প্রাণী কোলাহলের শিল্পআখ্যান
``শিল্প ক্রমাগতই প্রাণী কর্তৃক শিকারে পরিণত হয়েছে।``
- দুলুজ ও গুয়েতারি
১.
চিত্র বৈচিত্র্যে ভরা জগতের শত সহস্র প্রাণী সহ জীবের কোলাহলে মুখরিত। আমরা মানুষেরা সকল প্রাণীর ভাষা বুঝিনা। তথাপি তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে বাঁধা হয়নি। বরং বাস্তব, অতিপ্রাকৃত, আদিভৌতিক, আধ্যাত্মিক কত রহস্য ঘেরা সম্পর্কেইনা আবদ্ধ মানুষ ও প্রাণপ্রকৃতি।
`সুতসোম জাতক`এ প্রাণীকে নিয়ে এক অদ্ভুত গল্প আছে। এমন মর্মভেদী কাহিনী খুব কমই আছে, চলুন সেটি একবার পড়া যাক-
বারাণসী রাজ সুদাস অশ্বপৃষ্ঠে পারিষদ ও দেহরক্ষীবর্গ নিয়ে চলেছেন মৃগয়ায়, সাথে পোষা কুকুর। অরণ্যে পলায়নরত মৃগদল ও বন্য বরাহ। হঠাৎই রাজা দলচ্যুত হয়ে পড়েন, ক্লান্ত রাজা ভু-সজ্জায় নিদ্রিত হন। ইতিমধ্যে একটি সিংহী ঘুমন্ত রাজার পদলেহন করে এবং রাজার প্রতি অনুরক্ত হয়। রাজা গান্ধর্বমতে সিংহীকে বিবাহ করে রাজপুরীতে নিয়ে আসেন। রাজ্যের মানুষজন এতে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। সিংহীর গর্ভে সুদাসের পুত্র সৌদাসের জন্ম হয়। পিতার মৃত্যুর পর সৌদাস হন কাশীশ্বর; কিন্তু পেলেন না কোনো মানবীর প্রেম, উপরন্তু লক্ষ্য করলেন তাঁকে কেন্দ্র করে প্রজা সাধারণের কৌতুক। একদিন সত্যই নরখাদক হয়ে উঠলেন সৌদাস এবং তার স্থান হল অরণ্যে। সেখানেও নির্বিচারে চলল পথিক হনন। একদিন ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা সুতসোম অরণ্যপথে চলছিলেন সন্ন্যাসী নন্দের আশ্রমে। সৌদাস সুতসোমের পথ রোধ করে দাঁড়ালেন। সুতসোম সব ঘটনা শুনে জানালেন `জন্মের জন্য কেউ দায়ী নয়, কর্মই মানুষের অধিকার।` সুতসোমের মুখে বুদ্ধের এই বাণী শুনে সৌদাস সদ্ধর্মের অনুসারী হয়, এবং শিষ্যত্ব গ্রহণ করে রাজর্ষি সুতসোমের।
``রাজহংস বালিহংস সারালি চকো আ।
লাউজালি কদমা পাখি নেখিছে সারা কাপড় দিয়া।।
কত সব পকখি ন্যাখছে পকখি বুলাবুল।
ঝাড়ের তোতা একটা ন্যাখছে, হাজার টাকা মূল।।``
- গোপীচন্দ্রের গান
শুরুতে প্রাণীজগতের চিত্রায়ন আসলে জীবজগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বৈরীতার লক্ষণাক্রান্ত থাকলেও ক্রমেই তা অবৈরী এমনকি সখ্য তথা প্রাণীজগতের সাথে সহাবস্থানে পর্যবসিত হয়।
তার আগে আদিমানব খাদ্য ও বাসস্থান অধিকারের জন্য পশুর সঙ্গে লড়াইয়ে প্রবৃত্ত হয়েছিল। খাদ্য ও বাসস্থান সংস্থান করতে গিয়ে মূলত প্রত্যক্ষ বৈরীতার সৃষ্টি হয় প্রাণীকুলের সাথে। সহজেই অনুমেয় যে, এ বৈরীতায় মানুষ প্রাণীর হিংস্রতার কাছে অসহায় থেকেছে অনেকদিন। ক্রমেই হননের কৌশল, দৈবের ওপর আস্থাশীল মানুষ দৈবশক্তিকে অনুকূল ভেবে প্ৰাণীবধের তথা প্রাণীর আক্রমণ রোধে পরিকল্পনা নিতে পারঙ্গম হয়ে ওঠে।
