বাংলার পুরোনো বিষয়

জন্ম লন্ডনে ১৬২০ সালে, ১৬৫৮ তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দিয়ে জব চার্নক এলেন হুগুলির কাশিমবাজার কুঠিতে। তার বেতন ২৫ টাকা। ১৬৭১ সালে বেতন ৫০ টাকায় পৌঁছে। ১৬৮০ সালে যথন তিনি কাশিমবাজার কুঠির ফ্যাক্টরি প্রধান তখন তার বেতন ৭৫ টাকা। পাটনা হয়ে বড় দায়িত্ব নিয়ে কলিকাতায় পা রাখলেন ২৪ আগস্ট ১৬৯০ সালে।
তার আগে বিলেতি ক'জন বণিক একত্রে একটি বাণিজ্যিক কোম্পানি গঠন করে সমুদ্র বাণিজ্যে পূর্বাঞ্চলে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর রানি প্রথম এলিজাবেথের কাছ থেকে 'দ্য গভর্নর অ্যান্ড কোম্পানি অব মার্চেন্টস অব লন্ডন ট্রেডিং ইন্টু দি ইস্ট ইন্ডিজ' নামে চার্টার গ্রহণ করে। রানিও আগ্রহী ছিলেন, কারণ ইন্দোনেশিয়া ও মালাক্কা প্রণালিতে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মসলা বাণিজ্যের একচেটিয়াত্বের অবসান ঘটাতে চাচ্ছিলেন। ভারতের সঙ্গে তখন পর্তুগিজ বাণিজ্য শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু পর্তুগিজ দস্যুবৃত্তি ও অবাধ্যতা ভারত সরকারও অপছন্দ করেছে এবং তাদের একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ সৃষ্টি হোক এটা সরকার চেয়েছে। পর্তুগিজরা ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ বন্দরে ভিড়তেই দেয়নি।
১৬০৮ সালে ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হকিন্স সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবার পর্যন্ত পৌঁছেন। অনেক প্রচেষ্টার পর ১৬১২ সালে কোম্পানি সুরাট বন্দরে বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে। ১৬১৫ সালে টমাস রো ব্রিটিশ রাজা প্রথম জেমসের দূত হিসেবে পর্যাপ্ত উপঢৌকনসহ রাজদরবারে হাজির হন এবং সম্রাটের সন্তুষ্টি অর্জন করে সুরাটে কুঠি নির্মাণের অনুমোদন লাভ করেন। ১৬৩৯ সালে নিজস্ব দুর্গ স্থাপনের অনুমতিও পেয়ে যায় কোম্পানি।
শতাব্দীর শেষে ১৬৯৮ সালে এ কোম্পানি তাদেরই স্বদেশীয় একটি কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়--সে কোম্পানির নাম 'দি ইউনাইটেড কোম্পানি অব মার্চেন্টস অব ইংল্যান্ড ট্রেডিং টু দি ইস্ট ইন্ডিজ।' দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে একটি ঐতিহাসিক 'মার্জার' বা একীভূত হওয়ার ঘটনা ঘটে ১৭০২ সালে। এটির বিশ্ববাণিজ্যের ইতিহাসে প্রথম দিককার একটি মার্জার। নতুন কোম্পানির নাম হয় 'দি ইউনাইটেড কোম্পানি অব মার্চেন্টস অব ইংল্যান্ড ট্রেডিং টু দি ইস্ট ইন্ডিজ'--কালক্রমে এটিই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ১৭১৬ সালে ৩০ ডিসেম্বর জারি করা মোগল সম্রাট ফাররুখশিয়রের ফরমানই মূলত কোম্পানিকে অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ দেয় এবং বাংলা সরকারের প্রতিপক্ষ করে তোলে।
বাংলায় কুঠি নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয় ১৬৩৩ সালে, ১৬৬৮ সালে কুঠি স্থাপিত হয় ঢাকায়। গোবিন্দপুর, সুতানুটি ও কলকাতার পত্তন নিয়ে জব চার্নক শহরের গোড়াপত্তন করেন।

'একদা জব চার্নক দেখিতে পাইলেন যে নানা অলঙ্কার ভূষিতা সুন্দর মূল্যবান বসনাবৃতা পতিসহ গমনোদ্দতা অথচ চিতারোহণে অর্ধ্ব অসম্মতা একটি পঞ্চদশবর্ষীয় বঙ্গীয় সুন্দর যুবতী তদীয় তদীয় বৃদ্ধ মৃত স্বামীর চিতাভিমুখে অতীব ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হইতেছেন। তিনি যুবতীকে চিতারোহনে অসম্মতা বুঝিতে পারিয়া ও তদীয় রূপমাধুরী সন্দর্শনে বিমুগ্ধ হইয়া নিজ রক্ষী সৈনিকদিগের দ্বারা সুন্দরীকে সহমরণ হইতে নিরস্ত করিলেন। তৎপরে রমনীকে নিজালয়ে লইয়া গেলেন এবং তাহাকে নিজ প্রণয়পাশে, আবদ্ধ করিতে কৃতকার্য্য হইয়াছিলেন, জব চার্নক যুবতীর প্রায়পাশে আবদ্ধ হইয়া বহুকাল সুখে অতিবাহিত করিয়াছিলেন। জব চার্নকের নতুন নগরী সংস্থাপিত হইবার কিয়ৎকাল পরে কতগুলি সন্তান সন্ততি রাখিয়া তাহার প্রণয়িনী তাহাকে দুঃখসাগরে সমর্পণ করিয়া লোকান্তর গমন করিলেন।' (জব চার্নক, অঘোর নাথ দত্ত)
কলকাতায় গোড়াপত্তন তারই হাতে কিনা এনিয়ে বিতর্ক থাকলেও তার সতী প্রীতির কাহিনীটি মিথ্যে নয়। ব্রিটিশ জাহাজের ইংরেজ পাইলট (পথ প্রদর্শক) জোসেফ টাউনসেন্ড কলিকাতায় জব চার্নকের সমাধির পাশে সমাহিত। তার এপিটাফে ও লেখা আছে জব চার্নকের কথা। তিনি বলছেন:
লম্বা পান্ডুর বিধবাটি আমার, ছোট বাদামি বালিকা তোমার।
The tall pale widow is mine Joe
The little brown girt's for you.

