নিষিদ্ধ বই পাঠ: কী স্পর্ধা!
১৬ এপ্রিল ১৯৩০
নিখিল বঙ্গ সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় একটি সভায় সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত শ্রীজ্ঞানাঞ্জন নিয়োগী রচিত 'দেশের ডাক' গ্রন্থটি পাঠ করা হয়। ৮ জন পাঠক বইটির নির্বাচিত অংশ পাঠ করে রাজদ্রোহ বিধি ভঙ্গ করেন। কিন্তু যারা এই গ্রন্থ পাঠ করেছেন একে একে তাদের সকলকেই পরে গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রন্থ পাঠ শুনতে প্রায় ৫০ হাজার লোকের জমায়েত হয়েছিল।
১৫ এপ্রিল ১৯৩০
ময়মনসিংহ ঢাকা থেকে এগিয়ে। ঢাকার একদিন আগে ১৫ এপ্রিল ১৯৩০ সালে ময়মনসিংহ শহরের টাউন হলে সরকারের বাজেয়াপ্ত করা বই পাঠ করে রাজদ্রোহ বিধি ভঙ্গ করা হয়। ১৭ তারিখ কলিকাতার আনন্দবাজারে প্রকাশিত সংবাদের উদ্ধৃতি:
সভায় শ্রীজ্ঞানাঞ্জন নিয়োগী প্রণীত 'দেশের ডাক', শ্রীযুত ভূপেন্দ্রনাথ রঙ্গিত রায় প্রণীত 'তরুণের অভিসার', শ্রীযুত শরৎচন্দ্র চ্যাটার্জি কর্তৃক প্রণীত 'পথের দাবী' এবং ডাক্তার স্যান্ডারন্যান্ড (প্রকৃত পক্ষে নামটি হবে ডাক্তার জাবেজ টি সান্ডারল্যান্ড) কর্তৃক প্রণীত 'ইন্ডিয়া-ইন-বন্ডেজ'-এই সব বাজেয়াপ্ত পুস্তক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে পড়িয়া শুনান হয়।
১৫ এপ্রিল ১৯৩০ টাঙ্গাইলে সূর্যকান্ত টাউন হলে ৬০০০ লোকের জমায়েতে সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত বই পাঠ করা হয়। ১৮ নভেম্বর ১৯৩০ বন্ধে মাতরম ধ্বনী উচ্চারণ করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বিরক্তি উৎপাদনের অভিযোগে মহাদেব চন্দ্র সাহা অভিযুক্ত হন এবং তাকে ২০ টাকা অর্থদন্ড অনাদায়ে ১০ দিনের সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়।
পুলিশ বাজেয়াপ্ত বইয়ের সন্ধানে তাদের সন্দেহভাজন জায়গাগুলোতে হামেশাই হানা দিচ্ছে এবং একটি অফিসে 'মরণ বিজয়ী যতীন দাস' ও 'স্বরাজ গীত' নামক বই দুটি পেয়ে এই বইসহ অফিসের খাতাপত্র কার্যবিবরণী নিয়ে গেছে। বাড়িতে বাড়িতে খানাতাল্লাসি করে কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে।
শিশির কর তার গবেষণামূলক গ্রন্থ 'ব্রিটিশ শাসনে বাজেয়াপ্ত বাংলা বই' গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯৩০ সালের ১২ এপ্রিল বাজেয়াপ্ত বই পাঠ ও বিক্রির জন্য কলেজ স্কোয়ারে এক সভা ডাকা হয়। ওই সভায় পুলিশের গুন্ডামি চরম ও বীভৎস রূপ নেয়। ছাত্ররা দলে দলে এতে যোগ দিয়েছিলেন। এর উদ্যোক্তা ছিল বেঙ্গল ন্যাশনাল মিলিশিয়া। আনন্দবাজার পত্রিকায় সভার বিবরণ দেয়:
'অপরাহ্ন সাড়ে ৬ ঘটিকার সময় সভা হইবার কথা ছিল, তাহার বহু পূর্বেই কলেজ স্কোয়ার পুলিশ কনস্টেবলদের লগুড়কন্টকে কন্টকাকীর্ণ হইয়া পড়ে। কলেজ স্কোয়ারে লাল পাগড়ী সমারোহের দৃশ্য দেখিয়া মনে হইতেছিল, কে যেন কতকগুলি লাল দিয়াশলাইয়ের কাঠি সারি সারি বসাইয়া দিয়া গিয়াছে, বহু সংখ্যক পুলিশ কনস্টেবলকে সিনেটের ধারে জমা রাখা হইয়াছিল।'
ছাত্র নেতা শচীন্দ্রনাথ মিত্র আনন্দবাজারের বাজেয়াপ্ত কংগ্রেস সংখ্যা পাঠ করলে পুলিশ কর্মকর্তা গর্ডন তাকে সেখানেই গ্রেফতার করেন। পুলিশ এই সভাকে বেআইনি ঘোষণা করে জনতার উপর লাঠি চালান দিয়ে তাদের হটিয়ে দেয়। বহু সংখ্যক আহতের মধ্যে গুরুতর আহত ১৪ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গ্রেফতার হন নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতির প্রেসিডেন্ট শচীন্দ্রনাথ মিত্র, বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র সমিতির সেক্রেটারি অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বেঙ্গল ন্যাশনাল মিলিশিয়ার জেনারেল সেক্রেটারি দুর্গাপদ দাসগুপ্ত, শিশির কুমার ব্যানার্জী, শ্রীপদ মজুমদার, প্রসন্ন কুমার বসু, সুরেন্দ্রনাথ লাহিড়ি প্রমুখ।
কলিকাতার নিষিদ্ধ বই পাঠের ঢেউ ঢাকা, ময়মনসিংহ টাঙ্গাইলসহ পূর্ববঙ্গের শিক্ষিতজনকে স্পর্শ করে। তখন রাষ্ট্রদ্রোহ বিধি ভঙ্গ করে বাজেয়াপ্ত বই পাঠ ও বিক্রিকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একটি ধারা বিবেচনা করা হয়। নিষিদ্ধ বই প্রকাশ্যে পাঠ করে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের মতো বরেণ্য নেতাকেও গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
রাজরোষে বই বাজেয়াপ্ত
কেবল ভারতবর্ষেই নয়, গোটা পৃথিবীজুড়ে বই বাজেয়াপ্ত হবার প্রধান কারণ রাজরোষ। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাঙ্গালিদের রাজা ছিলেন ব্রিটিশ রাজ। তিনি কিংবা তার পরিবার ও স্বজন, কিংবা তার প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ কেউই দু'লাইন বাংলা শেখেননি যে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত একটি পুস্তক কিংবা একটি পুস্তিকা কিংবা একটি লিফলেট পড়ে ভেতরের কথা বুঝবেন এবং কষ্ট পাবেন।
