পেশোয়ার এক্সপ্রেস: রক্তপিচ্ছিল এক রেলগাড়ির কথা
ভাগ হয়ে গেছে দেশ। ভাগ হয়ে গেছে মানুষের ভাগ্যও। এপারের মানুষ ওপারে ছুটছে। ওপারের মানুষ এপারে। বাকসো–পেটারা নিয়ে পালাচ্ছে যে যেভাবে পারে। পথে লোটা–কম্বল ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে। প্রাণটাও রক্ষা পাচ্ছে না। একজন দুজন নয়, প্রাণ হারাচ্ছে লাখো মানুষ। ধর্ম পরিচয়ে তাদের কেউ হিন্দু, কেউ মুসলিম। ঘাতকও তারাই। ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম নৃশংসতায় ভিজে যাচ্ছে মাটি।
এইসব দাঙ্গা আর খুনোখুনির কবলে পড়ে নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে লেখকদেরও পাড়ি দিতে হয় 'আনজান' ভূমিতে। সবই ঘটে তাদের চোখের সামনে। ফলে দেশভাগের পর যখন এ উপমহাদেশের লেখকরা থিতু হলেন, লিখলেন সে বেদনার কথা। গল্পে, উপন্যাসে, স্মৃতিতে উঠে এলো এক বেদনার অধ্যায়। 'দেশভাগের সাহিত্য' নামে আলাদা পরিচিতি পেলে এসব লেখাজোকা। সাতচল্লিশের আগের আর পরের সাহিত্যে দেখা গেল বড় পরিবর্তন।
এইসব হত্যা আর অনিশ্চিত যাত্রার বড় স্বাক্ষী দেশভাগের পরপর দু দেশের ভেতর চালু হওয়া ত্রিশটি 'স্পেশাল ট্রেন'। এই স্পেশাল ট্রেন নিয়ে উপমহাদেশের লেখকরা গল্প, উপন্যাস আর আত্মজৈবনিক নানা লেখা লিখেছেন।
উর্দু সাহিত্যর বিখ্যাত লেখক ইনতেজার হুসেইন তার হামসফর গল্পে এই স্পেশাল ট্রেনের স্মৃতিচারণ করেছেন। বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে লেখক ও তার বন্ধুরা অযাচিতভাবে 'স্পেশালে' চেপে বসেছিলেন। সেই থেকে ভারত আর তার দেশ থাকেনি। পাকিস্তান হয়ে যায় তার দেশ। ভৈরবের সন্তান লেখক মলয় কৃঞ্চ ধর তার 'ট্রেন টু ইন্ডিয়া' গ্রন্থে তুলে ধরেছেন তার সে বেদনাধায়ক রেলভ্রমণের স্মৃতি।
খুশবন্ত সিংয়ের ট্রেন টু পাকিস্তানের নাম শুনেনি এমন পাঠক পাওয়া মুশকিল। ১৯৫৬ সালে প্রকাশের পর এটি ঔপন্যাসিকের সেরা কাজ বলে সমালোচকরা মনে করেন। খুশবন্তের এ উপন্যাসটার নাম শুরুতে ছিল 'মানো মাজরা'। পরে বদলে 'ট্রেন টু পাকিস্তান' রাখা হয়। মানো মাজরা একটি গ্রামের নাম। সীমান্তবর্তী ছিমছাম একটি গ্রাম। সত্তুরটি পরিবারের বসত এ গ্রামে। শতবর্ষী এ গ্রামে হিন্দু, মুসলিম ও শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরা পরস্পরের সৌহার্দ্য নিয়ে বসবাস করে আছেন। নানা সময়ে অখণ্ড ভারতের নানা জায়গায় দাঙ্গা আর সাম্প্রদায়িক লড়াই বাঁধলেও এ গ্রামটিকে তা স্পর্শ করতে পারেনি। এ গ্রামের একমাত্র হিন্দু পরিবারটি জমিদার লালা রাম লালের। গ্রামের চারপাশের জমিজমা শিখদের। মুসলমানরা বর্গাদার। কয়েকটি মেথর পরিবারও আছে বটে, কিন্তু ধর্ম নিয়ে বিশেষ আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।
