প্রিজনার অব ওয়ার: নিয়াজির জামাই আদরে বন্দীজীবন
হত্যা ও ধর্ষণের দায় নিয়ে যার মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় নিঃসঙ্গ সেলে থাকার কথা, সেই জেনারেল নিয়াজি ভারতে জামাই আদরেই ছিলেন, নিয়াজির বর্ণনা সে কথাই বলে।
পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি নিজেই লিখেছেন ঢাকার রমনাতে ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্নে যখন আত্মসমর্পণ দলিল সই করেন তার হাত কাঁপছিল। দুঃখ তার অন্তর থেকে চোখে উঠে এসে চোখ ভারাক্রান্ত করে ফেলছিল।
টাইগার নিয়াজির বাঘ থেকে মেষ শাবকে পরিণত হবার বিবরণ অনেক বিদেশি সাংবাদিক দিয়েছেন। আত্মসমর্পনের পরপরই কমান্ডার থেকে শুরু করে ব্যাটম্যান পর্যন্ত সবাই বন্দী- 'প্রিজনার অব ওয়ার'।
নিয়াজির সৌভাগ্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ তার কোর্সমেট, এতোটাই ঘনিষ্ট যে নিয়াজি তাদের কাছে আবদুল্লাহ। তাদের হাসি ঠাট্টা পরাজয়ের গ্লানি অনেকটাই ঢেকে দিয়েছে। নিয়াজির লেখা থেকেই কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম এবং জব্বলপুরের যুদ্ধবন্দী ক্যাম্প ১০০- এর স্মৃতি এবং তার অনুভূতি, কোথাও অনুসৃত এবং কোথাও টীকা ও ব্যাখ্যাসহ উপস্থাপন করা হলো।
'সেনাবাহিনীর যুদ্ধবন্দী সৈনিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের ভারতের বিভিন্ন অংশে যুদ্ধবন্দী শিবিরে নিয়ে যাওয়া শুরু হলো। লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগৎ সিং (ইস্টার্ন কমান্ডের অধীন আসামভিত্তিক ফোর্থ কোর-এর কমান্ডার, তার নেতৃত্বেই ভারতীয় বাহিনী মেঘনা পাড়ি দিয়ে ঢাকায় এসেছে) আমাকে জানালেন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ কোলকাতা নেওয়া হবে। তবে বিস্তারিত তদন্তের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করতে ভারতীয়রা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে ঢাকায় আটকে রাখতে চেয়েছিল। গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে সকল বিষয়েই তার হস্তক্ষেপ ছিল, তিনি গভর্নরের সিদ্ধান্তে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতেন। ভারতীয় এবং বাঙ্গালি উভয়েরই অভিযোগ নির্বাচন ও সংসদ অধিবেশন পেছানোতে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা হস্তান্তর বাধাগ্রস্ত করতে তিনিই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
২৫ মার্চের অভিযান পরিকল্পনা ও পরিচালনার মুখ্য ভূমিকা তারই। তারা তাকে ক্ষমা করতে অনিচ্ছুক। কিন্তু আমি জোরাজুরি করলাম তদন্তের জন্য কোনো পাকিস্তানি সৈন্যকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হবে না-জেনারেল মানেকশ (ভারতীয় সেনাপ্রধান) আমাদের সে নিশ্চয়তা দিয়েছেন। এ ধরনের যে কোনো তদন্তের বিষয় সিদ্ধান্তের জন্য তা পাকিস্তানি আদালতে দাখিল করতে হবে। একইভাবে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কাঠামোতে কর্মরত কাউকে আটক করার অনুমোদন নেই। আমাদের সাথে কিছু সংখ্যক আল-বদর এবং আল শামস সদস্যও রয়েছেন, যারা যুদ্ধের সময় আমাদের সহায়তা করেছেন এবং এখন বাঙ্গালিরা তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।