জব চার্নকের কথায় জোসেফ টাউনসেন্ডও চিতা গমনোন্মুখ এক বালিকাবধুকে তুলে এনে বিয়ে করেন।
জব চার্নকের মর্যাদায় আঘাত এলো নতুন সহস্রাব্দে ২০০৩ সালের মে মাসে। হাইকোর্ট রায় দিল জব চার্নককে আর কলিকাতা শহরের প্রতিষ্ঠাতা বলা যাবে না। আরো স্পষ্ট করে দিল শহরের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠাতা থাকে না, শহর হুট করেও গড়ে উঠে না। জব চার্নক কলিকাতা ছেড়ে, সতী নারী ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে যাননি। ১০ জানুয়ারি ১৬৯২ এখানেই মৃত্যুবরণ করেছেন।
১৬৬ বছর আগে কলিকাতার 'খুচরা খবর'
১৮৫৫ সালে প্রকাশিত দ্য ক্যালকাটা অ্যালমানাক অ্যান্ড বুক অব ডিরেকশন গ্রন্থে বেশ কিছু কৌতুহল সঞ্চারক এবং দুর্লভ তথ্যের সমন্বয় ঘটেছে। এসব তথ্য 'প্রাচীন কলিকাতার খুচরা খবর' এ সাজিয়েছেন ইন্দু প্রসাদ মিত্র। তার রচনা থেকে কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে:
১৮৫০ দশকে বাঙ্গালিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেতন পেতেন প্রসন্ন কুমার ঠাকুর। তার বেতন ১২৫০ টাকা। পদবী: ক্লার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্য লেজিসলেটিভ কাউন্সিল। তখন পর্যন্ত কোনো বাঙ্গালী ব্যারিস্টার হননি, একজন বাঙ্গালি অ্যাটর্নি ছিলেন বেনীমাধব বন্দোপাধ্যায়।
প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেতন ১০০০ টাকা পেতেন রায় হরচন্দ্র ঘোষ। তিনি কলিকাতা অধস্তন আদালতের তৃতীয় জজ ছিলেন। তৃতীয় সর্বোচ্চ বেতনধারী ছিলেন কলিকাতার জুনিয়র পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট কিশোরীচাঁদ মিত্র। তিনি পেতেন ৮০০ টাকা। ভালো বেতনের ৫ জন বাঙ্গালি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন: যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (৪৫০ টাকা), গোবিন্দ্র প্রাসাদ পন্ডিত (৫০০ টাকা), শিবচন্দ্র দেব (৫০০ টাকা), গোবিন্দ চন্দ্র বসু (২০০ টাকা) এবং গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৫০ টাকা)।
অধঃস্তত আদালতে বাঙ্গালি উকিল ছিলেন ৬ জন : গুরুদাস রায়, রামচন্দ্র পাল এবং যাদবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। সদর দেওয়ানি ও নিজামত আদালতে ৩০০ টাকা বেতনে একজন সিনিয়র গভর্নমেন্ট প্লিডার ছিলেন রমা প্রসাদ রায় আর ২৫০ টাকা বেতনের জুনিয়র গভর্নমেন্ট প্লিডার ছিলেন শম্ভুনাথ পন্ডিত। এ কথা বলা প্রাসঙ্গিক যে এসব বাঙ্গালির অধীনে অনেক ইংরেজ কর্মচারি কাজ করতেন যাদের বেতন ১৫ থেকে ২০ টাকার মধ্যে ছিল।
প্রথম বাঙ্গালি ব্যারিস্টার জ্ঞানেন্দ্র মোহন ঠাকুর, ভারতীয়দের মধ্যেও প্রথম ব্যারিস্টার। তিনি হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি প্রথমে বর্ধমানের মহারাজার মাসিক ৪০ টাকার সিনিয়র স্কলারশিপ নিয়ে মেডিকেল কলেজে শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯ বছর বয়সী প্রথম স্ত্রীর অকাল মৃত্যুর পর রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়ের কাছে খ্রিষ্ট ধর্মের দীক্ষা নেন এবং তার কন্যা কমলমণিকে বিয়ে করেন। তারপর ইংল্যান্ডে গিয়ে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে এসে কলিকাতা বারে যোগ দেন। এটা জানাও প্রাসঙ্গিক সে সময় বাংলায় বাঙ্গালি পাদ্রি ছিলেন তিনজন। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়, রেভারেন্ড জে এন ঘোষ এবং রেভারেন্ড গোপালচন্দ্র মিত্র।
১৮৫০ দশকে কলিকাতা থেকে ৭টি ইংরেজি দৈনিক প্রকাশিত হতো আর বাংলা দৈনিক ২টি। ইংরেজিগুলো হচ্ছে: The Englishman and Military Chroricle, The Bengal Harkara, The Morning Chroricle, The Citizen, The Economist, The Daily Exports & The Daily Imports.
