তপেশের টফি
কেবল পড়াশোনা করে কি হবে যদি তা মানুষের কাজে না লাগে?
বিকেল। তপেশ একা বিছানায় শুয়ে। তাদের এই মফস্বল শহরে একটাই মাত্র ছোটো পাটকল, পার্টির শ্রমিক যোগাযোগের অধিকাংশটাই সেখানকার। কমরেড মুন্না'র স্ত্রীর কথা মনে পড়ে এই মুহূর্তে৷ বাসায় একটা উন্মাদনাময় ঝগড়ার শেষে বাবা বের করে দিয়েছিলেন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে৷ সোজা মুন্না দাদার বাসায় গিয়ে ওঠা। মুন্না তখন ঢাকায়। শ্রমিক সংগঠনের সেন্ট্রাল কমিটির দুইদিনব্যাপী মতবিনিময় ও ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারক বৈঠক। বাসায় তখন মণি দি একা৷ সাঁচি ঘুমোচ্ছে। তিন বছরের কন্যা। রাত এগারোটা পার হয়েছে অনেক আগে। দরজায় নক করতেই কোমল সুরের রবীন্দ্রগায়ন থেমে গেলো।
- আরে, তপু বাবু? কি মনে করে?
রাত হওয়াটা যেন কোনো বিষয়ই নয়৷ ভারী তো দু তিন বছরের বড়ো। তাতেই একটা দিদির মতো হালচাল। তপুর কমপ্লেক্সে ভোগার ধাত৷ সব সময় মনে হয় কেউ না কেউ শাসন করছে।
- মণি দি থাকতে এসেছি। বাবা গেটাউট করে দিয়েছে।
সাতাশ বছর বয়সেও কোনো কাজ খুঁজে পাচ্ছে না করার মতো, সংসারে কন্ট্রিবিউট করার মতো তুচ্ছ, সামান্য একটা কাজ- সে কি তার দোষ? গ্রাজুয়েশনটাও এক বছর বাকি-
- এসো। খেতে বসেছিলাম।
সাধারণ খাবার। ডাল - ডিম মামলেট- শাকভাজি। সেই কোন্ সন্ধ্যায় স্টুডেন্টের বাসায় ট্যালটেলে চা ও তৎসহ খান দুই নেতিয়ে যাওয়া ক্রিম বিস্কুট। আমার জীবনেও এমন কিছু বছর ছিলো ক্রিম বিস্কুট ছাড়া কিছু খেতাম না, নতুন- ঝকঝকে বই ছাড়া পড়তাম না, পালিশ ছাড়া জুতো অকল্পনীয় ছিলো- ভাবে তপেশ খেতে খেতে, আনমনা-
- তা, তপুবাবু, মাসীমা আছেন কেমন? মেসোমশাই?
মরিচের টুকরো চিবিয়ে চোখে জল এসেছিলো, মৃদু আলোয় মণিদি খেয়াল করেনি - নইলে কি ভেবে বসতো!
- ভালোই, মা'র অসুখ কমেনি- বাবা সেই দুই দুই চার ঘন্টা ঠেঙিয়ে অফিস করে যাচ্ছেন- মাঝে মাঝে জানো মণিদি, ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুড়ে কোথাও চলে যাই-
- তাতে কি লাভ হবে কোনো- বাবামা'র উপকার হবে?
