বাংলাদেশের এপ্রিল ১৯৭১
একাত্তরের এপ্রিলের প্রথম দিনই ভারতের যুগান্তর পত্রিকা সম্পাদকীয় লিখলো: পাকিস্তান দুই ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকার। একের হাতে জনতার সনদ অপরের হাতে আসুরিক বল। একের লক্ষ্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অপরের লক্ষ্য তার ধ্বংস। এই দুয়ের মধ্যে কোনো মিলন সেতু নেই। যদি থাকতো তাহলে মুজিব-আইয়ুব আলোচনার সময়ই তা বেরিয়ে পড়তো।
ভারত সরকারের কাছেই তাদের প্রশ্ন: নয়াদিল্লি কি মনে করে ব্রিটেন ও আমেরিকা ইয়াহিয়ার ওপর চাপ দেবে? সেন্টোভুক্ত দেশ হিসেবে উভয় দেশই পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেন্টো হচ্ছে সেন্ট্রাল ট্রিটি অরগানাইজেশন। সদস্য রাষ্ট্র ব্রিটেন, তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান, ইরাক এবং পেছনে সংগঠক যুক্তরাষ্ট্র। উদ্দেশ্য সোভিয়েত হস্তক্ষেপ ও প্রভাব রোধ করা এবং নিরাপত্তা হুমকিতে পরস্পরের জন্য সামরিক সহায়তা প্রদান করা।
যুগান্তর আরও উল্লেখ করেছে: 'চীন পড়েছে উভয় সঙ্কটে। এতদিন সে দহরম-মহরম করেছে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সঙ্গে। এখন পূর্ব বাংলার উত্তাল তরঙ্গে নৌকা ভাসাতে তার শরম লাগছে। দুনিয়ার সর্বত্র গণআন্দোলনের উত্তাল সমর্থনে চীনের বিল্পবী আত্মা নেচে ওঠে। পূর্ব বাংলার ব্যাপারে সে নীরব। সোভিয়েত রাশিয়ার পদক্ষেপ সতর্ক। সে মুখ খুলছে না। মার্কিন, সোভিয়েত এবং চীনা অস্ত্র নিয়ে ইয়াহিয়ার ফ্যাসিস্ট বর্বর দল চালাচ্ছে বাংলাদেশে গণহত্যা। সামরিক অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে অসামরিক জনতা ধ্বংসে। গণহত্যা প্রতিরোধে তাদের সাহায্য পাওয়া দুঃসাধ্য, অথচ তাদের সমর্থন ছাড়া রাষ্ট্রসংঘে এক পাও এগুনো যাবে না।'
পত্রিকা ইঙ্গিত করেছে: আন্দোলন যেখানে এসে পৌঁছেছে সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। স্বাধীনতার ঘোষণা প্রত্যাহারের পরিণতি বর্তমান নেতৃত্বের আত্মহত্যা- কাজেই লাশের পাহাড় বাড়তে থাকলেও লড়াই করে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে।
১ এপ্রিল ১৯৭১ সুইডেনের এক্সপ্রেসেন স্টকহোম লিখেছে বাংলায় গণহত্যা:
শেখ মুজিবুর রহমানকে যে বন্দী করা হয়েছে তা প্রমাণ করতে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ একটি আলোকচিত্র অবমুক্ত করেছে। তাঁর বন্দীদশার ছবিটি দেখিয়ে সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনোবল ভেঙে দিতে চায়। প্রশ্ন, ছবিটি আগে ছাড়া হল না কেন? কোন তারিখের ছবি তা-ই বা উল্লেখ করা হয়নি কেন? তারা শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন দেখাচ্ছে না?
