মঙ্গল বিজ্ঞানীদের কাছে এতো আকর্ষণীয়!
অতি সম্প্রতি মঙ্গলের মাটি ছুঁয়েছ নাসা-র মার্স ২০২০ পারসিভিয়ারেন্স রোভার। পারসিভিয়ারেন্সের পরীক্ষানিরীক্ষার ফলাফলই খুব সম্ভব আগামী কয়েক দশকের মঙ্গল-অভিযানের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দেবে। কেন, তা ব্যাখ্যা করেছেন নাসার বিজ্ঞানী অমিতাভ ঘোষ।
পারসিভিয়ারেন্স আর দশটা সাধারণ রোভার মিশনের মতো নয়। মঙ্গলে পাঠানো সবচেয়ে উন্নত, সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং সবচেয়ে জটিল ভ্রাম্যমাণ ল্যাবরেটরি এটি। পারসিভিয়ারেন্সের পাঠানো পরীক্ষানিরীক্ষার ফল যে শুধু আগামী কয়েক দশকের মঙ্গল-অভিযানের গতিপ্রকৃতি ঠিক করে দেবে তা নয়; এটি মঙ্গলে প্রাণের সন্ধানে চালানো অভিযানের ভবিষ্যতও ঠিক করবে।
গত ৩০ বছরের মঙ্গল-বিজ্ঞান
মঙ্গলে প্রথম অভিযান চালানো হয়েছিল ১৯৬০-এর দশকে। এরপর থেকে গত প্রায় ৬০ বছরে গ্রহটির ব্যাপারে আরও অনেক কিছু জানা গেছে। মধ্য-সত্তরের দশকে পরিচালিত ভাইকিং মিশন থেকে প্রথম মঙ্গলের মাটির রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা হয়। জৈবিক কার্যক্রম শনাক্ত করবার জন্য চালানো হয় জীবতাত্ত্বিক পরীক্ষা। তবে এসব পরীক্ষায় গ্রহটিতে প্রাণের উপস্থিতি থাকার নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকে, খনিজ পদার্থ ও শিলার গঠনবিন্যাস দেখে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, মঙ্গলে প্রাণ সৃষ্টির উপযোগী এলাকা থাকতে পারে। ১৯৮৪ সালে মহাকাশযান ভাইকিং দিয়ে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের আইসোটোপিক অনুপাত মাপা হয়। এতে দেখা যায়, দুর্লভ গ্যাস (জেনন, ক্রিপটন, নিয়ন ও আরগন) এবং মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের আইসোটোপিক অনুপাতে মিল রয়েছে। এ আবিষ্কার ভূরসায়নবিদদের সামনে মঙ্গল থেকে আনা নমুনা গবেষণার জন্য এক নতুন দুয়ার খুলে দেয়। সেইসাথে লাল গ্রহটির ভূরাসায়নিক বিবর্তন বোঝার সুযোগ করে দেয় মানবজাতিকে।
২০ শতকে মঙ্গলকে শুকনো গ্রহ মনে করা হতো। এ ধারণা পাল্টে যায় ২০০১ সালে, যখন মার্স ওডিসি নামক মহাকাশযানের গামা রে স্পেকট্রোমিটার গ্রহটির বুকে বরফ-পানির অস্তিত্ব শনাক্ত করে। কিন্তু তারপরও সন্দেহ থেকে যায়। কারণ পানি ছাড়াও জৈব যৌগসহ আরও অনেক যৌগেই হাইড্রোজেন থাকে।
পানির উপস্থিতি পরীক্ষা করে দেখবার জন্য ২০০৭ সালে মঙ্গলের দক্ষিণ মেরুতে একটি মহাকাশযান পাঠায় নাসা। যানটি যান্ত্রিক হাত দিয়ে সেখানকার মাটি পরীক্ষা করে প্রথমবারের মতো সন্দেহাতীতভাবে লাল গ্রহের বুকে পানির অস্তিত্ব প্রমাণ করে।