এমনকি ভারতের গভর্নর জেনারেল কিংবা বাংলার গভর্নর ব্রিটিশ সাহেবদের কেউ কেউ কথ্য বাংলা শিখলেও বাংলা বই পড়ে পুলকিত হওয়া কিংবা কষ্ট পাবার মতো বিদ্যা কেউ আয়ত্ব করেননি। গভর্নর ইন কাউন্সিল-বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের ব্রিটিশ এবং এমনকি ফার্সি/উর্দুভাষী বাঙ্গালী (বাংলায় জন্মসূত্রে) সদস্যদের রাজার হয়ে রুষ্ট হবার মতো বাংলা বিদ্যা ছিল না। সর্বপ্রথম একজন কাউন্সিল সদস্য মহারাজা ক্ষৌনিশ রাজরোষে নিপতিত একটি গ্রন্থ পাঠ করে তার মন্তব্য প্রদান করলেন। সেই বইটির নাম 'পথের দাবী',
লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আসলে ব্রিটিশ রাজের পক্ষে তখন ক্ষুব্ধ হতেন থানার দারোগা ও কনষ্টেবল, মুকতারগিরি করে উকিল হওয়া সরকারি কিছু আইনজীবী, ফৌজদারি ও দেওয়ানি প্রশাসনের বেতনভুক্ত কিছু কর্মচারি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারত সচিবের দৃষ্টিতে পড়তে উচাটন দু একজন ভারতীয় কালেক্টরও উঠেপড়ে লাগতেন। একালে কথিত রাজরোষ কাগজে কলমে প্রকাশ না করে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটলেও রাজকর্মচারিদের যেহেতু জবাবদিহি করতে হতো, কাগজে কলমেই সেই ক্ষোভটা ঝাড়তে হতো। আর সে জন্য দরকার ছিল রাষ্ট্রের 'লিগাল ইনস্ট্রুমেন্ট' যা রাষ্ট্রীয় কাজকে বৈধতা প্রদান করত। ব্রিটিশ বাংলায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে ভারতীয় দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ১২৪-এর ধারা।
এই ধারাটি রাষ্ট্রদোহের। এতে বলা হয়েছে: যে ব্যক্তি তার কথা কিংবা লিখিত শব্দ কিংবা সংকেত কিংবা চিত্রকল্প দিয়ে আইনানুগভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি ঘৃণা ও অবজ্ঞা সৃষ্টি করেন বা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাকে অপরাধের শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদন্ড কিংবা বিচারকের বিবেচনা অনুযায়ী যে কোনো মেয়াদের মেয়াদের কারাদণ্ড ও সাথে অর্থদণ্ড কিংবা তিন বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড কিংবা কেবল অর্থদণ্ড হতে পারে।
এখানে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে ঘৃণা, অবজ্ঞা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করা বা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। আর বিদ্বেষ মানে আনুগত্যের অভাব ও শত্রুতামূলক মনোভাব পোষণ করা। পুলিশকে আক্রমণ করে লেখাও এই ধারায় আসবে কারণ রাষ্ট্র পুলিশের মাধ্যমে তার কাজ সম্পাদন করে থাকে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে (আসলে সরকারের বিরুদ্ধে) কবিতা, নাটক প্রকাশ করা, পাঠ করা, অভিনয় করা এই ধারায় আওতায় আসে।
১৮২০ সালের এই আইনের একই ধারা বাংলাদেশেও দণ্ডবিধির ১২৪-ক হিসেবে বিরাজ করছে।
সরকারের আর একটি 'লিগাল ইনস্ট্রুমেন্ট' হচ্ছে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯-এ ধারা। সরকারের কাছে যদি প্রতীয়মান হয় কোনো পুস্তক, সংবাদপত্র বা অন্য কোনো প্রকাশনায় রাষ্ট্রদ্রোহসহ দণ্ডবিধির ১৫৩-এ, ১৯২, ১৯৫-এ, ৬০৫ ও ৫০৫-এ ধারার অপরাধে দণ্ডনীয় বিষয় রয়েছে কিংবা যা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর, কিংবা যা 'অশ্লীল, উত্তেজক ও সংহতি বিনষ্টকারী তা তল্লাসি ও বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা সরকারের রয়েছে।
দণ্ডবিধি ১৫৩-এ বিভিন্ন শ্রেণীর জনগণের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করা। দুই বছর সশ্রম বা বিনা শ্রম কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডই হতে পারে।
সাথে যোগ হয়েছে ১৯১০ সালের ইন্ডিয়ান প্রেস অ্যাক্ট-এর ১ অনুচ্ছেদের ৪ ও ১২ উপ অনুচ্ছেদ এবং ১৯৩০ সালের ইন্ডিয়ান প্রেস ইমার্জেন্সি পাওয়ার অ্যাক্টের ১৯-ধারা।
ফৌজদারি কার্যবিধি ৯৯-এ কতিপয় প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত ঘোষণা ও তল্লাশি পরোয়ানা জারি করা। সরকার যদি মনে করে প্রকাশনায় দণ্ডবিধি ১২৩-এ, ১২৪-এ, ১৫৩-এ, ১৯২, ১৯৫-এ, ৫০৫, ৫০৫-এ ধারার উপাদান রয়েছে, তখন প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত করার অধিকার রাখে।
বাংলার বইপত্র নিষিদ্ধকরণের দলিলপত্র
