দুনিয়া জুড়ে বসতি যাদের
শত শত বছর ধরে জিপসি সম্প্রদায়ের আদি ইতিহাস রহস্যে ঘিরে আছে। আজ এখানে তো কাল আন্য কোথাও হারিয়ে যাওয়া এই বিচিত্র স্বভাবের শ্যাম বর্ণের যাযাবর গোষ্ঠীটি স্থায়ী বসতিস্থাপনকারী মানুষের কৌতূহল জাগিয়ে এসেছে। বহু লেখকই এই হেঁয়ালির উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিচিত্র ধরনের তত্ত্ব খাড়া করেছেন। এইসব তত্ত্ব আবার প্র্রায়শই কষ্টকল্পনা হতে দেখা গেছে।
বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ইতিমধ্যে হেঁয়ালির উত্তর যোগালেও উনিশ শতকেও অকল্পনীয় সব কল্পকথার জন্ম দেওয়া হচ্ছিল। জিপসি সম্প্রদায়ের ভাষা নিয়ে নিবিড় গবেষণার সামনে এইসব বুদ্ধিদীপ্ত অথচ নাজুক ধারণা টিকতে পারেনি। রেনেসাঁর সময় থেকেই এই ভাষা নিয়ে পণ্ডিতদের কিছু চিন্তাভাবনা ছিল। তবে তারা একে কোনো ভাষিক গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত করেননি, বা এর উৎসস্থান শনাক্ত করেননি। আঠারো শতকের শেষে অবশ্য পণ্ডিতরা বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ভিত্তিতে জিপসিদের উৎস নির্ধারণ করতে পেরেছিলেন।
সেই থেকে নাম করা ভাষাবিদরা আদিকালের পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকে নিশ্চিত করে এসেছেন। জিপসি সম্প্রদায়ের ভাষার ব্যাকরণ এবং শব্দভাণ্ডার সংস্কৃত এবং জীবিত ভাষা কাশ্মিরি, হিন্দি, গুজরাতি, মারাঠি এবং নেপালি ভাষার কাছাকাছি।
আধুনিক পণ্ডিতরা এখন জিপসিদের আদিনিবাস ভারত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সংশয় প্রকাশ করছেন না, তবে তাদের জাতি সত্তা, সামাজিক শ্রেণী এবং প্রাচীনতম অভিবাসনকাল সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার মীমাংসা এখনও বাকি রয়ে গেছে। ভাষাগত দিক থেকে পণ্ডিতররা জিপসিদের আদি উৎস বের করতে পেরেছেন, তবে নৃবিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং জাতিবিজ্ঞানেরও অবদান রাখার প্রয়োজন রয়েছে।
যে সময়টিকে 'জিপসিদের অদি ইতিহাস' হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে সেই সময়কাল সংক্রান্ত দলিলপত্রের সংখ্যা ভীষণ সীমিত। প্রাচীন ভারতীয় লেখকরা কেবল দেবদেবী এবং রাজরাজড়াদের ব্যাপারেই বেশি কৌতূহলী ছিলেন; জোত, অর্থাৎ জাত, লুলি, নুরি কিংবা ডোম সম্প্রদায়ের দিকে কচিৎ নজর দিয়েছেন তারা। মূলত দুটো ফারসি টেক্সটের সুবাদে এই গোত্রটির পশ্চিমমুখী প্রথম অভিবাসন কাল থেকে শুরু করে আমাদের হাতে জিপসিদের সম্পর্কে অনেক বেশি নির্ভুল তথ্য রয়েছে। অবশ্য এ দুটি টেক্সটে ইতিহাস ও কিংবদন্তী মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। দশম শতকের মাঝামাঝি সময়ের লেখক ইস্ফাহানের হামজা পার্সিয়ায় ১২ হাজার জোত বাদক হাজির হওয়ার কথা লিখেছেন।