একপর্যায়ে সভ্যতার অগ্রগমনের সাথে সাথে ক্রমশ মানুষ তার প্রয়োজনে জীবজন্তুকে বশে এনে, পোষ মানিয়ে নিজ সান্নিধ্যে রক্ষনাবেক্ষন ও প্রতিপালনের চেষ্টা করে। বুদ্ধিবলে মানুষ তাদের জীবন ও জীবিকায় প্রাণীকে সঙ্গী করে সভ্যতার পথে অগ্রসর হয়। আর মানুষ আরও সহজে কিছু প্রাণীকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করে। এমনকি মানুষ আরও উপলব্ধি করল যে এই প্রাণীদেরও কতকটা মানুষেরই মত অনুভূতি আছে। আনন্দে বেদনায় প্রহারে ভালোবাসায় তাদের অভিব্যক্তি মানুষেরই মত। আবার কতক স্থলে প্রাণীর ইন্দ্রিয়ানুভূতি মানুষের চাইতে প্রবল ও তীক্ষ্ণ। যেমন কুকুরের ঘ্রাণশক্তি, অন্ধকারে বিড়ালের দৃষ্টিশক্তি। হস্তির শারীরিক ক্ষমতা, পাখির উর্ধ্বাচারী ভ্রমন, বন্য বরাহ ও সিংহের হিংস্রতা মানুষ উপলব্ধি করল সবিস্ময়ে। প্রাণীজগতকেও মানুষ তাদের স্বভাব ও প্রয়োজন অনুসারে দুটি ভাগে ভাগ করে নেয়। গৃহপালিত ও বন্য। গৃহপালিত পশু দিয়েই শুরু হল কৃষি উৎপাদন। যুদ্ধ, লড়াই ইত্যাদিতে পশুর ব্যবহার হতে থাকলো। এক কথায় ক্রমেই মানুষের সুখ দুঃখ দিনানুদৈনিক প্রয়োজনে পশু বা প্রাণীজগৎ হয়ে উঠলো অনস্বীকার্য এক নির্ভরশীল সম্পর্কে। ফলে প্রাণীকুলের সাথে মানুষের যে সুদীর্ঘকালের বোঝাপড়ার সম্পর্ক রচিত হল তাতে পরবর্তীতে সাহিত্য, ভাস্কর্য, চিত্রে প্রাণীজগতের নতুন রূপ বিন্যাস প্রতিভাত হতে থাকলো। বিষ্ণুশর্মার পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলিতে পশুপাখি বুদ্ধিতে মানুষের সমকক্ষ।
``প্রাক-মুসলমান বৌদ্ধস্তূপ বিশেষভাবে সাঁচী এবং অমরাবতীতে জীবজন্তুর প্রতিকৃতি অতি নিপুণতার সহিত খোদিত হইয়াছে। সাঁচীকে বিশেষজ্ঞগণ `একটি চমৎকার অকৃত্রিম ভারতীয় জঙ্গল বিষয়ক পুস্তক` বলিয়া অভিহিত করেন।``
- মুসলিম চিত্রকলা, সৈয়দ মাহমুদুল হাসান
সুদীর্ঘ বৌদ্ধ ও হিন্দু যুগের চিত্রকলায় যে দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিয়ে পশুপাখির স্থান নির্ণয় হয়েছিল, পরবর্তী সুলতানি ও মুঘল যুগের চিত্রায়নের ক্ষেত্রে পশুপাখির চিত্রাঙ্কন সম্পূর্ণ আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সূচিত হয়েছিল। চিত্রাংকন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ধারাকে সচেতন ভাবে মনে রেখেই ভারতশিল্পে পশুপাখির প্রাধান্যের কতগুলি স্তরবিন্যাস বা দৃষ্টিভঙ্গির বিভাজন রেখা প্রতীয়মান হয়।