তবে এটা স্পষ্ট, ইয়াহিয়া খানের শাসন যে কোনো মূল্যে তাঁর (শেখ মুজিব) শহীদ হওয়ার সুযোগ প্রতিহত করতে চাইবে। প্রশ্ন হচ্ছে কারাবন্দী শেখ মুজিবকে দেখার যে অনুভূতি পূর্ব পাকিস্তানে জন্মাবে, তা কি পরিস্থিতি পাল্টে দেবে? তাঁকে নিয়ে কিংবা তাঁকে ছাড়া (বন্দীদশায় রেখে) যে অবস্থায়ই হোক না কেন, পূর্ব পাকিস্তানের আর পিছু হটার পথ নেই।
সত্য গোপন করার জন্য সামরিক সরকারের সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমরা এখন জানি পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে। শরণার্থীরা ব্যাপক গোলাবর্ষণ, বেপরোয়া ধ্বংসযজ্ঞ এবং গণহত্যার সাক্ষ্য দিয়েছে।
শত সহস্র মানুষ তাদের ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে। ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ হানা দিয়েছে। পাকিস্তানের ঐক্য অটুট রাখতেই হবে-এই প্রণোদনার নামে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতি শক্রতার অস্ত্র প্রয়োগ করা হচ্ছে। দেশের প্রথম সংসদীয় নির্বাচনের ফলাফল ভণ্ডুল করে দেওয়ার জন্য সামরিকজান্তা সহিংস শক্তি প্রয়োগ করে চলেছে। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল হজম করার প্রস্তুতি পাকিস্তানি শাসকদের ছিল না-উলটো সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছে। এটা স্পষ্ট, এই পদ্ধতিতে কখনোই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের পুনর্মিলন ঘটানো সম্ভব হবে না। নির্মমভাবে অধিকার প্রতিষ্ঠা অথবা যুদ্ধ-এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এই নীতি অনুসরণের জন্য অবশ্যই নিন্দা জ্ঞাপন করতে হবে।
***
২ এপ্রিল, ১৯৭১ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি বাংলাদেশ পরিন্থিতি নিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে যে চিঠি লিখেছেন এটাই ছিল প্রথম সর্বোচ্চ পর্যায়ের চিঠি:
ইয়াহিয়া খানকে পদগর্নি
মস্কো, ক্রেমলিন ২ এপ্রিল, ১৯৭১
সম্মানিত প্রেসিডেন্ট
ঢাকায় আলোচনা ভেঙে যাওয়ার খবর এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক প্রশাসনের চরম ব্যবস্থা গ্রহণ ও সশস্ত্র শক্তিপ্রয়োগের খবর সোভিয়েত ইউনিয়নে গভীর আশঙ্কার সৃষ্টি করেছে।
যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে পাকিস্তানের অসংখ্য মানুষের মৃত্যু, ভোগান্তি ও দুস্থাবস্থায় সোভিয়েত জনগণ উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। এম রহমান ও অন্যান্য রাজনীতিবিদ, যাঁরা সম্প্রতি সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সমর্থনে বিজয়ী হয়ে এসেছেন, তাঁদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতন সোভিয়েত ইউনিয়নে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। সোভিয়েত জনগণ সব সময়ই পাকিস্তানের জনগণের সর্বোচ্চ কল্যাণ ও উন্নতি কামনা করেছে এবং যেসব জটিল সমস্যা দেশ মোকাবিলা করেছে, গণতান্ত্রিকভাবে এর সমাধানে যখনই সমস্যা এসেছে, সোভিয়েত জনগণ আনন্দ প্রকাশ করেছে।
পাকিস্তানি জনগণের এই সংকটের দিনে প্রকৃত বন্ধু হিসেবে কিছু কথা না বলে পারছি না। আমরা বিশ্বাস করি, পাকিস্তানে শেষদিকে যে জটিল সমস্যা দেখা দিয়েছে, কোনো ধরনের বল প্রয়োগ না করে রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান করা সম্ভব এবং তা-ই করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর অত্যাচার, অবদমন ও রক্তপাত অব্যাহত রেখে সমাধানকে আরও কঠিন করে তোলা হবে এবং তা পাকিস্তানের সব মানুষের মৌল স্বার্থের প্রচণ্ড ক্ষতি করে ছাড়বে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম সোভিয়েত প্রেসিডিয়ামের পক্ষে আপনাকে জানানো আমাদের কর্তব্য যে অবিলম্বে রক্তপাত বন্ধ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর নিপীড়ন কমিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ দেখুন। আমরা মনে করি, কেবল তাতেই জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা এবং আঞ্চলিক শান্তি রক্ষা করা সম্ভব হবে। সোভিয়েত জনগণ শান্তিপূর্ণ সমাধান সানন্দে গ্রহণ করবে।
বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণার মানবিক নীতিমালা অনুসরণ করে আমরা এই আপিল জানাচ্ছি, আমরা পাকিস্তানের বন্ধুপ্রতিম জনগণের সম্মতিতে তাদের সবার জন্য এই আপিল পেশ করছি।
প্রেসিডেন্ট সাহেব, আমরা আশা করব, এ চিঠির প্রকৃত মর্মার্থ অনুধাবনে আপনি সক্ষম হবেন। আমাদের একান্ত প্রত্যাশা, অবিলম্বে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক।