বাংলা ২টি ছিল। পূর্ণচন্দ্রোদয় এবং প্রভাকর। পূর্ণচন্দ্রোদয় পত্রিকার বাৎসরিক গ্রাহকমূল্য ৮ টাকা এবং প্রভাকরের ১২টাকা। সপ্তাহে ৩ দিন প্রকাশিত হতো এমন বাংলা পত্রিকা ২টি ভাষ্কর এবং চন্দ্রিকা। মাসিক পত্রিকা ছিল ৭টি: বিবিধার্থ সংগ্রহ, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, সত্যার্নব, মাসিক পত্রিকা, সুলভ পত্রিকা, উপদেশক, ধর্মানুরাজিকা। এই ৭টির মধ্যে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাই পরবর্তী সময়ে আলোচিত হয়েছে।
এ সময় কলিকাতায় ছাপাখানা বা 'মুদ্রাযন্ত্র' ছিল ১৬টি। এর মধ্যে ১টির মালিক ছিলেন বাঙ্গালি ঈশ্বরচন্দ্র। ১৮৫ নম্বর বহুবাজার স্ট্রিটে অবস্থিত তার ছাপাখানার নাম বসু স্টানহোপ প্রেস।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ইংরেজ স্বীকৃত প্রথম কবি
১৩ বছর বয়সে বঙ্কিমের লেখা স্বামী-স্বীর কথোপকথন বিষয়ক কবিতা ১৮৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবির নাম শ্রী ব.চ.চ.। পনের বছর বয়সে হুগলি কলেজে ভর্তি হয়েই ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকরের কবিতা প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে শ্রেষ্ঠ কবির পুরস্কারটি পেয়ে গেলেন। কলেজের প্রিন্সিপাল জেমস কার এতোটাই খুশি হলেন যে, তা সরকারকে জানানো জরুরী মনে করলেন। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৪ তিনি ফোর্ট উইলিয়ামে কাউন্সিল অব এডুকেশনের সেক্রেটারিকে যে চিঠি লিখলেন নিবন্ধকারকৃত তার বাংলা ভাষান্তর:
হুগলি
২০শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৪
মহোদয়,
সম্মানের সাথে কাউন্সিল অব এডুকেশনকে এই তথ্যটি জানাতে চাই সিনিয়র স্কুলের প্রথম পর্বের ছাত্র বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ভালো কবিতা রচনার পুরস্কার দেবার জন্য কাউন্সিল অব এডুকেশনের কুড়ি টাকা পেয়েছি। প্রভাকর সংবাদপত্রে তার কবিতার প্রকাশ ঘটেছে। পুরস্কারের কুড়ি টাকা বর্ণিত সাময়িকীর সম্পাদক বাবু ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়েছে। বাবু রামমোহন রায় এবং রংপুরের জমিদার কালী চরণ রায় চৌধুরী উপস্থিত থেকে তার নিকট পুরস্কারে অর্থ হস্তান্তর করেন।
জে. কার
অধ্যক্ষ
হুগলি কলেজ

এই প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণকারীদের মধ্যে হিন্দু কলেজের ছাত্র দীনবন্ধু মিত্র (পরে বিখ্যাত নাট্যকার) এবং কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্র দ্বারকানাথ অধিকারীও (অকাল প্রয়াত কবি) ছিলেন। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পুরস্কার প্রাপ্ত কবিতার নাম 'কামিনীর প্রতি উক্তি।' বঙ্কিম চন্দ্রের কবিখ্যাতি শেষ পর্যন্ত তার ঔপন্যাসিক খ্যাতির কাজে চাপা পড়ে গেল।
প্রথম বাংলা উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী
বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসটি রচনার সূচনা বাংলাদেশের খুলনাতে ১৮৬৪ সালে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন ম্যাজিস্ট্রেট। তারপর বদলি হলেন চব্বিশ পরগনার বারুইপুর। সেখানেই উপন্যাসটি শেষ করলেন। ছাপাখানায় পাঠাবার আগে বঙ্কিম তার কাঠালপাড়ার বাড়িতে ক'জন পন্ডিতকে ডেকে পড়ে শোনালেন। তিনি চাচ্ছিলেন পন্ডিতরা তার ভাষার ভুলত্রুটি ধরে দিলে তিনি তা সংশোধন করে পাণ্ডুলিপি ছাপাখানায় দেবেন।
