দুনিয়া বদলে দেওয়া বারোটি ম্যাপ
জুন, ২০১২। গুগলের একজন কর্মকর্তা ব্রায়ান ম্যাকক্লেন্ডন ঘোষণা করলেন, গুগল ম্যাপ আর গুগল আর্থ অ্যাপল আর ফেসবুক মানচিত্র সেবা কার্যক্রমের মার্কেটে যে অবদান রাখতে চায় তার চেয়েও অনেক মহৎ ও সুদূরপ্রসারী। ম্যাকক্লেন্ডনের এক ব্লগ পোস্টে এ বিষয়ে লেখার মধ্যে একটি বাক্য ছিলো : 'নিঁখুত মানচিত্রের অনুসন্ধান চির অশেষ'
"আমরা সারা পৃথিবীর একটা ব্যাপকতর মানচিত্র নির্মাণ করতে চাই —পাবলিক আর সকল স্তরের সম্ভাব্য সব ছবি নিয়ে (স্যাটেলাইট, এরিয়াল আর রাস্তার ছবি) এবং লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারীর যৌথ তথ্যের সাহায্যে। ' ম্যাকক্লেন্ডন লেখেন। 'সাহসী পথচারীদের পিঠে ক্যামেরা স্ট্যাপের সাহায্যে যুক্ত করে, ব্যবহারকারীদের মানচিত্রের তথ্য যাচাইয়ের কাজে যুক্ত করা, আর পুরো পৃথিবীর একটা থ্রি ডি মডেল তৈরি করা।' তিনি যুক্ত করেন, নিঁখুত মানচিত্র বানিয়ে তোলার এক ধাপ কাছে চলে এসেছে গুগল।
এটা প্রযুক্তির এক ধরণের চূড়ান্ত বিজয়, জেরি ব্রটন স্মিত হাসিতে বলেন, "সকল সংস্কৃতিই সব সময় বিশ্বাস করে এসেছে যে তাদের কাছে যে ম্যাপ আছে সেটিই সবচেয়ে আসল, নিঁখুত, স্বচ্ছ আর নৈর্ব্যক্তিক। ' লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির রেনেসাঁ স্টাডির অধ্যাপক ব্রটন লেখক উরি ফ্রিডম্যানকে জানান , 'সকল মানচিত্র সবসময়ই সাবজেক্টিভ। .... এমনকি এখন অনলাইনের ভৌগোলিক স্থানসংক্রান্ত মানচিত্র যা আপনাদের সকল মোবাইল ডিভাইস কিংবা ট্যাবে দেখেন আপনারা, গুগল এপল কিংবা যারাই বানাক, মানচিত্রগুলি প্রায়শই সাবজেক্টিভ। '
অন্য দিকে ভেবে দেখতে গেলে কোনো নিঁখুত মানচিত্র নেই - মানচিত্রগুলো নিছক ( কম বেশি) সময়ের কোনো একটা বিমূর্ত সময়ে পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া তুলে ধরে। তাঁর নতুন বই, 'বারোটি মানচিত্রে পৃথিবীর ইতিহাস' - বইটিতে ব্রটন মানচিত্রগুলো গ্রন্থিত করেছেন যে সেসব খুব সহজেই মানুষের ইতিহাসের কেন্দ্রীয় কালখণ্ড সম্পর্কে আমাদের জানতে সাহায্য করে ৷ ব্রটন বারোটি মানচিত্র নির্বাচন করে দিয়েছেন I আমরা সেসব নিয়েই কথা বলবো। পাঠক চাইলে তার বেছে নেওয়া মানচিত্র জুম করে দেখে নিতে পারবেন। আসুন, মানচিত্রের ইতিহাসের দিকে যাত্রা করি।
১. কার্টোগ্রাফি ফাউন্ডেশন : টলেমির জিওগ্রাফি (১৫০ খ্রিস্টাব্দ)
মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে মানচিত্র এঁকে যাচ্ছে। কিন্তু ক্লডিয়াস টলেমিই প্রথম গণিত আর জ্যামিতি ব্যবহার করে পৃথিবীর চেহারাটা মানচিত্রে ধরবার একটা কৌশল আবিষ্কার করেন একটা আয়তক্ষেত্র আর পরস্পরচ্ছেদী লাইনের মাধ্যমে। —পদ্ধতিটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর বাইজেন্টিয়ামে নতুন করে উঠে আসে এবং সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকটা পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়। এই আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসী গ্রিক স্কলারটি, হয়তো নিজে কোনোদিন মানচিত্র আঁকেননি, ইউরোপ এশিয়া আফ্রিকার আট হাজারের বেশি স্থানের অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ নিয়ে আলোচনা করেছেন ৷ উত্তর দিককে অবলম্বন করে মেডিটারেনিয়ান কেন্দ্রিক পৃথিবীর কথা ভেবেছেন যাতে আমেরিকা, অস্ট্রেলেশিয়া আর সাউদার্ন এশিয়া, ফার ইস্ট, প্রশান্ত মহাসাগর আর আটলান্টিক মহাসাগরের বেশির ভাগটার উল্লেখ নেই। ( আপনি দেখবেন ম্যাপের নিচের দিকে আফ্রিকা উঁকি দিয়ে এশিয়ার সাথে মিশে যাচ্ছে৷)। ব্রটন বলেন, টলেমির ভুগোলবিদ্যা মূলত দেড় হাজার বছরের উত্তরাধিকার ৷
২. সাংস্কৃতিক বিনিময় : আল ইদ্রিসির বিশ্ব মানচিত্র ( ১১৫৪)
আল - শরীফ আল -ইদ্রিসি, আল - আন্দালুসের একজন মুসলমান, নর্ম্যান রাজা দ্বিতীয়ের হয়ে কাজ করতে সিসিলি যান। আরবী ভাষী এক ভৌগোলিক গাইড তৈরি করেন তিনি যাতে ইহুদী, গ্রিক, খ্রিস্টিয়ান আর ইসলামী ট্রাডিশন সম্পর্কে উল্লেখ ছিলো। এই গাইডে দুটি মানচিত্র ছিলো : উপরের দিকে ছোটো, চতুষ্কোণ একটি এবং সত্তরটি পরস্পর সংযুক্ত আঞ্চলিক মানচিত্র। সেই সময়ের প্রাচ্যকেন্দ্রিক খ্রিস্টীয় মানচিত্রের বদলে, আল ইদ্রিসির মানচিত্র মুসলিম মানচিত্র নির্মাতাদের অনুসরণে দক্ষিণ দিকটাকে সবার উপরে রেখেছেন।
মুসলিম মানচিত্রনির্মাতারা যেহেতু মক্কা দক্ষিণে, ধরে নিতেন ( আফ্রিকা হলো উপরের দিকে চন্দ্রাকৃতি ভূমি আর আরবীয় পেনিনসুলা এর কেন্দ্রে) টলেমির চেয়ে আলাদা ইদ্রিসি, জলপথে ভ্রমণপ্রতিম এক আফ্রিকার বিবরণ দিয়েছেন, নীল সাগর সারা দুনিয়াকে আবৃত করে আছে। শেষ পর্যন্ত মানচিত্রটি বাস্তবিক ভৌগোলিক উপস্থাপনা আর ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ - গণিত কিংবা ধর্মের নয়। ব্রটন বলেন, 'তাঁর মানচিত্রে কোনো দানব নেই। '
৩. খ্রিস্টীয় বিশ্বাস : হেরেফোর্ডের মাপ্পা মুন্ডি ( ১৩০০)
ইংল্যান্ডের হেরেফোর্ড ক্যাথেড্রাল থেকে নেয়া মানচিত্রটি বিষয় মধ্যযুগীয় খ্রিস্টানদের কাছে পৃথিবীটা কেমন দেখাতো সেটা বলা - ব্রটন জানান দেন আমাদের।
