ঢাকা: স্বাধীনতার আগের শেষ সপ্তাহ
নিয়াজি, শের খান, পিটার কান ও জ্যাক এন্ডারসনের ডায়েরি
ইয়াহিয়া, ভুট্টো এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক আমলাতান্ত্রিক ও জোতদার গোষ্ঠির হয়ে লড়ে নিয়াজিকেই বলির পাঠা হয়ে আত্মসমর্পণ করতে হয়, সে ব্যাখ্যা তিনি নিজেই দিয়েছেন। ইউনাইটেড ফিচার সিন্ডিকেটের প্র্রতিবেদক ও কলাম লেখক জ্যাক এন্ডারসনের যে প্রতিবেদনগুলো বিবেচনায় আনা হয়েছে, সেগুলো মূলত ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের যুদ্ধ নিয়ে, যার পরিণতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা। পিটার আর. কান ১৯৭১-এর ডিসম্বেরে ঢাকায় অবস্থান করেন এবং যুদ্ধের কারণে রিপোর্ট পাঠাতে না পারায় ঢাকা ডায়েরি লেখেন, যা পিটার কানের ঢাকা ডায়েরি হিসেবে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত হয়। এই ডায়েরি পিটার কানকে এনে দেয় পুলিৎজার পুরস্কার। ব্রিগেডিয়ার শের খানেরটি ঠিক ডায়েরি নয়, ঢাকা থেকে পলায়নের বিবরণী।
শেষ সপ্তাহটিতে কার্যত দাপ্তরিক কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে ইন্টারন্যাশনাল সেফ জোন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল।
বৃহস্পতিবার ৯ ডিসেম্বর
নাশতার সময় একজন আমেরিকান ব্যবসায়ী বললেন, ক্রিসমাস কেনাকাটার মাত্র দশ দিন হাতে পাচ্ছি। কিন্তু এই ঝামেলা তো শেষ হচ্ছে না। অন্য একজন আমেরিকান ইনকাম-ট্যাক্স ফর্ম আনতে কনস্যুলেট অফিসে গেলেন। তিনি বললেন, 'আমি হয়তো আশাবাদী, কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবে।' আতঙ্কিত মানুষও আছে। ধূসর লোমওয়ালা একটি কুকুর হোটেলে আটকে পড়া তার 'প্যারেন্টস' সঙ্গে আছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই কুকুরটাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে।
এটা নিশ্চিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পতন ঘটতে যাচ্ছে। নিয়াজির পালিয়ে যাওয়ার গুজবটি এখনো এ কান ও কান ঘুরছে। আমাদের খবর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইউনিট ঢাকা থেকে কুড়ি মাইলের মধ্যে বসে পড়েছে। ভারতীয় বেতার বলছে, ঢাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের সব প্রধান শহরের পতন ঘটেছে। পাকিস্তানের বেতার তা নাকচ করে দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পজিশন নিচ্ছে। তারা যক্ষ্মা হাসপাতাল থেকে সব রোগী রাস্তায় বের করে দিয়ে সিট দখল করে নিয়েছে। আমরা গাড়ি নিয়ে শহরে বের হই, অল্পসংখ্যক সৈন্যের দেখা পাই, কিন্তু একজন পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশকে দেখলাম একজন বাঙালিকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। তাদের আচরণের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, আগের মতোই আছে। সবাই এটাই ভাবছে--পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত ঢাকা শহরের ওপর তাদের মরণ-কামড় বসাবে কি না। জাতিসংঘের কয়েকজন বলাবলি করছেন, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সৈন্যদের শর্তযুক্ত আত্মসমর্পণের কথা চলছে। শর্ত হচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ। কিন্তু সেই গ্যারান্টি কে দেবে?
