ঢাকা নামের এক জটিল নগরী
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হওয়ার পর বাংলার মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলো নিয়ে পাকিস্তানের পূর্ব অংশ গঠন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান বরাবরই গ্রাম অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল। আজও (এই নিবন্ধ লেখার সময়) এ অঞ্চলে ৫০ হাজারের বেশি জনসংখ্যার শহর রয়েছে মাত্র চারটি। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় শহরটি হলো পূর্ববঙ্গের নতুন রাজধানী ঢাকা। ১৯৫১ সালে এ শহরের জনসংখ্যা ছিল ২,৭৩,০০০। এ হিসেব থেকে অবশ্য তেজগাঁওয়ের জনসংখ্যাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সে সময় তেজগাঁওয়ের জনসংখ্যা ছিল ১,৫৯,০০০।
বুড়িগঙ্গার অপেক্ষাকৃত উঁচু উত্তর তীরে অবস্থিত ঢাকা। ঢাকার সবচেয়ে কাছের শহর নারায়ণগঞ্জ।
ধলেশ্বরী ও লক্ষ্যা নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ। এ শহর থেকে প্রায় পনেরো মাইল দূরে মেঘনা ও গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমনস্থল। এ থেকে পূর্ববাংলার নদীব্যবস্থা বোঝা যায়। নারায়ণগঞ্জ বন্দরটি অত্যন্ত ব্যস্ত একটি বন্দর। জায়গাটা সারাক্ষণই প্যাডেল-স্টিমার, পাটবাহী বজরা, লঞ্চ আর দেশি নৌকার আনাগোনায় মুখরিত থাকে। এ বন্দরে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা লবণ, ধান-চাল, মাটির তৈজসপত্র আনা-নেওয়া করা হয় এসব বাহনে করে। তার ওপরে, ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ, আসাম এবং দক্ষিণে চট্টগ্রামের সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত পূর্ববাংলা মিটারগেজ রেলওয়ে সিস্টেমের একটা টার্মিনালও এই নারায়ণগঞ্জ।
পূর্ব পাকিস্তানের পরিসংখ্যানবিদরা শহুরে তেজগাঁওয়ের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের ১,০০,০০০ জনসংখ্যাকেও (১৯৫১ সালে ৪,০১,০০০) 'বৃহত্তর ঢাকা'র অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্য এই সংযোজনটি এখনও যৌক্তিক নয়। কেননা এ দুটো শহরের উপকণ্ঠের মাঝখানে কমপক্ষে পাঁচ মাইল এলাকা এখনও খাঁটি অজপাড়াগাঁই রয়ে গেছে। ওই এলাকাটুকুর পুরোটাই জলাবদ্ধ ধানি জমি। এই নিম্ন ও গ্রীষ্মপ্লাবিত এলাকাকে নগরের রূপ দিতে বিস্তর টাকা খরচ হবে। তবে দেশভাগের পর আকস্মিকভাবে ঢাকার সীমানা বিস্তৃত হচ্ছে—সেই সাথে বাড়ছে প্রশাসনিক, আবাসিক ও শিল্প এলাকাও। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে অবধারিতভাবেই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ একীভূত হয়ে যাবে। এমন নজির দেখা যায় ইউরোপের অ্যাথেন্স ও পাইরেয়াসের একীভূত হওয়ার ঘটনায়।
