বাঙ্গালির কুম্ভীরাশ্রু
বাংলা ভাষার জন্য ভালোবাসার 'শো অফ' (বাংলা একাডেমির অভিধানে এর মানে আস্ফালণ, আত্মশ্লাঘা, জাহির ইত্যাদি) আর কুম্ভীরাশ্রুর (সংসদ অভিধানে এর মানে কপাট সমবেদনা, বাংলা একাডেমির অভিধানে মায়াকান্না) মাস হচ্ছে ফেব্রুয়ারি আর বাংলাদেশের জন্য একই কাজ করার দুটি মাস হচ্ছে মার্চ এবং ডিসেম্বর। যারা লেখালেখি করেন তাদের কমবেশি প্রাপ্তিযোগ ঘটে ফেব্রুয়ারি মাসে। করোনাকাল তাদের জন্য প্রাপ্তির মাসটাকে মার্চ ও এপ্রিলে ঠেলে দিয়েছে (এপ্রিলে এসে করোনা প্রাদুর্ভাব প্রাপ্তিযোগ অনিশ্চিত করে দিয়েছে)। ফেব্রুয়ারি যেমন ছিল তেমনই আছে। বাংলায় লেখালেখি করে টিকে আছি বলেই ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার কাছে একটু বেশি ঋণগ্রস্ত বোধ করি। আর কৃতজ্ঞতায় চোখ যতই বাষ্পচ্ছন্ন হোক না কেনো বাষ্প জমে যে ফোটাটি নেমে আসে আমারও মনে হয়, সম্ভবত তা কুমীরেরই কান্না।
ডাঙ্গায় পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে কুমীরকে তার চোখদুটি ভেজাই রাখতে হয়। এমন কি প্রিয় খাবার ছিঁড়ে কেটে খাবার সময়ও চোখ গড়িয়ে কথিত অশ্রু নেমে আসে। মানুষরও চোখের একটি অসুখের নাম ক্রোকোডাইল'স টিয়ার্স সিনড্রৌম যা বাগোরাড'স সিনড্রৌম নামে চক্ষু বিশেষজ্ঞদের কাছে পরিচিত- বেল প্যালসিতে মুখমন্ডলের স্নায়ুর অকার্যকরিতায় মুখ নাড়াচাড়াতেও চোখ থেকে অশ্রু নেমে আসে। আমাদের ফেব্রুয়ারি মার্চ ও ডিসেম্বরের কান্নার সাথে এসবের কিছু মিল রয়েছে।
মানি লন্ডারিং এবং সেকেন্ড হোম সৃষ্টির উদ্যোগ কোন মাসে বেশি হয় এর কোনো পরিসংখ্যান চোখে পড়েনি। আমি ধরে নিতে চাই, অন্তত কুম্ভীরাশ্রু তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, এই তিন মাসেই তা বেশি হয়। গবেষকরা চাইলে এই হাইপোথিসিস মিথ্যে প্রমাণ করে বলতে পারেন বারো মাসেই কুম্ভীরাশ্রু বর্ষিত হয়।
বাংলা নিয়ে হা-পিত্যেস কেবল ১৯৫২ পরবর্তী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা ঠিক হবে না। এই ভূখন্ড নিয়ে হা পিত্যেস দেড় দু'শ বছর আগেও ছিল। এই লেখাটিতে সেকালের পদ্যে, গদ্যে, কবিতায়, প্যারডিতে উচ্চারিত কিছু হাহাকার তুলে ধরা হবে। এই হাহাকার পার্সি যুগের পরের, ততোদিনে 'মহারানি ভিক্টোরিয়া ইংল্যান্ডশ্বরী হইয়া ভারত মাতার আসনে অধিষ্ঠিত হইয়াছেন'। সেকাল মানে শত বছর আগে। একালের বাঙ্গালি তার মৌলচরিত্র ধরে রেখেছে। এই লেখাটি একটি সংক্ষিপ্ত বাঙ্গালি চরিত্রনামা। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) মা ভিক্টোরিয়াকে সাদা মানুষের দাপটে অভাগা বাঙালি প্রজার পক্ষ নিতে বলছেন:
বাঙ্গালি তোমার কেনা এ কথা জানে কে না
হয়েছি চিরকেলে দাস
করি শুভ অভিলাষ
তুমি মা কল্পতরু আমরা সব পোষা গরু
শিখিনি শিং বাঁকানো
কেবল খাবো খোল বিচিলি ঘাস।।
মনোমোহন বসু (১৮৩১-১৯১২) লিখেছেন 'ভিক্টোরিয়া-গীতি'। 'কোথায় মা ভিক্টোরিয়া, দেখ আসিয়া ইন্ডিয়া তোর চলছে কেমন।
তার কবিতায় ঢুকে পড়েছে জজ, ব্যারিস্টার, ইন্সপেক্টরের সাথে হোমচার্জ, কন্ট্রিবিউশন, টেম্পোরারি রিমিশন, অ্যাক্সিডেন্ট, ইনস্যানিটির মতো শব্দ। একই কবিতায় আছে হাইড্রোফোবিয়া, রিওয়ার্ড ও প্রমোশন।
প্রধান লুট দমকা কলে--যারে বলে
হোমচার্জ আর কন্ট্রিবিউশন
তা-ছাড়া যোজন-জোড়া লম্বা তোড়া
সাহেব পাড়ার পেন্সন বেতন।
মানচেস্টার ধর্লে আবদার কাপড় সূতার
ডিউটি অম্নি হয় রেমিশন।
তদন্তের নামে সত্য উদঘাটন করতে, জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে, একালে যে সরকার কমিশন বসানোর প্রহসন করে থাকে সে কালেও তাই ছিল। কিছুকাল কমিশন নিয়ে মজে থাকলে সমস্যাগুলো সয়ে যাবে। মনোমোহন বসু তার ভিক্টোরিয়া গীতির উপসংহারে বলছেন :
কমিস্যন বসাস নে মা! তায় কাঁপে গা।
লোক ভুলাবার ফাঁদ কমিস্যন!