আবাসিক এলাকা দেখতে বের হই, সেখানে গতরাতে তিনটি বোমা পড়েছে। এটা ছিল এতিমখানা। এখন তিনটি বড় গর্ত, গর্তের চারপাশে মাটি ও ধ্বংসাবশেষের পাহাড়। দেখলাম মাটি সরিয়ে কয়েকটি ছোট ছোট দেহ বের করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এতিমদের 'দেহ গুণে' সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেল।
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস (জেনেভা) শেষ পর্যন্ত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও একটি হাসপাতালকে 'নিরপেক্ষ অঞ্চল'-এর ঘোষণা দিতে পেরেছে। সন্ধ্যাবেলায় রেড ক্রসের একটি দল এবং সাংবাদিকরা প্রত্যেক রুমে রুমে ঘুরে অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে এলো। মূলত এগুলো পশ্চিম পাকিস্তানি অতিথিদের কাছেই ছিল। মেয়েদের টয়লেটে বেশ কয়েক প্যাকেট বিস্ফোরক পাওয়া গেল। এগুলো হোটেলের লনে সরিয়ে আনা হয়েছে এবং বালির বস্তা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এর ফলে হোটেলের সুইমিংপুল বন্ধ করে দেওয়া হলো।
শুক্রবার ১০ ডিসেম্বর
নাশতার টেবিলে রাত ১০টার বোমাবর্ষণ নিয়ে কথাবার্তা, বোমা পড়েছে হোটেলের কাছাকাছি কোথাও। তুলনামূলকভাবে বেশি নিরাপদ মনে করে আরও অনেক বাঙালি ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে আশ্রয় নিচ্ছে। বাঙালি বন্ধু কান্নাভেজা চোখে অনেক উপশহরে বাঙালি হত্যাযজ্ঞের কাহিনী শোনাচ্ছে। তাদের মধ্যে 'কত যে শিশু'--এই বলে তিনি ফোঁপাতে শুরু করেন। অবাঙালি সংখ্যালঘুরা অধিকতর নিরাপদ মনে করে গ্রাম ছেড়ে ঢাকা আসতে শুরু করেছে। ঢাকায় অবস্থানরত বাঙালিরা সবাই মনে করছে গত দুবার এতিমখানাসহ বেসামরিক যে বোমাবর্ষণ হয়েছে তার দায় ভারতের ওপর চাপানোর জন্য পাকিস্তানি উড়োজাহাজ থেকেই করা হয়েছে। বিশ্বস্ত বিদেশি সূত্র থেকে জানা গেছে, এগুলো মিগ থেকে নিক্ষেপ করা বোমা নয়, প্রপেলার-চালিত উড়োজাহাজ থেকে ফেলা; এমনকি বোমা রাখার জন্য তৈরি করা তাকও নিচে পড়ে গেছে। অবস্থাগত পরিবেশই সত্যের সাক্ষী দেয়। সবই মনে হচ্ছে ঠাণ্ডা মাথায় করা কাজ। কিন্তু একজন কূটনীতিবিদ বলেছেন, 'মার্চ থেকে যারা এখানে আছেন এবং দেখে আসছেন এ ধরনের কাজ যে পাকিস্তানিদের করা এ নিয়ে এতটুকুও সন্দিগ্ধ হবেন না।'
একটি গুজব খোলাসা হয়েছে। জেনারেল নিয়াজি হোটেলের গেটে দেখা দিয়েছেন, তার মানে তিনি যে বার্মাতে নেই এটা নিশ্চিত। রেড ক্রসের নতুন বিধি অনুযায়ী তাকে বলা হয়েছে, তিনি তার অস্ত্র নিয়ে হোটেলে ঢুকতে পারবেন না। আটকে পড়া নাগরিকদের তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে জাতিসংঘের আলোচনা সফল হয়েছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে আগামী ২৪ ঘণ্টা কলকাতা-ঢাকা করিডরে অস্ত্রবিরতি কার্যকর করা হবে। উদ্ধারকারী উড়োজাহাজ অন্তত নারী ও শিশুদের নিয়ে আগামীকাল সকালে যাত্রা করার জন্য নির্ধারিত হয়েছে। তবে এ সিদ্ধান্ত তো আগেরই। যুদ্ধ শুরু হয়েছে ঠিক এক সপ্তাহ হয়ে গেল।
শনিবার ১১ ডিসেম্বর