ঢাকা এবারই প্রথম এই বদ্বীপ অঞ্চলের রাজধানী হওয়ার মর্যাদা লাভ করেনি। এ শহরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস আজ কালের ধূসর গর্ভে বিলীন। শহরটির স্বর্ণযুগ শুরু হয় সতেরো শতকে, ১৬০৮ সালে এখানে প্রতাপশালী মোগলদের পা পড়ার পর থেকে। ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে চিশতীকে রাজমহলের সুবাদার নিযুক্ত করেন সম্রাট জাহাঙ্গীর ইসলাম খান। ১৬১০ সালে চিশতী ঢাকা বিজয় করেন। দিনে দিনে শহরটির বিস্তার ও জৌলুশ বাড়তে থাকে। সেই সাথে নদীতীরে গড়ে উঠতে থাকে দৃষ্টিনন্দন অসাধারণ সব ভবন। সেসব ভবনের কিছু কিছু ধ্বংসাবশেষ আজও টিকে আছে। এ শহরের কিছু মসজিদ সেই মোগল আমলে তৈরি। ১৭০৬ সালে মগ জলদস্যু ও দুর্বৃত্তদের হাত থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে মোগল রাজপ্রতিনিধিকে ঢাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে সরিয়ে নেওয়া হয়। এর পর থেকেই শুরু হয় ঢাকার পতন।
ঢাকার মাটিতে পা রাখা প্রথম ইউরোপীয় ছিল পর্তুগিজরা। ১৬১২ সালে তারা একটি মিশন প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে ডাচ, ফরাসি, এবং প্রায় ১৬৬০জন ব্রিটিশ আসে এখানে। এদের সবাই নদী ও খালবিলের ধারে কারখানা স্থাপন করে। আঠারো শতকে তাদের পিছু পিছু আসে আর্মেনিয়ান ও গ্রিকরা। এরা মূলত লবণ, সুপারি ও কাপড়ের ব্যবসা করত। পরবর্তীতে, ১৮৫০ সালের পর, এরাই আধুনিক পাট ব্যবসার ভিত্তি স্থাপন করে।
ইউরোপীয় আগ্রাসনের ফলে ঢাকায় উন্নয়নের নবজোয়ার আসে। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটি আসে ১৭৬৫ সালে। ব্রিটিশরা অবশ্য হুগলি নদীর তীরবর্তী কয়েকটি গ্রামকে—বর্তমানে যা কলকাতা নামে পরিচিত—বাংলায় তাদের প্রধান ঘাঁটি হিসেবে বেছে নিয়েছিল। ফলে ঢাকা আবার গুরুত্ব হারায়। এরপর নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী নির্বাচিত হলে শহরটি ১৯০৬-১১ সাল পর্যন্ত কিছু সময়ের জন্য আবার পূর্বগৌরব ফিরে পায়। বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা ও প্রদেশের অন্যান্য মুসলিমরা অভূতপূর্ব প্রভাব-প্রতিপত্তি লাভ করে। ব্রিটিশ রাজত্বে এতখানি ক্ষমতা তারা আগে কখনও ভোগ করতে পারেনি। এর ফলে হিন্দুরা প্রবল প্রতিবাদ আরম্ভ করে। বঙ্গভঙ্গের ফলে কিছুদিন পরপরই দাঙ্গা সংঘটিত হতে থাকে, আক্রমণের শিকার হতে থাকে ব্রিটিশ স্থাপনাগুলো। ফলস্বরূপ ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায়। বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় মুসলমানদেরকে।
১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯০৬-১১ সালের মধ্যে ঢাকার উপকণ্ঠ রমনায় পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের সরকারি কর্মচারীদের বাসভবন ও প্রশাসনিক ভবন হিসেবে যেসব চোখধাঁধানো ভবন তৈরি হয়েছিল, সেগুলো নিয়ে গড়ে তোলা হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়।