এই নিবন্ধের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্রিটিশ ভারতের বাংলায় বইপত্র নিষিদ্ধকরণ-সংক্রান্ত দাপ্তরিক চিঠিপত্র, টোকা, প্রজ্ঞাপন, আদেশ ও আইনকানুনের ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষান্তর। শিশির কর 'ব্রিটিশ শাসনে বাজেয়াপ্ত বাংলা বই' নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন। উদ্ধৃতি ও ইংরেজি টেক্সট বেশির ভাগ তার গবেষণা গ্রন্থ থেকেই নেয়া হয়েছে।
আলোচনার প্রথম নিষিদ্ধ বইয়ের নাম 'বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ও মোছলমানদের কর্ত্তব্য'; লেখক মাহম্মদ আশানুল হক আফেনদি। বইটি বাংলাদেশের রংপুর থেকে প্রকাশিত।
রংপুরের জেলা প্রশাসক এই বইয়ের আপত্তিকর ও প্ররোচনামূলক কিছু অংশ শনাক্ত করেন:
ক. কে এই দেশের মোছলমানদের হাত হইতে এছলামের ঝান্ডা ছিনাইয়া লইয়াছে?
খ. কে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে মোছলমানদের বিরুদ্ধে জঘন্য ষড়যন্ত্র করিয়াছে?
গ. ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট সমগ্র মানবজগতের মধ্যে এছলামকে যতটা ক্ষতিগ্রস্ত করিয়াছে, ইহার আগে কখনও কোনো জাতি বা দেশ উহাকে এইরূপ সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে নাই।
ঘ. এইরূপ কঠোর আততায়ী ও এছলামের যথাসর্বস্ব লুণ্ঠনকারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ।
ঙ. মোছলমানগণ। বলুন, সত্য কথা বলুন ইহারা কে? ভারতের ২২ কোটি হিন্দু না কংগ্রেস না ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট।
চ. কে এ দেশের মোছলমানদিগকে দীর্ঘ এক শতাব্দী পর্যন্ত দাবাইয়া রাখিয়া হিন্দু ভ্রাতাদিগকে উপরে চড়াইয়াছে?
(শিশির করের গ্রন্থ থেকে)
এ ধরনের কিছু প্রশ্ন রেখে জেলা প্রশাসক বাংলা সরকারের চিফ সেক্রেটারিকে যে চিঠি লিখেন, তা অনূদিত হচ্ছে:
মহোদয়
এই চিঠির সঙ্গে 'বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ও মোছলমানদের কর্ত্তব্য' শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রেরণ করে আপনার বিবেচনা ও আদেশের জন্য নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো উপস্থাপন করছি।
ভারতীয় দণ্ডবিধি ১২৪ এ ধারায় বর্ণিত অপরাধের আওতায় বিবেচনাধীন বইটির পুরোটাই পড়ে এবং লেখকও মুদ্রাকর উভয়কেই এই ধারার আওতায় দায়ী করা যায়। এই সিদ্ধান্ত পূর্ব গৃহীত যে ব্রিটিশ ভারতে গঠিত সরকার মানে ভারতে ব্রিটিশ শাসন, এর প্রতিনিধিত্বকারী রাজনীতিক ব্যবস্থা প্রশাসনিক বিধিবিধান থেকে যত স্বতন্ত্রই হোক, তা ব্রিটিশ ব্যবস্থা হিসেবেই গণ্য।
বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে এই পুস্তিকার সব কপি আটক করা হয়েছে এবং ছাপাখানা থেকে পাণ্ডুলিপিও উদ্ধার করা হয়েছে।সাম্প্রতিক মাসগুলোয় রংপুর জেলায় বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যন্ত প্রতিনিয়ত কৃষক সভা ও সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্থানীয় পরিস্থিতি পর্যালোচনায় আমি বুঝতে পারি জনগণের মনে উত্তেজনা সঞ্চার করার (৭৫ ভাগ মুসলমান) চেষ্টা করা হচ্ছে, তা এখনই শক্ত হাতে দমন করা প্রয়োজন।
কাজেই এ অবস্থায় নিচে সংযুক্ত তফসিল অনুযায়ী লেখা ও মুদ্রাকরের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধি ১২৩ এ এবং ১৫৩-এর বিধান অনুযায়ী আইনে সোপর্দ করার সদয় অনুমোদন প্রার্থনা করছি। এ বইটিকে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বিবেচনা করা যায়।
তফসিল
১. মোহম্মদ আশানুল হক আফেনদি, গ্রাম: সোনারাই, থানা: ডোমার, জেলা: রংপুর।
২. নিবারণ চন্দ্র চক্রবর্তী, নবাবগঞ্জ, রংপুর শহর, কালীকৃষ্ণ মেশিন প্রেসের মালিক।
৩. মুদ্রাকর(এখনো নিশ্চিত শনাক্তকরণ করা সম্ভব হয়নি)।
এই চিঠি পাওয়ার পর সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রাজনৈতিক মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত এডিশনাল সেক্রেটারি মিস্টার হিচিংস জেলা প্রশাসককে লিখেন:
প্রিয় খান বাহাদুর
আপনার ৩১ মার্চ ১৯৩৯-এর ২২২-সি নং পত্রের (উপরের পত্র) জবাবে আপনাকে জানাচ্ছি যে 'বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ও মোছলমানদের কর্তব্য' লেখক ও মুদ্রাকরের এবং ছাপাখানার মালিকের বিচারের জন্য আপনি যে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন, সরকার তা অনুমোদন করেছে। তবে আনুষ্ঠানিক আদেশ জারির জন্য নিচের তথ্যগুলো আবশ্যক, যা যত শীঘ্র সম্ভব পাঠাবেন:
১. মুদ্রাকরের নাম ও ঠিকানা
২. যে পুলিশ কর্মকর্তা এ মামলার তদন্ত করবেন, তার নাম।
৩. এ মামলায় বিচার কি আপনি নিজে করবেন, না কোনো স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট তা করবেন জানাবেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪ ধারা অনুযায়ী সরকার তাকে নিয়োগ দেবে।
