পাকিস্তানপন্থীদের এপ্রিল ১৯৭১
স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি কী বলেছে, কী করেছে সেটাও ইতিহাসের উপাদান। এই রচনাটি পাকিস্তানপন্থীদের এপ্রিল ১৯৭১ কার্যক্রমের একটি আংশিক ডকুমেন্টেশন।
৪ এপ্রিল ১৯৭১ পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট নুরুল আমিনের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল 'খ' অঞ্চলের (পূর্ব পাকিস্তান) সামরিক আইন প্রসাশক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্যের মধ্যে ছিলেন মৌলভি ফরিদ আমদ, অধ্যাপক গোলাম আজম, খাজা খয়েরউদ্দিীন, শফিকুল ইসলাম, মাওলানা নুরুজ্জামান প্রমুখ। তারা টিক্কা খানকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন, ভারতের নগ্ন হস্তক্ষেপের নিন্দা করেন, ঢাকায় নাগরিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন।
লেফটন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান বলেন সাম্প্রতিক অচলাবস্থার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করতে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। তিনি বুঝতে পেরেছেন চাপে পড়েই বেসামরিক কর্মচারিরা কাজে যোগ দিতে পারেননি, ধর্মঘটের সময় প্রাপ্য তাদের বেতন দিয়ে দেবার নির্দেশও দিয়েছেন। দুষ্কৃতিকারী, সমাজ বিরোধী, রাষ্ট্রদ্রোহীদের আশ্রয় দেওয়া থেকে বিরত থাকতে তিনি দেশবাসীকে আহ্বান জানান। খাদ্যশস্য প্রেরণের সময় বাধাদানকারী দুষ্কৃতকারীদের কাঠোর হস্তে দমন করার কথা বলেন।
৬ এপ্রিল যারা টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে তাকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন তারা হচ্ছেন; হামিদুল হক চৌধুরী, গোলাম আযম, পীর মোহসেন উদ্দীন এবং এডভোকেট এ টি সাদী।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের অনাকাঙ্খিত হস্তক্ষেপের তারা নিন্দা জ্ঞাপন করেন। দেশপ্রেমিক বাঙ্গালিরা ভারতের চক্রান্ত নস্যাৎ করতে প্রস্তত বলে তারা সামরিক আইন প্রশাসককে আশ্বস্ত করেন।
৭ এপ্রিল ক'জন 'বিশিষ্ট রাজনৈতিক সহযোগী'কে সাথে নিয়ে খান আবদুস সবুর খান তার সাথে সাক্ষাৎ করেন।
১৬ এপ্রিল শান্তি কমিটির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যগণ তার সাথে দেখা করেন। নুরুল আমিন দলের নেতৃত্ব দেন, কমিটির আহবায়ক খাজা খয়ের উদ্দিন সহ ১৭ জন গভর্নর হাউসে আসেন।
৮ এপ্রিল জমিয়তে ওলামা ও নেজামে ইসলাম এর প্রতিনিধিবৃন্দ সাঈদ মাহমুদ আল মুস্তফা আল মাদানীর নেতৃত্বে গভর্নরের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৯ তারিখে সাক্ষাৎ করতে আসেন কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল।
১০ এপ্রিল শনিবার জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য সামনে নিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী শিবিরের নেতৃবৃন্দ খাজাখয়ের উদ্দীনকে আহবায়ক করে ১০৪ সদস্যের 'নাগরিক শান্তি কমিটি' গঠন করেন। কমিটিকে আরো সদস্য কো-অপট করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। শহরের ইউনিয়ন ও মহল্লা পর্যায়েও কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মধ্যে ছিলেন: এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম, গোলাম আজম, সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম, আবদুল জব্বর খদ্দর, মাহমুদ আলী, একে রফিকুল হোসেন, ইউসুফ আলী চৌধুরী, আবুল কাশেম, ফরিদ আহমদ, গোলাম সারওয়ার, সৈয়দ আজিজুল হক, এস এম সোলায়মান, পীর মোহসীন উদ্দীন, শফিকুর রহমান, মেজর আফসার উদ্দীন, সৈয়দ মোহসেন আলী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, সিরাজউদ্দিন, আতাউল হক খান, এ টি সাদী, মকবুলুর রহমান, মোহম্মাদ আকিল, রুহুল কুদ্দুস, নুরুর রহমান, মফিজুল হক, আবু সালেক, আবদুল নঈম প্রমুখ।