পন্ডিতদের একজন মধুসূদন স্মৃতিরত্ন পরে বলেছেন,'গল্প ও ভাষার মোহিনী শক্তিতে আমরা এতই আকৃষ্ট হয়েছিলাম যে, আমাদের সাধ্য কি অন্যদিকে মন নিবিষ্ট করি।'
১৮৬৫-র মার্চে দুর্গেশনন্দিনী প্রকাশিত হয়। কলিকাতার ৫৮/৫ নম্বর আপার সার্কুলার রোডের বিদ্যারত্ন যন্ত্র ছাপাখানায় উপন্যাসটি মুদ্রিত হয়। এক টাকা দামের এই বইটির পৃষ্ঠা ছিল ৩০৭টি। উৎসর্গপত্রে লিখা: 'জেষ্ঠাগ্রজ শ্রীযুক্ত বাবু শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের শ্রীচরণে এই গ্রন্থ উপহারস্বরূপ অর্পন করিলাম। শ্যামাচরণ বঙ্কিমের বড়দা।
উপন্যাস প্রকাশের পরের মাসেই ১৪ এপ্রিল ১৮৮৫ সংবাদ প্রভাকর দীর্ঘ আলোচনার শেষে লিখল: ... ইংরাজিতে যেমন উত্তম ২ উপন্যাস আছে বাঙ্গালা ভাষায় সেরূপ নাই; এই নিমিত্ত আমরা এই উৎকৃষ্ট ও প্রথম বাঙ্গালা উপন্যাসকে গৌরবস্থানীয় করিলাম। বাস্তবিক বঙ্কিমবাবু এ পুস্তকে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করিয়া বাঙ্গালার প্রথম উপন্যাসকার (first novelist) উপাধির অধিকারী হইয়াছেন।
সে সময় রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছিলেন: 'যখন দুর্গেশনন্দিনী প্রকাশিত হইল, তখন বঙ্গীয় সাহিত্যাকাশে সহসা একটি নতুন আলোকের বিকাশ হইল। বঙ্গবাসিগণ বুঝিল সাহিত্যে একটি নতুন যুগের আরম্ভ হইয়াছে, একটি নতুন ভাবের সৃষ্টি হইাছে--নতুন চিন্তা ও নতুন কল্পনা বঙ্কিমচন্দ্রকে আশ্রয় করিয়া আবির্ভুত হইয়াছে।' (উৎস : গোপালচন্দ্র রায়ের বঙ্কিমচন্দ্র: জীবন ও সাহিত্য)
মনের কথা বলতে বাংলা নয়, ভিন্ন ভাষা
মদনমোহন গরাই লিখলেন, 'আঠার শতকের অন্ধকারে বাংলাদেশ তখন আচ্ছন্ন। ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে আসীন সমাজপতির রক্তচক্ষুর কাছে ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত। ভক্তির অন্তরালে মানুষের ভয়ই ভাবী সর্বনাশের কবল থেকে পরিত্রাণের জন্য ধর্মের মন্দিরে নৈবেদ্য সাজাতে ব্যস্ত। স্বাধীন চিন্তা অথবা বিচার সেখা নৈব নৈব যে'। বাংলা তখনও বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার যোগ্য ভাষা হয়ে উঠেনি।
রামমোহনকে তাই নিজের কথা বলার জন্য ভিন্ন ভাষার আশ্রয় নিতে হলো। ১৮০৩-০৪ সালে তিনি লিখলেন 'তুহফাৎ-উল-মুয়াজিদীন'-গিফট টু দ্য মনোথিস্টস (একেশ্বরবাদীদের জন্য উপহার);বইটি লিখলেন ফার্সি ভাষায়, আর বইয়ের ভূমিকা আরবিতে।
এই বইতেই উল্লেখ করেছেন 'মানজারতুন আদিয়ান' নামে একটি ফার্সি গ্রন্থ আরো আগেই তিনি রচনা করে রেখেছেন। তুহাফাৎ গ্রন্থ রচনার সময় তিনি বাংলাদেশের ঢাকায় উডফোর্ডের একজন কর্মচারি হিসেবে কিছুকাল চাকরি করেছেন। এই গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন লামাদের কর্মে বাধা দেওয়ায় তার প্রাণ হুমকির মধ্যে পড়ে, তখন তিব্বতের নারীরা তাদের স্নেহচ্ছায় তাকে রক্ষা করেন।
