরা।
ঘন মেঘে ঢাকা আকাশে চাঁদের নামনিশানা নেই। তবে নিচে পাহাড়পর্বত, গাছপালায় ভরা জঙ্গলের আভাস চোখে পড়ছে। হঠাৎ কু গেয়ে উঠল ওর মন। জোর করে সেটাকে দূরে ঠেলে দিল ও। খোদা, ওই জায়গায় ঝাপিয়ে পড়তে হবে আমাকে? একটা আঙুল তুলে এক মিনিট বাকি থাকার ইঙ্গিত দিল ক্রু চিফ। অন্ধকারে ঝাপিয়ে পড়তে একে একে সামনে এগোতে লাগল ওরা।
সবার আগে বেরিয়ে গেল শের। বাকিরা সময় নষ্ট করল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সার্বিয়ার রাতের আকাশে বেরিয়ে এলো সবাই। ওদের শ্যূটগুলো একে একে খুলে যেতেই স্ট্র্যাপগুলো চেপে বসল। হ্যাঁচকা টান অনুভব করল তারিক। নিমেষে অতীতের সফল মিশনগুলোর স্মৃতি মনে করিয়ে দিল শরীরের পেশিগুলো। আগেও হ্যালো (হাই অল্টিচ্যুড, লো ওপেনিং) আর হ্যাহো (হাই অল্টিচ্যুড, হাই ওপেনিং) ট্রেনিংসহ বহুবার এভাবে ঝাপ দিয়েছে ওরা। অবশ্য, ইদানীং রুশ বন্ধু এবং সার্বদের হাতে নতুন রেডার এবং সার্চ সিস্টেম থাকার কথা কানে এসেছে ওর। শূন্যে ওদের মতো ক্ষুদে জিনিসের অস্তিত্বও ধরতে পাওে এসব। সেকারণেই এত অল্প উচ্চতা থেকে ঝাপ দেয়া, এটা প্যারাফয়েলগুলোকে খোলার মতো ফুরসতটুকুই দেবে কেবল।
লিড জাম্পার হওয়ায় কম্পাস আর নাইট ভিশন গিয়ারের সাহায্যে ওদের পথ দেখাচ্ছে মাইকেল শের। বাকিরা তার উপরে জটলা বেঁধে আছে। একের এর এক। নামার পথে কর্কস্ক্রুর কায়দায় পাক খাচ্ছে ওরা। পুবে বেশ দূরে দিগন্তে চারপাশে হলদে-লাল ট্রেসার ফায়ার চোখে পড়ছে। ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করল তারিক। ওদের নিশানা করে ছোঁড়া হচ্ছে না ওগুলো। মাথা ঘামানোর পক্ষে বহু দূরে।
কিন্তু অন্য একটা ব্যাপার উড়িয়ে দিতে পারল না ও। নিচে, চারপাশের বন থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানো খানাখন্দে ভরা পাথুরে পাহাড়চূড়া ওদের ড্রপ যোন। ওর নিচে চারটে প্যারাফয়েল থাকার কথা, সবার শেষে লাফ দিয়েছে ও।
কিন্তু মাত্র তিনটা চোখে পড়ছে।
বিশ সেকেন্ডও পেরোয়নি হতচ্ছাড়া মিশন শুরু হয়েছে, এখনই কেঁচে যেতে বসেছে।
একে একে পাহাড়ের মাথায় নেমে এলো ওরা। কালো শ্যূটগুলো পেছনে পতাকার মতো উড়ছে। ওগুলোকে একসঙ্গে গুছিয়ে নিজেদের অবস্থান নিরাপদ করল ওরা। শ্যূটগুলো লুকিয়ে রেখে মাথা গুনল ও। নিশ্চিতভাবেই একজন লাপাত্তা।
ক্লেটন।
দলের সবাইকে একসাথে করল ও। এক হাঁটু গেড়ে বসেছে ওরা, সতর্ক। কথা বললেও নাইট ভিশন গিয়ার পরে নিয়েছে। ফলে চারপাশের সমস্ত কিছু ভৌতিক সবুজ রংয়ে আলোকিত হয়ে উঠেছে।
'কি ঘটেছে কেউ দেখেছ?' জানতে চাইল তারিক।
জবাব নেই।
'তোমরা কেউ শ্যূট দেখেছ?'
ফের নীরবতার মোকাবিলা করল ও।
'খালিদ,' বলল তারিক। 'আমরা ঝাপ দেয়ার সময় ক্লেটনের পিছে ছিলে তুমি। কি দেখেছ?'