এখনও ঢাকার সবচেয়ে আধুনিক অংশ রমনা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর, ঢাকা আবার পূর্ববাংলার রাজধানী হওয়ার পর থেকে শহরের এ অংশের উন্নয়ন হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ভবিষ্যতে ঢাকার সম্প্রসারণের জন্য যে নতুন মাস্টারপ্ল্যান নেওয়া হয়েছে, তা মূলত রমনাকেন্দ্রিক। এ এলাকায় ইতিমধ্যে অনেকগুলো নতুন ভবন উঠে গেছে নয়তো নির্মাণাধীন রয়েছে। রমনাকে মূলত 'ময়দান' বা প্রাক্তন রেসকোর্সকে ঘিরে আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এর ভেতরে আছে বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি ভবন বা সচিবালয়, ক্লাব এবং একটি অত্যাধুনিক হোটেল। হোটেলটির নির্মাণকাজ শেষ হবে ১৯৫৩ সালে। এটিই গোটা পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম 'পশ্চিমা মানের' হোটেল হবে। হোটেলের অনতিদূরেই রয়েছে ক্লাব আর সার্কিট হাউস, অফিসার ও অতিথিদের জন্য একটি ছোট সরকারি মালিকানাধীন হোটেল। অবশ্য ঢাকার সেরা আবাসিক এলাকাটি সার্কিট হাউস ও ক্লাবের মাঝখানে অবস্থিত। গত কয়েক বছরে সার্কিট হাউসের উত্তরে ও পুবে অনেকগুলো আধুনিক বাংলো এবং দুই ও তিনতলা বাসভবন গড়ে উঠেছে। ইস্পাহানি বিল্ডিং এগুলোরই অংশ।
রেলপথের পশ্চিমে, আজিমপুর শহরতলিতে একটা আধুনিক কিন্তু দ্বিতীয় সারির আবাসিক অঞ্চল গড়ে উঠছে। আগে এ এলাকার পুরোটাই ছিল ধানি জমি। ১৯৫২ ও ১৯৫৩ সালে সেসব ধানক্ষেতে গড়ে ওঠে সাদা তিনতলা বিল্ডিংয়ের বড় একটা ব্লক। ঘনবসতিপূর্ণ এ এলাকায় ছোট ব্যবসায়ী, কেরানি, অধ্যাপক এবং অন্যান্য পশ্চিমা মধ্যবিত্ত শ্রেণির বসবাস। আজিমপুরের উত্তরে, ব্রিটিশ আমলের নিউ ক্যান্টনমেন্টের কাছেই সম্প্রতি নতুন একটা আধুনিক বাজার গড়ে উঠেছে।
ঢাকার সবচেয়ে গরিব এলাকাটি উত্তর-পশ্চিমে, লালবাগ কেল্লা নামে পরিচিত মোগল দুর্গ এবং এনায়েতগঞ্জের মাঝখানে অবস্থিত। এ এলাকাটি বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ-পুব থেকে রেলরোড ধরে নারায়ণগঞ্জের সদর রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই শহরতলিগুলো পুরান ঢাকার সীমানা বাড়িয়ে চলেছে। ঢাকার অবস্থানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হলো, এর বিস্তৃতি বুড়িগঙ্গার উত্তর তীর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকা। এর বাইরে শহরটি সম্প্রসারিত না হওয়ার একমাত্র কারণ হলো, দক্ষিণ তীরের নিম্নভূমিগুলো বর্ষার সময় বন্যায় তলিয়ে যায়। বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ তীরের গ্রামগুলো আজও পূর্ববাংলার আর দশটা গ্রামের মতোই অজপাড়াগাঁ রয়ে গেছে। একেবারেই গা-ঘেঁষা রাজধানীর পরিবর্তনের ছোঁয়া এখানে লাগেনি বললেই চলে। তবে ঢাকার পাইকারি বাজারগুলোর