মোমের আলোয় মণিদিকে কেমন মা মা লাগছে। আদ্যিকালের একটা ফোটো এলবামের ভেতর যুবক নিরঞ্জনের পাশে তরুণী জ্যোৎস্না দীর্ঘ চুলসমেত এইরকম। নিরঞ্জন ও জ্যোৎস্না যথাক্রমে তপেশের বাবা ও মা।
- লাভ কিছু নেই তবু -
ভাত খুঁটে বসে বসে- আনমনা -
লাস্ট ট্রেনের চলে যাওয়ার শব্দ- বুড়ো রেললাইনের হাঁড়পাঁজরা শুদ্ধু যেনো আলগা হয়ে যাবে।
- দিদি, আপনি শুয়ে পড়েন- আমি ধুয়ে দিচ্ছি-
মণিদি অনেক মানা করলো কিন্তু তপেশ অটল- রাতের এঁটো বাসন ধুতে তার ভালো লাগে। মোমের আলোয় রান্নাঘরের কলের নিচে বসে তপু আস্তে আস্তে থালা, বাটি, গ্লাস মেজে চকচকে করে তুলতে লাগলো। অতি সামান্য ভাত- থালায় রয়ে যাওয়া, ডালের নোনা গন্ধ ফোড়নমাখা- মরিচের কিছু টুকরো- বিদ্যুৎ চলে আসায় এইসব দেখা গেলো - জলের তোড়ে কয়েকটি কাঁচা মরিচের টুকরো ভাসতে ভাসতে চলে গেলো- ব্যর্থ এরা- সৌন্দর্য বর্ধন ছাড়া কোনো কাজেই লাগলো না- সাদা এলবুমিনের শরীরে হলুদ কুসুমখানার ভেতর থেকে সবুজ এই কাঁচামরিচের টুকরো জীবনের ঘোষণা করে। খাবার মানুষের প্রধান প্রয়োজন। না হলে সব ব্যর্থ। প্রেম ও আন্দোলন, আকাঙ্ক্ষা ও যৌথতা। থালা বাসন গুছিয়ে রেখে তপু মুন্নাদার স্টাডিরুমে শুতে এলো।
একটা ইজি চেয়ার, গোটা চারেক বইঠাসা আলমিরা, টেবিলল্যাম্পসহ টেবিল, মাথার উপর ফ্যান৷ দেয়ালে কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডারিক এঙ্গেলস এবং মার্কসের তিন কন্যা- জেনি, এলিওনর এবং লারা'র গ্রুপছবি এনলার্জ করে বাঁধানো৷ সারা ঘরে এটিই একমাত্র ছবি- ঢং করে একটা ঘন্টা পড়লো মুন্নাদার দাদুর আমলের ঘড়িতে। বাতি যখন জ্বলছে খানিক পড়া যাক৷ পড়তে পড়তে মাথায় ফ্রডেয়ীয় চিন্তা ঢুকে পড়লো। আচ্ছা, মণিদি কি ঘুমোচ্ছে? ঘুমোলে মেয়েদের জামা কাপড় খানিক অবিন্যস্ত হয়ে যায় না?
সুন্দর মণিদি'র কণ্ঠার ঠিক নিচে - টেবিলে চা পাতা, চিনি, দুধ, বইয়ের শেলফের কাছে একটা টুলের নিচে একটা স্টোভ আবিষ্কার করে ফেলল তপু। এক মগ চা বানালো। মুন্নাদা পাশের দেশে একটা আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে গিয়ে স্মরণিকা হিসেবে এই মগ উপহার পেয়েছিলেন। তপু সিগারেট ধরায়৷ খানিক আগের চিন্তার জন্য নিজের প্রতি দুঃখ হয় - ছোটো কাগজের কবি স্বাতীলেখা মিত্রের দু'টো পংক্তি হঠাৎ মনে পড়ে - 'আমার রক্তে অবদমন- মুখ চেপে ধরে/ মানুষের মুক্তির কথা বলতে পারি না- '
ওঃ! নিঃসঙ্গ এইসব রাত, নির্ঘূম ও ভয়াবহ। শুকনো গ্রন্থ কি সমাধান দিতে পারে সব কিছুর? চায়ের মগে লেখা ' শ্রমিক সংহতি দীর্ঘজীবী হোক' - লেনিনের সেই চিরপরিচিত ছবি- প্রশান্ত - তপু চা শেষ করে আস্তে উঠে পড়ে। মণিদি নিশ্চয় দরজা বন্ধ রাখবে আর সেক্ষেত্রে আবার ফিরে এলেই চলবে। কেউ তো দেখতে পাচ্ছে না। মূলত ঈশ্বর নেই ও আত্মরতি তথা মাস্টারবেশন ক্ষতিকর নয় - এই দুই উজ্জ্বল সত্য জানার পর জীবন অনেক সুন্দর, সহজ হয়ে গিয়েছে। না, মণিদি দরজা বন্ধ করেনি, অতি আস্তে একটা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো- নিয়মিত বিরতিতে বুকের ওঠা নামা- মা ও মেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে- মৃদু আলোয় রুদ্ধশ্বাস সুন্দর এই দৃশ্য ও নির্মল- আরো এগিয়ে যায় তপেশ ক্লোজ আপে দেখবে বলে।