শান্তি কমিটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হিন্দুস্তান নিলর্জ্জ হস্তক্ষেপ ও হীন প্রচারণার বিরুদ্ধে সতর্ক করে, পাকিস্তানের অখন্ডতা ও সংহতি রক্ষার কথা জোর দিয়ে বলে এবং পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিহত করতে দেশপ্রেমিক পূর্ব পাকিস্তানি জনগণকে আহবান জানায়।
১৪ এপ্রিল বুধবার নাগরিক শান্তি কমিটির বৈঠকে সংস্থার নতুন নামকরণ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এই কমিটির নাম হবে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি; ২১ সদস্যের কার্যকারী কমিটি দ্রুত মহকুমা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যক্রম বিস্তৃত করবে। শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় মগবাজারের ৫ নম্বর এলিফেন্ট লেন। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি ঢাকা শহরের ইউনিয়ন ও মহল্লায় শান্তি কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে আহবায়ক নির্বাচন সম্পন্ন করেছে।
২২ এপ্রিল রাষ্ট্রবিরোধী লোকদের হিংসাত্মক ও নাশকতামূলক কার্যকলাপ প্রতিরোধের জন্য শান্তি কমিটি সশস্ত্র বাহিনীকে সহযোগিতা করবে- এই ঘোষণা দেওয়া হয়। পরদিনের দৈনিক পাকিস্তানে উল্লেখ করা হয় :
সশস্ত্র বাহিনী যেখানেই যাবে সেখানে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসার এবং রাষ্ট্র বিরোধী ব্যক্তি ও দুষ্কৃতিকারীদের নির্মূল করার অভিযানে সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর জন্য শন্তি কমিটি দেশপ্রেমিক জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কমিটি বলেছে, দেশের সেনাবাহিনীকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
শান্তিপ্রিয় ও দেশপ্রেমিক পূর্ব পাকিস্তানী জনগণ ভারতীয় বেতারের বিদ্বেষ প্রচারণার এবং রাষ্ট্রবিরোধী লোকদের গুজব ছড়ানোর প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে পারবেন বলে কমিটি আশা প্রকাশ করেছেন।
খণ্ডিত হওয়ার হাত থেকে দেশকে রক্ষার মহান কাজে সোনাবাহিনীর সাফল্যের জন্য কমিটি আল্লাহর কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
২৭ এপ্রিল ১৯৭১ জারি করা হয় মার্শাল ল অর্ডার ১৪৮। এতে বলা হয় যদি কোনো ব্যক্তি বা দল রাস্তাঘাট, রেলওয়ে খাল ও বিমানবন্দরের ক্ষতিসাধন করে, টেলিফোন টেলিগ্রাম, ওয়ারলেস কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি করে তাহলে এমএলও ১৪-এর আওতায় তার বিচার করা হবে; এতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
এপ্রিলের চিঠি
২৯ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে বোর্ডের অবাঙ্গালি অফিসার অন স্পেশাল ডিওটি আরশাদ মাহমুদ চট্টগ্রাম থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্র লিখেছেন। তিনি শিঘ্রই পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাচ্ছেন তার আগে তিনি জানাচ্ছেন:
আমাদের আলোচনার এক পর্যায়ে যারা রাষ্ট্র বিরোধী কাজের সাথে সম্পৃক্ত তাদের সম্পর্কে বলেছি। আমি জেনেশুনে এবং বিশ্বাস করেই লিখছি যে রেলওয়ে বোর্ডের সেক্রেটারি এবং চিফ প্লানিং অফিসার মোহাম্মদ শফি, চিফ পার্সোনেল অফিসার নাসির উদ্দিন আহমেদ, ডিভিশনাল সুপরিনটেনডেন্ট মকবুল আহমেদ, সিভিল ডিফেন্স অফিসার তাহুর খান, রেলওয়ে বোর্ডের ডেপুটি সেক্রেটারি সিরাজুল হক, ডিভিশনাল মেক্যানিক্যার ইঞ্জিনিয়ার কফিল আহমেদ এবং আতাউর অগ্নিকাণ্ড হত্যা লুটতরাজের জন্য দায়ী যার পরিণতিতে রেলওয়ে বোর্ডের মেম্বার ইঞ্জিনিয়ারিং আশফাক এবং চিফ ইঞ্জিনিয়ার ইয়াসিনের মৃত্যু ঘটেছে। বর্ণিত কর্মকর্তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করেছে এবং অর্থ যুগিয়েছে টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে বেঙ্গল আর্মির জন্য পরির্বহন সুবিধা দিয়েছে।
প্রায় ১০ দিন আগে আমি এবং সেক্রেটারি রেলওয়ে ব্যক্তিগতভাবে ব্রিগেডিয়ার আহসানের কাছে তালিকাটি হস্তান্তর করলেও চিফ প্লানিং অফিসার মোহাম্মদ শফি এবং পিপিআরও আতাউর রহমান ছাড়া অন্য কাউকে তুলে নেয়নি। নিশ্চয়ই কর্তৃপক্ষের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ততার কারণেই অধিক নজর দেওয়া সম্ভব হয়নি। এতে তারা রেলওয়ে স্টেশন অফিসে দলিলপত্রে ঘষামাজা করার সুযোগ পেয়েছে। তারা এখনও তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রমাণ নিশ্চিহ্নকরণের কাজে লিপ্ত আছে।
আপনাকে ছেড়ে আসার পর অবাক হয়ে দেখলাম দুটো গুরুত্বপূর্ণ নাম বাদ পড়ে গেছে। একজন এম এ করিম, অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ইলেক্ট্রিফিকেশন) যখন গুলি চালাল তাতে আমার পিয়নের বোন নিহত হয় এবং অবসর প্রাপ্ত সিনিয়র পার্সোনেল অফিসার আর এন বাগচি বরাবরই ভারতপন্থী কাজে মদত যুগিয়েছেন এবং তা অফিস রেকর্ডে আছে।
সবশেষে তিনি উল্লেখ করেন দেশপ্রেমবোধ থেকেই তিনি এই চিঠি লিখতে বাধ্য হয়েছেন। চিঠির এই অনুলিখিতে প্রাপক কে তা স্পষ্ট না, সম্ভবত ব্রিগোডিয়ার মাহমুদ বা উর্ধ্বতন কেউ।
৭ এপ্রিল অঞ্চলের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে অ্যাডমিরাল কে এম আহসানের স্থলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করা হয়। বাল্টিমোর সান পত্রিকার জন উডরাফের ভাষায়:
নতুন গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান বাঙালীদের কাছে এক কঠোর বাজপাখি ১৯৬০-এর দশকে বেলুচিস্তানে নির্মমভাবে বিদ্রোহ দমনের সূত্রে বাঙালীরা তাকে বেলুচিস্তানের কসাই নামে অভিহিত করেছে।
ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী তাকে শপথ গ্রহণ করাতে অস্বীকার করেন জানা গেলেও ৯ এপ্রিল গভর্নর হাউসে তাকে শপথ গ্রহণ করান। অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি মিশনের কূটনীতিববৃন্দ হাইকোর্টের বিচারকগণ এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলারা উপস্থিত ছিলেন।
১৮ এপ্রিল বেতার ভাষণে টিক্কা খান বলেন: রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়েছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যারাই আওয়ামী লীগে ছিলেন তারা সবাই পাকিস্তানের সংহতি ও অখন্ডতার বিরোধী। যারা পাকিস্তানের মঙ্গল চান তাদের ভয় পাবার কারণ নেই, তার এগিয়ে এসে অন্য দেশপ্রেমিকদের সাথে যোগ দিতে পারেন।
অবশ্য তিনি একথাও বলেন, অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগ এমন এক পথ ধরেছিল যা বহু ত্যাগের বিনিময়ে উপমহাদেশে সৃষ্ট মুসলমানদের আবাসভূমিকে ধ্বংস করে দিত। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানি মুসলমানরা পাকিস্তানকে রক্ষা করতে দৃঢ় সংকল্প। সেনাবাহিনী এই সব দেশ প্রেমিকদের সহায়তায় দেশের সুরক্ষা এবং আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হবে।