কয়েকটা বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ তীরে স্থাপিত হয়েছে। মোগল ঢাকার প্রাচীন প্রাণকেন্দ্র, চকে খুব সহজেই যাতায়াত করা যায় এ অঞ্চল থেকে। এখানকার জমির দামও খুব সস্তা। দক্ষিণ তীরের পাইকারি বাজারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো কাঠের বাজার। বিশেষ করে জ্বালানি কাঠের চাহিদা এখানে তুমুল। এখান থেকে নৌকায় করে উত্তর তীরের চক বাজারে যাতায়াত করা হয়।
প্রাচীন ঢাকা ছিল বুড়িগঙ্গা ও ধোলাই খালের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত হিন্দু অধ্যুষিত শহর। ধোলাই খাল খনন করা হয় মোগল আমলের গোড়ার দিকে। ধোলাই নামের ছোট্ট নদী থেকে খালটি কাটা হয়। খালটি এমনভাবে কাটা হয় যে ধোলাই নদী ও খাল একত্রে পুরনো শহরটিকে বেষ্টিত করে ফেলে। এর ফলে শহরটির নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত হয়, তেমনি চমৎকার অভ্যন্তরীণ পানির উৎসও পাওয়া যায়। তারপরও এই খাল দিয়ে কেবল জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত জলপথে যাতায়াত করা যায়। এ সময় ধোলাই খালের পানির গভীরতা থাকে পাঁচ থেকে দশ ফুট। শীত ও বসন্তে এই জলপথটি স্থবির, সরু নালায় পরিণত হয়। ফলে ম্যালেরিয়া বিস্তারকারী মশার আদর্শ প্রজননক্ষেত্রে পরিণত হতো খালটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ব্রিটিশ সরকার এ খালের জীবাণুমুক্তকরণ শুরু করে।
চারটি পুরাতন ইউরোপীয় কারখানার তিনটিই ছিল—পর্তুগিজ, ফরাসি ও ব্রিটিশ—ধোলাই খাল 'দ্বীপে'। ডাচ কারখানাটি বানানো হয়েছিল অপর তিনটির ঠিক পশ্চিমে, বর্তমান মিটফোর্ড হাসপাতালের দখলকৃত জায়গায়। 'দ্বীপের' কেন্দ্রবিন্দু—ভিক্টোরিয়া পার্ক—এখন ঢাকার প্রাণকেন্দ্র। জায়গাটি এখন ছোট্ট ধূলিময় চত্বরে পরিণত হয়েছে। ঢাকার বেশিরভাগ গির্জা ও ব্যাংকই ভিক্টোরিয়া পার্কের আশেপাশে অবস্থিত। একটি ব্রিটিশ ও আমেরিকান স্কুল এবং প্রধান পোস্ট অফিসও আছে এ এলাকায়।
পুরান ঢাকার সড়ক ব্যবস্থা ভীষণ জটিল। সংকীর্ণ, আঁকাবাঁকা এ রাস্তাগুলো যেন একেকটা গোলকধাঁধা। সদর রাস্তাগুলো সাধারণত বিশ-ত্রিশ ফুট প্রশস্ত, অন্যান্য রাস্তার বেশিরভাগই পনেরো ফুটেরও কম চওড়া। কোনো রাস্তাতেই ফুটপাত নেই, বেশিরভাগেরই বেহাল দশা। সারাদিনই এসব রাস্তা পথচারি আর সব ধরনের যানবাহনের—জিপ, কার, লরি, মোটরসাইকেল, দুই চাকার ঘোড়ার গাড়ি ও অগুনতি রিক্সা—চলাচলে কোলাহলমুখর থাকে।