মানচিত্রটি সংগঠিত করে তোলার নিয়ম ছিলো সময়, বিশেষত বাইবেলের সময়, স্থান নয়। যীশু পৃথিবী ব্যাপ্ত করে ভ্রমণশীল, দর্শকেরা উপরে ইডেনের উদ্যান থেকে একেবারে নিচের জিব্রালটার প্রণালীর কাছে হারকিউলিসের স্তম্ভের কাছে মানসভ্রমণ করতে পারবেন। (বিশদ ভ্রমণের জন্যে এই সহজে বহনযোগ্য গাইডে মানচিত্রের সীমান্তরেখা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন)। জেরুজালেমের কেন্দ্র, যীশুর ছবিসম্বলিত একটি ক্রুশ দিয়ে চিহ্নিত করা আর আফ্রিকার ডানে। আফ্রিকার তটরেখার মার্জিন কিছু উদ্ভট দানব বিন্দু দিয়ে চিহ্নিত । ব্রটন বুঝিয়ে বলেন আমাদের, 'একবার ঐ কিনারায় পৌঁছালে টের পাবেন ওসব বিপজ্জনক এলাকা ।'
৪. সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি : ক্যুন কুনের ক্যাংনিডো ম্যাপ ( ১৪০২)
ক্যুন কুনের নেতৃত্বে এক দল নক্ষত্রবিজ্ঞানীর নকশা করা এই কোরীয় ম্যাপের সবচাইতে বিস্ময়কর বিষয় হলো, উত্তর এটির উপরের দিক হিসেবে চিহ্নিত। 'এই মানচিত্র আশ্চর্য করে কেন না আমাদের কাছে পাশ্চাত্য মানচিত্র হিসেবে পরিচিত প্রথমটি ১৪০২ খ্রিস্টাব্দে প্রাপ্ত কোরিয়ার মানচিত্রটি ' – ব্রটন তথ্যটি নথিভুক্ত করেন। তিনি টিপ্পনী কাটেন, সেই সময়ে ঐ অঞ্চলের শক্তি রাজনীতির নমুনা এই মানচিত্র ।
'দক্ষিণ এশিয়া আর চৈনিক সাম্রাজ্যবাদী আদর্শ অনুযায়ী, আপনি সম্রাটকে সম্মান নিবেদন করতে উত্তরদিকে তাকাবেন আর তিনি প্রজার দিকে তাকাবেন দক্ষিণ দিকে।' ব্রটন বোঝান আমাদের। ইউরোপ হচ্ছে ' অতি ক্ষুদ্র, বর্বর কলংকের দাগ' উপরের বাম দিকে, নিচে জলপথে ভ্রমণপ্রতিম আফ্রিকা (অবশ্য আফ্রিকার মাঝখানে অন্ধকার ছায়া হ্রদ না মরুভুমি বোঝাচ্ছে সেটি স্পষ্ট নয়) আরবীয় উপদ্বীপ আফ্রিকার ডানদিকে। ভারত প্রায় অদৃশ্য। চীন মানচিত্রের কেন্দ্রে বিশালাকৃতি বিন্দু, এর ডানদিকে কোরিয়ার সাথে অসমঞ্জসভাবে বড়ো দেখাচ্ছে। জাপানের আইল্যান্ড নিচের ডানদিকে।
৫. স্থানিক আবিষ্কারের অনুসন্ধান : ভাল্ডসীমুলার্সের ইউনিভার্সালিস কসমোগ্রাফিয়া (১৫০৭)
জার্মান মানচিত্রনির্মাতা মার্টিন ভাল্ডসীমুলারের এই কাজটি বিশ্বের সবচেয়ে মচল্যবান মানচিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ ব্রটন জানান এটি 'আমেরিকার জন্মসনদ'। গুরুত্বের কারণে লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস এক জার্মান প্রিন্সের কাছ থেকে দশ মিলিয়ন ডলারে মানচিত্রটা কেনেন। এই মানচিত্রেই প্রথমবার প্রশান্ত মহাসাগর আর আলাদা মহাদেশ হিসেবে 'আমেরিকা'কে চিহ্নিত করা যায়।