কিউরিওসিটি রোভারে এসএএম (স্যাম্পল অ্যানালাইসিস অ্যাট মার্স) নামে একটি যন্ত্র রয়েছে। ওতে মঙ্গল গ্রহের জৈবযৌগগুলো শনাক্ত করার জন্য একটা স্পেকট্রোমিটার স্যুইট আছে। এসএএম-তে একটি ভর স্পেকট্রোমিটার আছে যা কেবল উপাদানগুলো নয়, আইসোটোপগুলোকেও মাপতে পারে। এই যন্ত্রটি মঙ্গলে বড় একটি জৈবযৌগের শেকল আবিষ্কার করেছে। মঙ্গলে এসব যৌগ কীভাবে গঠিত হয় তা জানা যায়নি। তবে সম্ভাবনা আছে যে, এসব অণু যে প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়েছে, তার সাথে জীবন গঠনের প্রক্রিয়ার সম্পর্ক রয়েছে।
মঙ্গলের ভূকম্পন এবং তাপ প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে আরও নতুন নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে। এসব তথ্য গ্রহটির গঠনবৈশিষ্ট্য জানতে সাহায্য করবে।
মঙ্গলের আকর্ষণ
মঙ্গল কেন বিজ্ঞানীদের কাছে এত আকর্ষণীয়? লাল গ্রহটি কেন এভাবে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে অভিযাত্রীসহ আমাদের সবাইকে? এর কারণ প্রধানত দুটো।
প্রথম কারণ, মঙ্গল এমন এক গ্রহ যেখানে হয়তো অতীতে কোনো এক সময় জীবনের অস্তিত্ব ছিল। পৃথিবীতে জীবনের আবির্ভাব ঘটেছিল ৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে। প্রায় ৪০০ বিলিয়ন বছর আগে মঙ্গলের অবস্থা অনেকটাই ওই সময়কার পৃথিবীর মতো ছিল। গ্রহটির পুরু বায়ুমণ্ডল ছিল। ওই বায়ুমণ্ডলের কারণে পানির অস্তিত্ব ছিল লাল গ্রহের মাটিতে। মঙ্গলের তখনকার পরিস্থিতি যদি সত্যিই পৃথিবীর মতো হয়ে থাকে, তবে গ্রহটিতে আণুবীক্ষণিক জীবন বিকশিত হওয়ার বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ, মঙ্গলই একমাত্র গ্রহ যেখানে মানুষের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে ঘুরতে যাওয়া বা বসবাস করা সম্ভব। শুক্র আর বুধের তাপমাত্রা অনেক বেশি। গ্রহ দুটোর গড় তাপমাত্রা ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি—অর্থাৎ গ্রহ দুটো রান্নার চুলার চেয়েও অনেক বেশি উত্তপ্ত। বৃহস্পতিসহ সৌরজগতের বাকি সব গ্রহ গ্যাস দিয়ে তৈরি। ওসব গ্রহের তাপমাত্রাও ভীষণ শীতল। কোনো পাথর বা সিলিকেটের অস্তিত্ব নেই ওই গ্রহগুলোতে। তাপমাত্রার দিক থেকে মঙ্গল তুলনামূলক সহনীয়। এ গ্রহে নিরক্ষরেখায় তাপমাত্রা সবসময় ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরেই ওঠানামা করে—মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ১২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে।
নমুনা আনার মিশন মঙ্গলে কি প্রাণের অস্তিত্ব আছে?
