পৃথিবীর মঙ্গল গ্রহে ভ্রমণ
প্রযুক্তি এখনো আমাদেরকে ভিনগ্রহে ভ্রমণের সুবিধা এনে দিতে পারেনি। লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরের গ্রহগুলোতে মহাকাশযানে চড়ে নিমিষেই চলে যেতে পারার ব্যাপারটি এখনও পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী আর চলচ্চিত্রেই দেখা যায়। তবে পৃথিবীতেই এমন কিছু স্থান রয়েছে যেখানে গেলে আমরা অন্যান্য গ্রহ, যেমন "লাল গ্রহ" মঙ্গল কেমন হতে পারে, তার ভূপ্রকৃতি, জীবন কেমন হতে পারে, সে ব্যাপারে সামান্য ধারণা পাওয়া সম্ভব।
জায়গাটির মাটির রঙ মঙ্গলের মতই লালচে বাদামী; এবং এর মাঝে আগ্নেয় বালির কালচে রঙের চিহ্নও দেখা যায়। ভিনগ্রহের মত দেখতে এলাকাটিতে শুষ্ক উপত্যকা, খাড়া পাহাড় এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কালো, ব্যাসাল্ট পাথরের চাঁইয়ের সন্নিবেশ ঘটেছে। এই বিরূপ পরিবেশের মধ্যেও দৌর্দন্ড প্রতাপে দাঁড়িয়ে আছেন বিজ্ঞানী ক্লেয়ার কাজিন্স। তার এখানে আসার উদ্দেশ্যই হচ্ছে পাথর নিয়ে গবেষণা করা; তিনি জটিল ও স্পর্শকাতর বৈজ্ঞানিক ক্যামেরাগুলোকে পাথরের উপর প্রক্ষেপণ করছেন মঙ্গল গ্রহে প্রাণের উৎস খুঁজে পাবার আশায়। তবে তিনি লাল গ্রহটিতে না গিয়ে পৃথিবীতে বসেই এই গবেষণা চালাচ্ছেন। আরো সঠিক ভাবে বলতে গেলে, তার গবেষণার জায়গাটি হচ্ছে আইসল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল।
কাজিন্স এর মত আরও শত শত বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে বসেই মঙ্গল গ্রহের স্বাদ আস্বাদন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এজন্য তাদের অনেকেই দূর দূরান্তের বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন। এসব "মঙ্গলের সমতূল্য" জায়গাগুলো তাদেরকে সাহায্য করছে বহুদূর কক্ষপথের সেই লাল গ্রহটিকে বুঝতে। মঙ্গলের ভূমিসদৃশ এসব স্থানে নভোচারীদেরকে এনে মঙ্গল মিশনের জন্য প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে।
আতাকামা মরুভূমি, চিলি
চিলির আন্তোফাগাস্তা শহরটি হচ্ছে মঙ্গল গ্রহের সাথে সবচেয়ে বেশি মিল থাকা একটি অঞ্চল। শহরটি আতাকামা মরুভূমির একদম কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। এটি একটি পরিত্যক্ত খনি শহর, ইউনগেই থেকে দক্ষিণ দিকে যেতে থাকলে সেখানে পৌঁছানো যায়।
এটি পৃথিবীর শুষ্কতম জায়গাগুলোর একটি। এমনও হয়েছে যে কয়েক দশক চলে গেছে, কিন্তু সেখানে এক ফোঁটা বৃষ্টিও হয়নি। গড়পড়তায় আন্তোফাগাস্তায় বছরে ১০ মিলিমিটারেরও কম বৃষ্টিপাত হয়, এবং এ কারণে সেখানকার মাটি অতীব শুষ্ক এবং অনুর্বর।
"বাইরে থেকে দেখলে এ এলাকাটিকে মঙ্গল গ্রহের মতই মনে হবে", বলেন কাজিন্স, যিনি সেইন্ট এন্ড্রিউস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। "আজকের মঙ্গল হচ্ছে একটি খুবই ঠান্ডা, নির্জন এবং পাথুরে মরুভূমি"।