এন. পদগর্নি
৪ এপ্রিল নয়া দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম সাক্ষাৎকারটি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বৈধ সরকার গঠনের তাগিদ এবং ভারতের অব্যহত সহায়তার আশ্বাস স্বাধীনতা আন্দোলনে একটি দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
সে সময়ের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম বিবিসির কয়েকটি এপ্রিল সংবাদ:
পূর্ব পাকিস্তান থেকে একটার পর একটা সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের খবর আসছে। লন্ডন টাইমসের বিদেশ সংবাদদাতার চাক্ষুষ বিবরণ থেকে যশোরের অবস্থা জানা যায়। তিনি বলেন, পাকিস্তান সরকারের বাহিনী মিলিটারি ক্যাম্প এলাকা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করেছে। ফলে শহরটি এখন পূর্ব পাকিস্তানি বাহিনী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থক ও অনুসারীদের দখলে। তিনি বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের অনিয়মিত আধা-সামরিক বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানে জন্ম এমন সব মানুষকে ঘিরে, হাঁটিয়ে বাজারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করার অভিযোগ আনা হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেভাবে গুলি করে বাঙালিদের হত্যা করেছে তারই প্রতিশোধ হিসেবে একই নির্মমতায় তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
পশ্চিম পাকিস্তান রেডিও একটানা বলে যাচ্ছে, পূর্বাঞ্চলীর প্রদেশের সবগুলো প্রধান শহর এখন শান্ত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী উড়োজাহাজ, ট্যাঙ্ক ও রকেটের সাহায্যে ভয়াবহ প্রত্যাঘাত করছে বলে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কাছে নালিশ জানিয়েছে।
৭ এপ্রিল ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বিভিন্ন দেশের একদল নাগরিক কলকাতায় এসে পৌঁছেছেন এবং সেখানে গণহত্যা ও রাস্তায় মৃতদেহ স্তুপীকৃত হয়ে থাকার কথা বলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, দুই সপ্তাহের লড়াইয়ে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে। একজন মার্কিন নাগরিক সংবাদদাতাদের জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম একটি ভৌতিক নগরীর মতো হয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনী, মৃতদেহ এবং কুকুর ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই। এক মার্কিন নাগরিককে উদ্ধৃত করে সংবাদদাতা জানিয়েছেন, চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল এবং তারা বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যা করেছে। বিদ্যুত যোগাযোগ পুনঃস্থাপনে সহায়তা করার জন্য সেনাবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি রাস্তায় অনেক নিহত মানুষের লাশ দেখেছেন। মৃতদেহের গন্ধ সমগ্র চট্টগ্রামজুড়ে। একজন শরণার্থী বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা দেখামাত্রই পূর্ব পাকিস্তানিদের গুলি করছে এবং একই নির্মমতায় স্থানীয়রাও চট্টগ্রাম বন্দরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হত্যা করছে।
১০ এপ্রিল ১৯৭১ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র পাঠ করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপ্রধান এবং রাষ্ট্রপ্রধানের অনুপস্থিতিতে অস্থাযী রাষ্ট্রপ্রধান তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বচিত হন। ১৭ই এপ্রিল সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বৈদ্যনাথতলা নব নামায়নে মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করে।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বেতার ভাষণের শুরুতে বলেন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত।... হাজার হাজার মানুষ আজকের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর বীর বাঙালি যোদ্ধারা এই স্বাধীনতা সংগ্রামের যে যুদ্ধ তার পুরোভাগে রয়েছেন এবং তাদের কেন্দ্র করে পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, ছাত্র, শ্রমিক ও অন্যান্য হাজার হাজার সংগ্রামী মানুষ এই যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। সাগরপাড়ের বাঙালি ভাইয়েরা যে যেখানে আছেন আমাদের অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য পাঠাচ্ছেন।...