এই বইয়ের কাহিনী শোনানো এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য এটা জানানো প্রথম আলোকিত বাঙ্গালি (এনলাইটেন্ড) রাজা রামমোহন রায় বই লেখার জন্য ফার্সি ভাষার উপর নির্ভর করেছেন কারণ বাংলা পদ্য তখনও বিকশিত হয়নি। এমনকি উনবিংশতকের প্রথমভাগেও ফার্সি ছিল শিক্ষিতজনের ভাষা, চাকরিজীবীর ভাষা, জ্ঞান অন্বেষণের ভাষা অর্থকরী ভাষা ফার্সি ভালো জানলে দোভাষী হিসেবে স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপন করা যেত। রামমোহনের ফার্সি গ্রন্থটি রচনার ৮০ বছর পর ঢাকা গভর্নমেন্ট মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট মৌলবি ওবেদুল্লাহ ১৮৮৪ সালে গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন এবং ইংরেজি প্রকাশনার আরো ৬৫ বছর পর ১৯৪৯ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কর্তৃক অনুদিত হয়ে বাংলায় প্রকাশিত হয়। একবার ভাবুন রামমোহনের একেশ্বরবাদ যেহেতু পৌত্তলিকতার সাথে সাংঘর্ষিক, বাঙ্গালির ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কারণে রামমোহন রায়ের বইয়ের বাংলায় প্রকাশনা বিলম্বিত হয়েছে ১৪৫ বছর। রাহমোহন রায় কেবল গ্রন্থ রচনাই নয় বাংলার প্রথম ফার্সি সংবাদপত্রের সম্পাদনাও করেছেন।

অ্যাঙ্গলো ইন্ডিয়ান প্যাসেজ
ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসনের বই দ্য অ্যাঙ্গলো ইন্ডিয়ান প্যাসেজ: হোমওয়ার্ড অ্যান্ড আউটওয়ার্ড ১৮৪৫ সালে জেমস ম্যাডেন অ্যান্ড ম্যালকম পাবলিশার্স প্রকাশ করে। (২৬ ডলার ৭৫ সেন্ট দামের বইটি অ্যামাজন থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব)।
সাউদাম্মটন বন্দর থেকে জাহাজে চড়ে ডেভিড রিচার্ডসন ভারতে যখন এলেন একজন যাত্রীর জন্য জাহাজ ভাড়া গুণতে হতো ১৪৩ পাউন্ড স্টারলিং। যাত্রী উভয়লিঙ্গ বাচক শব্দ, যাত্রী যদি নারী হন তার ভাড়া কিছুটা কম না হলেও ১৪৩ পাউন্ডের বেশি তো হবার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে বেশি, ১৫৩ পাউন্ড। রিচার্ডসন তার সফরনামা প্রকাশ করা ছাড়াও ফ্লাওয়ার্স অ্যান্ড ফ্লাওয়ার গার্ডেনস, মিসসেলেনিয়াস পোয়েমস, লিটারেরি রিক্রিয়েশনস নামের বইয়ের গ্রন্থকার। এই বই নিয়ে কেশবচন্দ্র গুপ্ত লিখেছেন:
'সাগর দ্বীপের নিকট পৌঁছিয়া রিচার্ডসন সাহেব প্রথম "দুর্বল, সর্বাকার তাম্রবর্ণ বাঙ্গালির নমুনা দেখিতে পান। যে সকল বাঙ্গালী স্বচ্ছন্দে কলিকাতায় বসিয়া থাকে তাহারা অপেক্ষাকৃত সবল। বিলাতের লোকের অর্থ থাকিলেও স্থূলকায় হয় না। এখানে এমন কোনও ব্যক্তি দৃষ্ট হয় না যাহার মুদ্রার থলি পূর্ণ অথচ দেহ স্থূলকায় নহে"।
১৮৩৫ সালের কৃষ্ণকমল
তখন কৃষ্ণকমলের বয়স ২৫ বৎসর। তার জন্ম নবদ্বীপের ভজনঘাটে ১৮১০ সালে রথযাত্রার দিনে। তার প্রথম গ্রন্থ 'নিমাই-সন্যাস'-এর উপর ভিত্তি করে নবদ্বীপে যাত্রাপালার আয়োজন হয় এবং তা লিখকের জন্য অনেক সুনাম বয়ে আনে।
কৃষ্ণকমল ঢাকা আসেন এং তার যাত্রার বই 'স্বপ্নবিলাস' প্রকাশ করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই এই যাত্রা গ্রন্থের ২০০০০ কপি বিক্রয় হয়ে যায়। 'অনুপ্রাসবহুল' যাত্রা স্বপ্নবিলাসের জন্য মানুষ 'পাগল হইত'। কৃষ্ণ কমলের গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, বিচিত্রবিলাস, নন্দহরণ, নিমাই সন্ন্যাস, সুরথ সংবাদ, গোষ্ঠ ও ভারতমিশন।
বিদেশি অভিনেতা
ন্যাথনিয়েল ব্র্যাসি হ্যালেড সাহেব 'এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ' লিখে ও প্রকাশ করে স্মরনীয় হয়ে আছেন। তারই ভ্রাতুষ্পুত্র ন্যাথনিয়েল জন হ্যালেড বাংলা যাত্রা নাটকে অভিনয়ে স্মরণীয়। তিনি কতিপয় প্রাচ্যভাষায় বিশেষত বাংলা ভাষায় এ রূপ ব্যুৎপন্ন ছিলেন যে কখনও কখনও তিনি ছদ্মবেশে আমাদের দেশী কাপড় পড়িয়া আপনাকে দেশী লোক বলিয়া পরিচয় দিতেন তাহাকে তাহারা সহসা কেহ বিদেশী বলিয়া বুঝিতে পরিত না। যখন তিনি পাঁচজনের সঙ্গে তামাক খাইতেন তাহাকে ইউরোপীয় বলিয়া চেনা দায় হইত। বর্ধমান রাজবাড়িতে তিনি যাত্রা করিয়াছিলেন। সকলেই তাহার অভিনয়ে প্রীতি লাভ করিয়াছিলেন।