আমি আপনাকে জানাতে চাই মুদ্রাকরের নাম পাওয়া না গেলে তার বিরুদ্ধে বিচারের আদেশ প্রদান করা সম্ভব হবে না।
১৮৬৭ সালের প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অব বুকস অ্যাক্ট-এর ৩ ধারায় বাধ্যতামূলক প্রকাশক ও মুদ্রাকরের নাম সংযোজন এই পুস্তিকায় করা হয়নি। এ অপরাধের দায়ে আপনি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবছেন কিনা জানাবেন।
স্বরাষ্ট্র দপ্তরের এডিশনাল সেক্রেটারির চিঠির জবাব:
গোপনীয়
আধা সরকারি পত্র নম্বর ৫২৭/সি
রংপুর জেলা অফিস
১৬ আগস্ট ১৯৩৯
প্রিয় মিস্টার হিচিংস
আপনার ২৬ জুলাই ১৯৩৯ তারিখের ১৬৫০ নম্বর পত্রে 'বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ও মোছলমানদের কর্তব্য' পুস্তিকার লেখক, মুদ্রাকর ও ছাপাখানার মালিকের বিচার-সংক্রান্ত আমার প্রস্তাবের জবাবে আমি কয়েকটি বিষয় উপস্থাপন করছি: প্রেস অ্যাক্ট-এর ১২ ধারায় ছাপাখানার মালিক নিবারণ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে এর মধ্যেই মামলা হয়েছে। ছাপাখানার মালিক বৃদ্ধ এবং পেশাগত দিক দিয়ে একজন পুরোহিত। তিনি অজ্ঞতাবশত এ কাজটি করেছেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের পুস্তিকা প্রকাশ করবেন না বলে অঙ্গীকারনামা দিয়েছেন।
মুদ্রাকরের নাম নিশ্চিত হওয়া গেছে, কিন্তু পুলিশ সুপার মনে করেন তার সাক্ষ্যের তেমন বস্তুগত গুরুত্ব নেই, সুতরাং মামলায় তাকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেননি।
এই পরিস্থিতিতে আমি আপনাকে অনুরোধ করছি ভারতীয় দন্ডবিধি ১২৪-এ এবং ১৫৩-এ ধারা অনুযায়ী কেবল লেখকের বিরুদ্ধে মামলার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন প্রদান করুন।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাবির উদ্দিন বিশ্বাস, এস আই অভিযোগকারী হিসেবে মামলার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
এই মামলার বিচার করার জন্য সদরের মহকুমা কর্মকর্তা রাজা সুরেন্দ্র নারায়ণ রায় বাহাদুরকে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪ ধারার স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা যেতে পারে।
এর পর পরই গভর্নরের আদেশক্রমে রাজা সুরেন্দ্র নাথ রায় বাহাদুর স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হলেন।
'বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ও মোছলমানের কর্তব্য' বাজেয়াপ্ত হলো।
প্রজ্ঞাপন
নম্বর ৪১৯৩, ৭ আগস্ট ১৯৩৯
১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৯১-এ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে গভর্নর হিজ ম্যাজেস্টি ব্রিটিশরাজের অনুকূলে 'বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ও মোছলমানদের কর্তব্য' শীর্ষক পুস্তিকাটি যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখান থেকে বাজেয়াপ্ত করবেন। সোনারাই, ডোমার রংপুরের মোহাম্মদ আহসানুল হক কর্তৃক লিখিত এবং কালীকৃষ্ণ মেশিন প্রেসে মুদ্রিত এই পুস্তিকাটিতে ব্রিটিশ ভারতে স্থাপিত সরকারের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ, বা অসন্তুষ্টি ও শত্রুতার অনুভূতি ছড়াবার মতো উপাদান রয়েছে। হিজ ম্যাজেস্টির প্রজাদের মধ্যেও অনুরূপ অনুভূতির সৃষ্টি করে, যা ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ১৫৩-এ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
তারপর লেখক মোহাম্মদ আশানুল হক আফেন্দিকে অভিযুক্ত হলেন।
প্রজ্ঞাপন
নম্বর ৪৬২০-পি
তারিখ: ৩১ আগস্ট ১৯৩৯
গভর্নর অবহিত হয়েছেন যে, গ্রাম সোনারাই, থানা: ডোমার, জেলা: রংপুরের মোহাম্মদ আশানুল হক আফেন্দি তার লেখা 'বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ও মোছলমানের কর্তব্য' নামে বই লিখে দন্ডবিধি ১২৪-এ এবং ১৫৩-এ ধারায় বর্ণিত অপরাধ করেছেন। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৯৬ ধারার বিধানবলে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর সাবিরউদ্দিন বিশ্বাসকে উক্ত অপরাধ কাজ করার অভিযোগে পুস্তিকার লেখক মুহাম্মদ আশানুল হক আফেন্দির বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হলো।
গভর্নরের আদেশক্রমে
বাংলা সরকারের সেক্রেটারি
স্বরাষ্ট্র দপ্তর (রাজনৈতিক)
আগস্ট ১৯৩৯।
তারপর ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসরণ করে লেখকের বিচার হলো। লেখককে দন্ডবিধি ১২৪-এ ও ১৫৩-এ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে মামলা পরিচালনা করা হলো। ৩১ মে ১৯৪০ মামলার রায় হলো। স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট সুরেন্দ্র নাথ রায় ইংরেজি পত্রযোগে সরকারকে অবহিত করলেন:
সাজার ব্যাপারে বলতে গেলে এটা অনস্বীকার্য যে অপরাধটি অত্যন্ত গুরুতর। একই সঙ্গে এটা স্মর্তব্য এটিই অভিযুক্ত ব্যক্তির করা প্রথম অপরাধ। তার সামাজিক মর্যাদা ভালো এবং একজন জোতদার। আমি মনে করি সবদিক বিবেচনা করে তাকে দেড় বছরের সশ্রম কারাদন্ড ১২৪-এ ধারায় দেড় বছর এবং ১৫৩-এ ধারায় দেড় বছর, যা একই সঙ্গে চলমান থাকা সমীচীন হবে বলে মনে করি।
সুতরাং তাকে ১৮ মাসের সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করলাম।
এই পুস্তিকার রচয়িতা আদালতের এ আদেশ মেনে কারাবরণ করেছেন কিনা না, কিংবা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন কিনা এর কোনো রেকর্ড গবেষক খুঁজে পাননি।
নবীনচন্দ্র সেনের ছেলের আবেদন
জানুয়ারি ১৯১৬ সাহিত্যিক নবীন চন্দ্রের ছেলে ব্যারিস্টার এন সি সেন রেঙ্গুন থেকে বাংলা সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের (রাজনৈতিক বিভাগ) সচিবকে বাবার বইপত্র নিয়ে যে চিঠি লিখেন, তা অনূদিত হলো:
মহোদয়
সম্মানের সাথে আমি আপনাকে অবহিত করছি যে আমার বাবা প্রয়াত নবীন চন্দ্র সেন প্রথম শ্রেণীর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, দীর্ঘ ৩৫ বছর বিশ্বস্ততার সাথে চাকরি করে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁকে বাংলাভাষার একজন প্রধান কবি বিবেচনা করা হয় এবং তার রচনাবলী বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত উঁচু স্থান অধিকার করে আছে।
আমি তাঁর একমাত্র সন্তান এবং রেঙ্গুনে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত রয়েছি। আমার অবস্থান কোলকাতা থেকে অনেক দূরে হওয়ায় আমার বাবার বইপত্রের প্রকাশনার ব্যবস্থা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই ধরনের সমস্যা হতে পারে তা অনুমান করে মৃত্যুর কয়েক মাস আগে আমার বাবা এই দায়িত্ব তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পুত্র বাবু শরৎ কুমার বসুকে প্রদান করে। বাবার বন্ধু শৈশব থেকেই তার সাথে ঘনিষ্ঠ। আট বছর আগে আমার বাবা প্রয়াত হন, তারপর থেকেই বাবু শরৎ কুমার বসু অত্যন্ত সদয় হয়ে আন্তরিকতার সাথে তার বই ছাপা, প্রকাশ করা এবং বাজারজাত করার ব্যবস্থা করে আসছেন।
সম্প্রতি আমার বাবার একটি বই 'প্রবাসের পত্র' পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। ১২৯৯ বঙ্গাব্দে প্রথম প্রকাশিত এই বই ২৪ বছর ধরে মুদ্রিত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে এবং বাজারে বিক্রি হচ্ছে। বর্তমান সংস্করণটি কেবলমাত্র পুনর্মুদ্রণ, এতে কোনো সংযোজন বা বিয়োজন ঘটেনি। কিন্তু আমি শরৎ কুমার বসুর কাছ থেকে জেনেছি কলকাতার পুলিশ কমিশনার তাকে ডেকে নিয়ে জানিয়েছেন যে সরকার এই বইয়ের কয়েকটি অনুচ্ছেদ আপত্তিকর বলে মনে করছে এবং তাকে সমস্ত অবিক্রীত কপি সরকারের কাছে সমর্পণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
বাবু শরৎ কুমার বসু প্রস্তাব করেন যে সব পৃষ্ঠায় আপত্তিকর বক্তব্য রয়েছে, তা ছিঁড়ে ফেলে সরকারের কাছে সমর্পণ করবেন এবং প্রয়োজনীয় অংশ ছেপে আবার বইয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করবেন। পুলিশ কমিশনার এ প্রস্তাবে রাজি না হলে তিনি অবশিষ্ট অবিক্রীত বই সমর্পণে সম্মতি জানান।
যেহেতু বাবু শরৎ কুমার বসু আমার পক্ষে আমার বাবার এই পত্রের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছেন এবং যেহেতু এগুলোর গ্রন্থস্বত্ব সম্পূর্ণভাবে আমারই, সেজন্যই পুলিশ কমিশনারের সাথে তার সাক্ষাতের বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন।
আমি সবিনয়ে আপনাকে জানাতে চাই, আমার বাবা যখন এই বইটি লিখেন তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ছিলেন এবং তখন তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত। সে সময় তার পক্ষে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ ছড়ানো কিংবা সরকারকে হেয় করে কিছু লেখা সম্ভব ছিল না এবং এতে ব্রিটিশ সরকারের সপ্রশংস অনুচ্ছেদ রয়েছে, ব্রিটিশ শাসনে ভারতে যে উপকার সাধিত হয়েছে এবং যে দীর্ঘ ও অবিচ্ছিন্ন শান্তি বিরাজ করছে, তিনি তার প্রশস্তি রচনা করেছেন।
যা-ই হোক এখন যেহেতু বইটির কিছু অনুচ্ছেদ অবাঞ্ছিত মনে করা হচ্ছে, তা আর বইয়ে ছাপা ঠিক হবেনা। আমি সেই অনুচ্ছেদগুলো বাদ দিতে এবং সরকার নির্দেশ অনুযায়ী তা প্রকাশ করতে আগ্রহী। আমি একান্ত ভাবে আশা করছি সরকার আমার প্রার্থনা কবুল করবেন এবং আমি বিশ্বাস করি এ রকম উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সাহিত্যকর্ম সরকার চিরদিনের জন্য মুছে ফেলতে চাইবে না।