সকালের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র তথ্যকেন্দ্রে (ইউসিস) বিস্ফোরণ। ধ্বংসাবশেষ আশপাশে এক শ গজ পর্যন্ত ছড়িয়েছে। চারদিকে বইপত্র ছিটকে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে 'দ্য নিউক্লিয়ার ইয়ার্স' 'দ্য রোল অব পপুলার পার্টিসিপেশন ইন ডেভেলপমেন্ট'। ধ্বংস করার জন্য সবার অংশগ্রহণের দেশ এটি। কাজটা কি মুক্তিবাহিনী করেছে? লাইব্রেরিয়ান বললেন, যে লোকটা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, তার জবান উর্দু, পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা। কে জানে, হতেও পারে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ধ্বংসাবশেষের ভেতর থেকে সব বই লুট হয়ে গেল। একজন বৃদ্ধ তার বগলে করে নিয়ে গেলেন 'রিলিজিয়ন অ্যান্ড এথিকস' নামের একটি বই।
সারা দিনের বড় গুজব ডেপুটি মার্শাল ল' অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জেনারেল রাও ফরমান আলী, তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর 'জেন্টেলম্যান জেনারেল' হিসেবে পরিচিত, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর শর্তযুক্ত আত্মসমর্পণের লক্ষ্যে আপাতদৃষ্টিতে জাতিসংঘের সঙ্গে গোপন সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আরও গুজব--তার এই পদক্ষেপ এখানকার কমান্ডার জেনারেল নিয়াজি এবং প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান জেনে গেছেন। আজ থেকে আটকে পড়া নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার যে পরিকল্পনা ছিল, এসব ঘটনার প্রভাব তার ওপর পড়ে, আজ উড়োজাহাজ আসেনি। উড়োজাহাজ নিয়ে সমস্যার একটি কারণ ভারত চাচ্ছে রাজনৈতিক কারণে কলকাতা থেকে উড়োজাহাজ ঢাকায় যাক, আবার রাজনৈতিক কারণেই পাকিস্তান তা চাচ্ছে না।
আটকে পড়া বিদেশিরা ভাবতে শুরু করেছেন তারা এখন রাজনৈতিক জিম্মি। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানাচ্ছে, শহরে আরও সৈন্য টেনে আনা হচ্ছে অথবা নিজেরাই তাদের সদর দপ্তরে ফিরে আসছে। শুনেছি এয়ারপোর্টে নিয়াজি একজন রিপোর্টারকে বলেছেন, 'আপনারা এখানে থেকে আমাকে মরতে দেখবেন।'
আমেরিকান কনস্যুলেট অত্যন্ত বিষণ্ন অবস্থায় রয়েছে। কারণ আমেরিকা সমর্থন করেছে হারতে যাওয়া পক্ষকে। এর কূটনৈতিক পরিণতি ভুগতে হবে, অন্য কোনো পরিণতিও হতে পারে।
একজন পশ্চিমা কূটনৈতিক বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি পুরো লেজে-গোবরে করে ফেলেছে। আজ অপরাহ্ণে শহরে কারফিউ বলবৎ করা হয়েছে। রাস্তা জনশূন্য। আমাদের ধারণা, শহরের তেরো লাখ মানুষের অর্ধেকের কম এখনো রয়ে গেছে।
রেড ক্রস হোটেলে বৈঠক ডেকেছে। সভাপতিত্ব করছেন একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ কর্নেল, এখন রেড ক্রসের কর্মকর্তা। দেখতে নায়ক ডেভিড নিভেনের মতো। তিনি হোটেলবাসীদের বললেন, অসাধারণ গুজব, যা কিছু শুনতে পাচ্ছেন কোনোটাই কানে তুলবেন না। হোটেলের ওপরের তলাগুলোতে যারা থাকছেন, তারা কিছুটা নিচে নেমে আসতে চাইছেন।