আমেরিকা নামটি ভাল্ডসীমুলার তখনো জীবিত আমেরিগো ভেসপুচ্চির নামানুসারে রেখে সম্মান জানান। উল্লেখ্য, ভেসপুচ্চিই প্রথম আমেরিকাকে স্বতন্ত্র ভূখণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করেন।(ভেসপুচ্চি আর টলেমির মানচিত্রের উপরে আবির্ভাব ঘটে।(মানচিত্রটিতে বারোটি কাঠের টুকরো আছে। এখানে ইউরোপীয় আবিষ্কারকদের অনেক সাম্প্রতিক আবিষ্কারের উল্লেখ আছে। আপনি টের পাবেন কাঠের মিস্ত্রিকে শেষ মুহূর্তে কেপ অফ গুড হোপের জন্য জায়গা তৈরি করতে হয়েছিলো। 'এই হলো সেই সময় যখন পৃথিবী সম্প্রসারিত হচ্ছে আর সকল আবিষ্কার অল্প সময়ের ব্যবধানে ঘটে যাচ্ছে।' – ব্রটন বলেন ।
৬. রাজনৈতিকীকৃত ভুগোল : রিবিয়েরোর পৃথিবীর মানচিত্র ( ১৫২৯ )
পতুর্গীজ মানচিত্রবিশারদ ডিয়োগো রিবিয়েরা মালাক্কা নিয়ে স্পেন আর পতুর্গালের তিক্ত বিবাদের মধ্যে এই মানচিত্র প্রস্তুত করেন। মালাক্কা হচ্ছে এখনকার ইন্দোনেশিয়ার একটা দ্বীপমালা, এটি মশলাবাণিজ্যের কেন্দ্র ছিলো (১৪৯৪ সালে, এই দুই দেশ দুনিয়ার নতুন আবিষ্কৃত ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিত করে একটি চুক্তি সম্পাদিত করে)। ১৫২২ সালে ফার্দিনান্দ ম্যাগেলানের প্রথমবার জলপথে বিশ্বভ্রমণের পর, রিবিয়েরো স্প্যানিশ রাজার কর্মী,'মশলা দ্বীপ' ইচ্ছে করেই ভুলভাবে তাঁর নির্মিত বৈজ্ঞানিক মানচিত্রে স্প্যানিশ অর্ধাংশের ঠিক পাশে রাখলেন। রিবিয়েরো হয়ত জানতেন এই দ্বীপমালার (মানচিত্রের একদম ডান আর বাম দিকে দেখা যাবে) আসল মালিক পতুর্গাল কিন্তু তিনিএটাও মাথায় রেখেছিলেন পয়সাটা কার পকেট থেকে আসছে। ব্রটনের মতে,'রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত মানচিত্রের এটি সেরা উদাহরণ।
৭. স্থানিক নৌচালনবিদ্যা : মেরকাতরের বিশ্ব মানচিত্র ( ১৫৬৯ )
ব্রটন বলেন, টলেমির পরে, গেরারডিউস মেরকাতর হচ্ছেন ম্যাপ নির্মাণের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ফ্লেমিশ জার্মান এই মানচিত্রশিল্পী একটা সমান কাগজের টুকরোতে পৃথিবীর উপরিতলের বক্রতা অনুকরণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, একটা সোজা লাইনে লিসবন থেকে আমেরিকার পশ্চিম সমুদ্রতীরবর্তী উপকূলে চলে যাবেন এবং দিকচিহ্নের নিশানাও ঠিক রাখবেন।