এর অর্ধ শত বছর পর এই একই গল্প শাহনামার রচয়িতা ফার্সি ইতিহাস লেখক এবং কবি ফেরদৌসি আবার উল্লেখ করেছেন। গল্পটি ব্যাপকভাবে কিংবদন্তীসুলভ হয়ে থাকতে পারে, তবে এটি আমাদের ভারত থেকে আসা আগেই বাদক হিসাবে উল্লেখ করা বহু জিপসির পার্সিয়ায় থাকার কথা জানায়। কৃষিকাজে অনীহ, যাযাবরসুলভ এবং অনেকটা চৌর্যবৃত্তিতে অভ্যস্ত ছিল তারা। গোটা এশিয়া জুড়ে জিপসি সম্প্রদায়ের ঘুরে বেড়ানো সম্পর্কে এই দুটোই একমাত্র টেক্সট। এই গল্পটিকে ভাষা সংক্রান্ত প্রমাণের সাহায্যে জোরালো করে তোলা যেতে পারে।
পারস্যে জিপসিরা এমন সব শব্দে তাদের শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছিল যেগুলো পরবর্তী সময়ে সকল ইউরোপিয় ভাষায় পাওয়া গেছে। এরপর, ব্রিটিশ ভাষাবিদ জন স্যাম্পসনের মতে, এরা দুটি শাখায় ভাগ হয়ে যায়। কেউ কেউ দক্ষিণপুবে যাত্রা অব্যাহত রাখে; অন্যরা উত্তরপশ্চিমে চলে যায়।
শেষের এই দলটি আর্মেনিয়া হয়ে (এখানে ওরা সেই ওয়েলস অবধি টিকে থাকা কিছু শব্দ আয়ত্ত করে যেগুলো প্রথম গোষ্ঠীদের অজানা ছিল) ককেসাস পার হয়। এখানে ইরানের ওসেটিয়ার ক্ষুদ্রজনগোষ্ঠি ওসেটিয়ানদের ওসেটস ভাষা থেকে শব্দ ধার করে ওরা। সবশেষে হাজির হয় ইউরোপীয় বাইজান্টিনিয় বিশ্বে। এরপর থেকে জিপসিদের উল্লেখ আছে, এমন টেক্সট, বিশেষ করে পবিত্র ভূমির উদ্দেশ্যে পথে নামা পাশ্চাত্য পর্যটকদের ভ্রমণ কাহিনীর সংখ্যা অনেক বেড়ে ওঠে।
১৩২২ সালে দুজন ফ্রায়ার মাইনর সাইমন সিমিওনিস এবং হিউ দ্য এনলাইটেন্ড ক্রিটে একটি জনগোষ্ঠেীর উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন, এদের হাম গোত্রের সদস্য মনে করা হতো। গ্রিক অর্থোডক্স আচার পালন করতো এরা এবং আরবদের মতো তাঁবু বা গুহায় বাস করতো। গ্রিসে বাদক ও গণকদের এক গোষ্ঠীর নামে আটকিঙ্গানোস বা আটসিঙ্গানোস হিসাবে পরিচিত ছিল এরা। মোরিয়ার সুরক্ষিত শহর এবং পশ্চিম উপকূলের অন্যতম প্রধান বন্দর মোদান ভেনিস থেকে জাফ্ফা অবধি যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এখানেই পশ্চিমা পর্যটকরা জিপসিদের বেশি দেখেছেন। 'ইথিওপিয়দের মতো কৃষ্ণাঙ্গ,' এরা পেশায় সাধারণত কামার ছিল এবং কুড়ে ঘরে থাকতো। সম্ভবত নীল বদ্বীপের মতো উষর এলাকায় উর্বর ভূমি হওয়ায় জায়গাটা 'লিটল ঈজিপ্ট' নামে পরিচিত ছিল।
এ জন্যেই ইউরোপের জিপসিরা ঈজিপশিয়ান, গিতান্স, বা জিপসি হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। এদের প্রধান বা সর্দারদের প্রায়ই লিটল ঈজিপ্টের ডিউক বা কাউন্ট বলে উল্লেখ করা হতো।