আমরা তোর দুঃখী সন্তান কর পরিত্রাণ,
অভয় দে মা ধরি চরণ।
এ কবিতা রচিত হবার প্রায় দেড়শত বছর পরও কমিটি আর কমিশন একইভাবে বসানো হচ্ছে, সঙ্কট ধামাচাপা দিতে আর দুজর্ণকে রক্ষা করতে।
হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩) বাজিমাৎ কবিতায় লিখলেন :
পড়তে পারি বলতে পারি ইংরাজি ভাষায়
পিয়ানো বাজাতে পারি ইংরাজি প্রথায়
এনলাইটেন সবার আগে কর্তা বিলেত যান
তোমার গুণে, গুণমণি হারাল সে মান।
হেমচন্দ্রের কবিতার প্রেক্ষাপট যুবরাজ এডওয়ার্ডের (পরবর্তী কালের সপ্তম এডওয়ার্ড) বাংলা সফর এবং বাঙ্গালি 'জেনানা' দেখতে সরকারি উকিল জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে আগমন। এ নিয়ে কলিকাতায় যে শোর উঠেছিল হেমচন্দ্র সেই পরিস্থিতিটি কবিতায় তুলে ধরেছেন।
দেশিয় ম্যাজিস্ট্রেট যত ঝানু হন, দেশিয় সেশন জজ যত বয়ষ্কই হোন অপরাধী যদি শেতাঙ্গ হয় তিনি তার বিচারই করতে পারতেন না। তাদের বিচারের ক্ষমতা দিতে আইন-সচিব স্যার কোর্টনি ইলবার্ট একটি বিল আনেন, তাতে ছোট লাট থেকে শুরু করে শ্বেতাঙ্গ সকলেই চটে যান। নেটিভের সামনে শ্বেতাঙ্গ কেমন করে দাঁড়ায়? তার কবিতার নাম 'নেভার নেভার: নেটিভের কাছে নেভার নেভার'।
অথচ বাংলা ও বাংলা ভাষার মুন্ডুপাত করে শ্বেতসঙ্গ পেতে, বিলেত যেতে প্রাণ আকুপাকু করে।
বিলেত ফেরত বাঙ্গালি যুবক যখন তার ভারতবাসী স্ত্রীর কাছে ফিরে এসে তাকে মেম বানাতে চাচ্ছে। কবি হারানচন্দ্র রাহা বিব্রত স্ত্রীকে দিয়ে বলালেন :
আমি হব না বিবি থাকিতে এ প্রাণ,
কেমনে হোটেলে যাব
কেমনে টেবিলে খাব?
কেমনে সহিব বল পিঁয়াজের ঘ্রাণ?
দিন পাল্টে গেছে। এখন বিদেশের অভিজাত অঞ্চলে আগে সৃষ্টি হয় বেগমপুরা বা বেগমপাড়া। বেগমরা যান, সন্তানরা যান, সব লুটেপুটে বাঙ্গালি যান সবার শেষে।
অমৃতলাল বসুর (১৮৫৩-১৯২৯) চানক্য শ্লোক প্রকাশিত হয় ১৩০৪ বঙ্গাব্দে:
সাহেবেরা আমাদের তুল্য নহে হক।
সাহেব থাপ্পড়দাতা বাঙ্গালী খাদক।
শে^তাচর্মে সাহেবের সর্বদোষ কাটে।
কালোচামঢাকা পীলা পদে পদে ফাটে।
অমৃত লাল বসুর গানের পঙ্ক্তি
মুখে বলি লম্বা কথা ভালোবাসি দেশ
দেশের আচার-ব্যেভার রং তামাশা হয়ে গেছে শেষ
আছে মাত্র গাত্রে কালো রংটি অবশেষ।
যোগেন্দ্র চন্দ্র বসু (১৮৫৪-১৯০৫) দীর্ঘ কবিতায় ভারতমাতার শ্রাদ্ধ করলেন। মায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র গয়ারাম দেশ দেশান্তর ঘুরে মাকে জাগাতে মন্ত্র পড়ল Awake o Mother! arise, awoke, মায়ের মুখে জুস দিল, ব্রান্ডি দিল, মিস্টার যদু, মিস ক্ষুদিরাম, মিসেস পাঁচী কেউই তাকে জাগাতে পারল না, জাহ্নবীর কুলে শ্মশানঘাটে মাকে তুলে নিয়ে গেল।
কালো কোট টাই পরা গয়ারাম শ্রাদ্ধের কী বোঝে?