ইতোমধ্যে সোভিয়েত রাশিয়া এবং ভারতবর্ষ এই নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে এবং সোভিয়েত রাশিয়া অবিলম্বে এই হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। গ্রেট ব্রিটেনও বাংলাদেশের এ অবস্থা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছে। যে সমস্ত পাকিস্তানি বিমান মৃত্যুর সরঞ্জাম নিয়ে ঢাকা আসার পথে জ্বালানি সংগ্রহ করছিল, তাদের জ্বালানি সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সিংহল ও ব্রহ্মদেশ।
আমাদের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে স্থিরবিশ্বাস; কারণ প্রতিদিনই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে এবং আমাদের এ সংগ্রাম পৃথিবীর স্বীকৃতি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে শেষ পরাজয় মেনে নেওয়ার আগে শত্রুরা আরও অনেক রক্তক্ষয় আর ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করবে। তাই পুরোনো পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংকল্পে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। আমাদের এই পবিত্র দায়িত্ব পালনে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে গেলে চলবে না যে, এ যুদ্ধ গণযুদ্ধ এবং এর সত্যিকার অর্থে এ কথাই বলতে হয় যে, এ যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ।
১৭ এপ্রিল ১৯৭১ বিবিসির সংবাদ
সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি করে পূর্ব পাকিস্তানিদের একটি দল, তাদের ভাষায়, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের ভেতর একটি গ্রামের (বৈদ্যনাথতলা) আম্রকাননে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের সামনে নজরুল ইসলাম ঘোষণা পাঠ করেন। তিনি বলেন, তাঁর সরকার পৃথিবীর সব দেশের কাছে বাংলাদেশের জনগণের সহায়তায় এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী এবং কে এম আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করে তিনি একটি মন্ত্রিসভার ঘোষণা দিয়েছেন। এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য ভারত থেকে একদল সংবাদদাতাও এসেছিলেন।
২১ এপ্রিল ১৯৭১
পাঁচজন স্থানীয় নেতাকে তাদের বিরুদ্ধে আনীত বিভিন্ন অভিযোগের জবাব দেবার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ আগামী সোমবার ঢাকায় সামরিক আইন সদর দফতরে হাজির হবার নির্দেশ দিয়েছে। ঘোষণায় বলা হয়েছে, তারা হাজির হতে ব্যর্থ হলে অনুপস্থিতিতেই তাদের বিচারকার্য সম্পন্ন করা হবে। তাদের একজন হচ্ছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ-যাকে গত সপ্তাহান্তে পাকিস্তান থেকে ভেঙে আসা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করা হয়েছে।
২৮ এপ্রিল ১৯৭১
ব্রিটেনের লেবার পার্টির এমপি ব্রুস ডগলাসম্যান কেবলই পূর্ব পাকিস্তানে এক সপ্তাহ সফর শেষ করে লন্ডনে ফিরে এসে বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক সহিংসতার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। তার অবস্থানকালে যেসব কাগজপত্র পেয়েছেন তাতে তার মনে করার কারণ রয়েছে যে, আড়াই লক্ষ মানুষকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যা করেছে। তিনি বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ফিরে না আসা পর্যন্ত পাকিস্তানকে সকল সাহায্য প্রদান স্থগিত রাখার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে বোঝাতে চেষ্টা করবেন। তিনি আরও বলেন, ব্রিটেনের উচিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া।