অনেকের ধারণা, চলচ্চিত্রে ক্লোজ আপের স্রষ্টা গ্রীফিথ। পূর্ণেন্দু পত্রীর সিনেমাবিষয়ক লেখার একটা কোটেশন মনে পড়ে গেলো। ক্লোজ আপ আবিষ্কারক গ্রীফিথ নন। পোর্টারের 'দি গ্রেট ট্রেন রবারি'-তে একেবারের শেষে ক্লোজ আপ ব্যবহৃত হয়। গ্রীফিথ আবিষ্কারক নন ঠিকই কিন্তু মুখাবয়ব ব্যবহারের বলা ভালো চলচ্চিত্র মাধ্যম যদি একটি প্রবন্ধ হয় তবে কোনো একটি বস্তু বা মুখ অনেক কাছ থেকে দেখার, উদ্ধৃত করবার এই পদ্ধতিকে আরো সংহত, আরো কার্যকর, আরো কাব্যিক করে তোলেন গ্রীফিথ। মণিদি'র মুখে দু'একটি উড়ন্ত চুল, মাঝে মাঝে তাঁর কপাল কুঁচকে উঠছে, হয়তো কোনো স্বপ্ন দেখছেন, সাঁচি হাসে ঘুমের মধ্যে। ছেলেবেলায় দিদিমা বলতেন, শিশুদের মধ্যে ভগবান বিষ্ণু থাকেন। সেজন্য তাদের গায়ে পা লাগলে পাপ হয়। কতো বিষ্ণুকে আমরা নালায় ফেলি প্রতিদিন। আমরা বিষ্ণুর স্রষ্টা। বাবা।
পায়ের গোড়ালি সুন্দর- পায়ের তলা সুন্দর - একেবারেই শৈশবে, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়বার সময় তপেশের একমাত্র ছোটো বোন জন্মায়, তার আঙুল- বিশেষ করে পায়ের বুড়ো আঙুল চুষতে ভালো লাগতো তপেশের। একটা আঙুল দিয়ে গোড়ালি ছোঁয় তপু, সাবধানে, মসৃণ- পা সরিয়ে অন্য পাশ ফিরে শোন মণিদি। সরে আসে তপু। বেরিয়ে পড়ে৷ বাকি রাত তার আর ঘুম আসে না। শেক্সপিয়ারের সমকালীন নাট্যকার লোপা দে ভেগা'র নাটকের অনুবাদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে রাত কাটিয়ে তেরোটি সিগারেট ও চার মগ চা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সে রাতে একটা চমৎকার স্বপ্ন দেখে।
বাল্যে পড়া মিশনারী স্কুলের ব্রাদার র্যালফ আদুরে স্বরে ডাকেন- ট্যপেশ, মাই ডিয়ার চাইল্ড, টোমাকে একটি চাকরি দিবো গির্জার ঘন্টা নাড়িবার - বেতন দৈনিক একুশটি ক্রিম বিস্কুট- ঢং ঢং শব্দে বালক ঘন্টা নাড়াতে থাকে- রীতিমত ঝুলতে ঝুলতে- মা মেরীর উজ্জ্বল কোলে রাশি রাশি টফি, আঁচলে ; মেরী'র চেহারা অনেকটাই জ্যোৎস্নার সঙ্গে মেলে - ঘন্টা বেজে যায়, বালক তপেশ একুশটি ক্রিম বিস্কুটের আশায় কোনো সেফ গার্ড ছাড়া অনেক উঁচু ঐ ঘন্টার দড়িতে ঝুলে ঝুলে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে - ওঠো, আর ঘুমাইও না, প্রার্থনার সময় হইয়াছে। ঘুম ভাঙ্গতে তপেশ ঘন্টাধ্বনি শোনে। প্রখর দুপুর। স্টাডি রুমের ঘড়িতে দুপুর বারোটা। চেয়ারে হাতলে খুলে রাখা শার্ট ও গেঞ্জি নেই৷ রান্নাঘরের পাশেই বাথরুম। স্টাডিরুম পেরোলে একটা ছোট্ট করিডর। তাতে নাইলনের দড়িতে ক'টি জামা কাপড়ের সাথে ঝুলছে তপুর গেঞ্জি, শার্ট ধোয়াপরবর্তী শুকোবার অপেক্ষায়।
- এতোক্ষণে বাবুর ঘুম ভাঙ্গলো- বাব্বা!