হিন্দু দেব দেবীকে কেন্দ্র করে পশু চিত্রাঙ্কনের বিপুল সমাবেশ প্রত্যক্ষ করা যায়। হিন্দু পূরাণে অবতারবাদে ভগবান বিষ্ণু দশাবতার রূপে জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীর ভার মোচন করেন। বিষ্ণু প্রথম অবতারে মৎস রূপে অবতীর্ন হন। কূর্ম বা কচ্ছপ রূপে দ্বিতীয়বার ভাসমান পৃথিবীকে রক্ষা করেন। বিষ্ণু তৃতীয় অবতারে বরাহ রূপে হিরণ্যাক্ষ বধ করেন। চতুর্থ অবতারে বিষ্ণু নৃসিংহরূপে হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন। দেখা যায় চারবারই ভগবান বিষ্ণু পশু রূপ ধারণ করেন।
এ ছাড়াও তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর প্রত্যেকেরই একটি করে পশু বা পাখি বাহন হিসাবে নির্দিষ্ট হয়ে আছে। যেমন শিবের বৃষ, কৃষ্ণের ধেনু, দুর্গার সিংহ, লক্ষ্মীর প্যাঁচা, স্বরস্বতীর হংস, কার্তিকের ময়ূর ও গণেশের মূষিক।
প্রশ্ন জাগতেই পারে, কেন পশুপাখীই বাহন এই দেবদেবীদের? হয়তো এসব পশুপাখির স্বভাব ও গুণাবলীর সাথে দেবদেবীর বৈশিষ্ট্য সাযুজ্য। লক্ষ্যণীয়, যে শিবকে অনায়াসে লাভ করা যায় তার বাহন ও চারপাশে অনায়াসেই দৃশ্যমান। কৃষ্ণের ধেনু আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথেই জড়িত। জীবনের লীলা খেলার সাথে কৃষ্ণলীলা ও অনেকটা সম্পৃক্ত। সকল অবতারের সমন্বিত শক্তি যার সেই দুর্গার বাহন সিংহ না হলে মানায়? ঐশ্বর্য্যের অতন্দ্র প্রহরায় ব্যস্ত লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচা। জগতের নানা অপবিদ্যা থেকে বাঁচিয়ে সুবিদ্যাধরী দেবী হংসের বাহনে, কেননা হংস সব পাশ কাটিয়ে ভেসে বেড়াতে পারঙ্গম। রূপশ্রেষ্ঠ কার্তিকের বাহন ও সুদৃশ্য ময়ূর। আর সিদ্ধিদাতা গণেশ আছেন মূষিকে, যাকে দমনের মধ্য দিয়েই না ব্যবসায় সিদ্ধি! বাহন সম্পর্কে যত ব্যাখ্যাই থাকুক না কেন, দেয়াল গাত্রে বিশেষত মন্দিরে পশুচিত্রের ব্যবহার ও কিন্তু প্রচুর।
২.
মোগল শিল্পীদের দেখা যায় অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রাণীচিত্র অঙ্কন করতে। মোগল বংশের প্রতিষ্ঠাতা বাবর তাঁর বিখ্যাত আত্মচরিত `বাবরনামা`য় জীবজন্তু পশুপাখি চিত্রিত করিয়েছেন শিল্পীদের দিয়ে। বাদশা আকবর নিজেও আঁকতেন। পারসিক চিত্রকর আব্দুস সামাদের নিকট তিনি শিল্প শিক্ষা গ্রহণ করেন। বাজপাখি হাতে আকবরের একটি চিত্র আছে। মোগল চিত্রকলায় বিভিন্ন সময় প্রাণীকে চিত্রে স্থান দেয়া হয়েছে বেশ গুরুত্ব দিয়ে। আবুল ফজল বলেন, `আকবরের রাজত্বে প্রতিকৃতি চিত্রকর দাসাওয়ান্ত ও প্রাণীর চিত্রকর জগন্নাথ ছিলেন উল্লেখযোগ্য।` সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর আত্মজীবনীতে পশুপাখি সম্পর্কে তার ঔসুক্য এবং তাদের চিত্রিত করার কথা উল্লেখ করেছেন। `যে সকল জীবজন্তু আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকিয়াছে, তাহা আমি বর্ণনা করিয়াছি, এবং অঙ্কন করিতে আদেশ দিয়েছি, অবশেষে ইহার সমাদর বাড়াইয়াছি।`