মঙ্গল থেকে নমুনা আনার জন্য অনেকগুলো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বহু-স্তরীয় এ পদক্ষেপগুলোর একটি পারসিভিয়ারেন্স। মঙ্গল থেকে নিয়ে আসা পাথরের নমুনাগুলো গবেষণাগারে পরীক্ষা করলে সম্ভবত জানা যাবে গ্রহটিতে অতীতে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল কি না।
নমুনা নিয়ে আসার ধাপগুলো এরকম:
প্রথম ধাপে পারসিভিয়ারেন্স ৪৩ সিগার-আকারের টিউবে শিলা এবং মাটির নমুনা সংগ্রহ করবে। এসব নমুনা সংগ্রহ করে ছোট বাক্সে ভরে মাটিতে রেখে দেয়া হবে।
এর পরের ধাপে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির পক্ষ থেকে দেয়া মার্স ফেচ রোভার বিভিন্ন জায়গা থেকে সমস্ত নমুনা কুড়িয়ে মূল ল্যান্ডারে ফিরে আসবে।
তারপর ফেচ রোভার বাক্সগুলোকে 'অ্যাসেন্ট বাহনে' স্থানান্তর করবে। মার্স অ্যাসেন্ট বাহনটি একটি অরবিটারের সাথে মিলিত হবে। এরপর অরবিটার নমুনাগুলোকে পৃথিবীতে নিয়ে আসবে।
এই দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছে এমএসআর—মার্স স্যাম্পল রিটার্ন। মঙ্গলের বিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা, তাতে বিপ্লব ঘটাবে এমএসআর। এমএসআর যদি সফলভাবে সম্পন্ন হয়, তবে লাল গ্রহে আণুবীক্ষণিক জীবনের অস্তিত্ব ছিল কি না তার সন্তোষজনক উত্তর পাবে মানবজাতি।
মঙ্গলে অক্সিজেন উৎপাদন: একটি অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন
মঙ্গলের বুকে চালানো অভিযান ফলপ্রসূ করার জন্য যৌক্তিক খরচ প্রয়োজন। খরচগুলো যৌক্তিক করার জন্য গ্রহটিতে পাওয়া কাঁচামাল ব্যবহার করে মঙ্গলে অক্সিজেন উৎপাদন করার প্রযুক্তি এবং অবকাঠামো গড়ে তোলা দরকার।
মঙ্গলে অক্সিজেন তৈরির নিরেট উপায় বের করতে না পারলে এ গ্রহে চালানো অভিযান হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং অবাস্তব। লাল গ্রহে নির্ভরযোগ্য অক্সিজেন-উৎপাদন পরিকল্পনা ছাড়া ওখানে বাণিজ্যিক পরিবহন সরবরাহ করার জন্য ইলন মাস্কের যে পরিকল্পনা, তা ভেস্তে যাবে।
পারসিভিয়ারেন্সে এমওএক্সআই (মার্স অক্সিজেন ইন-সিটু রিসোর্স ইউটিলাইজেশন এক্সপেরিমেন্ট) নামে একটি যন্ত্র আছে। যন্ত্রটি বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যবহার করে প্রায় ১০ গ্রাম অক্সিজেন উৎপাদন করতে ৩০০ ওয়াট শক্তি ব্যবহার করবে।
এই পরীক্ষা যদি সফল হয়, তবে এমওএক্সআই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটো প্রয়োজন মেটাতে পারবে: শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন এবং পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার জন্য রকেটের জ্বালানি সরবরাহ।
মঙ্গলে ভূগর্ভস্থ জলের সন্ধান
পারসিভিয়ারেন্সে রাডার ইমেজ ফর মার্স' সাবসারফেস এক্সপেরিমেন্ট (RIMFAX) থাকবে। রিমফ্যাক্স ল্যান্ডিং সাইটের মাটির গঠনের হাই রেজোল্যুউশন ছবি পাঠাবে। যন্ত্রটি মঙ্গলের ভূপৃষ্ঠে পানির সন্ধানও করবে। তা যদি পাওয়া যায়, তাহলে মঙ্গলের বুকে মানব বসতি স্থাপনের প্রকল্প এক ধাক্কায় কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে।
মঙ্গলে হেলিকপ্টার ওড়ানোর পরীক্ষা
মঙ্গলে পাঠানো হেলিকপ্টারটি আসলে একটা ছোট ড্রোন। হেলিকপ্টারটির আসলে পাঠানো হয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে: মঙ্গলের পাতলা বায়ুমণ্ডলে তা উড়তে পারে কি না তা দেখার জন্য।
মঙ্গলের পাতলা বায়ুমণ্ডলের কারণে সেখানে হেলিকপ্টার বা বিমান ওড়ানো বলতে অসম্ভবই। সেজন্য এ গ্রহে দূরপাল্লার আকাশযান চালানোর জন্য রকেট-জাতীয় ইঞ্জিনের ওপর নির্ভর করতে হবে।
মঙ্গলের বুকে কখনও আণুবীক্ষণিক প্রাণের অস্তিত্ব ছিল কি না কিংবা এখনও আছে কি না, তা জানার জন্য সম্ভবত আরও এক দশক লেগে যাবে। এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে পারসিভিয়ারেন্স।
- ভাষান্তর: মারুফ হোসেন