সাংবাদিকরা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে ফোন করে চলেছেন কোনো পাকিস্তানি বা ভারতীয় সেনা সদস্য ধরা পড়েছে কি না পরীক্ষা করতে চাচ্ছেন। অধিকাংশ ফোন লাইনই অচল, তবে আমরা খুলনা পেয়ে গেলাম। কয়েক দিন আগে ঢাকা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমের এ শহরটি ভারতীয় বাহিনীর দখলে চলে আসে। কোনো এক সার্জেন্ট ফোন ধরেন। আমরা জিজ্ঞেস করি, ভারতীয়রা কোথায়? কাউবয় সিনেমার মতো জবাব, 'এখানে নেই'।
রবিবার ১২ ডিসেম্বর
কার্যত সারা দিনই কারফিউ। পুরো শহর নিস্তব্ধ, যেন কোনো মহামারি হঠাৎ শহরের সব মানুষ মেরে ফেলেছে, চারদিকে শুধু কালো কাক উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। অবশ্য এই শহরের জন্য মহামারির নাম আতঙ্ক। সি-১৩০ উড়োজাহাজ মাথার ওপর বৃত্তাকারে ঘুরছে, শব্দে আমরা জেগে ওঠি। মনে হচ্ছে নারী ও শিশুদের তুলে নেওয়ার জন্য উদ্ধারকারী উড়োজাহাজ এসে গেছে। যদি উড়োজাহাজ ফিরে যায় তাহলে সঙ্গে আমার ডায়েরিটিও যাচ্ছে।
১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
বঙ্গোপসাগরে সোভিয়েত ও যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তির মুখোমুখি হওয়ার পরিণতি হবে ভয়ংকর। ভারতকে নিরস্ত্র করার জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন নৌ টাস্কফোর্সকে ঝামেলার দিকে ঠেলে দিয়েছেন।
বিমানবাহী জলযান এন্টারপ্রাইজ বঙ্গোপসাগরের দিকে এগোচ্ছে, সঙ্গে আছে উভচর যান ত্রিপোলি, গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট কিং, গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার তিনটি-পার্সন, ডেকাটুর এবং টার্টার স্যাম।
একইসঙ্গে স্পষ্টতই ভারতকে সাহায্য করার জন্য বঙ্গোপসাগরের দিকে সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। গোয়েন্দা প্র্রতিবেদন থেকে আরও অমঙ্গলজনক খবর পাওয়া গেছে-ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজে সোভিয়েত টেকনিশিয়ান রয়েছে, সে জাহাজ পাকিস্তানি বন্দর এবং সংলগ্ন স্থাপনার উপর আক্রমণ চালিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ অন্যান্য দেশের বাণিজ্যিক জাহাজও আক্রান্ত হয়েছে, সমুদ্রতল থেকে উৎক্ষিপ্ত রকেটও শনাক্ত হয়েছে। সোভিয়েত সাবমেরিন থেকে রকেট নিক্ষেপ করা হয়েছে কি না তা জানতে যুক্তরাষ্ট্র আশু সাহায্য চেয়েছে।
এদিকে হোয়াইট হাউজের অভ্যন্তরে পাকিস্তানের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট নিক্সন-এর পক্ষপাত লুকোবার আর কোনো চেষ্টা করা হচ্ছে না।
পাকিস্তানের 'ডিনামিক' প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।
ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ নামে পরিচিত তার সংকটকালীন সহায়তা দলকে সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পাকিস্তানকে সাহায্য করার পথ বের করতে বলেছেন। প্র্রেসিডেন্টের নীতি-নির্ধারক হেনরি কিসিঞ্জার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই হোয়াইট হাউজের গল্পকথার গোপন 'সিচুয়েশন রুমে' প্রায় প্রতিদিনই সভা করছেন।
