ভাষা মরে যায়!

অদূর ভবিষ্যতে কি সিংহভাগ ভাষাই মরে যাবে? বিশেষজ্ঞরা মনে করেন কমপক্ষে ১ লক্ষ মানুষের মুখের ভাষা হিসেবে চালু না থাকলে কোনো ভাষাই টিকে থাকতে পারে না। পৃথিবীতে এখন ৬ সহস্রাধিক ভাষা টিকে রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ভাষা আছে যেগুলোতে কথা বলা লোকের সংখ্যা ১০ হাজারের কম। প্রায় ১৫০০ ভাষা আছে যেগুলোতে কথা বলা লোকের সংখ্যা ১ হাজারেরও কম। বর্তমান বিশ্বে মাত্র ২০টি ভাষা আছে যেগুলোতে কথা বলা লোকের সংখ্যা ১০ কোটি।
ভাষার মৃত্যু অবশ্য নতুন ঘটনা নয়। সেই প্রাচীনকাল থেকে ভাষার বৈচিত্র্য বাড়তে শুরু করার পর থেকেই কমপক্ষে ৩০ হাজার (কারও কারও মতে ৫ লক্ষ) ভাষা জন্মেছে। আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের চিহ্ন না রেখে মরেও গেছে। ভাষার আয়ুষ্কাল সাধারণত বেশ কম হয়। সে তুলনায় মৃত্যুহার হয় অনেক বেশি। বাস্ক, মিশরীয়, চীনা, গ্রিক, হিব্রু, লাতিন, ফার্সি, সংস্কৃত ও তামিলের মতো খুব অল্প কটি ভাষাই ২ হাজার বছরের বেশি টিকতে পেরেছে।

অনাদরে অবহেলায় সংখ্যালঘুদের ভাষা
ভাষাগুলো বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে মারা যাচ্ছে। ইউরোপের উপনিবেশ বিস্তারের কারণে মারাত্মকভাবে কমে গেছে ভাষাগত বৈচিত্র্য। ইউরোপীয়দের ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের ফলে তৎকালীন কমপক্ষে ১৫ শতাংশ ভাষা অস্তিত্ব হারায়। গত ৩০০ বছরে ইউরোপের এক ডজন ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ১৮ শতকের শেষ অবধি অস্ট্রেলিয়ায় ২৫০ ভাষা প্রচলিত ছিল—তার মধ্যে এখন টিকে আছে মাত্র ২০টি। ১৫৩০ সালে পর্তুগিজরা ব্রাজিলে উপনিবেশ স্থাপনের পর থেকে দেশটির প্রায় ৫৪০টি—অর্থাৎ ৭৫ শতাংশ ভাষারই বিলুপ্তি ঘটেছে।
একই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী নিয়ে যেসব জাতিরাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল, সেসব রাষ্ট্রও নিজেদের রাষ্ট্রভাষা ঠিক করার পর অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ভাষাকে একপাশে ঠেলে দিয়েছে। শিক্ষা, প্রচারমাধ্যম এবং প্রশাসনিক সেবার জন্য একটিমাত্র আনুষ্ঠানিক ভাষা প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে সরকারগুলোও সংখ্যালঘুদের ভাষাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে সচেতনভাবে।

ভাষার এই প্রমিতকরণের প্রক্রিয়া বেগবান হয়েছে শিল্পায়ন ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে। শিল্পায়ন ও বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ফলে দ্রুত, সহজ ও বাস্তবসম্মত যোগাযোগপদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। ভাষার বৈচিত্র্যকে দেখা হয়েছে বাণিজ্য ও জ্ঞানের প্রসারের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে।
ধীরে ধীরে একটি মাত্র ভাষা ব্যবহার করাকেই আদর্শ বিবেচনা করা হতে থাকে। একটিমাত্র বৈশ্বিক ভাষার ধারণাটি গড়ে ওঠে ১৯ শতকের শেষ দিকে। এ সময় লাতিনকে একমাত্র বৈশ্বিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্টিত করা যায় কি না তা-ও বিবেচনা করা হয়। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সে সময় অনেকগুলো কৃত্রিম ভাষার জন্ম হয়। প্রথম জন্ম নেয়া কৃত্রিম ভাষাটির নাম ছিল ভোলাপুক। এই কৃত্রিম ভাষাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা এবং সবচেয়ে বেশি আয়ুষ্কাল লাভ করা ভাষার নাম এস্পেরান্তো।
ইদানীংকালে অর্থনৈতিক বাজারের আন্তর্জাতিকীকরণ, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং বিশ্বায়নের অন্যান্য প্রভাবের কারণে 'ছোট' ভাষাগুলোর অস্তিত্ব আরও বেশি হুমকির মুখে পড়ে গেছে। আধুনিক পৃথিবীতে যে ভাষা ইন্টারনেটে নেই, সে ভাষার 'অস্তিত্বও নেই'।
বর্তমানে প্রতি বছর গড়ে ১০টি ভাষার বিলুপ্তি ঘটছে ধরিত্রীর বুক থেকে। কেউ কেউ ধারণা করছেন, বর্তমানে প্রচলিত ৫০-৯০ শতাংশ ভাষাই এই শতাব্দীর মাঝে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