১৩১৪ বঙ্গাব্দে গোবিন্দ চন্দ্র দাসের (১৮৫৫-১৯১৮) স্বদেশ প্রকাশিত হলো :
স্বদেশ স্বদেশ করিস নারে এদেশ তোদের নয়-
ডেনিস পেনিস টেনিস খেলে ভারতভূমি লয়
মরু দেশের গরুকাটা ভারত করে জয়?
অশ্বিনী কুমার দত্তের (১৮৫৬-১৯২৩) সালের বাবুটিকে বাবু বললে চটে যান, ইংরেজি ভাবেতে মন্ড আহারে বিহারে-
গরমির দিনে গরম কোট
পায়েতে বিলাতী বুট
কালো গায়ে বান্দর সাজেন ইংরাজ নকল করে
দিবা নিশি চিন্তা কিসে
ইংরেজের সঙ্গে মিশে
তাদের পদতলে পড়ে থাকিবেন ডিনারে।
বেনোয়ারী লাল গোস্বামী (১৮৬০-১৯৩৮) তার পোলাও কাব্যগ্রন্থের 'অষ্টম হাঁড়ি কবিতায় 'ন্যাশন' হিসেবে আত্মপ্রকাশের শর্ত দেখালেন ফিরিঙ্গি নামধারণ- রে, ডাট কিংবা মিটার আর জুই, শেফালি, টগর বেলি সরিয়ে ম্যাগনোলিয়ায় বাগান সজ্জা। শেষে ক্রোধ প্রকাশ না করে পারলেন না:
শিক্ষিত দেশ, শিক্ষিত দেশ
শিক্ষিত মোরা কোনখানে
Monumental Liar গুলো
সমজিবেদীর মাঝখানে।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) এর হাসির গান ১৯০০ সালে প্রকাশিত।
আমরা সাহেবি রকম হাঁটি
স্পীচ দিই ইংরেজি খাঁটি
কিন্তু বিপদেতে দেই বাঙ্গালিরই মত
চম্পট পরিপাটি।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটি প্যারডি বাঙ্গালি বুদ্ধিজীবী চরিত স্পষ্ট করে দেয় :
মদ্য আমার পানীয় আমার
সরাব আমার আমার Peg
কেন কোম্পানী নজর দিলে গো
কেন হল এই duty plague?
কিসে দুঃখ কিসের চিন্তা
কিসের duty কিসের 'সেস'
Buy যদি নাই করে গো সবাই
Steal, Borrow কিংবা করিবে Beg.
চুরি করার কিংবা ভিক্ষা করার মানসিকতা বাঙ্গালির আছে, নেই বাংলা ভাষার অভিধানের। ইংলিশ ভাষার আছে। বাংলা ভাষার এই দুর্লভ গুনটি নেই বলেই প্রতিনিয়ত সৃষ্ট শব্দ বাংলা আত্মীকরণ করতে পারে না কিংবা বাংলা ভাষাচার্য ও মোড়লরা তা হতে দেন না। ইংলিশের গ্রহণ করার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি বলেই পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াতে পারছে। ইংলিশে অভিধানে আমাদের অভিধানের চেয়ে অন্তত পাঁচগুণ বেশি শব্দ আছে। আমারা শব্দ ধারণ করতেও কুণ্ঠিত থাকি।
'সেই ফিরঙ্গী প্রভাবের দিনেও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদি স্নাতক ইংরাজি সাহিত্যে সুপন্ডিত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র বাঙ্গালীর নিকটে বাংলা ছাড়া ইংরাজিতে ভুলেও কখন চিঠি লিখতেন না'- এ কথা সত্য নয়। ভূদেব মুখোপাধ্যায়কে লিখিত দু'টি শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে লিখিত ১৩ টি সহ ১৯ টি চিঠি মুদ্রিত হয়েছে। 'সেকালে ইংরেজি জানা অনেকেই আত্মীয় স্বজনকে ইংরেজিতে চিঠি লিখতেন।' মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি কোন বাঙ্গালিকে ইংরেজিতে চিঠি লিখেননি। এমনকি তাঁকে লিখা বড় জামাতার ইংরেজি চিঠি না পড়েই ফেরত দিয়ে ছিলেন।
রাজনারায়ন বসূ মাইকেল মধুসূদন দত্তকে ইংরেজিতে চিঠি লিখলেও অন্যান্য বাঙ্গালিদের লিখতেন বাংলায়।
(প্রবাসী, কার্তিক ১৩৪৭)