মণিদি রান্না করছিলো। আঁচে মুখে বিন্দু ঘাম, রুশ মেয়েদের মত লাগছে৷ ব্যালাড অফ এ সোলজারের নায়িকা যখন টিউবওয়েল চেপে মুখ ধোয় অবিকল সেই দৃশ্য। মণি দি, তুমি কি আগের জন্মে আমার মা ছিলে! তপু মৃদু হাসে। হাত- মুখ ধুয়ে একেবারে স্নান সেরে বেরোতে - মণি দি মুন্নাদা'র লুঙ্গি ও টি শার্ট এনে দেয়।
- এগুলো পাল্টে ফেলো, তপু- স্নানের পর বাসি জামাকাপড় পড়তে হয় না -
অগত্যা আবার বাথরুম যাওয়া।
- ব্যস! দেখো কতো সুন্দর লাগছে আমাদের তপুকে-
সাঁচি ঘরময় হেঁটে বেড়াচ্ছে। ওর পায়ের নুপুরের শব্দ বুকের মধ্যে অপত্য স্নেহ জাগায়।
- কি খাবে বলো?
- ভাত-ই খাবো। তার বাদে একটু বাসার পরিস্থিতি দেখতে যাবো-
- বেশ- কিন্তু আরেকটু বসতে হবে- তরকারিটা নামিয়ে নিই- কেমন?
তপু সাঁচিকে আবিষ্কার করে স্টাডিরুমে থেবড়ে বসে ঝুনঝুনির শব্দের সমঝদার হিসেবে। মাথা নেড়ে নেড়ে কী চমৎকার মনোযোগে সে ঝুমঝুম করে বাজিয়ে চলেছে তার ঝুনঝুনি। তপু'র মনে হলো, যতক্ষণ যতদিন শিশুরা এইভাবে নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ ঝুনঝুনি বাজিয়ে যাবে বেঁচে থাকা আরো অর্থময় হবে-
- কাকু- তুমি - ভালো - আছো?
আচমকা আধো আধো বুলিতে সাঁচি বলে ওঠে। আর তখন এই শিশুমাত্র সামনে রেখে কেঁদে ফেলা ছাড়া তপু'র উপায় থাকে না। তপু সাঁচিকে কোলে নিতে, তাকে আরো বিস্মিত করে দিয়ে সে তপুর চোখের জল মুছে দেয় ছোটো দুই হাতে, বার বার বলে চলে - না, না, কাঁদে না, সোনা, না, না-
- তপু, খেতে এসো-
সে চোখ মুছে ফেলে- সাঁচিকে কোলে নিয়ে খেতে যায়- মণিদি সাঁচিকে কোলে নেয়- খেতে বসে - খেতে খেতে হঠাৎ তপু বলে ওঠে ফেলে - মণিদি, তুমি ঘুমোবার সময় শোয়ার ঘরের দরজা বন্ধ করোনি কেন? সাঁচিকে টিপে টিপে নরম করে ডাল- ভাত খাওয়াচ্ছিলো মণিদি। প্রশ্নটা শুনে একটু অবাক চোখে তাকায়- কেন, বন্ধ করবো তুই আমার ভাই না? মাথা নিচু করে ভাত খেতে খেতে তপু'র দু'চোখ আবার জলে ভরে উঠলো৷ দ্রুত সামলে নিলো সে। ঠোঁটে জলের স্বাদ নোনতা লাগলো।
বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। তপু মুন্নাদা'র ছোট্ট পরিবার ও নিজের অপরাধবোধের কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো- আবার বইয়ে ফিরে আসে- ভিখারি সব দেশেই, অন্তত প্রাচীন কালে ছিলো তবে এইদেশে সুপ্রাচীনকাল থেকেই অন্নভিক্ষা নানা ধরণের শাস্ত্রের সমর্থন পেয়েছিলো- বেদের যুগে ক্ষুধা ও খাদ্য, সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখা - সেদিন যজ্ঞে যেসব দেবতাকে মাথা খুঁড়ে মিনতি জানিয়ে ক্ষুধিত মানুষ বিফল হয়েছে তাদেরই উত্তরপুরুষরা আজ সরকারের পায়ে মাথা খুঁড়ে আবেদন- নিবেদন করে বিফল- মনোরথ হয়ে উপোস করছে- শেষ বাক্য; খানিকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইলো।