জিপসি গোষ্ঠীর নতুন শব্দ সংগ্রহের একটা উৎস ছিল গ্রিস, তবে সবার উপরে ক্রিশ্চান বিশ্বের সকল দেশ থেকে আগত অগুনতি তীর্থযাত্রীর উপস্থিতি ওদের সামনে জীবনযাপনের নতুন পথ তুলে ধরেছিল। তীর্থযাত্রীরা সুবিধাপ্রাপ্ত পর্যটকের মর্যাদা ভোগ করে বুঝতে পেরে জিপসিরা আবার পথে নামার সময় নিজেদের তীর্থযাত্রী বলে চালিয়ে নিতে সক্ষম হয়। গ্রিস এবং রোমানিয় প্রিন্সিপালিটি এবং সাইবেরিয়ার মতো বিভিন্ন প্রতিবেশি দেশে দীর্ঘ দিন অবস্থানের পর বহু জিপসি পশ্চিম যাত্রা অব্যাহত রাখে। যেসব প্রদেশ নিয়ে বাইজান্টাইন এবং তুর্কী সেনাবাহিনী লড়াই করেছে এবং দখল-পুনর্দখল করেছে, সেখানে এদের অবস্থা সুবিধাজনক ছিল না।
অভিবাসনের সময় তাদের রচিত বিবরণে আধ্যাত্মিক বা জাগতিক কর্তৃপক্ষের আস্থা পাওয়ার প্রয়াসে এমন অবস্থার সত্যতার প্রমাণ মিলতে পারে। মিশর ছেড়ে আসার পর গোড়ার দিকে পৌত্তলিক এবং পরে ক্রিশ্চান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে আবার পৌত্তলিকতায় ফিরে ফের রাজন্যদের চাপে ক্রিশ্চান হওয়ার কাহিনী বয়ান করেছে ওরা। বলেছে সারা দুনিয়ায় দীর্ঘ তীর্থযাত্রা করার জন্যে ওদের উপর বল প্রয়োগের কথা।
১৪১৮ সালে বড় আকারের বিভিন্ন দল হাঙ্গেরি ও জার্মানি হয়ে অভিযাত্রা করে, এখানে সম্রাট সিগমুন্ড তাদের নিরাপত্তা চিঠি দিতে রাজি হন। ওয়েস্টফিলিয়া, উত্তরের মুক্ত শহর এবং বাল্টিক উপকূলে হাজির হয়ে আরও একবার দক্ষিণে বাঁক নিয়ে সুইটযারল্যান্ডে পা রাখার আগে লিপজিগ এবং ফ্র্যাঙ্কফুর্ট আম-মেইনে পৌঁছায়।
১৪১৯ সালে বর্তমান ফ্রান্সের সীমানা পেরোয় এরা। এটা বিদিত যে এরা শ্যাটিলন-এন-ডুম্বসে ২২ শে আগস্ট, দুদিন পরে ম্যাকনে এবং ১ লা অক্টোবর সিস্টেরনে সম্রাট এবং ডিউক অভ স্যাভয়ের পাসপোর্ট দেখিয়েছিল। তিন বছর পর অন্যান্য দল আরাসের নাগরিকদের বিস্ময় জাগিয়ে লো কান্ট্রিজ সফর করে।
কিন্তু ম্যাকনের মতো এখানে ওদের জানিয়ে দেওয়া হয় যে ওরা রাজার রাজত্বে অবস্থান করায় সম্রাটের তরফ থেকে দেওয়া প্রতিরক্ষার চিঠির কোনো মূল্য নেই। ক্রিশ্চান বিশ্বে মুক্তভাবে সফর করতে হলে পোপের কাছ থেকে সর্বজনীন বৈধতা থাকার প্রমাণের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারে ওরা।
১৪৯২ সালের জুলাই মাসে ডিউক আন্দ্রে পোপের সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন ঘোষণা দিয়ে এক বিরাট সফর সঙ্গী নিয়ে বোলোগনা এবং ফোর্লি হয়ে এগিয়ে যান।
তবে রোমান দলিল বা ভ্যাটিক্যান মহাফেজখানায় ক্রিশ্চান বিশ্বের রাজধানীর উদ্দেশে এই সফরের কোনো উল্লেখ নেই। তাসত্ত্বেও, ফেরার পর জিপসিরা পোপের কাছ থেকে পাওয়া অভ্যর্থনার বর্ণনা দেয় এবং পঞ্চম মার্টিনের কাছ থেকে পাওয়া চিঠি হাজির করে। এসব চিঠি কি সত্যি ছিল? সত্য হোক বা না হোক, একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে পোপিয় চিঠিগুলো মিশরীয় বিভিন্ন দলের পক্ষে অনুকূল অভ্যর্থনা নিশ্চিত করেছে এবং তাদের যেখানে ইচ্ছা যেতে সক্ষম করে তুলেছে।