আমার আবেদন যদি মঞ্জুর করা হয়, তাহলে আমি প্রস্তাব করব, বর্তমান সংস্করণ থেকে আপত্তিকর অংশ বাদ দিয়ে তা বিনষ্ট করার জন্য সরকারের নির্ধারিত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে এ অংশগুলো দেওয়া হবে এবং কিছু পাতা পুনর্মুদ্রণ করে এর সাথে সংযোজন করা হবে। আমি সবিনয়ে জানাতে চাই প্রচুর অলংকরণসহ বর্তমান সংস্করণটি ছাপাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে, যদি সব কপি ধ্বংস করা হয়, তাহলে বিশেষ আর্থিক ক্ষতি সাধিত হবে।
যদি আমার প্রস্তাব গ্রহণ না করা হয়, তাহলে আমাদের হাতে থাকা সব কপি সমর্পণ করতে প্রস্তুত থাকব। একই সঙ্গে যেহেতু বইটি বহু বছর ধরে বিরাজ করছে, এর কোন কোন অনুচ্ছেদে আপত্তিকর কোনো কিছু রয়েছে এমন ধারণা ছাড়াই পুনর্মুদ্রিত হয়েছে, আমি কি ক্ষতি পুষিয়ে দেবার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাতে পারি না?
যথাযথ সম্মান প্রদান পূর্বক
আপনার একান্ত বাধ্যগত ভৃত্য
এন সি সেন
ব্যরিস্টার-এট-ল
১নং বার স্ট্রিট
রেঙ্গুন
৬ জানুয়ারি ১৯১৬
কবি ও লেখক নবীন চন্দ্র সেন ১০ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৭ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের রাউজানে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক পাস করে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করেন। ২৩ জানুয়ারি ১৯০৯ সালে তার মৃত্যু হয়। তার রচনার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত পলাশীর যুদ্ধ। অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে আকাশ রঞ্জিনী, তিন খন্ডে মহাভারত ভানুমতি, প্রবাসের পত্র, আমার জীবন, অমিতাভ, খ্রিস্টের জীবন, ক্লিওপেট্রা, গীতা ও চন্ডি।
নবীন চন্দ্রের পলাশীর যুদ্ধ রচনায় নিষিদ্ধ হওয়ার বহু উপকরণ থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি, তবে এর আপত্তিকর অংশ স্কুলপাঠ্য গ্রন্থ থেকে বাদ দেয়ার জন্য বাংলা সরকারের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি নবীন চন্দ্রকে চিঠি দিয়েছেন। পলাশীর যুদ্ধ নাট্যাভিনয়ও আপত্তির মুখে পড়ে। তখন বলা হয় এ নাটক ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। কলকাতার পুলিশ কমিশনারের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ১৪ মার্চ ১৯৩২ এর মঞ্চায়ন নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়।
প্রবাসের পত্র নিয়ে গোয়েন্দা বিভাগের আপত্তি করা অনুচ্ছেদ থেকে কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত হলো:
ক. যে ইংরাজ মোগলের দয়াতে ভারতে বাণিজ্য করিতে আইসে, সে মোগলের সিংহাসনে বসিল। ময়ূর সিংহাসন নাদের শাহ লইয়া গিয়াছিল, দেওয়ান-আম আর দেওয়ান-খাস ব্রিটিশ সেনানিবাস হইল। ব্রিটিশ রাজত্ব ক্রমে বিস্তৃত হইয়া পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তৃত হইল। রণজিৎ সিংহের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হইল। ভারতের মানচিত্র লাল হইয়া গেল।
খ. প্রতিহিংসায় মত্ত ইংরাজরা তোপের দ্বারা সহস্র সহস্র নর-নারীকে জলমগ্ন করিয়া নিহত করেন। কেবল একপক্ষেই নৃশংসতার অভিনয় হয় নাই।
গ. তখন সেনাপতি হডসন এই শিশুদিগকে দিল্লিদ্বারের কাছে বন্দিভাবে লইয়া গিয়া, স্বহস্তে তাহাদিগকে গুলি করিয়া বধ করেন। ইংরেজ শাসনে তাদেরই বিরুদ্ধে এই সত্যভাষণ সরকারের পছন্দ হবার কোনো কারণ নেই।
বিষের বাঁশি, প্রলয়শিখা, চন্দ্রবিন্দু, ভাঙ্গার গান
বিষের বাঁশির রচয়িতা এবং প্রকাশক উভয়ই কাজী নজরুল ইসলাম।
বিষের বাঁশিতে কতটা বিষ আছে, তা প্রথম সরকারকে একটি ইংরেজি পত্রে অবহিত করলেন বাবু অক্ষয় কুমার দত্ত গুপ্ত। তিনি ছিলেন বেঙ্গল লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান। পাবলিক ইনস্ট্রাকশন বিভাগকে লেখা তার পত্রটি অনূদিত হলো। চিঠির তারিখ ২১ আগস্ট ১৯২৪।
মহোদয়,
কোনো এক কাজী নজরুল ইসলাম রচিত বিষের বাঁশি নামের ২১ আগস্ট ১৯২৪ বেঙ্গল লাইব্রেরিতে গৃহীত হয়, বইটি এই চিঠির সাথে সংযুক্ত করা হলো।
ইংরেজিতে অনূদিত অংশ (এতদসঙ্গে সংযুক্ত) প্রমাণ করে এই প্রকাশনা কেমন ভয়ংকর, আপত্তিজনক প্রকৃতির; লেখক তার বিপ্লবী অনুভূতির প্রকাশ করেছেন এবং তরুণদের বিদ্রোহ করতে এবং আইন অমান্য করতে প্ররোচনা দিচ্ছেন। অস্বচ্ছ ধারণার ওপর ভয়াবহ উদ্দেশ্য সাধন করতে বারংবার যেসব উত্তেজক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে রক্ত, স্বৈরাচার, মৃত্যু, আগুন, নরক, দানব ও বজ্রের মতো শব্দ। আমি এর সাথে যোগ করতে চাই যে এই লেখক আগেও একবার রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। তখন থেকে তিনি এ ধরনের লোকের সাথে যোগসাজশ রক্ষা করে চলেছেন। আমি সুপারিশ করছি অপরাধ তদন্ত বিভাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চকে এ প্রকাশনাটির দিকে দৃষ্টি দিতে বলা হোক।