***
বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। ঘরে সিগারেট খায় না৷ এখন আবার রোজার মাস৷ ঈদের বেশি দেরি নেই৷ রেজাউল চিৎকার করে রাস্তার অন্য পার থেকে ডাকলো - ' কি কবি- কি খবর?' রেজাউলের কাছে গেলো তপু। ' কেমন আছেন?' প্রথাগত প্রশ্ন ও হাতমেলানো৷
- 'ঐদিকে তো পরিস্থিতি থমথমে। পাটকলের শ্রমিকরা বকেয়া বেতন ও বোনাস না পেলে গণ আত্মহত্যার ঘোষণা দিয়েছে আর মালিকপক্ষ বলছে ঈদের আগে কিছু সম্ভব না। কোরবানির ঈদে ডবল বোনাস দেয়া হবে৷ কিন্তু এইসব ফাঁকিঝুকি তো শ্রমিকরা বোঝে, তারা তো আর দুদু খায় না - কি বলো ভাই? যাবে না কি ওদিকে?'
ছাত্র পড়ানো সেই সন্ধ্যায়। হাতে আরো দু'ঘন্টা। যাওয়া যাক৷ কিছু করার নেই৷ ঘরের একমাত্র টিভি আজ মাস তিনেক নষ্ট পড়ে আছে, ঠিক করানোর পয়সা নেই৷ ছোটো বোন গত সন্ধ্যায় টিভি দেখতে গিয়ে ধমক খেয়ে এসেছে৷ পাশের বাড়ির টিভিটা একদিন গুঁড়িয়ে দেবে তপু৷ নিষ্ফল আক্রোশ! আরে - মৌসুমীকে খুব সুন্দর লাগছে তো - ল্যাম্পপোস্টের গায়ে সাঁটা পোস্টারটা মন দিয়ে দেখে - তার ঠোঁট দুটি এতো সুন্দর তো কোনোদিন লাগেনি, অবশ্য বহুজাতিক কসমেটিকের কেরামতিও আছে, আছে অনেক তিমি মাছের চর্বি। সারা শরীর বেলুনের মতো ফুলে ওঠে তপুর৷ সামলাতে কষ্ট হয়। তাড়া দেয় রেজাউল- আরে চলো চলো, পরেও দেখতে পারবে৷
রেজাউলের গল্পটা একটু অবাক করা। দু'বার উচ্চ মাধ্যমিক ফেল করে, ক'দিন ফ্রিজ- টিভি মেরামতি শিখে কোথায় উধাও হয়ে গেলো- ফিরলো টুকটুকে বউ নিয়ে- এসে দেখে যাকে দেখার জন্য ফিরেছে সে-ই মা কবরে- জমি জবিরদখল অতএব বস্তি সম্বল। সেখানে সুখ না থাকলেও অসুখ ছিলো না। সারাদিন খাটতো। সন্ধ্যার পর বউঅন্ত প্রাণ৷ মাঝে মাঝে সিনেমা৷ এক রাতে রেজাউল পাশের শহরে গেলো কাজে - ফিরে দেখে বউ ঝুলে আছে কড়িকাঠে, একদিনের বাসী মড়া। কারো সাথে সদ্ভাব ছিলো না এই পরিবারটির৷ তবু কোন্ গোপন দুঃখে তার জরিনা মারা গেলো বুঝে উঠতে পারে না রেজাউল, উন্মাদ হয়ে গেলো- রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো, কেউ দিলে খেতো, নইলে উপোস দিতো।
মাস তিনেক পর ইউসুফ, রেজাউলের বাল্যবন্ধু বিদেশ থেকে ফিরে রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়ে এক মুখ দাঁড়িগোঁফের ভেতর তাকে চিনে ওঠে। নিজের বাসায় তোলে। টানা দেড় বছর পর সুস্থ হয় রেজাউল। জরিনার মৃত্যু মেনে নেয়। একদিন গান শুনতে পার্টি অফিস গিয়েছিলো ইউসুফ বন্ধুকে নিয়ে। ক'দিন পর আবার ফিরতে হবে কানাডায়৷ বন্ধুর জন্যে বারবার ফেরা পিছিয়ে দিচ্ছিলো। তার অনুপস্থিতিতে বন্ধুকে কে দেখে শুনে রাখবে- এটা ভেবেও উদ্বিগ্ন, ঠিক করেছিলো অনুষ্ঠানের পর পার্টিনেতার সাথে কথা বলবে।