প্রথম দিককার ব্যাংকার
আবদুল করিম বেঙ্গল ফ্যাক্টরি রেকর্ডস ঘেঁটে ১৪ ব্যক্তি বা তাদের নামে চালু ব্যাংকের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন তালিকাভুক্ত নামের অধিকাংশ রাজপুতানা বা বাংলার বাইরে থেকে আগত:
১. শেঠ মাহতাব রায় ২. শেঠ স্বরূপ চাঁদ ৩. শিব রায় ৪. নয়ন চাঁদ, জগৎ শেঠের গোমস্তা ৫. ধনরাম ৬. খোশাল চাঁদ মতি চাঁদ ৭. আলমচাঁদ মতিচাঁদ ৮. অনুপচাঁদ কিশেনচাঁদ ৯. কিজুর দাস ১০. মতিরাম সেন ১১. শান্তি রাম ১২. বলরাম রায় ১৩. হরি কিশেন বা হরিকৃষ্ণ ১৪. আনন্দ রাম।
আন্তঃমহাদেশীয় বিয়ে
ব্রাহ্মণের সঙ্গে কায়স্থের বা কায়স্থের সঙ্গে নবাশাখের বিয়ের প্রস্তাব শ্রবণ করলে 'লোকে কর্ণে অঙ্গুলি প্রদান করিয়া ঘৃণার সহিত এতাদৃশ প্রস্তাবকে তুচ্ছ করিতেন।' কিন্তু কালপ্রভাবে এমনকি বিদেশী ও ভিন্নধর্মীদের মধ্যেও বিয়ের নজির সৃষ্টি হচ্ছে। শ্রী ধর্মানন্দ মহাভারতী বামাবোধিনী পত্রিকায় (আশ্বিন ১৩১৩/ অক্টোবর ১৯০৬ সংখ্যা) এ ধরনের বিয়ের উদাহরণ দিয়েছেন। পাতিয়ালার মহারাজার স্ত্রী বিলেতি রমণী, আলোয়ারের মহারাজার স্ত্রী ইউরোপীয়, বাঙালি ব্যারিস্টার এইচ দত্ত ও পি দত্ত ইউরোপীয় রমণীর পাণি গ্রহণ করেছেন। মুসলমান বিচারপতি সৈয়দ আমির আলি ও ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ রসুলের স্ত্রী বিলেতি রমণী। হায়দারাবাদের প্রধান বিচারক মৌলবি চেরাগ আলীর স্ত্রী লন্ডনের এক বণিক-কন্যা। আজমির ইংরেজি স্কুলের হেডমাস্টার দীননাথের স্ত্রী ইউরোপীয়। আগ্রার রোমান ক্যাথলিক পাদ্রী জোসেফ ইয়াকুব আলীর স্ত্রী আমেরিকান রমণী। কবিবর মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্ত্রী হেনরিয়েটাও ইউরোপীয় নারী। কলকাতার বিখ্যাত ডাক্তার আর সি চন্দ্রের স্ত্রী বিলেতি লর্ডের ভগ্নি।
বিখ্যাত ব্যারস্টিার মনোমোহন ঘোষের কন্যা তার পিতার বিলেতি প্রাইভেট সেক্রেটারিকে বিয়ে করেছেন। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা বিলেতি যুবককে বিয়ে করে মনমোহিনী হুইলার নামে পরিচিত হয়েছেন। পাঞ্জাবের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ কর্নেল ওয়ারবর্টনের মাতা একজন ভারতীয় মুসলমান রমণী। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি কেম্প সাহেব একজন বাঙালি রমণী বিয়ে করেছিলেন, তারই গর্ভজাত সন্তান কেম্প জুনিয়র বরিশাল জেলার সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় কানপুরে নিহত কর্নেল হুইলারের স্ত্রী গাত্রবর্ণ, আচরণ ও কথোপকথন শুনে অনেকে তাকে ইউরোপীয় মনে করলেও তিনি ছিলেন বাঙালি রমণী।
স্যার উইলিয়া জোন্স যখন দ্বিতীয় বিয়ে করেন, তিনি তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং বোম্বে নৌ সেনাদলের অধিনায়ক। তার দ্বিতীয় স্ত্রী ভারতীয় নারী। ব্রিটিশ জেনারেল কন্যা নগরের প্রধান বাবুর্চিকে বিয়ে করেছিলেন। ১৮৭৩ সালে আইসিএস অফিসার আরজি মেলভিল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এক খানসামার কন্যাকে বিয়ে করায় চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। পাতিয়ালার মহারাজার ইউরোপীয় স্ত্রীর পিতা ছিলেন মহারাজার আস্তাবলের সহিস।