আতাকামার তাপমাত্রা মঙ্গলের মত নিচে না নামলেও তা রাতের বেলায় ০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে শুরু করে দিনের বেলায় ৪০ ডিগ্রী পর্যন্ত ওঠে। অপরদিকে, আমাদের প্রিয় "লাল গ্রহ" মঙ্গলের তাপমাত্রা গড়পড়তায় মাইনাস ১৯৫ ডিগ্রী থেকে ২০ ডিগ্রীর মাঝে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, আতাকামার মাটির রঙ হুবহু মঙ্গলের মরচে পড়া রঙের মত।
এই এলাকাটি মহাশূন্য মিশনের জন্য তৈরি করা রোবটচালিত যন্ত্রগুলোকে পরীক্ষা করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে অনেকবার। মঙ্গল গ্রহগামী ভাইকিং ১, ভাইকিং ২ এবং ফিনিক্স মার্স ল্যান্ডারের সব যন্ত্রপাতি, এবং একই সাথে ইউরোপীয় মহাশূন্য এজেন্সির এক্সোমার্স রোভারের পারদর্শিতা পরখের পরীক্ষাগুলোও এখানেই সম্পন্ন হয়েছে।
২০১৯ সালে, নাসা এবং যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বৈজ্ঞানিক একত্রিত হয়ে "জোই" নামক একটি রোবটের মাধ্যমে কিছু পরীক্ষা চালান। রোবটটি আতাকামা মরুভূমির পিঠে ড্রিল করা শুরু করে, এবং বেশ খানিকটা গভীর পর্যন্ত গর্ত খুঁড়ে। সেই গর্ত থেকে আবিষ্কৃত হয় কিছু বিচিত্র ধরণের লবণ নিরোধক ব্যাকটেরিয়া। নাসার এই মিশনটি থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে মঙ্গল গ্রহে কোনদিন প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেলে তা এধরণের এককোষী জীবাণু হবার সম্ভাবনাই বেশি।
কিভাবে যাবেনঃ ইউরোপীয় মহাশূন্য এজেন্সির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, নিকটতম বিমানবন্দরটি চিলির আন্তোফাগাস্তার মূল শহরে অবস্থিত।
ম্যাকমার্ডো ড্রাই ভ্যালিস, এন্টার্ক্টিকা
পৃথিবীর সবচাইতে ঠান্ডা মহাদেশ, এন্টার্ক্টিকার পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত এক সারি বরফ-মুক্ত উপত্যকার নাম হচ্ছে "ম্যাকমার্ডো ড্রাই ভ্যালি"। এ জায়গাটি খুব সহজেই মঙ্গলের সাথে বৈরিতার প্রতিযোগিতায় নামতে পারবে। বছরজুড়ে, এখানে গড় তাপমাত্রা থাকে -১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে -৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস, এবং এর কিছু অংশে সম্ভবত মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরেও কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি। বৃষ্টির পরিবর্তে সেখানে বরফপাত হয়, এবং তা বছরে ৭ থেকে ১১ মিলিমিটার বৃষ্টির সমপরিমাণ। কিন্তু সেই বরফ মাটিতে নেমে আসার আগেই সরাসরি গ্যাসে রুপান্তরিত হয়ে যায়। মঙ্গল গ্রহেও একই ধরণের একটি প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়, যার মাধ্যমে গ্রহটির পৃষ্ঠে কার্বন ডাই অক্সাইড বরফে রুপান্তরিত হয়, যার কারণে সেখানে বড় বড় খাঁজেরও সৃষ্টি হয়েছে।