ঢাকার ফ্লাইট ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
ব্রিগেডিয়ার শের খান (অবঃ) লিখেছেন. ১৫ ডিসেম্বর স্কোয়াড কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার লিয়াকত আসরার বুখারি অফিসারদের নিয়ে একটি সম্মেলন করলেন এবং বললেন, ইস্টার্ন কমান্ড তাকে নির্দেশ দিয়েছে, উড্ডয়ন উপযোগী সব উড়োজাহাজ সে রাতেই বার্মার আকিয়াব নিয়ে যেতে হবে, সঙ্গে যত বেশি সংখ্যক নারী ও শিশু। একটি এলুয়েট এবং এর ক্রুদের যদি জেনারেল নিয়াজির প্রয়োজন হয়, সেজন্য রয়ে যেতে হলো। যেহেতু আমি ও তৌহিদুল হক ব্যাচেলর, ক্রু হিসেবে আমাদেরই নির্বাচন করা হলো।
(জেনারেল মতিনউদ্দিনের কথায়) '১৫ ডিসেম্বর (১৯৭১) জেনারেল নিয়াজি (ফিল্ড মার্শাল) মানেকশর কাছে সিগনাল পাঠিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে শর্তযুক্ত অস্ত্রবিরতি প্রস্তাব মেনে নিলেন। জেনারেলের চার আর্মি এভিয়েশন স্কোয়াডের কমান্ডিং অফিসার লিয়াকত আসরার বুখারি প্রস্তুত, অনুমতি পেলেই রাতের অন্ধকারে তার দলবল ও হেলিকপ্টার নিয়ে বার্মা চলে যাবেন। ভারতীয় বিমান বাহিনী তুলনামূলক অধিক শক্তি ও আকার বিবেচনা করে রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ মত দিলেন, লিয়াকতকে একটা সুযোগ দেয়া যায়। উড়োজাহাজ যেন শত্রুর হাতে গিয়ে না পড়ে, সেজন্য লিয়াকতকে বাধা দেয়া ঠিক হবে না। জেনারেল নিয়াজি রাজি হলেন এবং লিয়াকতকে আদেশ দিলেন, আহত মেজর জেনারেল রহিমকে সঙ্গে নিয়ে যাক, মেজর জেনারেল রহিমের সঙ্গে ইসলামাবাদ নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রও থাকবে।
১৬ ডিসেম্বর ভোর ৩টার দিকে চারটি এমআই ৮ এবং দুটি এলুয়েট দক্ষিণমুখী হয়ে উড়ে গেল। আমাকে জানানো হলো, চট্টগ্রামে 'কিন্ডার' রাডার এখনো ঢাকায় কাজ করছে। পাকিস্তান এয়ারফোর্সের লোকজন তা কিছু সময় সচল রাখার পর ধ্বংস করে দেয়। এয়ারফিল্ডে অবস্থানরত এফ-৮৬ জেট শত্রুর হাতে পড়া এড়াতে তারা এ কাজটি করে। পরদিন সকালে আমাকে বিস্মিত করে মেজর সগির ও মাহমুদ আনোয়ার স্কোয়াড্রন কমান্ডপোস্টে এসে হাজির, এটা আমি চালাচ্ছি। তাদের তো অন্যান্য উড়োজাহাজের সঙ্গে আগেই আকিয়াব চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাদের এলুয়েট স্টার্ট না নেয়ায় তারা যেতে সক্ষম হয়নি। তারা আমাকে অনেক তোষামোদ করে বোঝাতে চেষ্টা করল, আমি যেন ইস্টার্ন কমান্ডকে রাজি করিয়ে দিনের আলোতেই তাদের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করি। 'হেড কোয়ার্টার্সের অবস্থা খুবই গোলমেলে, আত্মসমর্পণের সময় ঘনিয়ে আসছে। আমার যদ্দুর মনে হয়, তিনি এয়ার কমডোর ইনাম, আমরা কেন যাইনি সেজন্য বকাঝকা করলেন এবং হেলিকপ্টারে দ্রুত স্থান ত্যাগ করার পরামর্শ দিলেন। পাকিস্তান এয়ারফোর্সের একজন অফিসারকে আমাদের সঙ্গে নিতে বললেন। কারণ এখানে তার আর কোনো কাজ নেই।