মাদ্রাজের গভর্নর স্যার ফ্রান্সিস কুকের স্ত্রীর নাম বাণী। তিনি একজন হিন্দু রমণী। বিখ্যাত গভর্নর জব চার্নকের স্ত্রী বাঙালি। তার গর্ভে চারটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে। এ চার কন্যার একজন 'ইংল্যান্ড রাজ্যেও সর্বপ্রধানমন্ত্রী (দ্বিতীয় আর্ল লিভারপুর) মহাশয়েরর মাতামহী।
ভারতীয় ও ইউরোপীয় সুসম্পর্ক ও সখ্য কমে যাওয়ায় ধর্মানন্দের মতে শতবর্ষ আগে এ ধরনের বিয়ে অনেকটাই হ্রাস পায়।
জব চার্নকের ল্যাটিন এপিটাফ
জব চার্নকের ল্যাটিন এপিটাফের বাংলা ভাষান্তর প্রাচীন কলিকাতা গ্রন্থ থেকে তুলে ধরছি:
'জব চার্নক যোদ্ধা, একজন জাতীয় এবং বঙ্গদেশে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হইয়াছিলেন, ইঙ্গরেজ জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ, মনুষ্যজাতির মধ্যে ক্ষমতাশালী, তিনি তাহার নিজ অস্ত্রসহ মার্বেল প্রস্তুরের নিম্নে শায়িত খ্রীষ্টের আগমণকাল পর্যন্ত সমাধি হইতে সুখকর পুনরুত্থানের আশায় তিনি এ স্থানে নিদ্রিত থাকিলেন যিনি বহুকাল হইতে নিজ মাতৃভূমিতে পরিভ্রমণ করেন নাই কিন্তু অনন্তকালের জন্য নিজ আবাসে প্রত্যাগমণ করিয়াছেন ১৬৯২ খৃষ্টাব্দে ১০ই জানুয়ারি দিবসে মানবলীলা স্মরণ করেন।'
অ্যারিস্টোক্র্যাসি: পুরোনো খান্দান
১৮৩১ সালে সরকারি তত্ত্ববধানে বাঙ্গালি সম্ভ্রান্ত পরিবারের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল তাতে মুসলমান কেউ অন্তর্ভুক্ত হননি, সম্ভবত ছিলেনও না। সুরেন্দ্রনাথ সেন মহাফেজখানা ঘেটে বেঙ্গল অ্যারিস্টোক্র্যাসির তালিকা ও বিবরণ প্রস্তুত করেছেন। সেই তালিকা থেকে কিছু নাম :
১. মহারাজা দুর্লভরামের বোনের বংশধর। বাবু জগন্নাথপ্রসাদ বা তার ভাইয়েরা অজিাত হিসেবে সমাদৃত। জগন্নাথপ্রসাদ মুর্শিদাবাদবাসী আর তার ভাই কাশীনাথপ্রসাদ কলিকাতা শহরে বাস করেন।
২. লর্ড ক্লাইভের দেওয়ান রাজা নবকৃষ্ণের পুত্র মহারাজা রাজকৃষ্ণ রাহাদুর একজন বিশিষ্ট অভিজাত। মীর জাফরের সহায়কদের অন্যতম একজন নবকৃষ্ণ। তিনি অঢেল অর্থের মালিক হয়েছিলেন।
৩. বাবু গোপীমোহন দেব একই সাথে রাজা নবকৃষ্ণের ভাস্তে এবং দত্তক পুত্র। সন্তান পেতে বিলম্ব হওয়ায় রাজা তাকে দত্তক গ্রহণ করেন এবং সম্পত্তির অর্ধাংশ প্রদান করেন।
৪. রবার্ট ক্লাইভ এবং বাংলার অন্যান্য গভর্নরদের ব্যাংকার লক্ষীকান্ত ধর অঢেল অর্থ উপার্জন করেন। তার দৌহিত্র সুখময় বিচারপতি এলাইজা ইম্পের দেওয়ান করে ভূ-সম্পত্তি বৃদ্ধি করন। তার পুত্র রাজা রামচন্দ্র রায় তার ভাই কৃষ্ণচন্দ্র রায় বৈদ্যনাথ রায়, শিবচন্দ্র রায় এবং নরসিংহ রায় সকলেই স্বীকৃত অভিজাত।
৫. নিমাইচন্দ্র মল্লিক সম্পত্তি নিয়ে মামলায় ছয় লক্ষ টাকা খরচ করে এবং বিলেতের আপিল আদালত পর্যন্ত মামলা ঠেলে দিয়ে বিখ্যাত হয়েছেন। তার জীবিত ৬ পুত্রই অভিজাত: রাজাগোপাল, রামরতন, রামতনু, রামকানাই, রামমোহন এবং হীরা লাল।
৬. হ্যাস্টিংস এর আমলের কাউন্সিল বোর্ড অব রেভেনিউর দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের দৌহিত্র কৃষ্ণসিংহ লালবাবুর মৃত্যুর পর তার নাবালক পুত্র শ্রীনারায়ন সিংহ ও অভিজাত হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়েছন।