'দুঃখিত, ওস্তাদ,' বলল খালিদ। 'ঝটপট ঘটেছে সবকিছু। এসব কেমন হয় জানো তুমি। শ্যূট খোলার পর তিনটা কর্কস্ক্রুর পরেই জমিনে নেমে এসেছি আমরা।'
'পেয়েছি ওকে,' বলে উঠল আলীয়া বোরোযান। 'বেঁচে আছে ও।' অসংখ্য বিষয়ে ট্রেনিং পেলেও আলীয়াওদের দলের লীড মেডিক। একটা এনক্রিপটেড হ্যান্ডহোল্ড ডিভাইস রয়েছে ওর হাতে। তারিকের ঘাড়ের একটা জায়গা চুলবুল করছে। লো-রেঞ্জ ট্রান্সসিভারসহ ছোট আঠাল মেডিকেল ডিভাইস লাগানো আছে ওখানে। বোরোযানকে ওর এবং বাকি সবার শারীরিক অবস্থা বোঝার সুযোগ দেয় এটা।
'বেঁচে আছে?' জানতে চাইল তারিক।
'হ্যাঁ,' বলল ও। 'এখান থেকে আনুমানিক দেড়শো মিটার উত্তর পশ্চিমে আছে ও। বিয়ারিং ৩১৬ ডিগ্রি।'
তাহলে ঠিক আছে, ভাবল তারিক।
কোনো প্রশ্ন নয়, কোনো তর্ক নয়, নয় কোনো বিবাদ। অপারেশনের ব্যাপারটা আছে বটে, তবে তারচেয়ে জরুরি কিছুও ব্যাপারও থাকে।
'ঠিক আছে,' বলল ও। 'খালিদ, সামনে থাকো তুমি। চলো, ওর পাত্তা লাগানো যাক।'
আরও গুলির শব্দ। এবার আগের তুলনায় বেশ কাছে।
'সার্বিয়ায় স্বাগত,' ফিসফিস করে বলল আলীয়া বোরোযান।
চার
শত্রু-এলাকায় পৌঁছে গেছে, তাই ভীষণ ধীর গতিতে এগোচ্ছে ওরা। তাছাড়া এখানে বৈধ উপায়ে লড়তে আসেনি; যেভাবেই দেখা হোক না কেন, সংখ্যার বিচারে এমনিও আগেই একরকম হেরে বসে আছে। কিন্তু অন্য ব্যাপারটা হচ্ছে পয়েন্ট কিউ বা দার্কো লাতোসের ডেরার দিকে যাচ্ছে না ওরা, যেখানে কোকেনের নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুমিয়ে আছে লোকটা। উঁহু, বরং উল্টোদিকে পা বাড়িয়েছে। ডাল্টন কিংবা ডিসিতে ওর বস শাটনারএটা জানলে ওদের পেটের ভাত ঠিক চাল হয়ে যাবে।
তারিকের একপাশে স্যাটেলাইট ফোন ঝুলছে। চাইলে ওটা দিয়ে যেকোনো সময় দুনিয়ার যেকারও সাথে কথা বলতে পারে ও। ওদের একবার ফোন করা উচিত ছিল হয়তো, কিন্তু কি দরকার? তো এগিয়ে চলল ওরা।
সবার সামনে রয়েছে খালিদ। বাকিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে এগোচ্ছে। সবার পেছনে তারিক। এখানে কোনো মিলিশিয়ার অস্তিত্ব না থাকার ব্যাপারটা নিশ্চিত করছে। পেছন থেকে যেন ওদের উপর আচমকা হামলে পড়তে না পারে। জট পাকানো গাছপালায় ভরা জঙ্গল, তবে ওদের ঠিক পথে রাখতে চমৎকার কাজ দেখাচ্ছে খালিদ। সহসা একটা রাস্তার দেখা পেয়ে গেল ওরা।
ইট বিছানো চমৎকার রাস্তা।
ইট বিছানো রাস্তা ঘেন্না করে তারিক।
ওটার উপর দিয়ে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে এঁটো বাসনের উপর মাছির মতো ধরা খেতে হবে। ওটার উপর দিয়ে ছুটে গেলে মাথার উপর থেকে কোনো যন্ত্র-ড্রোন, বিমান বা হেলিকপ্টার হতে পারেÑঠিক দেখে ফেলবে তোমাকে। ওটা পেরুতে গেলেই দ্রুত গতিতে ছোটা পার্সোনেল ক্যারিয়ার বা স্কোয়াড ভেহিকল বাঁক ঘুরে হাজির হয়ে হেডলাইটের আলোয় গেঁথে ফেলতে পারে। তারপর শুরু হয়ে যাবে মেটাল জ্যাকেটেড অগুনতি গুলির অবিরাম ধারা।