এন্টার্ক্টিকার শুষ্ক উপত্যকাগুলো ক্রমাগতভাবে হারিকেন ঝড়ের মত তীব্র গতির বাতাসের আঘাত সইতে থাকে, যাদের গতিবেগ ঘন্টায় প্রায় ৩২০ কিলোমিটার (২২৩ মাইল) এর মত। এই তীব্রতা মঙ্গলের বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগের চেয়েও তিন গুণ বেশি। তবে উভয় স্থানেই এই জোরালো বাতাস শুষ্ক মাটিকে চাবুকের মত আঘাত করে ধূলির মেঘ তৈরি করে থাকে। এরকম একটি দুর্ঘটনার ফলশ্রুতিতেই লাল গ্রহের "অপরচুনিটি রোভার" নামক যানটির ১৫ বছরব্যাপী অভিযানের পরিসমাপ্তি ঘটে।
গ্রীষ্মের মাসগুলোতে ম্যাকমার্ডোর শুষ্ক উপত্যকায়, সূর্য থেকে আসা অতি বেগুনী রশ্মি তীব্র ভাবে আঘাত হানতে থাকে। কিন্তু এ ধরণের বৈরি অবস্থার মধ্যেও এই বরফ শীতল, মরু উপত্যকায় প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।
ছোট ছোট কোয়ার্টজ পাথরের দলার নিচে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, যারা সূর্যের আলোকে শক্তিতে রুপান্তর করতে সক্ষম। কোয়ার্টজ পাথর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক অতি বেগুণী রশ্মিকে শুষে নিতে পারে, আর একইসাথে সে ততটুকু আলোকে তার মাঝ দিয়ে যেতে দেয়, যার মাধ্যমে সবুজ ব্যাক্টেরিয়া বড় হওয়ার মত যথেষ্ট পরিমাণে শক্তি তৈরি করতে পারে। অ্যাস্ট্রোবায়োলজিস্টরা বিশ্বাস করেন যে মঙ্গল গ্রহে প্রাণ সৃষ্টি হলে সেটি এরকমই হবে।
এই শুষ্ক অঞ্চলটির সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ব্যাপারটি পরিলক্ষিত হয় টেইলর উপত্যকার একটি স্থানে, যেখানে পাহাড়ের ভেতরের হিমবাহগুলোর অগ্রভাগ থেকে আয়রন অক্সাইডে রাঙা লবণাক্ত পানি ছুটে বের হয়ে আসতে থাকে। খনিজ সমৃদ্ধ পানির আঘাতে হিমবাহের রঙ রক্তের মত লাল হয়ে যায়।
কিভাবে যাবেন: ম্যাকমার্ডোতে পৌঁছানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে সামরিক প্লেন কিংবা গবেষণার কাজে ব্যবহৃত আকাশযানের ব্যবহার। সেখানে প্রায় সাতটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফিল্ড ক্যাম্প রয়েছে; যার যেকোনটিতে অনুমতি সাপেক্ষে যাওয়া যেতে পারে।
হ্যাঙ্কসভিল, ইউটাহ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণপশ্চিম প্রান্তে, চারটি রাজ্যজুড়ে বিস্তৃত কলোরাডো মালভূমির ক্যানিয়নল্যান্ডস নামক স্থানে একটি গভীর, পাথুরে স্তর রয়েছে, যা জুরাসিক সময়কাল থেকে অবিকৃত রয়েছে। প্রাচীন জলা ভূমির মাধ্যমে আসা পলিমাটি এবং বালি জমা হয়ে ইউটাহ মরুভূমিকে কমলা-লালবর্ণে রাঙিয়েছে, যা দেখতে অনেকটাই মঙ্গল গ্রহের মত।
হ্যাঙ্কসভিল শহরের কাছে অবস্থিত এই ভূখন্ডটিকে সম্প্রতি কানাডার মহাশূন্য এজেন্সি এবং ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন ক্যামেরা এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি পরীক্ষার করার জন্য। পরীক্ষা শেষে এসব যন্ত্র ইএসএ'র এক্সোমার্স রোভারের সাথে করে মঙ্গল গ্রহে পাঠানো হবে পরে কোনো অভিযানে।