হেলিকপ্টারগুলো যেখান পার্ক করা, আমরা গাড়ি চালিয়ে সেখানে এলাম। মেজর সগির আমার চেয়ে খানিকটা দূরে ছিলেন। পরে তার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে আমাদের আকিয়াবে দেখা হয়। আমরা যার যার মতো করে বোঝা নিয়েছি। সঙ্গে বাড়তি জ্বালানি। কারণ এলুয়েটের উড্ডয়নক্ষমতা অনেক কম। আকিয়াবে পৌঁছতে আরো বেশি সময় আকাশে থাকতে হবে (এমআই ৮ বহু দূরবর্তী সফরের জন্য বাড়তি ট্যাংক সংযোজন করা আছে), আমাদের জাহাজ চালু হলো, টেকঅফ করল, এয়ারপোর্টে যেখানে জেনারেল অরোরাকে অভ্যর্থনা জানানো হবে, সেই রিসেপশন লাইনের উপর দিয়ে আমরা উড়ে গেলাম। গাছগাছালি পাশ কাটিয়ে আমরা দক্ষিণে চলেছি। চট্টগ্রাম থেকে খানিকটা দূরে থাকতেই ফুয়েল ফিল্টারের সতর্কতা বাতি জ্বলে উঠল। মানে পাইপে জ্বালানি আটকে গেছে। এটা পরিষ্কার করতে হবে অথবা পাল্টাতে হবে নতুনবা কয়েক মিনিটের মধ্যে ইঞ্জিন তেলশূন্য হয়ে পড়বে। আমরা তখনো শত্রুর সীমানার ভেতর, কাজেই বেপরোয়া হয়ে আমরা পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে আরাকান অরণ্যে খানিকটা খালি জায়গা পেয়ে সেখানে ল্যান্ড করি।
মেজর ইজাজ মিনহাস ফুয়েল ফিল্টার বদলানোর আয়োজন করলেন। ফিল্টার না করেই আমরা জেরিক্যান থেকে জ্বালানি সরাসরি ট্যাংকে ঢাললাম। স্বাভাবিক অবস্থায় এমনটি কখনো করা হয় না। আদিবাসী উপজাতীয়দের কেউ কেউ কী হচ্ছে, দেখার জন্য উঁকিঝুঁকি দিলে আমরা তাদের দিকে সাব-মেশিনগান তাক করে রইলাম। আমরা যখন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করার পরও ইঞ্জিনের আলো জ্বলল না। আরো কয়েকটি প্রচেষ্টা একইভাবে ব্যর্থ হলো। ইঞ্জিনে জ্বালানি প্রবেশ করছে না। ততক্ষণে ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে এসেছে। ঢাকা থেকে পালিয়ে আসার পর বার্মার অরণ্যে এ এক অদ্ভুত অনুভূতি, গন্তব্য থেকে শতমাইল দূরে। ব্যাটারিকে স্বয়ংক্রিয় শক্তি অর্জনের জন্য কিছুটা সময় দেয়া হলো। আমাদের ঠোঁটে প্রার্থনা, হৃদয় চলে এসেছে মুখে। শেষে চেষ্টা হিসেবে আমি আরেকবার ইঞ্জিন ক্র্যাংক করলাম। ধীরে, অলসভাবে, মনে হলো অনন্তকাল পর শেষ পর্যন্ত ইঞ্জিনে আলো জ্বলল, গতিসঞ্চার হলো, আমরা উড়তে সক্ষম হলাম। যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, আমরা আকিয়াব অবতরণ করতে সমর্থ হলাম।
জেনারেল নিয়াজির পাঁচদিন
১২ ডিসেম্বর
লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান আরেকটি ভুয়া চিত্র আমার সামনে তুলে ধরেন। তিনি পশতু ভাষায় আমাকে বলেন, 'উত্তর থেকে হলুদ এবং দক্ষিণ থেকে সাদা' আসছে। আমাকে পূর্ব পাকিস্তান আর ৩৬ ঘণ্টা ধরে রাখার জন্য বলা হয়, কারণ উত্তর দিক থেকে চীন এবং দক্ষিণ দিক থেকে আমেরিকা আসছে। এ এক ডাহা মিথ্যে। আমি কখনো তাদের বলিনি যে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, প্রকৃতপক্ষে আমার প্রতিটি সিগনাল বার্তায় শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা বলেছি। আমার ওপর দায় ফেলে দেয়ার এ আরেক চতুরতা। পরে টেলিফোনে আমি গুল হাসানকে জানাই, দয়া করে আর মিথ্যে বলবেন না, আমি সাহায্যও চাইনি, তার প্রয়োজনও নেই। আমি আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি, পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধটার দিকে নজর দিন, সে যুদ্ধটা জেতা দরকার। আমারটা আমি বুঝব।