যেদিন আমাদের কলকাতা যাবার কথা সেই ২০ ডিসেম্বর সকালবেলা আমি আমার কমান্ড পোস্ট এরিয়ায় (হেডকোয়ার্টার্স, কমান্ডারের ক্ষেত্রে) যাই; সেখানে কিছু সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক নাগরিক জমায়েত হয়েছেন। আমি তাদের কাছে ব্যাখ্যা করি-পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নির্দেশে অস্ত্র সমর্পন করা হয়েছে- প্রেসিডেন্ট আতঙ্কিত ছিলেন ভারতীয় বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানে আরও ভয়ঙ্কর আক্রমণ চালাতে পারেন, আমাদের সবার ভিত্তি সেখানে, আমাদের পরিবার সেখানে, প্রেসিডেন্ট সেই পশ্চিম পাকিস্তানের রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
একটি ক্যারিবু উড়োজাহাজে (ডি হ্যাভিল্যান্ড কানাডার ক্যারিবু উড়োজাহাজ মূলত সামরিক কাজে ব্যবহৃত শর্ট টেকঅফ এবং শর্ট ল্যান্ডিং ক্ষমতার বিশেষায়িত জাহাজ, মালামাল পরিবহনে বিশেষভাবে উপযোগী) মেজর জেনারেল ফরমান, অ্যাডমিরাল শরিফ, এয়ার কমোডোর ইনাম উল হক, আমার চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী, আমার আর্টিলারি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এম এস কাসিম, আমি নিজে, আমাদের এডিসি এবং ব্যাটম্যান ঢাকা থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমি যেহেতু আমার পাবলিক রিলেশনস অফিসার মেজর সিদ্দিক সালিককে বাঙ্গালিদের করুণার উপর ভরসা করে রেখে যেতে চাইনি--তার অপকর্মের তদন্তের জন্য ভারতীয় এবং বাঙ্গালিরা তাকে চাচ্ছিল, আমি তাকে ফরমানের এডিসি সাজিয়ে হেলিকপ্টারে তুলে নিলাম। মিলিটারি গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগৎ সিং আমাদের ঢাকা এয়ারপোর্ট বিদায় জানালেন আমরা কলকাতায় দমদম এয়ারপোর্টে অবতরণ করলাম। দুটি স্টাফ কার আমাদের হেলিপ্যাড থেকে তুলে নিয়ে ফোর্ট উইলিয়ামের ভেতরে আমাদের জন্য নির্ধারিত আবাসনে নিয়ে এলো।
নতুন নির্মাণ করা তিন তলা ভবন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, যথাযথভাবে সজ্জিত। একটি কক্ষকে ডাইনিং রুম বানানো হয়েছে, সেখানে সকল কর্মকর্তা তাদের খাওয়া দাওয়া করেন। আমাদের সেপাই রেশন বরাদ্দ করা হয়েছে। ভারতীয় পাচক খাবারটা রান্না করে দিলেও আমাদের আর্দালি তা পরিবেশন করে। আমাদের সময় কাটানোর প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠে-ব্যায়াম করা, বই পড়া এবং রেডিও শোনা।