কিন্তু, কোন্ রহস্যময় কারণে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সুর শুনে রেজাউল শ্রোতার আসন থেকে সোজা উঠে মঞ্চের বৃন্দগায়নে সমাবেত হলো কেউ বুঝে ওঠার আগেই- রহস্যময় কারণটি জানা গেলেও এইটুকু সেদিন আবিষ্কৃত হলো রেজাউলের গানের গলাটি সুন্দর৷ রেজাউল এখন ফুল- টাইমার। কালচারাল স্কোয়াডের নেতা। প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে গ্রাজুয়েট হয়েছে৷ পার্টির মানুষ-ই এখন তার মানুষ৷ ফেলে দেয়া কাগজ, কাঠের টুকরো, রং দিয়ে নানারকম ছোটো ছোটো খেলনা বানায়। পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দেয়। বাচ্চাদের দেয়। পাখি, ফুল, বল,পুতুল, কাগজ কেটে বানানো লেনিনের ছবি- ছোটো ছোটো জাতীয় পতাকা। একদিন বলেছিলো তপুকে - বুঝলে তপু, পতাকার সূর্যটার সামনে দাঁড়ালে মনে হয় আমার গোপন সব দুঃখ জমাট বাঁধা প্রাচীর আর ঐ সূর্যের প্রচন্ড তাপ তা গলিয়ে দিচ্ছে -
কিন্তু কান্নায় কী ফল বলো? এইসব প্রশ্ন বা অনুভবের সামনে নিরুত্তর থাকতে হয়। রেজাউল আর তপেশ মাইল দেড়েক হেঁটে পাটকলের সামনে আসে। শ'তিনেক শ্রমিক জমাট বেঁধে বসে পড়েছে রাস্তায়। পার্টিনেতা মানিক ভাই এই মুহূর্তের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন৷ এরপর সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের পরিবেশনা৷ এক গাড়ি পুলিশ। অনেক দূর থেকে দেখা যায় আরেক গাড়ি আসছে৷
'...কমরেডস, আমরা এই মুহূর্তে ঘোষণা করছি, আমাদের দেয়া চব্বিশ ঘন্টার আল্টিমেটাম যেহেতু শেষ হয়ে গেছে- আমাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচী পদযাত্রা আমরা পালন করবো। মালিক ও তার দালালদের, আমাদের শহরের দালাল ও পোষমানা বুদ্ধিজীবীদের বুঝিয়ে দিতে হবে দাবি আদায়ের জন্য শ্রমিকরা মৃত্যুকে আলিঙ্গনেও পিছপা হয় না। বন্ধুগণ, আপনারা প্ল্যাকার্ড, লাল পতাকা, ব্যানার হাতে সারিবদ্ধভাবে শান্তিপূর্ণ পদযাত্রার প্রস্তুতি নিন। কোনো বাধাই আজ আমাদের টলাতে পারবে না। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক৷ শ্রমিক- মেহনতীর জয় অনিবার্য।'
মানিক ভাইয়ের বক্তৃতা শেষ হতেই মফস্বলের আকাশ বাতাস গর্জে উঠলো- 'দুনিয়ার মজদুর এক হও', 'বকেয়া বেতন এবং বোনাস দিতে হবে, দিয়ে দাও', 'বীর শ্রমিক জনতা গড়ে তোলো একতা'- এইসব শ্লোগানে- ভোজবাজির মতো তৃতীয় ও চতুর্থ পুলিশের গাড়ির উদয় হলো- দীপা তাকে ছেড়ে না গেলেও পারতো, হঠাৎ মনে হলো, ভাবতে ভাবতে- ভাবনা থেকে নিজেকে সরাতে ইচ্ছে না থাকলেও একটা লাল পতাকা নিয়ে মিছিলে নামে- বাসায় ফেরার সময় মায়ের ওষুধ নিতে হবে- দীপা, আমি তোমাকে ভালোবাসতাম- তুমি এখন দ্বিগুণ বয়সের একজনকে বিয়ে করে কি কষ্টটাই না পাচ্ছো! আর দু'টো বছর ধৈর্য্য ধরতে না পারলে ভালোবেসেছিলে কেন? চুমু খেয়েছিলে কেন?