২১ এপ্রিল প্রকাশিত সরকারি ভাষ্যে জানানো হয়েছে পাকিস্তানের সশস্ত্র সেনাবাহিনী সীমান্ত সুরক্ষিত রেখেছে এবং সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্য সমূহ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ ঠৈকাতে তারা সজাগ রয়েছে। সীমান্তবতী ব্রাক্ষণবাড়িয়া আখাউড়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতীয় যে সব বিজয়ের গল্প ও পাকিস্তানি ব্যর্থতার কথা শোনাচ্ছে তার সবই কল্পনা বিলাস।
পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্রে উদ্ধৃত হয়েছে:
৪ এপ্রিল ১৯৭১ পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগণা জেলা থেকে 'টাইম' পত্রিকার প্রতিনিধি জানিয়েছেন বোমা ও বন্দুক সীমান্ত দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে ঢুকছে। পূর্ব বাংলার বেনাপোলে সীমান্তে পশ্চিমবঙ্গে গেরিলা যোদ্ধাদের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা গেছে। ২৮ এপ্রিল ১৯৭১ নয়াদিল্লি থেকে এফএফপি নিশ্চিত করেছে যে পূর্ব পাকিস্তানে ১০,০০০ প্রাক্তন সৈনিক যুদ্ধের জন্য সংগঠিত হচ্ছে। ২ জুন ১৯৭১ লন্ডন 'টাইমস' এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ভারত সরকার প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের ধারণাকে জিইয়ে রেখেছে। এ পত্রিকার কলকাতা প্রতিনিধি জানিয়েছেন নিয়োগকৃত ৩০,০০০ লোক সীমান্তবর্তী প্রায় ৩০টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভারতীয় ইন্সট্রাকটরদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। তিনি আরও জানান যে তথাকথিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আসলে ভারত ভূখণ্ডের ভেতরেই। তিনি বললেন, কয়েক সপ্তাহ চুপচাপ থাকার পর এই পলায়নপর স্বাধীনবাংলা বেতার দাবি করে বসল অনেক স্থানে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা সদস্যদের উৎখাত করা হয়েছে।
আজ সকালে আমি একটি রেডিও ডিরেকশন ফাইন্ডিং কয়েল ব্যবহার করে রেডিও স্টেশনটির অবস্থান জানার চেষ্টা করি। এ রেডিওতে বলা হচ্ছিল যে বাংলাদেশের ভেতরে কোনো স্থান থেকে সম্প্রচারের কাজটি করা হচ্ছে। কিন্তু বিস্ময়ের সাথে আমি লক্ষ্য করলাম যে সম্প্রচার পূর্ব দিক থেকে হচ্ছে না বরং যেদিক থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিও ব্রডকাস্ট হচ্ছিল স্বাধীনবাংলার সম্প্রচারও সেদিক থেকে। আরও বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষায় দেখা গেছে উত্তর দিক থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিও ট্রান্সমিটার যেখানে সেখানেই এ সম্প্রচার হচ্ছে।
১৫ এপ্রিল 'গার্ডিয়ানে' প্রকাশিত মার্টিন ওলাকটের প্রতিবেদনটি উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে জানানো হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের অস্থায়ী সরকারের অবস্থান বাংলাদেশের ভেতরে কোথাও। মার্টিন ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের এই প্রতিবেদনকে গল্প বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন সরকারের সকলেই কলকাতায় আছেন এবং রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে অবস্থান করছেন। এ সংবাদদাতা আরো জানিয়েছেন গত শুক্রবার এই সব ব্যক্তিবর্গের সাজানো একটি স্বাধীনতা ঘোষণার অনুষ্ঠানে ভারতীয়রা চেয়ার ও অন্যান্য আসবাপত্র সরবরাহ করেছে এবং বেসামরিক পোষাকে ভারতীয় সেনাবাহিনী-এই উৎসবের নিরাপত্তা বিধান করেছে।