এর পর থেকে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলা এড়িয়ে যান। পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর জেনারেল কাজী মজিদকেও ঢাকায় শেষ অবলম্বন হিসেবে রাখা হয়নি।
১৩ ডিসেম্বর
আমি সেনা সদর দপ্তরে সিগনাল পাঠাই: ঢাকা প্রতিরক্ষা ব্যুহ সুগঠিত, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে ঢাকা প্রতিরক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি একটি প্রেস বার্তাও পাঠাই। তাতে বলা হয়, আমার মরদেহের ওপর দিয়ে ট্যাংক যাবে।
সে রাতে আমি আরো একটি সিগনাল পাঠাই: 'চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছি।' আর শেষ সৈন্যটি জীবিত থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আদেশ জারি করি। ওদিকে সরকার কিংবা আমার সঙ্গে কোনো রকম সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই ফরমান প্রস্তাব করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে আন্তর্জাতিক নিরাপদ এলাকা (ইন্টারন্যাশনাল সেফ জোন) ঘোষণা করা হোক।
রাত ১৩/১৪ ডিসেম্বর
আত্মসমর্পণ করার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে একটি খোলা, অশ্রেণীবিন্যস্ত (আনক্ল্যাসিফায়েড) সিগনাল আসে। আমি তাদের বলি, 'আমার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এখনো বহাল আছে।' গভর্নরের পক্ষে ফরমান যে সিগনাল পাঠিয়েছে, প্রেসিডেন্টের সিগনাল তারই জবাব। অথচ ফরমানের পাঠানো সিগনাল সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই। সেনাবাহিনীর প্রধান কিংবা পীরজাদা কাউকে পাওয়া গেল না। গুল হাসান এ সম্পর্কে কিছু না জানার ভান করলেন, যদিও তিনি চিফ অব জেনারেল স্টাফ এবং মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ও সিগনাল ডিরেক্টরেটের প্রধান।
গভর্নর মালিক ও তার মন্ত্রিপরিষদ পদত্যাগ করলে আমি নিঃসঙ্গ হয়ে যাই এবং চাপের মুখে পড়ি। কারণ আমি আত্মমর্পণে অনিচ্ছুক ছিলাম। একই সঙ্গে গভর্নরও আত্মসমর্পণ দলিল সই করা এড়িয়ে যেতে চাইলেন।
১৫ ডিসেম্বর
রাশিয়ার সমর্থনে পোল্যান্ড জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করে, যাতে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার এবং প্রাথমিকভাবে ৭২ ঘণ্টা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়া হয়। সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদের একান্ত সচিব ব্রিগেডিয়ার জানজুয়া আমার চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার মালিককে বর্ণিত সিগনালটি পাঠানো হচ্ছে বলে জানান। আমি সেনা সদর দপ্তরে আবার সিগনাল পাঠিয়ে জানিয়ে দিই, 'শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ করার আমার সিদ্ধান্ত বহাল আছে।'
জেনারেল হামিদ ও এয়ার চিফ মার্শাল রহিম ফোন করে ১৪ ডিসেম্বরের সেনা সদর দপ্তরের সিগনাল মান্য করার নির্দেশ দিলেন, কারণ পশ্চিম পাকিস্তান বিপজ্জনক অবস্থায়। ভারতের কমান্ডার ইন চিফের কাছে রুশদের মাধ্যমে, আমেরিকানদের নয়, বার্তা পাঠাতে ফরমান পীড়াপীড়ি করেন। আমি যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্য ও অনুগত পাকিস্তানিদের নিরাপত্তা চেয়ে বার্তা পাঠাই।