এই পত্রের সাথে সংযুক্ত গ্রন্থটি কাজ শেষ হয়ে যাবার পর দয়া করে ফেরত দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
অক্ষয় কুমার দত্ত গুপ্তের সুপারিশ বিফলে যায়নি। ১৮ অক্টোবর ১৯২৪ পুলিশ কমিশনার মিস্টার টেগার্ট বাংলা সরকারের চিফ সেক্রেটারিকে লিখলেন:
মহোদয়
যথাযথ সম্মান জানিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯২৪ বাংলার পাবলিক ইনস্ট্রাক্টরকে লিখিত কাজী নজরুল ইসলামের 'বিষের বাঁশি'-সংক্রান্ত একটি পত্রের অনুলিপি আপনার কাছে পাঠাচ্ছি।
এই গ্রন্থের লেখক গত বছর ভারতীয় দন্ডবিধির ১২৪-এ ও ১৫৩-এ ধারায় শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি। ধূমকেতু রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় তার এক বছর সশ্রম কারাদন্ড হয়েছিল। এই বইয়ের যে বিষয়, কিছু অনূদিত অংশ থেকে তা স্পষ্ট করে দেয় যে এটি বিপজ্জনক ধরনের আপত্তিকর। তাই আমি বইটি অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করার সুপারিশ করছি।
২২ অক্টোবর ১৯২৪ চিফ সেক্রেটারি এ এন মোবারলের স্বাক্ষরে 'বিষের বাঁশি' বাজেয়াপ্ত করার আদেশ জারি হয় এবং তা গেজেটে ছাপা হয়।
এ আদেশের পরপর পুলিশ বই আটক করতে নেমে যায়। কলকাতার আর্থ পাবলিশিং হাউজ (কলেজ স্ট্রিট), ইন্ডিয়ান বুক ক্লাব (কলেজ-স্ট্রিট মার্কেট), কল্লোল পাবলিশিং (কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট), ডি এম লাইব্রেরি(কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট), বরেন্দ্র লাইব্রেরি (কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট), সরস্বতী লাইব্রেরি (রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট), বরেন্দ্র এজেন্সি (কলেজ স্ট্রিট), বাণী প্রেস (মদন মিত্র লেন) এই আটটি প্রতিষ্ঠানে হানা দিয়ে মোট ৪৪টি বিষের বাঁশি উদ্ধার করে।
এ রকম একটি মারাত্মক উসকানিমূলক বই লেখার অপরাধে কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কাজী নজরুল ইসলামকে ছয় মাসের কারাদন্ড দেন।
***
নজরুলের 'প্রলয় শিখা' নিষিদ্ধ হওয়ার ১৭ বছর পর ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ম্যাজিস্ট্রেট টি রক্সবারা এই গ্রন্থ রচনার জন্য ভারতীয় দণ্ডবিধি ১২৪-এ ধারার প্রমাণিত অপরাধে কাজী নজরুল ইসলামকে ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। নজরুল প্রলয় শিখার কেবল লেখকই নন, প্রকাশক ও মুদ্রাকরও।
চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল হয়।
হাইকোর্টে বিচারক ছিলেন জাস্টিস লর্ড উইলিয়ামস এবং জাস্টিস এস কে ঘোষ। ৩১ মার্চ ১৯৩৯ প্রকাশিত সংবাদ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় হাইকোর্ট চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বাতিল করে দেন এবং আসামি কাজী নজরুল ইসলামকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন।লেখক মুক্ত হলেও বই নিষিদ্ধই রয়ে গেল।
১৯৩৭ সালে 'ফনীমনসা' নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব যথারীতি চিফ সেক্রেটারির কাছে আসে এবং তিনি সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন এই বইয়ে ভারতীয় দন্ডবিধি ১২৪-এ এবং ফৌজদারি কার্যবিধি ৯৯ এ ধারায় মামলা রুজু করার পর্যাপ্ত উপাদান নেই।
১৯৬২ সালে 'সর্বহারা'র কৃষাণের গান, ধীবরের গান, রাজা-প্রজা, ফরিয়াদি ও সর্বহারা কবিতার জন্য এই বই বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করার এবং নজরুলকে ১২৪-এ ও ১৫৩-এ ধারায় বিচারের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কবি বেঁচে যান এবং তার কাব্যগ্রন্থও নিষিদ্ধ হওয়ার হাত থেকে রেহাই পায়।
রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ রুদ্রমহলের লেখক কাজী নজরুল ইসলামের বিচারের প্রস্তাব উত্থাপিত হলেও শেষ পর্যন্ত তা বেশি দূর এগোয়নি।
১৯৩৯ সালে স্বরাষ্ট্র দপ্তর বলল, বইগুলো (নজরুলের) আপত্তিকর এবং দেশদ্রোহমূলক। এসব বইয়ের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেয়া ঠিক হবে না।
এর মধ্যে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য হুমায়ুন কবীর ১০ মার্চ ১৯৩৯ কাউন্সিল অধিবেশনে কাজী নজরুল ইসলামের বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, চন্দ্রবিন্দু, প্রলয় শিখা ও যুগবাণী -এই পাঁচটি বইয়ের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি সরকার বিবেচনা করছে কি না জানতে চান।...
