ঠাকুর-অ্যালবামে কয়লা ধূলি
কয়লা সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চল ভারত। সম্প্রতি দেখা গেছে, এ জিনিসের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ক্ষমতাও প্রচুর। ভারতের খনিগুলো থেকে কয়লা উত্তোলনের ইতিহাস কিন্তু এই সেদিনের। ডি পি ঝা তার এক গবেষণাপত্রে লিখেছেন, খনিজ কয়লার কোনো নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক নাম নেই। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে নানা খনিজ পদার্থের নাম থাকলেও, সেখানে খনিজ কয়লার কোনো উল্লেখ নেই।
মাঝেসাঝে সংস্কৃত 'অঙ্গার' শব্দটি ব্যবহার করা হয় কয়লার পরিভাষা হিসেবে। কিন্তু ঝা দেখিয়েছেন, 'অগ্নিস্ফুলিঙ্গ' বা 'উত্তপ্ত ছাই' অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ 'কাঠকয়লা'কে 'অঙ্গারে'র প্রায় যথার্থ পরিভাষা বলা যায়।
ঝা লিখেছেন, 'সেই প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন ভারতীয় জনগোষ্ঠী যে কেবল কাঠকয়লা ব্যবহার করেই লোহা গলিয়ে আসছে, এ কথা সুবিদিত।' আসলে ভারতের বন-জঙ্গল থেকে এত বেশি পরিমাণ কাঠকয়লা পাওয়া যায় যে খনিজ কয়লার সন্ধান করার প্রয়োজনই হয়নি।
শুরুর কথা
এশিয়ার বৃক্ষহীন ঠান্ডা অঞ্চল থেকে আসা মোগলরা খনিজ কয়লার ব্যাপারে জানত। বাবর যেখান থেকে এসেছিলেন, সেই ফারগানায় কয়লা ব্যবহার করা হতো আগুন জ্বালাতে। কিন্তু ভারতবর্ষে এসে বাবর আর কয়লা নিয়ে কোথাও কিছু বলেননি।
ভারতে সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে প্রথম খনিজ কয়লা উত্তোলনের পদক্ষেপ নেন একজন আমেরিকান। তার নাম সুয়েটোনিয়াস গ্রান্ট হিটলি। জন্ম রোড আইল্যান্ডের নিউপোর্টে। আমেরিকান বিপ্লবের সময় তার পরিবার ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত থাকে এবং ব্রিটেনে পালিয়ে যায়।
১৭৬৬ সালে, সম্ভবত ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসের আনুকূল্যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দেন হিটলি। ছোটনাগপুর ও পালামৌয়ের কালেক্টর হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। এ অঞ্চলে সফরের সময় হিটলি লক্ষ করেন, আদিবাসীরা কয়লা দিয়ে আগুন জ্বালাচ্ছে। ঝা লিখেছেন, এসব কয়লা এ অঞ্চলের মাটির উপরের স্তরেই পাওয়া যেত। জায়গাটা দামোদর নদীর অদূরেই।
গ্রান্ট ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আরেক কর্মচারী জন সামনার বুঝতে পারেন, এ অঞ্চলে কয়লাখনি আছে। এবং সেই কয়লা উত্তোলন করে নদীপথে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া যাবে সহজেই।
ব্যর্থ উদ্যোগ
গ্রান্ট ও সামনার কয়লা উত্তোলনের অনুমতি চেয়ে কোম্পানির কাছে আবেদন করেন। কিন্তু ১৭৭০ সালে তাদের প্রথম আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়। ব্রিটেন থেকে আমদানি করা খনিজ কয়লা ভারতে চড়া দামে বিক্রি করার একচ্ছত্র অধিকার হারানোর ভয়েই সম্ভবত কয়লা উত্তোলনের অনুমতি দেয়নি কোম্পানি।
এছাড়াও কোম্পানির ভয় ছিল ভারতীয়রা খনিজ কয়লার সঠিক ব্যবহার শিখে ব্রিটিশদের চেয়ে এগিয়ে যাবে। ব্রিটিশরা ভয় পাচ্ছিল, কয়লা ব্যবহার করে ধাতু-আকর গলিয়ে কামানের গোলা বানানোর কৌশল শিখে ফেললে ভারতীয়রা তাদেরকে টেক্কা দিয়ে দেবে।