আমরা সেদিন রেডিওতে শুনলাম ভুট্টো ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। ফরমান মন্তব্য করলেন, তাহলে অভ্যুত্থান ক'দিন দেরিতে হলো। (ভুট্টো ২০ ডিসেম্বরই প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ তিনি জাতিসংঘ থেকে ফিরে আসেন। ২০ ডিসেম্বর তাকে রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট হাউসে নেওয়া হয় এবং তিনি পাকিস্তানের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট এবং প্রথম বেসামরিক চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনস্ট্রেটর এর দায়িত্বভার ইয়াহিয়ার কাছ থেকে গ্রহণ করেন)।
কিছু সময় পর আমাদের সাথে যোগ দিলেন মেজর জেনারেল নজর হোসেন, মেজর জেনারেল মোহাম্মদ হোসেন আনসারি, মেজর জেনারেল কাজি মজিদ। মেজর জেনারেল জামশেদ তখনো এসে পৌছেননি। আমি উদ্বিগ্ন কলকাতায় আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্নেল খারাকে জামশেদের খবর জিজ্ঞেস করলাম। আমাকে বললেন, প্রশাসনিক ব্যাপার সামাল দিতে তিনি এখনো ঢাকায় রয়ে গেছেন। তার শরীর ভালো আছে, তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কিন্তু আমি পরে জানতে পারি জামশেদ কলকাতা জেলে নিঃসঙ্গ ফটকে অবস্থান করছে। আমার অজ্ঞাতে তাকে জেলে নেওয়া হয়েছে।
কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম থেকে আমাদের জব্বলপুরে যুদ্ধবন্দী ক্যাম্প নম্বর ১০০ তে নেওয়া হলো--এটি জেনারেলদের ক্যাম্প নামে পরিচিত। আমাদের ব্যাটম্যানদের সাথে রাখতে দেওয়া হলেও এডিসিদের ভিন্ন ক্যাম্পে সরিয়ে নেওয়া হলো। ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী এবং ব্রিগেডিয়ার কাসিমকে পাঠানো হলো বেরিলি ক্যাম্পে, সিদ্দিক সালিক চলে গেলেন এডিসিদের সাথে। আবার তাদের দৃষ্টি নিবন্ধ হলো ফরমানের উপর। ঢাকা চুক্তি লঙ্ঘন করে ভারতীয়রা ফরমানকে জেরা করতে চাইল। আমি কর্নেল খারাকে ডেকে শক্তভাবে প্রতিবাদ করলাম। জেনেভা কনভেনশন ও ঢাকা চুক্তির শর্তের আলোকে আমি তাকে বললাম তাদের প্রস্তাব কনভেনশন ও চুক্তির স্পষ্ট বরখেলাপ জিজ্ঞাসাবাদের নামে তার ওপর যুদ্ধকালীন ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়া হবে এবং তিনি অত্যাচারের ভুক্তভোগী হবেন।
কর্নেল খারা আমাকে বললেন মুজিবের মুক্তির প্রশ্নে বাঙালিরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। বাঙালি স্বার্থের বিরুদ্ধে ফরমানের বাড়াবাড়ির কারণে তারা উত্তেজিত, তাকে যুদ্ধ অপরাধী হিসেবে বিচার করতে চায়। ১৪ ডিসেম্বর ফরমানের টেবিলে পাওয়া একটি ডায়েরি উদ্ধারের কাহিনী খারা আমাকে শোনালেন। সেদিন বেসামরিক প্রশাসন গুটিয়ে নেওয়া হয়। সকলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেন। তার ডায়েরিতে ফরমানের হাতে লিখা ছিল 'সবুজ জমিন লাল করে ফেলা হবে'- (অর্থাৎ রক্তাক্ত)। আমি যখন পাকিস্তানে ফিরলাম ভুট্টো আমাকে এই মন্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন।