মানবসভ্যতার পায়ে পায়ে হেঁটেছে মানুষের প্রাণী সংশ্রবের সংস্কৃতি। যখন মানুষ প্রথম গুহার গায়ে আঁকতে শুরু করল তখন প্রাণী জগৎই হয়ে ওঠেছিল তাদের মুগ্ধতার অন্তহীন উৎস। পরবর্তীতে শিল্পীরা প্রাণিজগৎকে ব্যবহার করেছেন আক্ষরিক ও আলঙ্করিকভাবেও মানুষি বিষয়বস্তু সহায়ক করে এমনকি তার বাইরেও। শিল্পকর্মে চিত্রিত প্রাণীরা কেবল তাদের ছবি হয়েই থাকেনা, বরং আমরা তাদেরকে যে গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যাবলী দিয়ে চিহ্নিত করতে চাই তা স্মরণ করিয়ে দেয়। শিল্পীদের চিত্রাংকনে প্রাণীদের নানা উপায়ে প্রতিনিধিত্বশীল করে আঁকা হয়েছে। প্রতীক, নৈতিকতা পাঠের, নান্দনিক এবং বৈজ্ঞানিক আবেশ, সঙ্গী ও ভাব বিনিময়ের সহচর। এমনতরো সাহচর্য রসায়নে কতিপয় অর্থউদ্ভবী যা সুখ উপচানো, দুঃখবোধ, প্রাকৃতিক সমস্যা, লিঙ্গ ভূমিকা ইত্যাদিও ওঠে এসেছে।
প্রথম গুহাচিত্র থেকে ক্রমান্বয়ে তা প্রতীকী ও রূপকাশ্রয়ী উপস্থাপন ও লক্ষ্যণীয়। মানুষ ও প্রাণী জগতের আমাদের সময়ে পারস্পরিক সম্পর্ক যা দৃশ্যশিল্পে বহুধা প্রাণী চিত্রণে প্রকাশমান।
৩.
প্রথম গুহাচিত্র মূলত শিকার আকাঙ্খা অনুপ্রাণিত হয়ে আঁকা। যেখানে তাদের বাস্তববাদ ও জীবন্ত বা সজীবতা উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয় যে ১৯ ও ২০ শতকের শিল্পীদের তুলনায় চতুষ্পদ প্রাণীদের চলন আরও সঠিকভাবে চিত্রিত করতে পেরেছিল প্রাচীন পূর্বজরা। ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের লাসগো গুহায় যখন চিত্রাবিস্কৃত হয়েছিল তখন শিল্পী পাবলো পিকাসো বলেছিলেন যে, `আমরা বারো হাজার বছরে কিছুই শিখিনি`! বিশ্বের প্রতিটি মহাদেশের আদিবাসী চিত্রে মানব ও প্রাণী বৈশিষ্ট্যাবলী বিশ্লেষণ করে প্রতীয়মান হয় যে, সেসব প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে মানুষের বন্ধনেরই উজ্বল প্রতীক সেসব ছবি।
অনেক জায়গায় প্রাপ্ত প্রাচীন শিল্প অবলোকনে দেখা যায় শিল্পের মধ্যে নানা মাত্রায় মানব ও প্রাণী সংশ্লিষ্টতা। এসব মিথস্ক্রিয়ার উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায় তখনকার মৃৎশিল্পে, ভাস্কর্যে যেসব মাটি, পাথর, বা অন্যকোন ধাতুতে রূপ দিয়েছিল। তাঁদের সেসব উপস্থাপনায় দেবত্ব, রাজত্ব এবং প্রকৃতি জগতের উর্বরতা ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছিল।