এ গ্রামটি আরো একটি কারণে আলাদা। এ গ্রামে আছে ছোট্ একটি রেলব্রিজ। আছে একটি নদী। রেললাইন বসানোর জন্য দুপাশে পাথরের বাঁধ। রেলসেতুটি আহামরি কোনো সেতু নয়, তবে অন্যসব গ্রাম থেকে আলাদা করে রেখেছে মানো মাজরাকে। এখানকার রেল স্টেশনে গুরুত্বপূর্ণ কোনো রেলগাড়ি বিরতি দেয় না। তবু যে কয়টি রেলগাড়ি থামে তা নিয়েই আবর্তিত হয় গ্রামের মানুষের জীবন। সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার আগে সবাই ঘরে ঢোকে এবং এক্সপ্রেস ট্রেন আসার আগেই শুয়ে পড়ে। অবশ্য ট্রেন আসার নিশ্চয়তা থাকে না কোনো।
সাতচল্লিশের স্বাধীন ভারত ঘোষণার পরে সব আর আগের মতো থাকে না। প্ল্যাটফর্মে সেনাটহল বসে। দিল্লি থেকে আগত ট্রেনের চালক ও গার্ড বদলানো হয় পাকিস্তানে রওয়ানা হওয়ার আগে। আবার পাকিস্তান থেকে যেসব ট্রেন আসে সেগুলো এখানে এসে যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। একদিন ব্যতিক্রম ঘটলো। পাকিস্তান থেকে আসা ট্রেন থেকে এলো ভীষণ দুর্গন্ধ। সৈন্যরা লোকজনদের হটিয়ে দিলো। সেনারা হুকুম দিলো লাকড়ি আর কেরোসিন নিয়ে আসতে। ট্রেনভর্তি লাশ। লাকড়ি আর আগুনে পোড়ানো হলো। গ্রামবাসীর শান্তি উবে গেল সেই থেকে। একটা পর্যায়ে নিজেদের সৌহার্দ্যও আর টিকিয়ে রাখা গেল না। শিখদের লাশ দেখে মুসলমানদের উপর নির্দেশ জারি হলো গ্রাম ছাড়ার। বহুদিনের একত্রবাসের মায়া উড়ে গেল। গ্রামের মুসলমানদের তাড়ানোর পর তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি দেখভালের দায়িত্ব দেয়া হলো এক চোরকে। চোখের সামনে সব লুটপাট চলল। এরপর ট্রেন থামতে দেখলেই আতঙ্কিত হয় এ গ্রামের মানুষ। তাদের স্বধর্মের কারো লাশ বুঝি এলো।
এখানেই শেষ নয়। একদিন সন্ধ্যায় গুরুদোয়ারায় শিখরা যখন প্রার্থনারত তখন দামি গাড়িতে কয়েকজন যুবক এসে খবর দিলো আগামীকাল এক ট্রেন মুসলমান শরণার্থীকে এ পথ দিয়ে পাকিস্তানে পাঠানো হবে। তাদের সবাইকে হত্যা করা করবে এই শিখ জোয়ানরা। সে মতে ফন্দিও আঁটা হয়। সলাপরামর্শ মতো সেদিন রাতে উৎ পেতে থাকাও হয় যথারীতি। কিন্তু একটি মানুষ এসে সে ফাঁদ ভেঙে দেয়। বিনিময়ে গুলি করে তাকে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। বেঁচে যায় 'ট্রেন টু পাকিস্তান'।