যদিও ফরমান বলেছেন তিনি সামরিক বল প্রয়োগের বিরোধিতা করেছেন, ২৫ মার্চ অপারেশনে তার পরিকল্পনা ও পরিচালনা তার ভণ্ড আচরণের সাক্ষ্য দেয়। ফরমান কখনো সরকারের নীতিমালার বিরোধিতা করেননি--যুক্তিসঙ্গত কারণেই আমাদের ধরে নিতে হবে তিনি তা সমর্থন করেছেন। তাকে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ মনে করা হতো। সরকার তার পরামর্শের মূল্য দিত এবং সে অনুযায়ী কাজ করত, তার উপদেশ এবং সুপরিশ মান্য করত। পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হবার ঘটনা থেকে তার সংযুক্ততা বাদ দেবার কোনো সুযোগ নেই।
আমি ভারতীয়দের কাছে ব্যাখ্যা করি ফরমানের সম্পৃক্ততা সত্ত্বেও আত্মসমর্পণ চুক্তি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বাধা রয়েছে। তার নিয়তি কি হবে সেটা পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্ত নেবার বিষয়। আমি খারাকে বলি যেন তিনি অরোরাকে (ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা) তার প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন। খারা আমার কথা শুনে বেরিয়ে যান। কয়েক ঘন্টা পর ফিরে এসে আমাকে জানালেন, ফরমান যেতে পারবে।
আমি যখন ফরমানকে সংবাদটা দিলাম তিনি আনন্দে উদ্বেল হয়ে আমাকে বারবার ধন্যবাদ দিলেন। বললেন, 'স্যার, আমাকে সাহায্য করার জন্য আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। পাকিস্তানে ফেরার পরও আমাকে সাহায্য করবেন। আমি তাকে প্রতিশ্রুতি দিলাম, কিন্তু আমার জানাই ছিল না যে পাকিস্তানে ফিরে ফরমান পুরস্কৃত হবেন। পরিণাম হচ্ছে পাকিস্তানে ফেরার পর আমার আর তাকে কোনো সাহায্য করার প্রয়োজন হয়নি। যে ব্যক্তি তার দেশ এবং সেনাবাহিনীকে এমন অসম্মানজনক অবস্থায় নিয়ে গেল তার জন্য নির্ধারিত হলো বড় পুরস্কার, প্রথমে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে বদলি, তারপর ফৌজি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং শেষে মন্ত্রী।
আমাদের থাকার জায়গা বিওকিউ-র (ব্যাচেলার অফিসার্স কোয়ার্টার্স) কোনো একটি ইউনিটে। প্রত্যেক অফিসারের জন্য বরাদ্দ এটাচড বাথসহ একটি বেডরুম, একটি বসার ঘর, সামনে একটি বারান্দা। এই আবাসনটি নব নির্মিত, আসবাবপত্র পর্যাপ্ত। আমরা একটি কক্ষকে মসজিদে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নিলাম, আর একটিকে মেস। একটি দিয়ে দিলাম আমাদের সাথের বাঙালিদের। খাবারটা ছিল একেঘেয়ে--ভাত, চাপাতি, সবজি, ডাল কখনো কখনো মাংস। কাটাতার ঘেরা প্রাঙ্গনের পঞ্চাশ গজ ভেতরে আমাদের ক্যাম্প। কেউ যাতে পালাতে চেষ্টা না করে তার ব্যবস্থা করতে চার কোনায় চারটি কুড়ি ফুট উঁচু ওয়াচ-পোস্ট, রাতের বেলায় সার্চ-লাইটের আলোতে চারপাশ প্লাবিত থাকে, একটি অ্যালসেশিয়ান কুকুর নিয়ে একজন পেট্রলম্যান সার্বক্ষনিক প্রহরায়। এসব অভ্যন্তরীন বৃত্তের ভেতরে, বাইরে এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য মোতায়েন করা, তারাই বহিঃবৃত্ত। কাজেই জেলপালানোর মতো কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে সে জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