মধ্যযুগের শিল্পে বাস্তব ও আলংকারিক উভয় ধারায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। সাধারণত প্রাণীর মোটিফ আলংকারিক চিত্রভাষায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল শিল্পীরা বিভিন্ন সাধারণ জায়গায় সৃজন করত পৌরাণিক প্রাণীচিত্র যা পবিত্র পাণ্ডুলিপি অলংকরণের নিমিত্তে ব্যবহৃত হতো। অথবা শিল্পীরা নিয়োগ পেত এসব এমনভাবে ব্যবহার করতে, যাতে হাস্যরসের মিশেলে দৈনন্দিন বিষয়সকল যুক্ত করত। এইসব চিত্রে প্রাণীরা প্রায়শই উচ্চমানের বৈচিত্রতায় প্রতীকায়িত হয়ে ওঠতো।
খ্রিস্ট শিল্পে মেষ শাবক খ্রিস্টের প্রতীক হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। যেখানে মানবতার জন্য আত্মত্যাগের উপর জোর দেয়া। ইতিহাস জুড়ে অনেক পোষা প্রাণীর দেহ সমাধিস্থলে প্রতীকী অর্থে স্মৃতি বিজড়ণ হিসেবে চিত্রিত হয়েছিল।
পাখিরা সাধারণত `উড়ন্ত আত্মা` হিসেবে প্রতীকায়িত। সিংহ ঈশ্বরের শক্তিমত্তার প্রতিনিধিত্বশীল প্রতীক, যা প্রায়শই সমাধির পাথরে খোদাই করা হতো।
প্রজাপতি মৃত ব্যক্তির আনুগত্য এবং ভালোবাসার স্বাক্ষর স্বরূপ; ডলফিন মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের ধারণাটি নিয়ে চিত্রিত; মাছ বিশ্বস্ততার প্রতীক, আর ঘোড়া মানে সাহস, উদ্যম ও উদারতা।
মাছ, সাপ, হাতি প্রজনন, প্রণয় ও মঙ্গলের প্রতীক। কাক ও প্যাঁচা কখনও মৃত্যুর প্রতীক। চিল, বাজপাখি, শকুন, শৃগাল মহামারীর প্রতীক।
এছাড়াও প্রাণীর চিত্রায়নে তাদের স্বতন্ত্র আধ্যাত্মিক এবং রহস্যময় দিক ও ছিল। প্রাকৃতিক ইতিহাস, নৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারের সাথেও প্রাণী চিত্র নির্মিতি, বর্ণনা, ব্যাখ্যা আসলে মানুষের সাথে জীব বৈচিত্র্যের সহাবস্থানের শৈল্পিক বয়ান হিসাবেও দেখা যায়, যা শিল্পীর বৈচিত্রময় উদ্ভাবন।
ক্রমেই আরও বিজ্ঞানসম্মত অধ্যয়ন হতে থাকে, প্রাণীদের ঘনিষ্ঠ ও নিখুঁত পর্যবেক্ষণ ছিল রেনেঁসা কালের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
লেয়োনার্দো দা ভিঞ্চি কর্তৃক প্রভাবিত জার্মান শিল্পী আলব্রেখট ডুয়াহ এর মতো শিল্পীরা শিল্পে গণিত ব্যবহার করেছিলেন এবং প্রাণীদের শরীরবৃত্তির মাপজোক যত্ন সহকারে অধ্যয়ন করেছিলেন, যা ছিল শিল্পীদের জন্য নতুন মান নির্ধারণী। রেনেসাঁস জুড়ে কুকুর নানা ভাবে চিত্রে স্থান করে নেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনামূলক চিত্র পটভূমির মোটিফ, শিকারের দৃশ্য অংশ, ধর্মীয় পৌরাণিক বা রূপকীয় রচনা হিসাবে তাদের অন্তর্ভুক্তি দেখা যায়। আর সেই থেকে কুকুর পশ্চিমা শিল্পের একটি সাধারণ `দৃশ্যমোটিফ` হয়ে এবং শিল্পীদের `সেরা বন্ধু` বলে চিহ্নিত হয়।
পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে এমন শিল্পী নেই যিনি কিনা প্রাণীচিত্র আঁকেননি। প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প শিক্ষায় প্রাণীচিত্র আঁকার বা অনুশীলন শিক্ষা কার্যক্রমের ও অংশ। আজকের উত্তরাধুনিক শিল্প জগতের পাশাপাশি বাংলার লোক শিল্পীরা বিশেষ ভাবে প্রাণী চিত্র তথা প্রাণী অবয়বকে অবলম্বন করে এখনো চর্চা অব্যহত রেখেছেন। সে চর্চা হোক নকশি কথা, দেয়ালচিত্র, কাঠ, ধাতু, মাটি, বাঁশ, বেত, বয়ন, সেলাই তথা নকশি কাঁথা, অর্থাৎ সর্বত্রগামী।
বাংলা মঙ্গল কাব্য ও মধ্যযুগের সাহিত্য জুড়ে দেখা পাওয়া যায় লোকজ জীবনে আঁকাআঁকি, নকশা জুড়ে পাখিদের উপস্থিতি। এখানে সোনাই এর শাড়ির বর্ণনায় পাখিদের বর্ণাঢ্য উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়।
``কাঁচি চুরা, জং বাদুরা ভাইরে
হাঁসের নাইরে তলা
কুরুয়া পক্ষী লেইখ্যা থইছে
যার বা বড় গলারে।
কুঁড়া পক্ষী লেইখ্যা থইছে
বুড় দিয়া আধার ধরেরে।
কাঁঠ কুড়াইল্যা লেইখ্যা থইছে
গাছে ঠুকর মারে,
মাইচ্যারাঙ্গা লেইখ্যা থইছে
চুঁখ দিয়া আধার ধরেরে।
পেঁচায় বুলে পেচুনী ওরে
সুন্দর বলে করে?``
- সোনাই বিবির পালা
``শাড়ির মধ্যে লেখ্যা থুইছে হাঁসাহাঁসির জোড়া
শাড়ির মধ্যে লেখ্যা থুইছে আশী ডাঙর ঘোড়া।
হাঁস লেখছে কবুতর লেখছে হরিণ পালে পাল
শাড়ির মধ্যে লেখ্যা থুইছে সিঙ্গী জানোয়ার।
বগা বগী লেখ্যা থুইছে মারিয়া আধার করে,
শৌলা শৌলী লেখ্যা থুইছে নোনা লয়ে চলে।
অডট্যা মডট্যা লেখছে সদা অড় অড় করে,
মুরগি আওড্ডা লেখ্যা থুইছে অসক্যা অসক্যা চলে।
অডা লেখছে হাঁসা হাঁসী সোণাসার টিয়া,
নল গুঙ্গী কাম কুড়া ডাক সাতই করিয়া।
ওডই পোডই লেখ্যা থুইছে গরগর চড়া,
উকা বারই লাউয়া বারই বারই পিয়ারা।
কুঞ্চল দৈগল লেখছে যার বুক কাল,
কয়ার কুকুরা লেখছে রাও শুনিতে ভাল।
আরও যত পক্ষী লেখছে শোন্যে উড়িয়া যায়,
চড়া চড়ি লেখ্যা থুইছে বেড়ী যার পায়।
বায়ার ভেলুয়া লেখছে যার বড় রাও,
আড়গিলা লেখ্যা থুইছে যার লম্বা পাও।``
-ওতলা সুন্দরীর পালা, জসিম উদ্দিন
এই যে নানাবিধ পশু পাখির চিত্রিত বর্ণনা তাতে এটা স্পস্টতই যে গার্হস্থ্য জীবন ছিল তখন প্রাণ প্রকৃতির বিচিত্রতায় মোড়া। ফলে তার প্রকাশ ঘটেছে সকল সফল সুকুমার প্রকাশে।
হিন্দু সমাজে দেবদেবীর আখ্যান চিত্র ও প্রতিমা ভাস্কর্য তো আছেই মুসলমান সমাজেও যে প্রাণী চরিত্র এসেছে তাঁর একটি বুরাক, যা মাদী অশ্ব বেশে। অন্যদিকে শিয়া মুসলিমদের মহররম পালনে `দুলদুল ঘোড়ার` অবয়ব অত্যন্ত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।
তা ছাড়া ধর্ম নির্বিশেষে শখের হাড়ি, লক্ষ্মী সরা, গাজীর পট, আদিবাসী চৌকো পট, পটচিত্রে প্রাণীর উপস্থিতিই প্রাধান্যে বলে প্রতীয়মান হয়।
৪.