১৪২৭ সালের আগস্টে জিপসিরা প্রথমবারের মতো সেই সময় ইংরেজ অধিকৃত প্যারিসের দুয়ারে হাজির হয়। তিন সপ্তাহ এরা লা শ্যাপেলে-সেইন্ট-ডেনিস দখল করে রাখে। উৎসুক জনতা তাদের দেখতে ভীড় জমায়। বিশেষ কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে। বলা হয়ে থাকে যে চতুর গণকরা ভাগ্য গণনার সময় লোকজনের টাকার ব্যাগ উধাও হয়ে গেছে। প্যারিসের বিশপ নির্বোধ এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসীদের ভর্ৎসনা করেছেন। মিশরীয়রা পন্টোয়জের পথ ধরতে বাধ্য হয়।
অচিরেই এই দলগুলো ফ্রান্সের দৈর্ঘ-প্রস্থ বরারর সফর শেষ করে। ওদের কেউ কেউ এরপর আরাগন এবং কাতালোনিয়ায় এসে সান্তিয়াগো ডি কম্পোস্তেলায় তীর্থযাত্রায় যাওয়ার কথা বলে। ওরা ক্যাস্তিলে পেরিয়ে আন্দালুসিয়ায় হাজির হলে জিপসি কাউন্ট এবং ডিউকরা ক্যাস্তিলের সাবেক কন্সট্যাবল এবং চ্যান্সেলর মিগেল লুকাস ডি ইরানসোর জিয়নে দুর্গে অসাধারণ আপ্যায়ন লাভ করেন। সামান্যতম প্রমাণ ছাড়াই বেশ কয়েকজন লেখক জিপসিদের আফ্রিকার উপকূল বরাবর জাহাজ ভাসিয়ে মিশর থেকে আন্দালুসিয়ায় আসার কথা উল্লেখ করেছেন। অথচ স্প্যানিশ জিপসিদের শব্দভাণ্ডারে কোনো আরবি শব্দ ছিল না, এবং এদের যাত্রাপথও পূর্ণাঙ্গভাবে প্রদর্শিত হয়েছে।
আন্দালুসিয়ায় পৌঁছে এরা পোপ, ফ্রান্সের রাজা এবং ক্যাস্তিলের রাজার প্রতিরক্ষা দাবী করে। ষোলো শতকের গোড়ার দিকে পোর্তুগালে চিগানোদের কথা প্রথম সাহিত্যিক টেক্সটে উল্লেখ করা হয়। মোটামুটি একই সময়ে মিশরীয়রা স্কটল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডে হাজির হয়। ওদের বেছে নেওয়া যাত্রাপথ অজ্ঞাত। সম্ভবত জার্মানি, ফ্রান্স এবং লো কান্ট্রিতে এর আগের অবস্থানের তুলনায় কম নজর কেড়েছিল এরা, কেননা স্মরণাতীত কাল থেকে ব্রিটিশ আ্ইলসে জিপসিদের মতো জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত টিংকারদের অস্তিত্ব ছিল।
আয়ারল্যান্ডে থিতু হওয়া মিশরীয়দের কঠিন সময় মোকাবিলা করতে হয়েছে। এখানে আগে থেকে বিপুল সংখ্যায় অবস্থান করা টিংকাররা নবাগতদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে তাদের বিতাড়িত করতে সম্ভব সবই করেছে। লিটল ঈজিপ্টের কাউন্ট আন্তোয়নে গাজিনো ১৫০৫ সালে একটি স্কটিশ জাহাজে ডেনমার্কে পৌঁছান। স্কটল্যান্ডের চতুর্থ জেমস বিশেষভাবে তার কথা ডেনমার্কের রাজা জনের কাছে সুপারিশ করেছিলেন। ২৯শে সেপ্টেম্বর, ১৫১২ জনৈক কাউন্ট আন্তোনিয়াস, প্রায় নিশ্চিতভাবে একই লোক, স্টকহোমের বাসিন্দাদের অবাক করে সেখানে হাজির হন।