ইট বিছানো রাস্তা তাই ওর ভীষণ অপছন্দ।
হাঁটু গেড়ে বসে একটু দম নিল ওরা। ডানহাত উঁচু করে কব্জি দিয়ে ঝটপট বৃত্তাকার একটা ভঙ্গি করল ও। ওকে ঘিরে জড়ো হলো সবাই। রাস্তা বরাবর সামনে তাকাল ও। রাস্তার উল্টোদিকে দেখল খালিদ। ওদের পেছনে নজর চালাল শের। ওদিকে রাস্তার ভাটিতে চোখ আলীয়া বোরোযানের। সংখ্যায় কম হতে পারে, অস্ত্রের বিচারেও তাই, কিন্তু যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করছে ওরা।
'কিছু দেখা যায়?' জানতে চাইল ও।
জবাব নেই। ভালো। তার মানে বলার মতো কিছু চোখে পড়েনি কারও। ফের রাস্তা বরাবর সামনে তাকাল ও। তুষার ঝরতে শুরু করেছে। কেন নয়? রাতের বনের স্বাভাবিক শব্দ ছাড়া কোনো আওয়াজ নেই। আলো নেই, কিছু নড়ছে না। সুনসান।
ডান হাতে দ্রুত আবার কোপানোর ভঙ্গি করল ও। দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকে এসে ফের বনের ভেতর ঢুকে পড়ল ওরা। নিজেদের অবস্থা বিচার করে এক সারিতে আগে বাড়ল ওরা, যেন যুদ্ধে যাচ্ছে। ওদের কন্ট্যাক্ট ওদিকেই আছে, জানে। আবার এও জানে, গন্তব্যে গিয়ে মিশন শেষ করার সময়ও ফুরিয়ে আসছে।
একটা পাথরের জটলা পেরুনোর সময় কিছুক্ষণের থামতে হলো। ওর পাশে বোরোযান। 'পাঁচ মিটারের মতো দূরে আছে ও,' ফিসফিস করে বলল ও, 'বলতে গেলে ওর মাথার উপরই আছি আমরা।'
'রজার দ্যাট।'
সামনে ঝুঁকে পড়ল ও, তারিকের ডান কান ছুঁই ছুঁই করছে ওর ঠোঁট। 'শুনলাম এটা নাকি তোমার শেষ মিশন। তুমি ঘরে ফিরে যাচ্ছ। কিন্তু কোথায় তোমার বাড়ি?'
তারিক নড়ল না। 'তুমি এ-খবর পেলে কোথায়?'
'এই ক্ষুদে কাব স্কাউট দলটার মেডিক আমি। তোমার ফিল্ড মেডিকেল রেকর্ড পাঠানোর খবর এসেছে। দুই দুইয়ে মিলিয়ে নিয়েছি। তা একাজটা শেষ হলে কোথায় যাবে?'
'নিউ হ্যাম্পশায়ারের একটা নিরিবিলি লেকের ধারে।'
'কেন?'
'কারণ ওটা ম্যাসাচুসেটস না।'
'আমি আসতে পারব?'
'যদি তোমার বাদিং স্যুট নিয়ে আসো।'
'ভুলে যাই যদি?' জানতে চাইল ও।
'তাহলেও তোমার আসতে মানা নেই।'
মিষ্টি করে হাসল ও। আবার সামনে বাড়ল ওরা। পাথর, ঝোপঝাড় আর আগাছা ভেঙে এগোচ্ছে। সবুজ আলোয় বনটাকে এখনও ভূতুড়ে ঠেকছে। সামনে একটু কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে। বার্চগাছের একটা জটলা থেকে ঝুলছে কি যেন। ঘুরে অর্ধবৃত্তাকারে এগোল ওরা। সামনের জিনিসটা দেখে জায়গায় জমে গেল ও। ক্লেটনের লাশ, ওর প্যারাশ্যূটটা খোলেনি, এখনও পিঠে সেঁটে আছে। সামনে পা বাড়াল খালিদ।
'টেলিমেট্রি বলছে এখনও বেঁচে আছে ও,' নিচু কণ্ঠে বলল ।
ফিরে এলো খালিদ। 'তাই কি?'
'হ্যাঁ,' বলল আলীয়া বোরোযান।
'বেশ, কিন্তু আমার নিজস্ব টেলিমেট্রির হতচ্ছাড়া মাথায় বসানো চোখজোড়া বলছে মারা গেছে ও!'
'তুমি।'
'আগে বেড়ে পরখ করো, বোরোযান,' তিক্ত কণ্ঠে বলল খালিদ। 'নাকি তোমার ক্ষুদে কম্পিউটারের মতে পায়ের হাড় বুকে গেঁথে গেলেও মানুষ বেঁচে থাকে, অ্যাঁ?'