কদিন পর জেনারেল জামশেদ এসে আমাদের সাথে যোগ দিলেন। কাজেই আমাদের দলটা কলকাতার মতোই থাকলো, বাদ পড়ল দু'জন ব্রিগেডিয়ার এবং আমাদের ক'জন এডিসি। প্রশাসনিক ও অন্যান্য কাজ আমাদের ক্যাম্প সরাসরি স্টেশন কমান্ডারের অধীনে ন্যাস্ত হলো। মেজর জেনারেল পাড্ডা ছিলেন স্টেশন কমান্ডার। স্মার্ট, বুদ্ধিমান, নিখুঁত পোশাকের শিখ অশ্বারোহী অফিসার। তার অভিব্যক্তি সম্মানজনক, আচরণ সহানুভীতিপ্রবণ, তার কারণে পরিবেশটি সহনীয় এবং আন্তরিক। ক্যাম্প কমান্ডার একজন মেজর এবং ক্যাম্পে আমাদের চিকিৎসা সেবার জন্য একজন ক্যাপ্টেন মেডিক্যাল অফিসার। চিকিৎসা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত: জটিল কোনো কিছুর জন্য আছে জব্বলপুর কম্বাইন্ড মেডিক্যাল হসপিটাল। আমাদের কেউ কেউ জব্বলপুর সিএমএইচ ঘুরে এসেছি তবে কাউকেই সেখানে ভর্তি হয়ে থাকতে হয়নি বা আটকে রাখা হয়নি। সব মিলিয়ে ক্যাম্পের স্টাফদের আচরণ ছিল সম্মানজনক তাদের ব্যবহারে বা অভিব্যক্তিতে অসম্মানজনক কিছু ছিল না।
সময়ের সাথে সাথে আমরা একটি রুটিন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। বৈরিতা ও সঙ্কটের সময় আল্লাহতায়ালা রক্ষা করেন। তাই আমরা জেনারেল আনসারির ইমামতিতে নিয়মিত নামাজে অংশ গ্রহণ করি। বন্দী হবার আগেও আমি নামাজে নিয়মিত ছিলাম। এবার নামাজ আর সম্পূর্ণভাবে কোরআনে ডুবে থাকা আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়াল। আমরা রুমে ব্যায়াম করতাম এবং ক্যাম্প কম্পাউন্ডে হাঁটতাম এতে আমরা যে কেবল ব্যস্ত থাকতাম তাই নয়, আমাদের উদ্বেগও কেটে যেত। আমরা প্রচুর বইপত্র এবং ম্যাগাজিন পড়েছি--হয় কেনা হতো কিংবা স্টেশন লাইব্রেরি থেকে ধার নেওয়া হতো। বই ও ম্যাগাজিন ছাড়াও দৈনিক পত্রিকাগুলো সারা পৃথিবীর খবর এবং বর্তমান অবস্থা আমাদের অবহিত করত। তবে সময় কাটত ধীরে ধীরে।
নগদের পরিবর্তে টোকেন দেওয়া হতো। প্রতি মাসে আমি পেতাম ১৪০ রুপি। টাকার অঙ্কে যদিও কম, এটাই সে সময় অনেক সহায়তা করত। এই টাকায় আমরা বই, লেখার কাগজ কলম এবং কিছু খাবার কিনতাম। একাজের জন্য একজন ভারতীয় হাওয়ালদারকে নিয়োগ করা হয়েছিল, প্রতিদিন এসে জেনে নিতেন বাজার থেকে কী আনতে হবে, তিনি তা যথাযথভাবে সরবরাহ করতেন।
বন্দীত্বের কাল বেড়ে যাচ্ছে, খুব শিঘ্রই প্রত্যাবর্তনের কোনো নিশানা দেখা যাচ্ছে না। বন্ধু ও স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় চিঠি যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। আমরা চিঠি পেতে এবং লিখতে পছন্দ করতাম। বাড়ি থেকে আসা চিঠির চেয়ে বেশি আনন্দ অন্য কিছু দিতে পারে না। চিঠির মধ্য দিয়ে বিপুল সান্তনা ও ভালবাসা সম্প্রচার করা যায়। শুরুতে ভারতীয়রা আমাদের লেখার সামগ্রী সরবরাহ করত। পরে তারা এই বন্দোবস্তুটি স্থগিত করায় লেখালেখির সরঞ্জাম আমরাই কিনতে শুরু করি। প্রতিদিন আমাদের চিঠি নিয়ে যাওয়া হতো, আমরাও প্রতিদিন চিঠি পাওয়ার প্রত্যাশায় থাকতাম। চিঠি সেন্সর হতো।