ক্ষুধা সব যুগেই ছিলো তবে আদিম সাম্যবাদী সমাজে কেউ কারো খাবার কেড়ে নিতো না, তার উৎপত্তি শ্রেণিবিভক্ত সমাজে- অভ্যাসমত স্লোগানে কণ্ঠ মিলিয়ে যাচ্ছিলো- বিশৃঙখল দৌড়ঝাঁপ চোখে পড়লো না তখনই, চোখ জ্বালা করে উঠলো- কয়েকজন কমরেড ছুটে গিয়ে পাথর ছুঁড়ছে- প্রাচীন সামন্তের লাঠিয়াল, রাজার সৈন্য এখন পরিণত পুলিশ ও প্রতিরক্ষা বাহিনিতে- যাদের কাজ শাসন অক্ষুণ্ণ রাখা, লাল পতাকা হাতে ছুটে যায় অবদমিত যুবক তপেশ। একটা শব্দে কানে তালা লেগে যায়। বুকের একপাশ ব্যথা করে ওঠে। মাথা নিচু করে বুকপকেটের প্রিন্ট করা ফুলটা আরো লাল হয়ে উঠতে তপু অবাক হয়। লাল পতাকা হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে। না, পড়ে গেলে চলবে না৷ ভাগ্যে খানিকটা নরম মাটি পেয়ে যায়। সড়ক ও জনপথের দুর্নীতির ফলাফল। পতাকাটা গেঁথে দেয় মাটিতে, শরীরের অবশিষ্ট জোর দিয়ে৷ দীপা বড়ো ভালো মেয়ে ছিলো।
২.
না, সে মরে যায়নি৷ মাস ছয় যমে মানুষে টানাটানি করে বাঁচিয়েছে তাকে পার্টির সবাই। প্রচুর গণচাঁদা উঠেছিলো, বাবা ছেলেকে বাঁচাতে জায়গাজমি যা ছিলো সব বিক্রি করে দিয়েছিলেন।
পুরোপুরি সুস্থ হয়ে তপেশ একদিন শহর ঘুরতে বেরলো। তার টিউশনগুলো চলে যায়নি। সব কটাই আছে। সে আস্তে আস্তে সব কটা ছেড়ে দিলো। পার্টিনেতারা ততদিনে মালিকের সাথে আপোষ করে ফেলেছে। পার্টিফান্ডে যা জমা পড়েছে তা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে দুটো। সব কানে আসতে থাকে। পার্টিও ভেঙে গেলো। মানিক ভাই ঢাকার শাঁখারী পট্টিতে পৈতৃক শাঁখার দোকানে বসেন৷ বিয়েও করেছেন মিতুলদিকে। তপুকে ডাক্তার সিগারেট খেতে নিষেধ করেছে৷ সে নিজেকে বদলে ফেলে অতি ধীরে।
আমার সাথে তপুর মাঝে মাঝে পেনিনসুলায় দেখা হয়। তিনি আমার লেখা পছন্দ করেন। আমাকে ছাদে জলের ট্রিট দেন। এখন তিনি বিশাল সরকারী পোস্টে আছেন৷ দীপাদিকে রীতিমত তুলে এনে বিয়ে করেছেন বেশ কয়েক বছর পর। কেমন নিষ্ঠুর হয়ে গেছেন তিনি। একদিন আট পেগের ঘোরে তিনি আমায় গল্পটা বলেছিলেন। আর সেদিন তাঁকে আমি অঝোরে কাঁদতে দেখেছি। এসব লিখতে ইচ্ছে করলো৷ তাই আমি লিখে রাখলাম নিজের মতন করে।