কিভাবে যাবেন: হ্যাঙ্কসভিলের নিজস্ব বিমানবন্দর রয়েছে, যেখানে হালকা বিমান অবতরণ করতে পারে। তবে কেউ চাইলে সল্টলেক সিটির বড় বিমানবন্দরে অবতরণ করে সেখান থেকে গাড়ীতে করে হ্যাঙ্কসভিলে আসতে পারেন। প্রায় মঙ্গলগ্রহের মত জায়গাটি হ্যাঙ্কসভিল থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার (৭.২ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত।
টেনেরিফ, ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ
ক্যানারি আইল্যান্ডে আজ হতে প্রায় তিন মিলিয়ন বছর আগে একটি আগ্নেয়গিরির (যা বর্তমানে সুপ্ত) অগ্নুৎপাতে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে টেনেরিফ নামের জায়গাটি তৈরি হয়েছিল। টেনেরিফ বর্তমানে একটি আকর্ষণীয় অবকাশ যাপন কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত। তবে কেউ চাইলে এখানে এসে মঙ্গল গ্রহের অভিজ্ঞতাও পেয়ে যেতে পারেন। দ্বীপটির একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত ৩,৭১৮ মিটার উঁচু, "মাউন্ট টেইডে" নামক আগ্নেয়গিরিটির মধ্যে রয়েছে ফাঁপা লাভার টিউব এবং আগ্নেয়শিলার তৈরি গুহা, যা এস্ট্রোবায়োলজিস্টদের মতে, মঙ্গল গ্রহের সাথে তূলনীয়।
"মঙ্গল গ্রহের গুহা, দীর্ঘ লাভার স্রোত এবং সারি সারি কুয়ার অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়েছে ঘূর্ণায়মান মহাশূন্যযান থেকে তোলা ছবির মাধ্যমে"; বলেন মনিকা গ্রেডি, গ্রহবিজ্ঞানের একজন প্রতিথযশা অধ্যাপক। এখানকার গুহা, পানি ধরে রাখতে এবং বাইরের বৈরি পরিবেশ ও সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মির দাবদাহ থেকে যেকোন ধরণের "প্রাণ"কে নিরাপদ আশ্রয় দিতে সক্ষম।
গ্রেডি আরও বলেন যে "টেইডে ন্যাশনাল পার্কের গুহাগুলো মঙ্গল গ্রহের গুহাগুলোর একটি আদর্শ; পার্থিব প্রতিলিপি"।
কিভাবে যাবেন: এল টেইডে ন্যাশলান পার্কের মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছে একটি মহাসড়ক, এবং এর মাধ্যমে লাভা টিউব পরিদর্শ করা সম্ভব। এছাড়াও, একটি তারটানা গাড়ীপথের মাধ্যমে যাত্রীরা পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে পারেন আট মিনিটের মধ্যে। তবে পাহাড়ের আরো ভেতরের অংশে যেতে হলে অনুমতির প্রয়োজন পড়ে।
আইসল্যান্ড
আইসল্যান্ড হচ্ছে পৃথিবীর সর্বাধিক ভৌগলিক প্রক্রিয়া সমৃদ্ধ একটি জায়গা। আজকের আইসল্যান্ড এবং মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগের আইসল্যান্ড, উভয়েই মঙ্গল গ্রহ ভ্রমণের মত অভিজ্ঞতা প্রদান করতে সক্ষম। আইসল্যান্ডের অভ্যন্তরের বেশিরভাগ এলাকা মনুষ্যবিহীন আগ্নেয়-মরুভূমি অধ্যুষিত।
আইসল্যান্ডের গাঢ়, আগ্নেয় মৃতিকা খুবই স্বল্প পরিমাণ পানি ধরে রাখতে পারে, যে কারণে সেখানে প্রাণের সৃষ্টি হওয়া খুবই দুরুহ। বহু বছর আগে, আগ্নেয়গিরির বড় ধরণের অগ্ন্যুতপাতের কারণে সম্পূর্ণ উপত্যকাটি লাভায় ভরে গিয়েছিল। একই ধরনের ঘটনা মঙ্গল গ্রহেও ঘটেছে।