অনেক সময় চিঠির আসল বিষয়টাই সেন্সরের কাঁচিতে পড়ে যেত। আমি অনেক চিঠি পেয়েছি তিক্ততায় পরিপূর্ণ, অধিকাংশ চিঠিই অনুপ্রেরণাদায়ক যা দৃঢ়তার সাথে বন্দীত্বের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে উৎসাহ যোগাত। সংক্ষেপে হলেও আমি সব চিঠির জবাব দিতে চেষ্টা করতাম। বিদেশ থেকে খাবারের প্যাকেট, উপহারের পার্সেল এবং চিঠিপত্র আসত। পার্সেলে থাকত চকোলেট, টফি, দাড়িকাটার জিনিসপত্র, সুগন্ধী ইত্যাদি। পাকিস্তান এবং বিদেশ থেকে এতোসব প্রেরণা না পেলে আড়াই বছরের বন্দী জীবন নারকীয় হয়ে উঠত। ভারতীয় কূটনীতিবিদ ও ভারতপন্থী মুসলমানদের প্রতি আমাদের অভিব্যক্তি ছিল ভিন্ন। তবে তারা অন্যান্য ক্যাম্পে জুনিয়র পাকিস্তানি অফিসারদের সামনে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তৃতা দিতেন ও দর্শন প্রচারের চেষ্টা করতেন, তাদের মতামতের প্রতি জুনিয়ররা বৈরিভাব পোষণ করত।
আমাদের জুনিয়র অফিসার এবং সৈনিকদের ব্রেইনওয়াশ করায় ভারতীয় সমন্বিত উদ্যোগ ভীষণ ব্যর্থ হয়ে যায় এবং তাদের জন্য আমাদের অফিসার ও সৈনিকদের মধ্য থেকে গুপ্তচর পাবার চেষ্টাও ব্যর্থ হলো।
ভারতীয় অফিসারদের পরিদর্শন তেমন সাদরে গৃহীত না হলেও রেডক্রস-এর সদস্যদের পরিদর্শন আমাদের প্রত্যাশিত ছিল। তারা ভারতীয়দের উপর চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স নীতি প্রয়োগ করে নিশ্চিত করতে চাইতেন যেন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে কোনো অনিয়ম বা বাড়াবাড়ি না করা হয়। তাদের কাছে কোনো অভিযোগ করা হলে অবিলম্বে তার সুরাহা করতে চেষ্টা করতেন। বন্দীদশায় পাকিস্তানি সৈন্যদের মর্যাদাপূর্ণ আচরনের তারা প্রশংসা করেছেন।
এক পর্যায়ে ভারত ক্যাম্পের চারদিকে দেয়াল তুলতে শুরু করলে আমি প্রতিবাদ জানালাম। তখন আমাকে জানানো হলো যে আমাকে হত্যা করার জন্য পাকিস্তান সরকার দু'জনকে পাঠিয়েছে, তাদের দৃষ্টির আড়ালে রাখার জন্যই এই দেয়াল। জেনারেল পেড্ডা আমাকে বললেন যে তাকে দিল্লিতে সেনাসদরে ডেকে ভারতীয় গোয়েন্দাদের প্রাপ্ত সংবাদটি জানানো হয়েছে- তারা জামশেদ নামের একজনকে কলকাতায় আটক করেছে, যে জানিয়েছে নিয়াজিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে অপর একজনসহ তাকে পাকিস্তান থেকে পাঠানো হয়েছে। আর আমার জীবনের উপর যেন কোনো ঝুঁকি না আসে তা প্রতিহত করতে সেনা সদরদফতর তাকে নির্দেশ দিয়েছে। আমাদের ক্যাম্পের চারদিকে অনেক ঝোপঝাড়। টেলিস্কোপিক রাইফেল নিয়ে আমাকে তাক করার মতো যথেষ্ট অন্তরাল সেখানে রয়েছে। দেয়াল নির্মাণের পর যখনই আমি বের হতাম বহিঃবৃত্তের নির্দিষ্ট পোস্ট সতর্ক হয়ে যেত এবং ট্রেঞ্চে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে প্রস্তুত থাকত। সকালের দিকে সশস্ত্র পেট্রল চারপাশের এলাকাতে অনুসন্ধান চালাত। আমি যখন লাহোরে ফিরে আসি আমার জীবন সংহারের আরো দুটি উদ্যোগ নেওয়া হয়।
