ব্রিটিশ ভারতের বিস্মৃত শিল্পীরা
১৬০০ সালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্যবসার উদ্দেশ্যে। ১৮ শতকে জুড়ে গোটা ভারতে শক্তিশালী বহুজাতিক কর্পোরেশনটির নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকে। শক্তি বাড়ার সাথে সাথে মোগলদের জন্য কাজ করা অনেক ভারতীয় চিত্রশিল্পীকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করে কোম্পানিটি। জীবন ও প্রকৃতির ওপর আঁকা এসব হাইব্রিড ছবি নিয়ে লিখেছেন লেখক-ঐতিহাসিক উইলিয়াম ড্যালরিম্পল।
১৭৭০-এর দশকের শেষের দিকে কলকাতা ছিল এশিয়ার সর্ববৃহৎ বর্ধিষ্ণু নগর। প্রাসাদের নগর হিসেবে পরিচিত কলকাতা ছিল বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কার্য পরিচালনার কেন্দ্র। এক দশকের মধ্যে শহরটির বাসিন্দা চার লাখে গিয়ে ঠেকে। ফলে কলকাতা হয়ে ওঠে প্রাচ্যের সবচেয়ে বড় এবং ধনী কিন্তু বিশৃঙ্খল নগরী।
সে সময় কলকাতায় এসেছিলেন ভলতেয়ারের বন্ধু কাউন্ট দি মোদাভে। শহরটি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, 'খুব সহজেই একে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহরগুলোর একটিতে পরিণত করা যেত।' কিন্তু ইংরেজরা যাকে-তাকে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র অদ্ভুত সব নক্সার দালানকোঠা নির্মাণ করার অনুমতি দেওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি।
অবশ্য কলকাতায় আবাস গাড়তে আসা ইংরেজরাও শহরটির সৌন্দর্য নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায়নি। তাদের বেশিরভাগ চিন্তা ছিল একটাই—যত দ্রুত সম্ভব বিপুল পরিমাণ টাকাপয়সা রোজগার করা।
কলকাতা ছিল এমন এক শহর যেখানে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে বিস্তর পয়সা কামানো যেত। তারপর কয়েক মিনিটে বাজি বা জুয়ার টেবিলে বসে সেই সম্পদ হারানোও ছিল খুব সহজ। রোগে-শোকে ভুগে মারা যাওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। চোখের সামনে এত এত মৃত্যু দেখে মানুষ নিষ্ঠুর, ভাবলেশহীন হয়ে ওঠে।
সে সময় নতুন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন স্যার এলিজা ইম্পে। জোহান জোফানি-র আঁকা তার একটি ছবি আজও কলকাতা হাই কোর্টে ঝোলে। ছবিতে তাকে ফ্যাকাশে, মোটাসোটা দেখায়—পরনে গাউন, মাথায় পরচুলা।
কলকাতার ব্যাপারে অবশ্য খুব আগ্রহী ছিলেন ইম্পে।
ভারতে যাত্রা করার সময় একজন মুন্সী সঙ্গে এসেছিলেন তাকে বাংলা ও উর্দু শেখানোর জন্য। ভারতে পৌঁছেই নতুন বিচারপতি ফার্সি শিখতে এবং ভারতীয় পেইন্টিং সংগ্রহ করতে শুরু করেন। কলকাতায় তার বাড়ি পরিণত হয়েছিল ভারতীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে আড্ডা দেয়ার কেন্দ্রস্থলে।
ভারতের প্রাকৃতিক ইতিহাসের ব্যাপারেও দারুণ আগ্রহী হয়ে ওঠেন ইম্পে ও তার স্ত্রী মেরি। বিরল ভারতীয় প্রাণীর সংগ্রহ গড়ে তুলতে শুরু করেন তারা।
১৭৭0-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইম্পে দম্পতি সিদ্ধান্ত নেন তাদের ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানার ছবি আঁকানোর জন্য একদল শীর্ষস্থানীয় মোগল শিল্পীকে—শেখ জয়েন উদ্দিন, ভবানী দাস এবং রাম দাস—নিয়ে আসবেন।
অবশ্য তারাই যে প্রথম ভারতীয় শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, এমনটা নয়। জানা যায়, স্কটিশ উদ্ভিদবিদ জেমস কের ১৭৭৩ সালের দিকেই ভারতীয়দের আঁকা গাছপালার ছবি এডিনবরায় পাঠাচ্ছিলেন।
তবে প্রাকৃতিক ইতিহাসে ইম্পেদের চিত্রকলা অ্যালবামগুলো এ জাতীয় সমস্ত ছবির মধ্যে টিকে রয়েছে সবচেয়ে সফলভাবে। বর্তমানে নিলামে এই অ্যালবামের একেকটি পৃষ্ঠার দাম ওঠে ৩ লাখ ৩০ হাজার পাউন্ডেরও (৩ লাখ ৮৭ হাজার ডলার) বেশি। ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে ইম্পেদের অ্যালবামের ১৯৭টি ছবি আজ সবচেয়ে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলোর দলভুক্ত।