১৭ শতকের মধ্যে, প্রাণিচিত্রীদের জনপ্রিয়তা শিল্পীদের মধ্যে একটি বিশেষ ধারাকে সুনির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত`এনিম্যাল পেইন্টার` বা`প্রাণী চিত্রকর` শব্দবন্ধটি। এই বিশেষায়িত শিল্পীরা তাঁদের অন্যান্য বিষয়বস্তুর সাথে মূলত ভূপ্রকৃতিচিত্রে প্রাণীর উপস্থিতিও নিশ্চিত করেছে। এই ধারার শিল্পী ফ্রান্স স্নেইডার ও পিটার পল রুবেন্স অগ্রগামী বলে বিবেচিত। মানুষ ও প্রাণীর নাটকীয় জীবন মৃত্যুর লড়াইয়ের চিত্রে বিশেষত শিকার দৃশ্য ছিল তখন বিশেষ জনপ্রিয়। প্রাণীচিত্র বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিখ্যাত শিল্পীদের উল্লেখযোগ্য ছিলেন জ্যা ব্রুয়েগেল জুনিয়র, জ্যা ব্রুয়েগেল এলডার, জর্জ স্ট্যাবস, ইউজেন দেলাক্রেয়া এবং ফ্রেডরিখ ভিলহেম কুইনহার্ট।
১৮ শতকের পশ্চিমা শিল্প ঐতিহ্যের একটি সাধারণ বিষয় ছিল ঘোড়া চিত্র। সেই সময়কালে শিল্পীরা তাদের নিজ আবাসস্থলের সম্পৃক্ত বা নিজের পোষা প্রাণীদের সৌন্দর্য্য ও শক্তিকে মহিমান্বিত করে এঁকেছেন। শিল্পীদের ভূমিকা প্রায়শই যেন সদ্য আবিষ্কৃত প্রাণীকে সকলের নজরে আনার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত আগ্রহ। আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, একটা সময় পর্যন্ত বিশ্বে প্রাণীরা ছিল মানব যাপনের একেবারে কেন্দ্রে। যা রীতিমতো শক্তির উপাসনা ও জাদুকরী তাৎপর্যমন্ডিত নৃতাত্বিক সম্পর্কস্থিত।
১৯ শতকের নগর সভ্যতায় শিল্প বিপ্লবের ধ্বজা উড়তে শুরু করলে প্রাণীদের যে বিশেষত্ব মানবজীবন এতদিন পরম মমতায় বহন করে আসছিলো তাতে ছেদ পরে। বলা যায় প্রাত্যাহিক জীবন থেকে তারা উধাও হতে যেন খুব বেশি একটা সময় নেয়নি! যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে নতুন ভাবে এই প্রাণীরা কাঁচামাল হিসাবে উদ্ভুত হয়ে একেবারে জনপরিসর থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। মানুষের সাথে প্রাণীর বিশেষ সম্পর্ক ভেঙে যায়। কেবল গৃহপালিত কতিপয় পোষা প্রাণী ব্যতিরেকে বৃহৎ প্রাণীকুলের প্রান্তিকীকরণের ফলে একজন মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে এক অতল শূন্য স্থান দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। পরবর্তী কালের শিল্পে তা ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। যা সমসাময়িক কালের চিত্রে পরিদৃষ্ট।
`আমি আত্মপ্রতিকৃতিই আঁকি, কারণ আমি সবসময় একা থাকি, তা ছাড়াও আমিই সেই ব্যক্তি যাকে আমি সবচেয়ে ভালো জানি।` একথা যিনি বলেছিলেন তিনি ফ্রিদা কালো। ফ্রিদা তাঁর বিভিন্ন পোষা প্রাণীর সাথে অনেকবার নিজেকে এঁকেছিলেন। যার মধ্যে বানর, হরিণ এবং বিদেশী পাখি আছে। বানর মেক্সিকোর ঐতিহ্যগত পৌরাণিক অভিলাষের প্রতীক।
শিল্পী ডেভিড হিকি তাঁর `একটি অপ্রয়োজনীয় ক্ষমা প্রার্থনায়` বলেন- ``আপাতদৃষ্টিতে এই বিষয়টি সম্পর্কে আমার দুঃখপ্রকাশ করার কিছু নেই। এই দুটি প্রিয় প্রাণী আমার বন্ধু। তারা বুদ্ধিমান, প্রেমময়, কৌতুককর, এবং প্রায়শই বিরক্তিকর ও! তারা আমার কাজ দেখে; আমি অনুভব করি তাদের যৌথ উষ্ণতা, তাদের দুঃখ এবং উচ্ছলতা। এমনকি হলিউডের কুকুর বলে তারা যে করেই হোক বুঝতে পারে যে একটি চিত্র নির্মাণ করা হচ্ছে।``
পাশ্চাত্যের রেনেসাঁ চিত্রীদের মধ্যে পশু পাখি চিত্রণের কথা আগেই বলা হয়েছে তা ছাড়া আধুনিক চিত্রীদের মধ্যে পিকাসো, ভ্যান গঘ, রয় লিখস্টেনস্টাইন, লুসিয়ান ফ্রয়েড, গুস্তাভ ক্লিমট, ফ্রান্সিস বেকন, জন মিরো প্রমুখের চিত্রে নানাভাবে প্রাণী চিত্র তাঁদের নিজস্ব রচনাধর্মীতায় অর্থবহ হয়ে আছে।
৫.