মেজর জেনারেল পেড্ডার জায়গায় এলেন মেজর জেনারেল শাহবেগ সিং। শাহ বেগ যখন ব্রিগেডিয়ার ছিলেন, ঢাকায় তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। তিনি খুবই বন্ধু সুলভ এবং হিন্দুদের ব্যাপারে তার তিক্ততার কথা প্রকাশ করেছেন। তিনি খোলামেলাভাবেই বলেছেন শিখদের উপর অবিচার করা হয়েছে। তাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে যাতে পূর্ব পাঞ্জাবে তারা সংখ্যা গরিষ্ঠ হতে না পারে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম এটা একটা আলোচনার কৌশল, কিন্তু পরে তার অনুভূতির যথার্থতা আমাকে তা বিশ্বাস করায়। তিনি আমাকে শিখদের দাবিকৃত খালিস্তানের একটি স্কেচ ম্যাপ দেখান তাতে পুরো পূর্ব পাঞ্জাবসহ জম্মুরও খানিকটা অংশ অন্তর্ভুক্ত। ভারতীয় বাহিনী শিখদের পবিত্র মন্দিরে হামলা চালায় তখন সন্ত ভিন্দ্রানওয়ালের সাথে তিনিও নিহত হন।
এর মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পরিবর্তন ঘটেছে। পদোন্নতি দেওয়া না হলেও লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসানকে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ করা হয়েছে। গুল হাসানের জ্যেষ্ঠ সকল জেনারেলকে পেনসন দিয়ে অবসরে পাঠানো হয়েছে। একমাত্র টিক্কা খান তার জ্যেষ্ঠ হয়েও তার অধীনে চাকরি অব্যহত রাখলেন- এটি নজিরবিহীন ঘটনা। স্মরণ রাখা দরকার গুল হাসান পূর্ব পাকিস্তানে দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করেছিলেন। চিফ অব জেনারেল স্টাফ হিসেবে যুদ্ধ অপারেশনে তার ভূমিকা অত্যন্ত অসন্তোষজনক। শত্রুর তুলনায় অধিক সংখ্যক ট্যাঙ্ক ও সৈন্য থাকার পরও ৫.৫৫ বর্গমাইল পশ্চিম পাকিস্তানি জমিন ভারতের দখলে চলে গেছে। জেনারেল ইয়াহিয়ার সামনে মিথ্যে চিত্র তুলে ধরে ইস্টার্ন কমান্ডে ভুয়া বার্তা প্রেরণের মুখ্য ভূমিকা তারই।
শাহ বেগ আমাকে জানালেন, ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে খবর আছে এটি একটি অন্তবর্তীকালের ব্যবস্থামাত্র, শেষ পর্যন্ত টিক্কা খানকে দিয়ে গুল হাসানকে সরিয়ে দেওয়া হবে। আমি তার কথা বিশ্বাস করিনি কারণ গুল হাসান ভুট্টোকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছেন। কিন্তু আশ্চর্য, কতো সত্য ভারতীয় মূল্যায়ন! মনে হয়েছে তাদের গোয়েন্দা আমাদের সেনাবাহিনীর একেবারে ভেতরে ঢুকে যে তথ্য নিয়ে এসেছে, তা পাকিস্তানের নাগরিকরাও জানে না। স্পষ্টতঃ তারা ভুট্টোর অভিপ্রায় সম্পর্কে ভারত সচেতন ছিল--বিশ্বাসঘাতকতার সুফল যারা ভোগ করেন তারা সেই বিশ্বাসঘাতককেও বিশ্বাস করেন না। গুল হাসানের বিশ্বাসঘাতকতার কথা ভুট্টো জানতেন এবং তার সুফল তিনি ভোগ করেছেন। কিন্তু কাজ করেছেন সে প্রবাদের উপর ভিত্তি করে-- একবার যে বিশ্বাসঘাতক বরাবরই সে বিশ্বাসঘাতক। সর্বোচ্চ ক্ষমতাসীন হিসেবে চিফ অফ আর্মি স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের স্বল্পকাল পরে ভুট্টো গুল হাসানকে অমর্যাদার সাথে অনানুষ্ঠানিকভাবে সরিয়ে দেন।