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, সরকার বইগুলোকে দেশদ্রোহমূলক বলে মনে করে।
হুমায়ুন কবীরের প্রশ্ন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নাড়া দেয়। মন্ত্রণালয় থেকে কলকাতার পুলিশ কমিশনার ২৭ আগস্ট ১৯৪০ লেখা হয়:
মহোদয়
আমি আদিষ্ট হয়ে জানাচ্ছি যে কাজী নজরুল ইসলামের কয়েকটি বইয়ের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের চলতি অধিবেশনে হুমায়ুন কবীরের প্রশ্নেরপরিপ্রেক্ষিতে বইগুলো পুনরায় পরীক্ষা করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।
এ অবস্থায় সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত (ক) বিষের বাঁশি (খ) প্রলয় শিখা (গ) চন্দ্রবিন্দু (ঘ) ভাঙ্গার গান বইগুলো স্বরাষ্ট্র বিভাগে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হলো। কাজ শেষ হয়ে যাবার পর বইগুলো ফেরত পাঠানো হবে।
অখন্ড বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হক ১৬ জানুয়ারি ১৯৪১ সালে তার পাঠানো একটি নোটে উল্লেখ করেন: মুসলমানরা অভিযোগ করছেন হিন্দু লেখকদের বাজে বইও নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে, কিন্তু মুসলমান লেখকদের বেলায় বৈষম্য তাদের অসন্তষ্ট করেছে।
২৫ মার্চ ১৯৪১ স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয় কাজী নজরুল ইসলামের বই সম্পর্কে সরকারের মতামত জানিয়ে দেয়:
আমরা ভাঙ্গার গান, প্রলয় শিখা এবং চন্দ্রবিন্দুর কপি সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছি। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয় আর বিবেচনা করা সমীচীন হবে না।
যুগবাণী ১৯২২ সালে এবং বিষের বাঁশী ১৯২৪ সালে নিষিদ্ধ হয়েছিল, উভয় গ্রন্থই রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বিবেচিত হয়েছে। এই মহাযুদ্ধের সময় এসব বইয়ের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান হয়ে উঠবে। অন্তত যুদ্ধের কারণে নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকুক।
স্বরাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের পরামর্শ মুখ্যমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হকও মেনে নিয়েছেন। নথিতে লেখা হয়েছে; মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন নেই। নথির কার্যক্রম বন্ধ করে বিষের বাঁশি গ্রন্থটি কলকাতা পুলিশ কমিশনারকে পাঠিয়ে দেয়া হোক।
লেখক, প্রকাশক, মুদ্রাকর অনভিপ্রেত কিছু লিখলে, প্রকাশ করলে, ছাপালে শাস্তি পেতে পারেন।
কিন্তু আপনাকে কেউ বই উৎসর্গ করলে এবং সেই বইয়ে আপত্তিকর, প্ররোচনামূলক ও রাষ্ট্রদোহের উপাদান থাকলে আপনিও ছাড় পাবেন না।
হীরালাল সেন 'হুঙ্কার' নামের কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেছিলেন। হুঙ্কার কবিকে প্রায় জেলে ঠেলে দিল। রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে খুলনার আদালতে এসে বললেন, এই উৎসর্গ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না।
মামলায় সাক্ষী হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে গেলেন।
পাদটীকা:
কোনো কবি বা কথাসাহিত্যিক বা নাট্যকার আপনাকে তার লেখা একটি বই উৎসর্গ করেছেন বলেই পুলকিত হবেন না, আনন্দে গদগদ হয়ে পড়বেন না। এমন সম্ভাবনা থাকলে লেখককে পান্ডুলিপি পাঠাতে বলুন। আগে পান্ডুলিপি পরীক্ষা করুন, ভেতরে কি আছে দেখুন। নতুবা যোগসাজসের দায়ে দুষ্কর্মের সহযোগী হিসেবে ফেসে যাবেন। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে গিয়েছিলেন, আপনার বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আপনার এবং লেখকের কললিস্ট চেক করে গোয়েন্দা পুলিশ প্রমাণ করে ফেলবে যে আপনাদের মধ্যে যোগসাজস রয়েছে। যদি তা না করতে পারে তাহলে আপনাকে কিংবা লেখককে কিংবা উভয়কে রিমান্ডে নেবে।
স্ট্যালিনের আমলের গল্পটা জানেন তো? স্ট্যালিনকে খোঁচা দেওয়া একটি লিফলেট ক্রেমলিনের রাস্তায় পাওয়া যায়। কী দুঃসাহস!
আদেশ হলো লিফলেটের লেখককে বের করা হোক। পুলিশ প্রধান তিন দিন সময় চাইলেন। দ্বিতীয় দিন স্ট্যালিন অগ্রগতি জানকে চাইলেন। পুলিশ প্রধান বললেন, সন্দেহভাজন একুশজন লেখককে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল, এখন পর্যন্ত কুড়ি জন দোষ স্বীকার করেছেন, একজন এখনও বাকী। তিনিও বাধ্য হবেন।
সুতরাং পান্ডুলিপি না দেখে উৎসর্গ কবুল করবেন না।