৭. গভর্নর ভ্যান্সিটার্ট এবং সেনাপ্রধান জেনারেল স্মিথের দেওয়ান রামচরন রায়ের বংশধর চব্বিশ পরগনার রাজনারায়ন রায় তারকানাথ রায় এবং তাদের বংশধর অভিজাত তালিকাভুক্ত।
৮. ভেরেনস্ট সাহেবের দেওয়ান হিসেবে গোকুলচন্দ্র ঘোষাল সন্দিদ্বীপের জমিদারি লাভ করেছিলেন। তিনি কুষ্ঠরোগীদের আশ্রম নির্মাণের জন্য ভূমি ও অর্থ দান করে খ্যাতি লাভ করেন। তার বংশধর কালীশঙ্কর ঘোষাল স্বীকৃত অভিজাত।
৯. সূর্যকুমার ঠাকুর, চন্দ্রকুমার ঠাকুর কালীকুমার ঠাকুর, নন্দকুমার ঠাকুর, হরকুমার ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর কলিকাতার অভিজাত। তাদের পূর্বপুরুষ দর্প নারায়ন ঠাকুর হুইলার সাহেবের দেওয়ানি করার সময় প্রভূত বিত্তশালী হয়ে উঠেন।
১০. বড় বাজারে শেঠ ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার গৌরচরন শেঠ, ব্রজমোহন শেঠ কৃষ্ণমোহন শেঠ, রাজকুমার শেঠ অভিজাত দলভুক্ত।
১১. সরকারের খাজাঞ্চি রাধাকৃষ্ণ বসাক শেঠ বংশের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ। তিনি ধনী অভিজাতদের অন্যতম।
১২. রামদুলাল দে কলিকাতার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তিনি ভূ-সম্পত্তির মাধ্যমে ধন অর্জন করেননি, তিনি প্রকৃত ব্যবসায়ী। তিনি ফেয়ারলি কোম্পানির দেওয়ান ছিলেন, নিজে আমেরিকার ব্যবসায়ীদের সাথে কারবার করতেন।
১৩. চট্টগ্রাম ও নোয়াখালি অঞ্চলের লবনের এজেন্ট হ্যারিস সাহেবের দেওয়ান রামহরি বিশ্বাস বিস্তর ভূ-সম্পত্তির মালিক হন। তার পুত্র প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস ও জগমোহন বিশ্বাস অভিজাত গোত্রভুক্ত।
১৪. শান্তিরাম সিংহ পাটনার চিফ মিডলটন এবং স্যার টমাস রামবোল্ডের দেওয়ান ছিলেন। তার পুত্র প্রাণকৃষ্ণ ছিলেন ট্রেজারির পাঞ্জাবি। তার তিন পুত্র রাজকৃষ্ণ সিংহ, বিকৃষ্ণ সিংহ এবং শ্রীকৃষ্ণ হিংস তালিকাভুক্ত অভিজাত।
১৫. গোবিন্দ রাম কলিকাতা জমিদারির দেওয়ানি করা ছাড়াও নিজ উদ্যোগে ব্যবসা করে বিত্তশালী হন। তার ছয় দৌহিত্র অভিজাত তালিকাভুক্ত ভগবতীচরণ মিত্র, ভবানীচরণ মিত্র এবং আরো চারজন।
১৬. ভ'-সম্পত্তি দিয়ে নয়, ঠিকাদারির লাভের অর্থে সমৃদ্ধি লাভ করে বাগবাজারে বিশাল ভবন নির্মাণ করে গোকুলচন্দ্র বিখ্যাত হয়েছিলেন। তার দৌহিত্র নবকৃষ্ণ মিত্র, হরলাল মিত্র, হরিণচন্দ্র মিত্র প্রমুখ অভিজাত গোত্রভুক্ত হয়েছেন।
১৭, কেবল ব্যবসা করেই পামার কোম্পানির খাজাঞ্চি গঙ্গানারায়ন সরকার এক প্রজন্মেই অন্যতম ধনী ব্যক্তি এবং অভিজাত তালিকাভুক্ত হয়ে উঠেছেন গঙ্গানারায়ন সরকার।
১৮. একদা দরিদ্র কৃষ্ণচন্দ্র পালচৌধুরী জীবন সংগ্রাম করে লবণের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হন। আর চারপুত্র ঈষানচন্দ্র মৃত, প্রেমচন্দ্র, রতনচন্দ্র, এবং উমেশচন্দ্র অভিজাত দলভুক্ত হয়েছেন।
১৯. মথুরামোহন শরফ ব্যাংক ব্যবসায়ে প্রচুর লাভবান হন এবং জোড়াবাগানে প্রাসাদোপম বাড়ি নির্মাণ করেন। তার পুত্র রাজনারায়ন সেন, রূপনারায়ন সেন এবং অপর তিন পুত্র অভিজাত চিহ্নিত হয়েছেন।
২০. রামসুন্দর কানুরজি বৈবাহিক সূত্রে প্রচুর সম্পদের মালিক হন এবং আফিমের এজেন্সি তাকে আরো ধনী করে। তার পুত্র ফকিরচাঁদ বানুরজিও সম্পদ বৃদ্ধি করেন। ফকিরচাদের পুত্র রাধামাধব বানুরাজি এবং গৌরীচরন বানুরাজি অভিজাত দলভুক্ত। (তালিকাটি অসম্পুর্ণ)