ঢাকার প্রধান দুই সড়ক হলো ইসলামপুর রোড এবং নবাবপুর রোড। ইসলামপুর রোড বুড়িগঙ্গার তীর থেকে এক ফার্লংমতো দূরত্ব রেখে সমান্তরালে চলে গেছে। কয়েকটি নতুন নাম নিয়ে সড়কটি চক থেকে ভিক্টোরিয়া হয়ে চলে গেছে নারায়ণগঞ্জের দিকে। ইসলামপুর রোড ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে এসে দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। উত্তরের শাখাটি 'শেল স্ট্রিট' বা 'শাঁখারিবাজার রোড' নামে বিখ্যাত। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এখানকার প্রায় ৪,০০০ হিন্দু শাঁখ নির্মাণশিল্পের সাথে জড়িত ছিল। শাঁখ নির্মাণশিল্পের সাথে জড়িতদের বলা হয় শাঁখারি। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারির দাঙ্গার পর হাজার হাজার হিন্দু ঢাকা ছেড়ে ভারতে চলে যায়। তাদের মধ্যে অনেক শাঁখারিও ছিল। আজও বহু দোকানে শাঁখ বানানো হলেও, সিলন (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) ও মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই) থেকে শঙ্খ আমদানির ওপর রয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ। এই বিধিনিষেধের ফলে ঢাকার প্রাচীনতম শিল্পটি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। ইসলামপুর রোডের দক্ষিণ শাখা পরিচিত পাটুয়াটুলি নামে। কয়েক শতাব্দী ধরে গহনা এবং সোনা ও রুপার তার দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের গয়নার আঁতুড়ঘর হিসেবে গড়ে উঠেছে পাটুয়াটুলি। এই সনাতনী কারুশিল্পটিও আজ বিলুপ্তির মুখে।
ইসলামপুর রোডের ধোলাই খাল থেকে ভিক্টোরিয়া রোড পর্যন্ত অংশটি বোনা-কাপড় ও ঘড়ি বেচাকেনার কেন্দ্র। ধোলাই খাল ও চকের মাঝখানে একটা ছোট্ট চীনা কলোনি আছে। এই কলোনির বেশিরভাগ বাসিন্দাই জুতা প্রস্তুতকারক। তবে সড়কের এই অংশের বেশিরভাগ জুড়েই আছে মুদিখানা, মৃৎপাত্র এবং ছুরি-কাঁচির দোকান। চকের পুরোটাই একটা বিশাল পাইকারি বাজার। ১৯৫০ সালে মূল বাজার পুড়ে যাওয়ার পর থেকে অপরিচ্ছন্ন বাঁশের ব্যারাক তুলে বেচাকেনার কাজ হচ্ছে এখানে। পাইকার বাজারটি চকের পশ্চিম থেকে লালবাগ কেল্লা হয়ে বিশাল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পর্যন্ত বিস্তৃত। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার চকের উত্তরে অবস্থিত। চকের পশ্চিম অংশে মূলত চামড়ার (গরু ও ছাগল) ব্যবসা হয়ে থাকে। প্রায় সময়ই রাস্তায় দাঁড়িয়েই ব্যবসা চলে।
ঢাকার প্রধান খুচরা বেচাকেনার কেন্দ্র হচ্ছে নবাবপুর রোড। ভিক্টোরিয়া পার্কের উত্তর থেকে রেলরোড ধরে রমনার দিকে এগিয়ে গেছে সড়কটি। নবাবপুর রোড চলে গেছে একেবারে সদরঘাট পর্যন্ত। ইসলামপুরের মতো নবাবপুরেও আগে হিন্দু ব্যবসায়ীদের আধিপত্য ছিল। ১৯৫০-এর দাঙ্গার পর হিন্দুরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে খুব কম ব্যবসাতেই তাদের আধিপত্য আছে। অল্প সেসব ব্যবসার মধ্যে রয়েছে ফার্মেসি ব্যবসা। ডাক্তাররা ফার্মেসিগুলোতে বসে রোগী দেখেন। এর বিনিময়ে ওষুধ বিক্রি থেকে যে লাভ হয়, তার একটা অংশ পান তারা।