তবে আবেদন খারিজ হয়ে গেলেও দমে যাননি গ্রান্ট ও সামনার। ১৭৭৪ সালে ফের চেষ্টা করেন তারা। তখন কোম্পানির দায়িত্বে ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। এবার খনিতে খননের পাশাপাশি খনিসংলগ্ন পতিত জমি ব্যবহারের অনুমতিও চান গ্রান্ট ও সামনার। জমি চাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিকদের সামনে মূলা ঝোলানো— 'এসো, খনিতে কাজ করো, খনির কাজ শেষে পাশের জমিতে চাষবাস করো।' ইউরোপীয় মাইনার নিয়ে আসার অনুমতিও চান তারা।
এবার কোম্পানি রাজি হয়। তবে জমি অধিগ্রহণের সমস্যা অনুমান করে খনিসংলগ্ন জমি সাময়িক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। কোম্পানির অনুমান সত্যি করে দিয়ে জমি অধিগ্রহণ শুরু করতেই নানা রকম আইনি ঝামেলা আরম্ভ হয়। গোদের ওপর বিষফোঁড় হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে আনানো মাইনাররা ভারতের আবহাওয়ায় অসুস্থ হয়ে মারা যান। এছাড়াও দামোদরে কয়লা বয়ে নেওয়ার মতো পানি থাকত মাত্র কয়েক মাস। এসব নানা কারণে বারবার ভেস্তে যায় গ্রান্ট-সামনারের প্রচেষ্টা।
দ্বারকানাথের আবির্ভাব
মাইনার সমস্যার সমাধান করা হলো স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে। কিন্তু পরিবহন সমস্যা থেকেই গেল। এ সমস্যার কারণে কয়লার দাম বেড়ে গেল অনেক। কারণ খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করার সঙ্গে সঙ্গে ওগুলো পরিবহণে পাঠানো যেত না। উপযুক্ত সময়ে পরিবহণের জন্য বিপুল পরিমাণ কয়লা ফেলে রাখতে হতো গাদা করে। এর ফলে অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে যেত কয়লার মান।
১৭৭৮ সালে কোম্পানির কলকাতার স্টোরকিপার আমদানিকৃত ইংরেজ কয়লা ও ভারতীয় কয়লার মধ্যে একটি তুলনামূলক পরীক্ষা করে। তাতে দেখা যায়, এক মণ বিলেতি কয়লা দিয়ে যতটুকু কাজ করা যায়, ঠিক সে পরিমাণ কাজ করার জন্য দুই মণ দেশি কয়লা লাগে। ফলে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গ্রান্ট-সামনারের উদ্যোগ।
পরের চল্লিশ বছরে অবস্থা আর বদলায়নি। তবে ১৮১৪ সালের দিকে কলকাতায় কয়লার চাহিদা এত বেড়ে যায় যে ভারতের খনি থেকে কয়লা তোলার ব্যাপারে ফের চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উইলিয়াম জোন্সকে পাঠায় বর্ধমান থেকে কয়লা উত্তোলন করা যায় কি না দেখার জন্য। সে উদ্দেশ্যে জোন্স বর্ধমানের রানির কাছ থেকে ৯৯ বিঘা জমি ইজারা নেন। রানিগঞ্জ নামের সে জায়গায় কাজ শুরু করেন জোন্স। কিন্তু ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকেন। ১৮২১ সালে কলকাতার আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোং জোন্সের ঋণ পরিশোধ করে দিয়ে রানিগঞ্জের দখল নেয়। তারপর নিজেরাই কয়লা উত্তোলন আরম্ভ করে।
আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোং-এর সময় পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়। আগে যেখানে বছরে ৪ হাজার মণ কয়লা উত্তোলন হতো, সেখানে ১৮২৭ সালেসে পরিমাণ গিয়ে ঠেকে বার্ষিক ২ লক্ষ ৭ হাজার মণে। কয়লা উত্তোলন কোম্পানিটির সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়। এ ব্যবসায় বছরে তাদের লাভ থাকত ৭০ হাজার রুপি।