ভাষাগুলোর বিলুপ্তির প্রভাব বেশ কয়েকটি কারণে মারাত্মক হয়ে দেখা দেবে। প্রথম কারণটি হলো, আমরা সবাই যদি স্রেফ একটি ভাষায়ই কথা বলি, তাহলে আমাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ভাষাগত সৃজনক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা কখনোই মানুষের ভাষার উৎপত্তিস্থল আবিষ্কার করতে পারব না। পারব না 'মানব ভাষা রহস্যের' সমাধান করতে। প্রতিটি ভাষার মৃত্যুর সাথে সাথে মানব-ইতিহাসের একেকটি অধ্যায় বন্ধ হয়ে যায়।
বহু-সংস্কৃতির আদর্শ প্রতিচ্ছবি হলো বহুভাষা। ভাষাগুলোর মৃত্যু মানে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য কমে আসা।
একটি জনপদের মানুষের ওপর তাদের সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কহীন কোনো ভাষা চাপিয়ে দিলে সেই জনপদের সমষ্টিক সৃজনক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হয়। ভাষা কেবল মানুষের যোগাযোগের মাধ্যমই নয়, এর সাহায্যে মানুষ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, কল্পনা, দর্শন এবং জ্ঞান আহরণের পদ্ধতিও প্রকাশ করে।
বহু-সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়া মানে জীববৈচিত্র্যও হুমকিতে পড়া। জীববৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে একটি সহজাত যোগসূত্র রয়েছে। বিপন্ন গাছ ও প্রাণী প্রজাতির মতো বিপন্ন ভাষাও খুব ছোট এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য রয়েছে এমন ৮০ শতাংশেরও বেশি দেশের ভাষাগত বৈচিত্র্যও অনেক বেশি। এর কারণ হলো, মানুষ যখন চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়, তখন তাদের মধ্যে বিশেষ এক ধরনের জ্ঞানভাণ্ডার জমা হয়। সেই জ্ঞানের প্রতিফলন পড়ে তাদের ভাষায়। পৃথিবীর বহু বিপন্ন গাছ ও প্রাণীর খোঁজ কেবল তারাই জানে, যাদের ভাষাও আজ বিলুপ্তির মুখে। এই মানুষগুলো মারা যাবার পর পরিবেশের ব্যাপারে তাদের অর্জিত দুর্লভ জ্ঞানও কবরে নিয়ে যাবে।
বিজয়ী- পরাজিত
পৃথিবীর অর্ধেক মানুষই দৈনন্দিন জীবনে ৮টি ভাষা ব্যবহার করে। অন্যদিকে পৃথিবীতে প্রচলিত মোট ভাষার ছয় ভাগের এক ভাগই বলা হয় নিউ গিনিতে।
ভাষার বণ্টনে বেশ বড় ধরনের অসামঞ্জস্য রয়েছে। সামার ইনস্টিটিউট অফ লিংগুইস্টিক স্বল্পপরিচিত ভাষাগুলোর সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবমতে পৃথিবীতে প্রচলিত ৬ হাজার ভাষার মাত্র ৩ শতাংশ বলা হয় ইউরোপে। অন্যদিকে ৫০ শতাংশ ভাষাই বলা হয় এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। তারও মাঝে সবচেয়ে বেশি ভাষা প্রচলিত নিউ গিনি অঞ্চলে (পাপুয়া নিউ গিনি এবং ইরিয়ান জায়া-র ইন্দোনেশিয়ান এলাকা)। এ অঞ্চলেই পৃথিবীর মোট ভাষার ছয় ভাগের এক ভাগ প্রচলিত।
জনসংখ্যার ঘনত্বের সাথে ভাষা বৈচিত্র্যের কোনো মিল নেই। মোট ভাষার ৯৬ শতাংশই বলে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪ শতাংশ। মাত্র ২০টি ভাষায় কথা বলে পৃথিবীর ১০০ মিলিয়ন মানুষ।