দেশভাগের আগে ঢাকার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই ছিল হিন্দু। এখন তারা মোট জনসংখ্যার ১৫-২০ শতাংশের বেশি হবে না। এখনও তাদের বেশিরভাগ নবাবপুর রোডের পশ্চিমে, পুরনো হিন্দু বাজার এলাকায় থাকে। বাকিরা থাকে শাঁখারি বাজার ও ইসলামপুর রোডের আশপাশে।
নবাবপুরের সিকি মাইলটাক পশ্চিমে সমান্তরালে এগিয়ে যাওয়া রাস্তাটি ছুতার ও কাঠমিস্ত্রিদের কেন্দ্রস্থল। বাঁশ, সেগুন, শাল ও অন্যান্য কাঠ কেনাবেচা হয় এখানে। ইসলামপুর রোড যেখানে দ্বিখণ্ডিত হয়েছে, তার কাছেই, ফ্রেঞ্চ ফ্যাক্টরিতে এসে মিলেছে ফ্রেঞ্চ রোড। এখান থেকে আরও পশ্চিমে, ধোলাই খাল ক্রসিংয়ের কাছে একটা গলি গিয়ে মিশেছে ইসলামপুর এবং পুরান ঢাকার একমাত্র সবুজ জায়গার সাথে। এই জায়গাটি পরিচিত আরমানিটোলা পার্ক নামে।
কেন্দ্রীয় ঢাকায় কয়েকটি কুটির শিল্প রয়েছে। আছে কিছু সাবান ও দেশলাইয়ের কারখানাও। তবে বড় বড় শিল্পকারখানাগুলোর পত্তন হচ্ছে মূলত শহর অঞ্চলের উপকণ্ঠে। যেমন, হরদেও গ্লাসওয়ার্কস কারখানাটি শহরের পুব দিকে অবস্থিত। গত কয়েক বছরে রাবার, চামড়া ইত্যাদির নতুন নতুন কারখানা গড়ে উঠেছে তেজগাঁওয়ে। আশা করা হচ্ছে ঢাকার শিল্প-উন্নয়ন এসবকে কেন্দ্র করেই হবে।
নারায়ণগঞ্জের উত্তরে, লক্ষ্যা নদীর তীরে গড়ে উঠছে আরেকটি শিল্পকেন্দ্র। নতুন নতুন সড়ক বানিয়ে এই অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলা হচ্ছে ঢাকা। নারায়ণগঞ্জের এ শিল্প এলাকায় ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বড় বড় সুতা কাটার ও বয়ন কারখানা গড়ে উঠেছে। পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল, আদমজী জুটমিলও এখানেই অবস্থিত। পাটকলটি ইতিমধ্যে কলকাতার পাটশিল্পের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পাটকলটি মোট তিন ভাগে বিভক্ত—এর মাঝে দুটো অংশ ইতিমধ্যে চালু হয়ে গেছে। আশা করা হচ্ছে, তৃতীয় অংশটি ১৯৫৪ সালে উৎপাদনে যাবে।
'বৃহত্তর ঢাকা'য় টেক্সটাইল শিল্প ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এটিই যে শীর্ষস্থানীয় শিল্পে পরিণত হবে তাতে সন্দেহ নেই। পুরান ঢাকার বিখ্যাত মসলিন শিল্প বিলীন হয়ে যাবার জন্য যারা আফসোস করেন, তাদের জন্য এই শিল্প সান্ত্বনা হতে পারে। স্বচ্ছ দেশি সুতি কাপড়ে তৈরি অনিন্দ্য সুন্দর নক্সা-সমৃদ্ধ এই শাড়িটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গোটা ভারতবর্ষে চাহিদার শীর্ষে ছিল। ল্যাঙ্কাশায়ারের শিল্পকারখানায় উৎপাদিত সস্তা কাপড়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে উনিশ শতকের প্রথম দিকে হারিয়ে যায় এই অতুলনীয় শিল্প। বর্তমানে ঢাকার কোনো তাঁতিই অতীতের সূক্ষ্ম, নিখুঁত মসলিন বুনতে পারে না। ঢাকা এখন গৌরবমণ্ডিত মোগল আমলের 'আবিরাওয়ান', 'শবনম' প্রভৃতি নামের মসলিনের পরিবর্তে সস্তা পাটের থলে, চট ও সুতি কাপড় উৎপন্ন করে।