ক্লেয়ার কাজিন্স বলেন "এখানে পাওয়া পাথরগুলো রাসায়নিকভাবে মঙ্গলের পাথরগুলোর মতই, এবং উভয় জায়গার ভূপৃষ্ঠ একই প্রকৃতির"। তিনি আইসল্যান্ডে ইএসএ'র এক্সোমার্স রোভারের জন্য নির্মিত প্যানক্যাম নামের যন্ত্রটি পরীক্ষা করেছেন। তিনি আরও বলেন "এখানে এসে মনে হচ্ছে অন্য কোন গ্রহের পৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে রয়েছি"।
আইসল্যান্ডের এই অনন্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো বিজ্ঞানীদেরকে আরেকটি সুযোগ করে দিয়েছে, যা হলো "চার বিলিয়ন বছর আগে মঙ্গল গ্রহ দেখতে কেমন ছিল", তা অনুধাবন করার। পুরো দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে ঘিরে থাকা কার্যকর হট স্প্রিং (ঝর্ণা) গুলো "প্রাকৃতিক গবেষণাগার"-এর ভূমিকা পালন করছে। ঝর্ণাগুলোর পরিবেশকে তুলনা করা হচ্ছে মঙ্গলের প্রাথমিক যুগের পরিস্থিতির সাথে।
"আমরা এই ঝর্নাগুলো পর্যবেক্ষণ করে মঙ্গল গ্রহের ইতিহাসের প্রথম দিকের প্রাণী এবং সেখানে উপস্থিত রাসায়নিক পদার্থসমূহের ব্যাপারে একটি সম্যক ধারণা পেতে পারি", বলেন কাজিন্স। "আমরা এখানে কেমলিথোট্রোপ খুঁজে পেয়েছি—ওরা এক ধরণের জীবাণু, যারা পাথর এবং খনিজ পদার্থ ভক্ষন করে বেচে থাকতে পারে। তারা খুবই শক্তসমর্থ। খুব সম্ভবত তারাই মঙ্গল গ্রহের প্রথম প্রাণী"।
কিভাবে যাবেন: আইসল্যান্ডে সড়ক ও মহাসড়কের অভাব নেই; যেগুলো ব্যবহার করে বেশিরভাগ পর্যটক-বান্ধব এলাকায় পৌঁছানো যায়। কিন্তু এই দুর্গম, আগ্নেয়গিরিসংকুল; মঙ্গলসম এলাকায় পৌঁছুতে হলে প্রচুর পরিমাণে পর্বাতোরহণ এবং রুক্ষ ভূমির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে।
পিলবারা, অস্ট্রেলিয়া
"পিলবারা জায়গাটি আমাদেরকে কৌতুহলী করে তোলে, কেননা এখানে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম পাথরের সন্নিবেশ", বলেন ক্লেয়ার কাজিন্স। "কিছু পাথরের বয়স আমাদের সংগ্রহে থাকা মঙ্গল গ্রহের পাথরগুলোর সমান, কিংবা আরও পুরনো"।
পিলবারা অঞ্চলের কিছু বালুর পাথরের মধ্যে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে ৩.৪ বিলিয়ন বছর আগের ফসিল। ধরে নেয়া যায়, এটিই পৃথিবীর প্রাচীণতম প্রাণের প্রমাণ। এছাড়াও, সমুদ্রতটে এক ধরণের ক্ষুদ্র, স্ফটিকায়িত খনিজ পদার্থ পাওয়া যায় যা এক ধরণের প্রাচীণ ব্যাক্টেরিয়া হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই ব্যাকটেরিয়াটি সালফার গ্রহণ করে বেঁচে থাকতো।
মঙ্গল গ্রহে প্রাপ্ত উল্কাপিন্ডের নমুনায় একই অবশেষ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এই আবিষ্কারের ফলশ্রুতিতে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মাঝে তুমুল বিতর্কের শুরু হয়েছে। অনেকেই ভাবছেন, "তবে কি এই নমুনাগুলো লাল গ্রহের ব্যাক্টেরিয়ার ফসিলকৃত দেহাবশেষ?"