দেশভাগের বেদনা সবচে' মর্মান্তিকভাবে উঠে এসেছে উর্দু গল্পকার কৃষণ চন্দরের 'পেশোয়ার এক্সপ্রেস' গল্পে। এখানে পেশোয়ার এক্সপ্রেস নামক রেলগাড়িটি নিজেই উত্তম পুরুষের ভাষায় ঘটনার বর্ণনা দিয়ে যায়। পেশোয়ার শহর থেকে হিন্দু শরণার্থীভরা বগি নিয়ে যাত্রা শুরু করে এ ট্রেন। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চলবে বলে সে আনন্দিত মনে মনে। পেশোয়ার, মর্দান, কোহাট, চরসদ্দা, খাইবার, লান্ডিকোটাল, নওশেরা ও মানশেরার বাসিন্দা এসব হিন্দু মানুষ। পাকিস্তানে আর জানমালের নিরাপত্তা নেই বলে তারা এবার ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে। ভারত এমন দেশ যে দেশ আগে কোনোদিন দেখেনি তাদের অনেকে। সুরক্ষিত এ স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু হয়। পশতু আর পাঞ্জাবী ভাষী এসব নাগরিক ভারতের দিকে রওয়ানা হওয়ার আগ পর্যন্ত পেশোয়ার এক্সপ্রেসে নিরাপদই ছিলেন।
সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে পলায়নপর এসব যাত্রীর সঙ্গে হাসান আবদাল স্টেশন থেকে আরো একদল শরণার্থী যোগ দেয়। এরা শিখ। চোখেমুখে ভয়। ডাগর ডাগর চোখের শিশুগুলো পর্যন্ত ভয়ে কম্পমান। স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারা পেশোয়ার এক্সপ্রেসের পেটের ভেতর ঢুকে পড়ে। তক্ষশীলা স্টেশনে এসে এক্সপ্রেসকে থামতে হয় খানিকটা। স্টেশন মাস্টার জানালেন একদল হিন্দু শরণার্থী আসছেন। কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে। এক ঘণ্টা পর ঢোলের শব্দ শোনা গেল। যাত্রী হিন্দু শরণার্থীদের একটি দলকে দেখতে পেল পেশোয়ার এক্সপ্রেস। দলটা স্টেশনের কাছে এলেই এক ঝাঁক গুলির শব্দ হলো। জানালা খুলে বসা তরুণীর দল মুহুর্তে জানালা বন্ধ করে দিল। এ দলটি ছিল হিন্দু শরণার্থীর দল। মুসলমানদের আশ্রিত। এখন প্রতিটি মুসলমানের কাঁধে একেকজন গ্রাম ছেড়ে পালানোর চেষ্টারত হিন্দুর লাশ। এ রকম দুশো মৃতদেহ স্টেশনে এনে বালুচ সৈন্যদের হাতে সোপর্দ করা হলো। মুসলমান জনতার দাবি, এদের 'যথাযথ মর্যাদা' দিয়ে ভারতে পৌঁছে দিতে হবে। সৈন্যরা প্রতিটি বগির মাঝ বরাবর দুশো লাশ ভাগ করে রেখে দিল। এরপর আকাশে গুলি ছুঁড়ে মুসলমান জনতা স্টেশন মাস্টারকে ট্রেন ছাড়ার নির্দেশ দেয়। ট্রেনটি মাত্র চলা শুরু করেছে অমনি একজন চেইন টেনে থামিয়ে দিলো। এবার দলনেতা বললেন, দু শো হিন্দু বাসিন্দা চলে যাওয়ায় তাদের গ্রাম শূন্য হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ট্রেন থেকে দু শো হিন্দু ও শিখ যাত্রীকে নামিয়ে দিতে হবে। তাই করা হলো। বালুচ সৈন্যরা বিভিন্ন বগি থেকে পছন্দমত দু শো যাত্রীকে নামিয়ে তাদের হাতে তুলে দিলো।
সব কাফের সরে দাঁড়াও বলে নেতা হুঙ্কার ছুড়েন। শরণার্থীরা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল, নিষ্প্রাণ। বালুচ সৈন্যরাই গুলি করল। জায়গাটা ছিল তক্ষশীলা। যেখানে ছিল এশিয়ার সবচে' বড় বিশ্ববিদ্যালয়। সভ্য মানুষদের কেন্দ্র। বুদ্ধের সঙ্গীত শোনা যেত এর গ্রামে গ্রামে। প্রেম, সত্য আর সৌন্দর্যের বাণী এখানে বসেই লেখা হয়েছিল। পেশোয়ার এক্সপ্রেসে। প্ল্যাটফর্মে রক্তের স্রোত বয়ে গেল। এরপর সে পিচ্ছিল পথ ধরেই এগুতে লাগল কৃষণ চন্দরের পেশোয়ার এক্সপ্রেস।