ঢাকাকে নিয়ে অতি সংক্ষেপে লিখতে গেলেও শহরটির জনসাধারণের যাতায়াত-মাধ্যম নিয়ে লিখতে হবে। এছাড়া লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এ শহরে কোনো স্ট্রিটকার (ট্রাম) নেই; একটি টাউন বাস সার্ভিস আছে। কিন্তু বাসগুলো মান্ধাতার আমলের, জরাজীর্ণ, এবং অবধারিতভাবেই ধারণক্ষমতার চাইতে কয়েকগুণ বেশি যাত্রী বহন করে। এখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহন সাইকেল-রিক্সা। দুজন যাত্রী ওঠানো যায় এতে। গোটা শহরেই রিক্সা পাওয়া যায়। এছাড়াও কিছু দু-চাকার ঘোড়ার গাড়ি আর ট্যাক্সি চলে এ শহরের রাস্তায়। ট্যাক্সিগুলো মূলত আধুনিক আমেরিকান গাড়ি। ট্যাক্সিতে চড়ার খরচ মাত্রাতিরিক্ত বেশি।
ঢাকার উত্তরে, তেজগাঁওয়ে একটি বিমানবন্দর আছে। এখান থেকে সরাসরি করাচি, লাহোর ও রেঙ্গুন, এবং পূর্ববঙ্গের যশোর ও চট্টগ্রামের সাথে বিমান যোগাযোগ রয়েছে। তবে এসবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো রেল ও পানিপথে স্টিমার যোগাযোগব্যবস্থা। ঢাকা থেকে স্টিমার দিয়ে মূলত চট্টগ্রাম, সিলেট ও উত্তরবঙ্গে (রংপুর-দার্জিলিং) যাওয়া যায়। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ হয়ে, গঙ্গার ওপর দিয়ে গোয়ালন্দ হয়ে, মেঘনা ও গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থলে যাতায়াত করা যায়। সেখান থেকে ট্রেনে করে কলকাতা বা চালনার নতুন পাট বন্দর থেকে ১৫ মাইল দূরে, খুলনায় যাওয়া যায়। এছাড়াও ঢাকা ঘাট থেকে বরিশালের সুন্দরবন এলাকায় সরাসরি স্টিমার সার্ভিস আছে।
সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা কেবল ঢাকা নয়, গোটা প্রদেশেই সমস্যায় জর্জরিত। ঢাকা থেকে অন্য কোনো জেলা শহরে যাবার সরাসরি কোনো রাস্তা নেই। শহর থেকে গাড়িতে করে কোনো দিকে পনেরো মাইলের বেশি যাওয়া যায় না। ঢাকার ভবিষ্যত উন্নতি যে পূর্ববঙ্গের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার ব্যাপক সম্প্রসারণের ওপর নির্ভর করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বন্যা ও নদীবিধৌত এই অঞ্চলের সমস্যাগুলো খুব জটিল। এখানে প্রায় সব রাস্তাই বাঁধের ওপর তৈরি করতে হবে। প্রক্রিয়াটা একে তো অত্যন্ত ব্যয়বহুল, তার ওপরে ধান ও পাটক্ষেতগুলো প্রাকৃতিকভাবে যে সেচের পানি পায় তা-ও বন্ধ হয়ে যাবে এর ফলে। উন্নত সড়কব্যবস্থার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। এ কাজ শেষ হলে ব্যাপক উন্নতি হবে পূর্ববঙ্গের রাজধানী ও প্রশাসনিক কেন্দ্র ঢাকার। সেই সাথে রাজধানীর সাথে তেতাল্লিশ মিলিয়ন মানুষের সহজ যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
ইয়োহানেস হুমলুম: ভূগোলবিদ, ডেনমার্কের, ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি ইউনিভার্সিটি অফ কোপেনগেহেগেনের ভূগোলের অধ্যাপক ছিলেন