১৮ শতকে ইম্পেদের অ্যালবাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাবার পর গত ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রথম অ্যালবামটির ৩০টি পৃষ্ঠা নিয়ে লন্ডনের ওয়ালেস কালেকশনে উন্মুক্ত করা হয় প্রদর্শনীর জন্য।
'ফরগটেন মাস্টারস: ইন্ডিয়ান পেইন্টিং ফর দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি' বইয়ে কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় ১৭৭০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে ভারতীয় শিল্পীদের আঁকা কিছু অসাধারণ কাজ তুলে ধরা হয়েছে।
ইম্পে তার কলকাতার মিডলটন স্ট্রিটের বাড়িতে যে তিনজন শিল্পীকে ডেকেছিলেন তারা সবাই এসেছিলেন পাটনা থেকে।
এই তিন শিল্পীর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন একজন মুসলিম—শেখ জয়েন-উদ-দীন। বাকি দুজন ছিলেন হিন্দু—ভবানী দাস ও রাম দাস।
মুর্শিদাবাদ ও পাটনার নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া এই শিল্পীরা মোগল শৈলীতে প্রশিক্ষিত ছিলেন। কলকাতায় এসে তারা অল্প সময়ের মধ্যেই ব্রিটিশ ওয়াটম্যান ওয়াটারকালার কাগজের ওপর জলরঙে আঁকা শিখে নিলেন। হাত মকশো করার জন্য মডেল হিসেবে ব্যবহার করলেন ইংরেজ উদ্ভিদকুলকে। এভাবেই ইংরেজ ও মোগল অঙ্কনশৈলীর মিশেলে জন্ম নিল অসাধারণ এক নতুন অঙ্কনরীতি।
জয়েন-উদ-দীনের সেরা কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউরোপীয় ও ভারতীয় ভাবধারার মিশেলে আঁকা প্রাকৃতিক নিসর্গের ছবি। তার সেরা কাজ হচ্ছে নিজের সময়ের ১৫০ বছর আগেকার মোগল রীতির সাথে মিশিয়ে আঁকা গাছপালা ও প্রাণীকুলের ছবিগুলো। এক্ষেত্রে তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে পাখপাখালি ও নানা প্রাণীর ছবি আঁকা প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী মনসুরের সঙ্গে তুলনীয়। বিশেষ করে জয়েন-উদ-দীনের আঁকা একটি বেনেবউয়ের ছবি তো রীতিমতো অতুলনীয়।
প্রথম দেখায় একে ইংরেজ রীতিতে আঁকা প্রাকৃতিক ছবি মনে হতে পারে। তবে মনোযোগ দিয়ে দেখলে ধীরে ধীরে বোঝা যায় যে ছবিটি আসলে মিশ্র রীতিতে আঁকা।
সাদাসিধেভাবে ব্যবহার করা রঙের উজ্জ্বলতা, সযত্নে করা ডিটেইলিং, রত্নের মতো হাইলাইটগুলো, ছবিটির জ্বলজ্বল করার ধরন—এসবই মোগল অঙ্কনরীতির পরিচায়ক।
স্বকীয় দৃশ্যকল্পটির পটভূমিও ইঙ্গিতবহ। গাছটির কাণ্ড গোলাকার—তবু এতে ঘাসফড়িঙ বসেছে, ঠিক যেন একটা দলিত ফুলের ওপর বসেছে। ফড়িঙটি আঁকা হয়েছে একেবারেই অস্পষ্টভাবে, কোনোমতে বোঝা যায়। ঠিক একই কৌশলে আঁকতেন মনসুরও।
তবে কোনো মোগল শিল্পী পাখিটিকে সাদা পটভূমির বিপরীতে অর্ধেক কাটা কাঁঠালগাছ থেকে বেরিয়ে আসা একটি ছোট্ট শাখায় বসা অবস্থায় আঁকতেন না।
অন্যদিকে কোনো ইংরেজ শিল্পীও গাছের কাটা কাণ্ডের গোলাকার অংশটিকে পাখিটার মতো অমন উজ্জ্বল হলুদ রঙে আঁকার কথা ভাবতেন না।
ইংরেজ ও মোগল, দুই রীতি মিলেমিশে এখানে নতুন এক ধারার সৃষ্টি করেছে।
জয়েন-উদ-দীনের সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ভবানী দাস। তিনিও অঙ্কনশৈলীতে গুরুর প্রায় সমকক্ষ হয়ে ওঠেন।
ছবির আকৃতি, গঠনবিন্যাস এবং অভিব্যক্তির প্রতি বিশেষ যত্নশীল ছিলেন ভবানী দাস। উদাহরণ হিসেবে তার আঁকা বাদুড়ের ছবিটির কথা উল্লেখ করা যায়। লক্ষ করলে দেখা যায়, বাদুড়টিকে আঁকা হয়েছে নিখুঁত গঠনবিন্যাসে।
হাইব্রিড অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্টাইলে আঁকা এই মহান ভারতীয় শিল্পীরা এই প্রথম তাদের প্রাপ্য মনোযোগ পেতে শুরু করেছেন এখন।
যুক্তরাজ্যে প্রথমবারের মতো কোনো জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে তাদের কাজ। এই প্রদর্শনের উদ্দেশ্য অসাধারণ ভারতীয় শিল্পীদের স্বকীয় ধারার ও রুচির কাজের সঙ্গে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেয়া। একটা কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়: এই শিল্পীরা—বিশেষ করে জয়েন-উদ-দীন—ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হওয়ার দাবিদার।
-
সূত্র: বিবিসি