২০ এপ্রিল প্যারিস থেকে প্রকাশিত ফরাসি দৈনিক "লা মঁদ" লিখেছে ভারতীয় সীমান্ত থেকে এক মাইল ভেতরে পূর্ব পাকিস্তানের সীমানারই একটি আম গাছের নিচে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যদিও সরকার গঠিত হয়েছে কলকাতাতেই। এটা করা হয়েছে যাতে বিদেশী-সংবাদ মাধ্যমগুলো জোর দিয়ে বলতে পারে যে সরকারের অবস্থান পূর্ব-পাকিস্তানের ভেতরেই।
ইয়াহিয়ার অঙ্গীকার সংঘর্ষের দিকে
দি সিউনি মর্নিং হেরাল্ড ২৯ এপ্রিল ১৯৭১ লিখেছে: প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা খাটিয়ে ট্যাংক গোলন্দাজ শক্তি আর যুদ্ধবিমান দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের শহরগুলোতে সাময়িক বিজয় হয়তো দেখাতে পারতেন কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এই বিজয় নস্যাৎ হয়ে যাবে।
"কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সেনাঘাঁটি থেকে হাজার মাইল দূরে তার সেনাদলের শক্তি প্রয়োগ করে ইয়াহিয়া খান কেমন করে আশা করেন যে তিনি গেরিলা যোদ্ধাদের পরাস্ত করবেন-যে যুদ্ধ জ্বলে উঠবে বাঙালি জাতীয়বাদের শক্তিতে, যে যুদ্ধ চলতে থাকবে অনির্দিষ্টকাল ধরে, যে যুদ্ধ চলবে পূর্ব পাকিস্তানের গ্রাম্য প্রান্তরে। ... কেবল ইয়াহিয়া খানের শুভবুদ্ধির উদয় হলেই এই ট্র্যাজেডির দীর্ঘায়িত হওয়া রোধ করা সম্ভব।
কিন্তু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ইয়াহিয়ার অঙ্গীকার সংঘর্ষের দিকেই।"
প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জন্য কিসিঞ্জারের ২৮ এপ্রিল মেমোরেন্ডামে তিনটি বিকল্প উপস্থাপন করা হয়:
বিকল্প-১
পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে আমাদের সম্পর্কে সুরক্ষাই আমাদের জন্য সুবিধাজনক পন্থা। আর তা করলে অসুবিধের দিক হলো বর্তমান পরিস্থিতিকে টেনে নিয়ে আরও দীর্ঘায়িত করতে পশ্চিম পাকিস্তানকে উৎসাহ জোগাবে এবং পাকিস্তান ও আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে।
বিকল্প-২
আমাদের ভাবমূর্তির প্রতিষ্ঠা করবে এবং জনগণের কাছে আমাদের অবস্থানের যৌক্তিকতা তুলে ধরার সুবিধাজনক পন্থা। অসুবিধের দিকটি হলো সামরিক ও আর্থিক সহায়তা ছেঁটে দিলে তা কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য লাভজনক হয়ে উঠবে। তাতে পশ্চিম পকিস্তানের সাথে সম্পর্কের যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটবে কিন্তু তা এমন পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও হবে না, যা পূর্ব পাকিস্তানকে যথেষ্ট সাহায্য করবে কিংবা একটি রাজনৈতিক মীমাংসার দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বিকল্প-৩
ইয়াহিয়ার সাথে সম্পর্কে সুরক্ষার পুরো সুবিধাই থেকে যাবে। যুক্তরাষ্টের এবং পাকিস্তানের স্বার্থ যতটা সম্ভব কম ক্ষুণ্ন করে পরিস্থিতি উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। আর এর অসুবিধের দিকটি হচ্ছে, রাজনৈতিক সমঝোতার উদ্যোগ ভেঙে গেলে যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের ৬০ কোটি মানুষের কাছ থেকে নিজেকে বিছিন্ন করে ফেলবে এবং শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান সরকারকে প্রভাবিত করতে যুক্তরাষ্ট্র অসমর্থ হয়েছে।