১৬ ডিসেম্বর
আমাদের ট্রুপস আত্মসমর্পণ করবে এ শর্তে ভারতের কমান্ডার ইন চিফ (জেনারেল মানেকশ) সম্মত হন। আমি তার জবাব সেনাপ্রধানকে জানাই, তিনি তা গ্রহণ করার এবং আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেন।
শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়ার জন্য এবং সেনাবাহিনীর সম্মান রক্ষা করার জন্য আমি প্রেসিডেন্টকে একটি সিগনাল পাঠাই। তিনি আমার সিগনালের ওপর লিখেন এনএফএ (নো ফারদার অ্যাকশন), আর কিছু করার নেই।
আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাই, কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। সেনাপ্রধান কোথায় আছেন, তাও বের করা যাচ্ছে না। জেনারেল পীরজাদা বেলা আড়াইটাই স্কোয়াশ খেলতে গেছেন এবং আমার সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না।
পোলিশ প্রস্তাব গ্রহণ করার বদলে ইস্টার্ন কমান্ডের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো অসম্মানজনক আত্মসমর্পণ। এভাবেই নিশ্চিত করা হলো পূর্ব পাকিস্তান কোনো উত্তরাধিকারী সরকার ছাড়াই থাকবে।
ওয়ার কমিশনে নিয়াজি
পাকিস্তান ওয়ার কমিশনের যে বক্তব্য, যে লড়াই করে তার বীরের মৃত্যুবরণ করা উচিত ছিল তিনি তা নাকচ করে দিয়ে আত্মসমর্পণের দায় নিতে অস্বীকার করেন। তিনি বরং আত্মসমর্পণের জন্য ইয়াহিয়াকে দায়ী করেন।
ওয়ার কমিশন নিয়াজির বিরুদ্ধে যুদ্ধকালীন সময়ে লাম্পট্যের ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে পান রফতানি বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ আনে। তিনি দাবি করেন, সদর দপ্তরের নির্দেশেই তাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে।
'আমি শপথ নিয়ে বলছি ইয়াহিয়া আমাকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিয়েছেন, আমি তখনও শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। আমি বার্তা পাঠিয়েছিলাম-- আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় থাকব। কিন্তু জেনারেল আবদুল হামিদ খান ও এয়ার চিফ মার্শাল রহিম আমাকে ফোন করেন এবং জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের ১৪ ডিসেম্বরের সিগন্যাল অনুযায়ী কাজ করার নির্দেশ দেন, কারণ পশ্চিম পাকিস্তান বিপদাপন্ন। ২০০১-এর ডিসেম্বরে ইন্ডিয়া অ্যাবোর্ড-এর আমির মিরকে নিয়াজি বলেন, 'এ অবস্থায় আমাকে সেনা সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে নির্দেশ দেওয়া হয়।' ইয়াহিয়া এবং অন্যান্য জেনারেলরা তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলেছেন, কারণ ইসলামাবাদ যদি যুদ্ধ চালিয়ে যায় সে ক্ষেত্রে তারা উদ্বিগ্ন ভারত গোটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তছনছ করে ফেলবে এবং পশ্চিম পাকিস্তান টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।