মিলেনিয়াম ফ্যামিলি এনসাইক্লোপিডিয়া-র ১৯৯৭ সালের হিসাব অনুসারে, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষই মাত্র ৮টি ভাষায় কথা বলে। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এ ভাষাগুলো হচ্ছে: চীনা (১২০ কোটি), ইংরেজি (৪৭.৮ কোটি), হিন্দি (৪৩.৮ কোটি), স্প্যানিশ (৩৯.২ কোটি), রুশ (২৮.৪ কোটি), পর্তুগিজ (১৮.৪ কোটি) এবং ফ্রেঞ্চ (১২.৪ কোটি)।
ব্যবহারকারীর সংখ্যার এই ভারসাম্যহীনতার কারণে প্রতি বছর ১০টি ভাষা হারিয়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এই হারে বিলুপ্তি চলতে থাকলে আগামী শতাব্দীর মধ্যে ৯৫ শতাংশ ভাষাই পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে। কোনো কোনো গবেষকের দাবি, প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে ভাষা মারা যায়। যেখানে ভাষাবৈচিত্র্য বেশি, সেসব অঞ্চলে ভাষা বিলুপ্তির হারও অনেক বেশি। আফ্রিকায় দুশোরও বেশি ভাষা আছে যেগুলোতে কথা বলা মানুষের সংখ্যা টেনেটুনে ৫০০জন হবে। এই ভাষাগুলো শিগগিরই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। একটি ভাষা টিকিয়ে রাখতে হলে সেই ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা হতে হয় কমপক্ষে ১ লক্ষ। উত্তর আমেরিকায় সবচেয়ে সংকটে আছে আদিবাসী ও ক্রেওল ভাষাগুলো। নাভাহো, ক্রি এবং ওবিজোয়া ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় প্রচলিত ২০০ অ্যামেরিন্ডিয়ান ভাষাই আজ বিপন্ন।
লাতিন আমেরিকার ৫০০ অ্যামেরিন্ডিয়ান ভাষার প্রায় অর্ধেকের অস্তিত্বই আজ হুমকির মুখে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বিপন্ন ভাষার দেশটির নাম ব্রাজিল। দেশটিতে বেশিরভাগ ভাষারই ব্যবহারকারীর সংখ্যা অত্যন্ত কম। তুলনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভাষাগুলোতে কথা বলা লোকের সংখ্যা অনেক বেশি। এ অঞ্চলের ৬০০-৭০০ ভাষার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সরকারের শাসন নীতির ওপর।
অন্যদিকে, রুশ ভাষার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে উত্তর-পূর্ব এশিয়ার বাইরের ৪৭টি ভাষার মধ্যে মাত্র ৬টি ভাষার সত্যিকার অর্থে টিকে থাকার সম্ভাবনা আছে। ২০টি ভাষা 'প্রায় বিলুপ্ত', ৮টি ভাষা 'মারাত্মকভাবে বিপন্ন' এবং ১৩টি ভাষা 'বিপন্ন'। 'প্রায় বিলুপ্ত' ভাষাগুলোর প্রতিটিতে মাত্র ১২জন মানুষ কথা বলে। 'মারাত্মকভাবে বিপন্ন' ভাষাগুলোতে কথা বলা মানুষের সংখ্যা অনেক, কিন্তু সেসব ভাষা তাদের সন্তানদের শেখানো হচ্ছে না। 'বিপন্ন' ভাষাগুলো ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক, তবে তাদের সন্তানদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই ভাষাগুলো ব্যবহার করে। উপরন্তু সে সংখ্যা দিন দিন আরও কমছে।

ইউনেসকোর হিসাব অনুসারে, ইউরোপে প্রচলিত ১২৩টি ভাষার মধ্যে ৯টি ভাষা প্রায় বিলুপ্ত, মারাত্মকভাবে বিপন্নের সংখ্যা ২৬টি এবং ৩৮টি ভাষা আজ বিপন্ন।
১৯৯২ সালে জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য অনুষ্ঠিত হয় রিও আর্থ সামিট। এখন সময় এসেছে ভাষা রক্ষার জন্য আরেকটি রিও সম্মেলন আয়োজন করার। ২০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অফ হিউম্যান রাইটস-এ (অনুচ্ছেদ ২) ভাষার অধিকার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে ভাষা রক্ষার প্রয়োজনীয়তাটি গুরুত্ব পাচ্ছে। সেই থেকে বেশ কয়েকটি প্রকল্প ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে ভাষা সংরক্ষণের জন্য। এসব আইন বা উদ্যোগ হয়তো ভাষাগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না, তবে বিলুপ্তির প্রক্রিয়াটি অন্তত ধীর করে দিতে পারবে। বহু-সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করতে পারবে।