ভারতীয় চিত্রকলায় প্রাণী প্রতিকৃতি যেমন আঁকা হয়েছে তেমনি চিত্র পরিসরে প্রাণীদের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। শিল্পী হুসেইন যেমন ঘোড়াকে নানা বৈচিত্রে তাঁর শিল্পকর্মে উপস্থাপন করে সুবিখ্যাত হয়েছেন। অন্যদিকে কলকাতাবাসি প্রয়াত বাঙালি চিত্রকর সুনীল দাস তার নিজস্ব শৈলীতে প্রচুর ঘোড়া এঁকেছেন। ষাঁড় এর চিত্রেও তাঁর খ্যাতি। তাঁর এই ঘোড়া প্রীতির সূত্রে নিজেকে `ঘোড়া দাস` বা সুনীল ঘোড়া দাস বলে আখ্যায়িত হতে চাইতেন!
তা ছাড়া গণেশ পাইনের কাজে প্রাণী এসেছে অন্য ভঙ্গিমায় চিত্রপটের অনুসঙ্গ হিসেবে, এবং তা বেশ জোরালোভাবেই। শিল্পী শুভাপ্রসন্নের কাক যুগলের প্রতিকৃতিটি তাঁর প্রাণী চিত্রের উদাহরণ।
শান্তিনিকেতনে ডিজাইন ভবনের যে কালো রঙে আঁকা ম্যুরালটি তা পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই অনুধাবনযোগ্য, এক অনাবিষ্কৃত প্রাণ প্রকৃতির জগতের ইশারা যেন। কত ভঙ্গিমায় বিচিত্রতায় প্রাণীকুলের উপস্থিতির বিনির্মাণ করেছেন শিল্পী কে জি সুব্রহ্মণ্যন।
বাংলাদেশের চিত্রকলায় অত্যুজ্জ্বল প্রাণীচিত্রণের উদাহরণ যার হাতে মুন্সিয়ানায় পরিব্যাপ্ত তিনি শিল্পী জয়নুল আবেদীন। বাংলাদেশের শিল্পান্দোলনের মুখ্য চরিত্র বলি উদ্গাতা এই শিল্পী তাঁর মই দেয়া, বিদ্রোহী, গরুর গাড়ি কিংবা দুর্ভিক্ষের চিত্রমালায় প্রাণীদের উপস্থিতি। তাঁর দেখা যাপিত জীবনে প্রকৃতি ঘনিষ্ঠ জীবন ঘনিষ্ঠতা উপলব্ধ হয় প্রাণীর উপস্থিতির ঔদার্য্যে।
তাঁর পরের প্রজন্মে বিশেষ ভাবে ততটা গুরুত্ব দিয়ে প্রাণীকে উপস্থাপন না করলেও ঘুরে ফিরে প্রাণ প্রকৃতি চিত্রপটে জায়গা করে নিয়েছে অবলীলায়। সে সবে হয়তো প্রাণীর উপস্থিতি এসেছে শিল্পভাষা, আঙ্গিকের পথ ধরে। তাতে প্রত্যেক শিল্পীর নিজস্ব অঙ্কন রীতি বৈশিষ্ট্য ধারণ করে প্রাণিকুল সমাসীন থেকেছে।
কামরুল হাসানের চিত্রকলার বিষয়াদি নর-নারী (বিশেষত রমণীর শরীর), পশু-পাখি (প্রধানত গরু ও শৃগাল), সাপ ও প্রকৃতি। এস এম সুলতানের চিত্রেও এসেছে গৃহপালিত প্রাণীর অবয়ব। শিল্পী হাশেম খান ও কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রে বাংলার ফুল, পাখি, নিসর্গ, নদ-নদী ও নীল আকাশ তার চিত্রকর্মের মূল বিষয়। শিল্পী রশিদ চৌধুরীর চিত্রে এসেছে সাপ, হাতি ইত্যাদি।
বাংলাদেশের আধুনিক নগর ভাস্কর্যে সেভাবে প্রাণী অবয়ব খুব দৃশ্যমান হয়ে উঠেনি! তবে তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ঢাকায় নির্মিত ও স্থাপিত শিল্পী আজিজুল জলিল পাশা`র `দোয়েল` ও মৃনাল হক এর `বক`।
এ ছাড়াও পৃথিবীর তো বটেই ভারতীয় এবং বাংলাদেশের শিল্পী ভাস্করদের শিল্পকর্মে প্রাণী উপস্থিতি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও প্রোজ্জ্বল।