কিভাবে যাবেন: পিলবারা একটি বিশাল এলাকা, কিন্তু এখানে জনবসতী খুবই কম। উত্তরের পোর্ট হেডল্যান্ড অথবা নিউম্যান শহরে বিমানে করে পৌঁছুনো সম্ভব। তারপর সেখান থেকে সড়কপথে পিলবারায় যাওয়া যায়।
বৌলবি, যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্যের নর্থ ইয়র্ক মুরস নামের জায়গায়, সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত পাহাড়ের মাঝে লুকিয়ে থাকা একটি গ্রামের পরিবেশ কখনোই মঙ্গল গ্রহের মত হবার কথা নয়। তবে সেই "বৌলবি" গ্রামের তলদেশে পটাশিয়াম এবং লবণের খনি রয়েছে, যার সাথে মঙ্গল গ্রহের পরিবেশের আংশিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
খনির সুরঙ্গপথটি ভূপৃষ্ঠের প্রায় এক কিলোমিটার তলদেশ পর্যন্ত গিয়েছে, এবং তা শেষ হয়েছে দক্ষিণ সাগরে গিয়ে। সুরঙ্গের দেয়ালে এবং ছাদে কিছু বহুভূজ আকৃতির বস্তু খুঁজে পাওয়া গেছে; যা হুবহু মঙ্গল গ্রহের "জায়ান্টস কজওয়ে" নামক অংশে প্রাপ্ত বহুভূজাকৃতি বস্তুর মত। মঙ্গলের এই এলাকাটিকে আয়ারল্যান্ডের উত্তর উপকূলে অবস্থিত চল্লিশ হাজার ব্যাসাল্ট কলামের সন্নিবেশে তৈরি পাথুরে এলাকার নামে নামকরণ করা হয়েছে।
বৌলবিতে যুক্তরাজ্যের মহাশূন্য এজেন্সি এবং লেইসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা মিলে একটি "রামান লেজার স্পেক্ট্রোমিটারের" প্রোটোটাইপ পরীক্ষা করেছেন, যাকে এক্সোমার্স রোভারের সাথে সংযুক্ত করা হবে। এই যন্ত্রের কাজ হবে মঙ্গল গ্রহের অনুমিত ব্যাকটেরিয়া সদৃশ প্রাণীদের রাসায়নিক চিহ্ন খুঁজে বের করা। খনিটির লবণাক্ত পরিবেশ ব্যাকটেরিয়াদের জন্য অত্যন্ত বৈরি। এখানে হ্যালোফিলস নামক জীবাণূ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, যারা এই বৈরি পরিবেশের সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নিয়েছে। হয়তো মঙ্গল গ্রহেও এ ধরণের প্রাণ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
কিভাবে যাবেন: সড়কপথে বৌলবি যাওয়া সম্ভব, কিন্তু সেই খনিতে প্রবেশ করতে হলে খনি মালিকের বিশেষ অনুমতি দরকার হয়। সেখানে এখনও খনন কাজ পূর্ণোদ্যমে চলছে।
সালবার্ড, নরওয়ে
সালবার্ড নামক পর্বতসংকুল দ্বীপপুঞ্জটি উত্তর মেরুর খুবই কাছাকাছি জায়গায় অবস্থিত। এখানে তেমন কোন গাছপালা কিংবা পশুপাখির অস্তিত্ব নেই। এখানকার মাটিতে শুধু লালচে রঙের বালু এবং নুড়িপাথর রয়েছে। তুন্দ্রা অঞ্চলীয় পরিবেশটি অনেকটাই পৃথিবীর চেয়ে শীতলতর মঙ্গল গ্রহের মত। এখানেও গ্রহ অভিযানের যন্ত্রপাতির পরীক্ষা নিরীক্ষা, এবং নভোযাত্রীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
সালবার্ডে নাসার কিউরিওসিটি রোভার এবং ভবিষ্যত অভিযাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে থাকা এক্সোমার্স রোভারের জন্য নির্মিত কিছু যন্ত্র পরীক্ষা করার কাজে অংশ নিয়েছেন জার্মান এরোস্পেস সেন্টারের ভূতত্ববিদ নিকোল স্কিমিটজ। তিনি বলেন "আমি সৌভাগ্যবান, কেননা আমি রোভারের চোখ দিয়ে প্রতিদিন মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠকে দেখি"।