মেরকাতর, লুথেরান প্রচল ধর্মমতের বিরুদ্ধ মত পোষণ করায়, ক্যাথলিক কর্তৃপক্ষের দ্বারা কারারুদ্ধ হন। তিনি ইউরোপীয় অভিযাত্রিকদের জন্যে এই মানচিত্র অঙ্কন করেন। কিন্তু ব্রটন মনে করেন, এটার আরো বড়ো উদ্দেশ্য ছিলো। 'আমার ধারণা এটি বৈরাগ্য দর্শন আর শ্রেষ্ঠতা সম্পর্কিত মানচিত্র।' তিনি বলেন,'আপনি যদি দুনিয়াটাকে কয়েক হাজার মাইল উপর থেকে দেখেন, এসব রাজনৈতিক আর ধর্মীয় যাপনের বিভাজনের দিকে তাকান, আপনি ছুটতে থাকা পিঁপড়েদের মতো ছোটোটি।' মেরকাতর ইউরোকেন্দ্রিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন, এই মানচিত্র নির্মাণের পর যা কি না এখনো নানা কারণে ব্যবহৃত হয়। আপনি যতই নিরক্ষবৃত্ত থেকে উত্তর বা দক্ষিণের অঞ্চলে সরতে থাকবেন অঞ্চলগুলো বিকৃত আকার ধারণ করে। ব্রটন এই দৃষ্টিকোণ উড়িয়ে দেন, যুক্তিহিসেবে বলেন, ইউরোপ তো এমনকি মানচিত্রটির কেন্দ্র নয়।
৮. বাণিজ্যিক মানচিত্রাঙ্কনবিদ্যা : ব্লেইউয়ের অ্যাটলাস মেজর ( ১৬৬২ )
ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মী জোয়ান ব্লেইউ সহস্রাধিক পাতায় শত শত বারোক মানচিত্রের এক মানচিত্রসমবায় প্রস্তুত করেন। 'তিনি হলেন ঐতিহ্যের শেষ সন্তান: প্রকৃত একক, মেধাবী, জাদুকরপ্রতিম এক মানচিত্রনির্মাতা। তিনি একবার বলেছিলেন,'আমি জাদু দিয়ে পুরো দুনিয়া আপনাকে দেখাতে পারি।'
ব্রটন বলেন, 'সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিগুলো দুনিয়ার প্রতিটি কোণা, ঘুপচির মানচিত্র তৈরি করতে চাইছিলো অজস্র অনামা কর্মীদলের সাহায্যে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে।' ব্লেইউয়ের বাজার- কেন্দ্রিক মানচিত্র সর্বাধুনিক ছিলো না। কিন্তু তিনি মানচিত্র নির্মাণে টলেমির ঐতিহ্য থেকে সরে আসেন মহাবিশ্বের কেন্দ্রে দুনিয়াকে রেখে। মানচিত্রের একদম উপরে তখন পর্যন্ত জ্ঞাত পাঁচটি গ্রহের কেন্দ্রে সূর্য, কোপার্নিকাসের বিশ্ববীক্ষায় এক ধরণের নতজানু প্রণাম। এমনকি পৃথিবী দুই গোলার্ধে বিভক্ত, মানচিত্রের কেন্দ্রে অবস্থান করে, টলেমির চেয়ে আলাদা হয়েই।(টলেমি উপরের দিকে বামে আর কোপার্নিকাস উপরের ডানে)। 'ব্লাউ নিরবে, সাবধানে বলেন, আমার মনে হয় কোপার্নিকাস হয়তো ঠিক।' ব্রটনের মতামত।
৯ . জাতীয় মানচিত্রায়ণ : কাসিনির ফ্রান্সের মানচিত্র ( ১৭৪৪ )
লুই চতুর্দশের আমল থেকে শুরু, চার প্রজন্ম ধরে কাসিনি পরিবার দেশের প্রতিটি ইঞ্চি মেপে চিত্রায়িত করবার প্রথম পদক্ষেপ নেন। কাসিনিরা ত্রিকোণমিতির বিজ্ঞান ব্যবহার করে প্রায় দুইশো স্থানবৃত্তান্ত সম্পর্কিত মানচিত্র প্রণয়ন করেন। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ফরাসি বিপ্লবীরা এই মানচিত্রগুলো জাতীয়করণ করেন। ব্রটনের মতে এই হলো,'আমরা জাতীয় রাষ্ট্রিক মানচিত্র বলতে যা বুঝি তার জন্ম, আগে মানচিত্র নির্মান ছিলো ব্যক্তির কাজ। এখন অবশ্য গুগল যুগে তা আবার ব্যক্তি হাতে এসে পড়েছে।'