প্রেসিডেন্টের জন্য হেনরি কিসিঞ্জারের এপ্রিল মেমোরেন্ডাম
ওয়াশিংটন স্পষ্ট বুঝে গেছে এই সময়টি 'স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা লাভের অন্তর্বর্তীকাল'।
এপ্রিল ২৮, ১৯৭১
[পূর্ব পাকিস্তানে] পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক হামলার পর পরিস্থিতি নিচের তিনটি বিবেচনায় বর্ণনা করা যায়- যে সমস্যা আমাদের অবশ্যই মোকাবেলা করতে হবে।
*পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী শীগ্রই প্রধান শহরগুলো এবং সংযুক্ত এলাকাসমূহের বাস্তব নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে সমর্থ হবে। এর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ তা আদৌ সংগঠিত নয় এবং প্রতিরোধের তেমন রসদও তাদের নেই।
*বাস্তব নিয়ন্ত্রণ মানেই অত্যাবশ্যকীয় সেবাসমূহ যেমন খাদ্য সরবরাহ চালু এবং স্বাভাবিক অর্থনৈতিক জীবন শুরু হওয়া নয়। কারণ সে জন্য বাঙালিদের যে সহযোগিতা প্রয়োজন তা পাওয়া যাবে না।
*এমনকি যদি খুব শীগ্রই প্রতিরোধ দমন সম্ভব হয়-তা পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক অসন্তোষ ও ঘৃণা ছড়িয়ে দেবে।
*ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা ১৯৬৫ সালের পর এখনই তুঙ্গে অবস্থান করছে। বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে নতুন দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের ভীতি থেকে যাবে।
ওপরের বিবেচনাগুলো থেকে প্রতীয়মান, এই পরিস্থিতি নিয়ে সম্ভবত কিছুটা দীর্ঘ একটি অন্তর্বর্তীকাল অতিবাহিত হবে যে সময় [ক] পশ্চিম পাকিস্তানিরা পুনরায় কার্যকরী প্রশাসন পুনঃস্থাপন করবেন; কিন্তু [খ] এমনকি প্রয়োজনীয় বাঙলি সহযোগিতা লাভের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন প্রদানের প্রযোজনীয়তার স্বীকৃতি দিতে হতে পারে।
কাজেই পূর্ব পাকিস্তানে আরও বেশি স্বায়ত্তশাসন এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা লাভের যে অন্তর্বর্তীকাল, আমাদের সে সময়ের মুখোমুখি হতে হবে। এই সময় কতটা দীর্ঘ ও সহিংস হবে তা নির্ভর করছে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে আমাদের কী বিবেচনা তার ওপর।
পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিরোধকারীদের নেতারা স্বাভাবিক সেবা বিশেষ করে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি প্রশাসনকে সহযোগিতা করার রাজনৈতিক অসুবিধার দিকটির তুল্য মূল্য হিসাব করবে। সরবারহ ব্যবস্থার পুনরুদ্ধার না হলে বড় ধরনের দুর্ভিক্ষ এড়ানো যাবে বলে মনে হয় না।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা তদের প্রান্তে আগামী কয়েক মাস ধরে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে। তারা আমাদের জানিয়েছে যদি জরুরি ভিত্তিতে বৈদেশিক মুদ্রা সহায়তা না মেলে তা হলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বন্ধ করতে এবং আমদানি সীমিত করতে বাধ্য হবে- তা এমনতর পর্যায়ে পৌঁছবে যে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়বে এবং সম্ভবত তা আর্থিক ব্যবস্থাকে ভেঙে দেবে। তার ফলে এমন হতে পারে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহদাংশ উচ্চমূল্যের চাপে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে দিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।