তিনি আরও বলেন "এ ধরণের এনালগ পরিবেশে থাকার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পেরেছি মঙ্গল গ্রহের মত একটি বৈরি জায়গায় গবেষণার কাজ করা কতটা দুরুহ হতে পারে। সালবার্ডে কাজ করার জন্য আপনাকে মহাকাশযাত্রীদের ব্যবহারোপযোগী মোটা স্যুট এবং দস্তানা পরতে হয়। আপনাকে ভারী যন্ত্রপাতি কাঁধে নিয়ে উঁচু জায়গায় আরোহন করতে হয় এবং বিভিন্ন জিনিস মেরামত করতে হয়। আপনি খুব সহজেই শীতে কাবু হবেন, ক্লান্ত হয়ে যাবেন, এবং শরীরের সব শক্তি ফুরিয়ে গেলেও বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বিন্দুমাত্র ফুরসৎ মিলবে না। সেখানে কোন ধরণের মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, এবং আপনি চাইলেও সাহায্যের জন্য আবেদন জানাতে পারবেন না সহসা। আপনাদেরকে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে, এবং একজনকে আরেকজনের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে সর্বক্ষণ। সর্বোপরি, হাতের কাছে যা আছে, তাই দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করতে হবে"।
কিভাবে পৌছুবেন: সালবার্ডের বৃহত্তম বিমানবন্দরটির নাম লংইয়ারবাইয়েন, কিন্তু দ্বীপপুঞ্জের দুর্গম জায়গাগুলোতে পৌঁছানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে নৌকাযোগে ভ্রমণ। বলাই বাহুল্য, এ যাত্রায় মেরু ভল্লুকের আকস্মিক আক্রমণ ঠেকানোর জন্য উপযুক্ত উপকরণ সাথে নেয়া আবশ্যক।
ডরসেট, যুক্তরাজ্য
প্রথম দেখায়, ব্রিটেনের দক্ষিণ উপকূলকে কোনো দিক দিয়েই মঙ্গলের সাথে মেলানো যাবে না। কিন্তু ডরসেটে রয়েছে কিছু অতিমাত্রায় এসিডযুক্ত সালফারের ধারা, যার মাঝে কিছু বিশেষ ধরণের ব্যাক্টেরিয়া বসবাস করে। সেইন্ট অসওয়াল্ড উপসাগরে অবস্থিত এ ধরণের একটি সালফার-ধারার ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে যে এটি "বিলিয়ন বছর আগের মঙ্গলের পরিবেশের প্রতিরুপ।''
গ্যেটাইট নামক লৌহযুক্ত খনিজ পদার্থটি এসিডের ধারায় সিক্ত হয়ে হেমাটাইটে রুপান্তরিত হয়, যে উপাদনটিকে মঙ্গল গ্রহে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে মঙ্গল গ্রহের হেমাটাইটের সুষ্ঠু বিশ্লেষণের মাধ্যমে লাল গ্রহটিতে প্রাণের উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতি সম্পর্কে একটি পরিষ্কার উপসংহার টানা যাবে।
"সেইন্ট অসওয়াল্ড উপসাগরের তীরবর্তি অঞ্চলটি হচ্ছে মধ্য যুগের মঙ্গল গ্রহের একটি প্রতিলিপি", বলেন জোনাথন ট্যান, যিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের একজন গ্রহ বিজ্ঞানী। তিনি আরও বলেন "এসিডের ধারা শুকিয়ে যাচ্ছে, যেমনটি মঙ্গল গ্রহের শুষ্ক যুগে ঘটেছিল, এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গ্যাটাইট খনিজ তৈরি হচ্ছে।এই খনিজে রয়েছে ফ্যাটি এসিডের উপস্থিতি, যা এমন একটি রাসায়নিক উপাদান, যা প্রাণের চিহ্ন হিসেবে কাজ করে"।
কিভাবে যাবেন: পশ্চিম লুলওয়ার্থ নামের ছবির মত গ্রামটি থেকে অল্প একটু হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন।
- সূত্র: বিবিসি, আর্থ