১০. ভূরাজনীতি : ম্যাককিন্ডারের ইতিহাসের ভৌগোলিক কেন্দ্র ( ১৯০৪ )
ছোটো লাইন ড্রইং এর বিনয় দেখে বোকা হবেন না – ব্রটন সতর্ক করেন আমাদের। 'রাজনীতিতাড়িত হয়েই ভৌগোলিক ব্যাপারগুলোর উদয় ও অস্ত – এই সার বক্তব্য বোঝাতেই এই সরল অঙ্কনের সৃজন।'ইংরেজ ভুগোলবিদ এবং পুঁজিপতি হ্যালফোর্ড ম্যাককিন্ডার ড্রইংটা একটা কাগজে যুক্ত করে তর্ক করেন যে রাশিয়া আর সেন্ট্রাল এশিয়া বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্র। ব্রটন এই ধারণায় বিশ্বাসী – নির্দিষ্ট কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক নেতৃত্বে ভাষান্তরিত হতে পারে। চিন্তাটি নাজিদের থেকে শুরু করে জর্জ অরওয়েল, এমনকি হেনরি কিসিঞ্জারকেও প্রভাবিত করেছিলো।
১১ . জিওঅ্যাকটিভিজম: পিটারের প্রজেকশন ( ১৯৭৩)
১৯৭৩ সালে, ডানপন্থী জার্মান ঐতিহাসিক আর্নো পিটার্স মেরকাতরের ইউরোকেন্দ্রিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত মানচিত্রের এক বিকল্প উন্মোচন করেন: একটি বিশ্ব মানচিত্র যেখানে প্রতিটি দেশ আর মহাদেশ তাদের সত্যিকারের উপরিতলের আয়তন দিয়ে বর্ণিত হবে।
এই কারণে প্রত্যাশার চেয়ে ছোটো উত্তর মহাদেশসমূহ, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার উদয় ব্রটনের ভাষায়, 'দীর্ঘ, লম্বা স্ফীত অশ্রু বিন্দুর মতো। 'সমান এলাকা'-র প্রজেকশন স্কটিশ পুরোহিত জেমস গলের আগের নকশার সাথে প্রায় আইডেন্টিক্যাল। প্রেস আর এন জিও ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিলো। কিন্তু ক্রিটিকরা তর্ক করেন গোলাকার উপরিতলের যে কোনো প্রজেকশন সমান উপরিতলে ঘোট পাকাবে। পিটার্স নানারকম গুরুতর গাণিতিক ভুল করে তর্ক উশকে দেন। 'কোনো মানচিত্রই অন্যটির চেয়ে খারাপ নয় । আসল কথা হলো, নির্মাতার উদ্দেশ্য ।'
১২. ভার্চুয়াল ম্যাপিং: গুগল আর্থ ( ২০০৫)
গুগল হচ্ছে ডিজিটাল ম্যাপনির্মাতাদের রীতিমত অধিনায়ক - ব্রটন বলেন ।
তিনি এটিও নোট করে রাখেন যে কোম্পানিগুলো মানচিত্রকে অনুসন্ধান আর বিজ্ঞাপনের উপায় হিসেবে ভাবছে 'আমার প্রশ্ন হচ্ছে ম্যাপে কি পাওয়া যাবে, কে ম্যাপ পেতে পয়সা দিচ্ছে আর কে দিতে পারছে না বলে মানচিত্রে অসনাক্ত থেকে যাচ্ছে? ষ' তিনি জিজ্ঞেস করেন 'আমাদের সময় যে ধরণের ম্যাপ ডিজার্ভ করে আমরা তাই পাবো।' – এই হচ্ছে ব্রটনের উপসংহার ।
(উরি ফ্রিডম্যানের নিবন্ধের অনুবাদ)