ছুটতে ছুটতে রাওয়ালপিন্ডি এসে থামল গাড়ি। এখানে কোনো শরণার্থী নেই। আছে মাত্র পনেরো–বিশজন পর্দানশীন নারী। তাদের সঙ্গে কয়েকজন যুবক পেশোয়ার এক্সপ্রেসের বগিতে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে রাইফেল আর কয়েক বাকসো গোলাবারুদ। ঝিলাম আর গুজরখাঁর মাঝামাঝি স্থানে রেল থামিয়ে দিয়ে নারীদের নিয়ে যুবকের দল নামতে গেলে, সঙ্গে থাকা পর্দানশীন নারীরা ঘোমটা সরিয়ে আচমকা চিৎকার করতে থাকে,'আমরা শিখ, আমরা হিন্দু, ওরা জোর করে আমাদের নিয়ে এসেছে।' যুবকেরা হেসে উঠে,'তোরা তো আমাদের লুঠের মাল। ঘর থেকেই ধরে এনেছি। যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করব। কে বাধা দেবে আমাদের?' দু জন হিন্দু পাঠান এগিয়ে গেলে বালুচ সেনাদের গুলি তাদের ঝাঁঝরা করে দেয়। এভাবে পনের–বিশজন যুবকের প্রাণ যাওয়ার পর মেয়েগুলোকে নিয়ে ওরা নেমে পড়ল। আর কালো ধোঁয়ায় মুখ লুকিয়ে ছুটে চলল পেশোয়ার এক্সপ্রেস।
লালামুসা স্টেশনে এসে বগির ভেতরে থাকা পচা লাশের দুর্গন্ধে টেকা মুশকিল হলে বালুচ সেনারা সিদ্ধান্ত নেয় লাশগুলোকে বাইরে ফেলে দেওয়া হবে। যেসব যাত্রীদের পছন্দ নয় তেমন যাত্রীদের ডেকে লাশগুলো দরজার কাছে এনে বাইরে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দেয় সেনারা। এরপর সেইসব যাত্রীদেরও বাইরে ফেলে দেওয়া হয় চলন্ত ট্রেন থেকে। এতে ভালোই হয়। যাত্রী সংখ্যা কমলে খানিকটা হাতপা খুলে বসতে পারে শরণার্থীরা।
লালামুসা থেকে পেশোয়ার এক্সপ্রেস পৌঁছে ওয়াজিরাবাদে। প্ল্যাটফর্মে ছড়ানো–ছিটানো মৃতদেহ। দূরে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। স্টেশনে কাছে শোনা যাচ্ছে কাসর–ঘণ্টাধ্বনি। অট্টহাসি আর উন্মত্ত জনতার করতালি। যেন বৈশাখী উৎসব। এরপর দেখা গেল একদল উলঙ্গ মেয়ে নিয়ে এগিয়ে আসছে জনতা। বৃদ্ধা–তরুণী, বাচ্চাকাচ্চা সবাই দিগম্বর। মেয়েদের সবাই হিন্দু, শিখ আর পুরুষগুলো মুসলমান। চারদিকে স্লোগান উঠছে, পাকিস্তান জিন্দাবাদ; কায়েদে আজম জিন্দাবাদ।
এবার পেশোয়ার এক্সপ্রেস থামে লাহোর প্ল্যাটফর্মে। দু নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছে অমৃতসর থেকে ছেড়ে আসা আরেকটি ট্রেন। পূর্ব পাঞ্জাব থেকে ট্রেনটি মুসলমান শরণার্থীদের নিয়ে এসেছে। জানা গেল এ ট্রেনটিকে পথে থামিয়ে চার শ শরণার্থীকে খুন করা হয়েছে। নিয়ে যাওয়া হয়েছে জনাপঞ্চাশেক মুসলমান স্ত্রীলোককে। বাকিদের লুন্ঠন করা হয়েছে ইচ্ছেমতো। এবার সে ট্রেন থেকে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী এসে পেশোয়ার এক্সপ্রেসের চার শ যাত্রীকে নামিয়ে নিয়ে গেল। পঞ্চাশজন শিখ ও হিন্দু নারীকে একইভাবে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো বদলা নেওয়ার জন্য।