১৫৪৪ সালে নরওয়েতে হাজির হওয়া প্রথম মিশরীয়রা একই রকম সুপারিশ পাওয়ার মতো ভাগ্যবান ছিল না। এরা ছিল কারাবন্দী, ইংরেজরা জোর করে তীরে তুলে দিয়ে এদের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিল। তাদের স্বদেশীরা যেমন ইংল্যান্ড এবং স্কটল্যন্ডে টিংকারদের স্থানীয় অধিবাসীদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিল তেমনি ভবঘুরে ফ্যান্টারদের মুখোমুখি হয় তারা। জিপসিদের কিছু দল সুইডেন থেকে ইংল্যান্ড ও এস্তোনিয়ায় অভিবাসন করে। মোটামুটি একই সময়ে পোল্যান্ড এবং লিথুয়ানিয়ার গ্র্যান্ড ডাচি হাঙেরি থেকে আসা 'পাহাড়ী জিপসি'দের এবং জার্মানি থেকে আসা 'সমভূমি জিপসি'দের স্বাগত জানান।
১৫০১ সালের দিকে জিপসিদের বিভিন্ন দল রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে সফর করছিল। অন্যরা পোল্যান্ড থেকে ইউক্রেনে পাড়ি জমাচ্ছিল। সবশেষে ১৭২১ সালে পোলিশ সমতলের জিপসিরা সাইবেরিয়ার রাজধানী তোবল্কে পৌঁছায়। এরা চীনে পাড়ি জমানোর ইচ্ছার কথা ঘোষণা করে, কিন্তু গভর্নর তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখার অনুমতি দেননি। এভাবে পনেরো ও আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়কালে ইউরোপের সমস্ত দেশই জিপসিদের গ্রহণ করেছিল। তবে আফ্রিকা এবং আমেরিকার বিভিন্ন কলোনির মতো দূরে বসতি করলেও সেটা নিজেদের ইচ্ছায় করেনি ওরা।
স্পেন বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জিপসিকে আটলান্টিকের অপর পাড়ে পাঠিয়েছিল, এরপরই পোর্তুগাল ষোলো শতক থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে বিশাল সংখ্যক চিগানোদের অ্যাঙ্গোলা, সাও তোমে, কেপ ভার্দে এবং সবচেয়ে বড় কথা ব্রাজিলে পাঠিয়ে দেয়। সতেরো শতকে জিপসিদের স্কটল্যান্ডে থেকে জ্যামাইকা ও বার্বাদোসে বিভিন্ন প্ল্যান্টেশনে কাজ করার জন্যে পাঠানো হয়; আঠারো শতকে পাঠানো হয় ভার্জিনিয়ায়।
চতুর্দশ লুইয়ের শাসনামলে জিপসিদের দাসত্বের অধীনে নিয়ে এসে 'আমেরিকার বিভিন্ন দ্বীপে' পাড়ি জমানোর শর্তেই কেবল মুক্তি দেওয়া হয়েছে। লুইসিয়ানার অনুসন্ধানের কাজে কোম্পেইনে দেস ইন্দেসের নিয়োজিত উপনিবেশবাদীদের ভেতর উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে বোহেমিয়রা। অন্য উপনিবেশবাদীদের মতোই নিউ অর্লিন্সে ঘরবাড়ি দেওয়া হয়েছিল এদের।
এক শতক পরে এদের উত্তরসূরিরা লুইসিয়ানার বিলোক্সিতে বসতি করে। এই সময়ও তারা ফরাসি ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতো। উনিশ শতকের শুরু থেকে বিপুল সংখ্যক জিপসি পরিবার মুক্তভাবে ইউরোপ থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমায়।
কানাডা, ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ ইয়র্ক ও শিকাগোর উপকণ্ঠে ও মেহিকো, মধ্য আমেরিকা এবং আরও দক্ষিণে আর্জেন্টিনা ও চিলিতে এদের দেখা মিলতে পারে। ইউরোপের মতো মোটামুটি একই পেশায় জীবন ধারণ করে এরা, একই আচার অনুসরণ করে এবং যেখানে থাকে সেখানেই স্বস্তি পায়, কারণ ওরা যেখানে থাকে সেটাই ওদের বাড়ি, সেটাই আপাত ঠিকানা মনে করে।
- সূত্র: দি ওয়ার্ল্ড দিয়ার হোমমল্যান্ড