মোগলপুরায় এসে সৈন্যবদল হলো। বালুচদের জায়গায় এলো শিখ ও ডোগরা সেনা। আটারি স্টেশন থেকে দৃশ্য পুরোপুরি পাল্টে গেল। হিন্দু ও শিখ শরণার্থীরা অসংখ্য মুসলিম শরণার্থীর লাশ পড়ে থাকতে দেখতে পেল। এবার খুশিতে তারা আত্মহারা। বোঝা গেল স্বাধীন ভারতের সীমানায় এসে গেছে পেশোয়ার এক্সপ্রেস।
পেশোয়ার এক্সপ্রেস অমৃতসর স্টেশনে পৌঁছে দেখে শিখরা স্লোগানে স্লোগানে আকাশ কাঁপিয়ে তুলছে। এখানেও মুসলমানদের লাশের স্তূপ। হিন্দু, রাজপুত আর ডোগরারা বগিতে উঁকি মেরে মেরে শিকার তালাশ করতে থাকে। অমৃতসর থেকে চারজন ব্রাহ্মণ উঠে বগিতে। তারা হরিদ্বার যাবে। মাথা ন্যাড়া, কপালে তিলক। রামনাম ছাপা ধুতি পরে তারা তীর্থে যাচ্ছে। অমৃতসর থেকে অস্ত্রশস্ত্রসহ শিখরা পূর্বপাঞ্জাব অভিমুখী ট্রেনে চেপে বসে। তারা শিকারের খুঁজে ঘুরতে থাকে। তাদের সন্দেহের চোখ থেকে রেহাই মেলে না তীর্থযাত্রীরা ব্রাহ্মণদেরও। একজন জিজ্ঞস করে,'তা ব্রাহ্মণ দেবতা যাওয়া হচ্ছে কোথায়?'
উত্তরে ব্রাহ্মণ বলে,'হরিদ্বারে।'
'হরিদ্বারে, না পাকিস্তানে!' একজন ইয়ার্কি করে বলে।
ভয়ার্ত ব্রাহ্মণের মুখ ফসকে বের হয়ে যায়,'আল্লাহ আল্লাহ করো!'
সঙ্গে সঙ্গে একজনকে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। বাকি তিনজন পালাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে অসহায় আত্মসমর্পন করে। তাদেরও হত্যা করা হয়। বাঁচার জন্য ব্রাহ্মণ সেজেও মুক্তি মেলে না।
এরপরের গল্প শুধু মুসলমানদের হত্যার। ঠিক পাকিস্তানের গল্পটা যেমন ছিল হিন্দু হত্যার। কৃষণ চন্দরের এ গল্পের শেষে এসে পেশোয়ার এক্সপ্রেস স্বগতসংলাপ করে বলে,'আমি সামান্য কাঠের তৈরি প্রাণহীন একটা ট্রেন। কেউ প্রতিশোধ ও ঘৃণার এমন জঘন্য ভারী বোঝা আমার পিঠে চাপিয়ে দিক, আমি তা চাই না। দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে আমাকে দিয়ে খাদ্য বহন করানো হোক। আমাকে দিয়ে গ্রামে ট্রাক্টর আর সার বহন করিয়ে নেওয়া হোক। আমাকে যেখানেই নিয়ে যাওয়া হোক না কেন, মৃত্যু ও ধ্বংসের মধ্যে যেন নিয়ে যাওয়া না হয়।
আমি চাই, আমার গাড়ির প্রতিটি বগিতে সুখী চাষী ও শ্রমিকের দল এবং তাদের স্ত্রীদের কোলে থাকবে পদ্মফুলের মতো সুন্দর শিশু। ওরা মৃত্যুকে নয়, বরং আগামী দিনের জীবনকে মাথা নত করে কুর্নিশ করবে।'