কিন্তু ১৮৩২ সালে আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোং লোকসানে পড়ে।
এরপর কয়লা খনির ব্যবসা চলে যায় 'কার অ্যান্ড টেগোর কোম্পানি'র হাতে। কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা দ্বারকানাথ ঠাকুর। পুলিশ কর্মকর্তার ঘরে জন্মানো দ্বারকানাথ ছিলেন ভারতের প্রথম বড় শিল্পোদ্যোক্তাদের অন্যতম। রাণীগঞ্জ কিনে নেওয়া ছিল দ্বারকানাথের ব্যবসা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ।
ব্যবস্থাপনা ও কারিগরি দিক দেখার জন্য দক্ষ লোক ছিল দ্বারকানাথের কোম্পানির হাতে। ছিল পর্যাপ্ত পুঁজি এবং কলকাতা ও স্থানীয় কর্মকর্তা উভয়কেই সামলানোর দক্ষতা। আগে কার অ্যান্ড টেগোরের লোকবল এদিক-ওদিক নানা ব্যবসায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। রানিগঞ্জ কিনে নেওয়ার পর কোম্পানিটির সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয় এখানে।
দ্বারকানাথের হাতে ছিলেন সি ডি টেইলর। প্রায় স্বশিক্ষিত এই মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারকে রানিগঞ্জের ম্যানেজার নিয়োগ দেয়া হয়। বন্যা, অগ্নিকাণ্ড, ইঞ্জিনের গোলমাল, পয়সার ঘাটতি, শ্রমিক ধর্মঘট, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আইনি ঝামেলা সব একা হাতে সামলাতেন তিনি।
প্রতিদ্বন্দ্বী
দুজন প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বারকানাথকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে। একজন জেরেমিয়াহ হামফ্রে। কলকাতার এক বিখ্যাত ফার্মের পৃষ্ঠপোষকতায় রাণীগঞ্জের কাছেই, নারায়নকুরিতে এক খনি কেনেন। তবে সেখানকার কয়লার মান এত ভালো ছিল না। আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আর্সকিন ভাইয়েরা। তাদের খনি ছিল মঙ্গলপুরে। আর্সকিন ভাইয়েরা আবার প্রভাবশালী নীলচাষীও ছিলেন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ওপর ভালো প্রভাব ছিলতাদের।
এ দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে নানাভাবে লড়তে হতো কার অ্যান্ড টেগোরকে। নানা আইনি ঝামেলা পোহাতে হতো। অবশেষে ১৮৪৩ সালে হামফ্রের প্রতিষ্ঠান কিনে নেন দ্বারকানাথ। গঠন করেন বেঙ্গল কোল কোম্পানি। এরপর বন্ধ করে দেন হামফ্রের কয়লাখনি।
আর্সকিনদের কোম্পানিকে টেক্কা দিতে কার অ্যান্ড টেগোর নীল ব্যবসায় নামে। বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে কৃষকদের ভাগিয়ে আনার চেষ্টা করে তারা। মোদ্দা কথা, পূর্ব ভারতের একমাত্র কয়লা সরবরাহকারী হওয়ার জন্য পথের সমস্ত কাঁটা দূর করার চেষ্টা করে কার অ্যান্ড টেগোর।
কোম্পানিটি এ প্রচেষ্টার সুফল পায় হাতেনাতে। শিল্পক্ষেত্রে তরতর করে উন্নতি করতে থাকে বাংলা। আর সেই উন্নতির জ্বালানি ছিল কার অ্যান্ড টেগোর।
দ্বারকানাথের একচেটিয়া ব্যবসার কারণে ব্রিটিশরা তার ওপর নাখোশ ছিল। তার আধিপত্যে চিড় ধরানোর জন্য নানান ফন্দি-ফিকির করতে থাকে তারা। যেমন, আসামের কয়লাখনি থেকে কয়লা উত্তোলনে উৎসাহ দেয় অন্যদের।
কিন্তু দ্বারকানাথ ছিলেন ঝানু ব্যবসায়ী। ইংরেজদের ওষুধ ইংরেজদেরকেই গেলান তিনি। ব্রিটিশরা যখন আমদানি করা কয়লায় বাজার সয়লাব করে দেওয়ার চেষ্টা করল, সেসবের সিংহভাগই কিনে নিলেন দ্বারকানাথ। তারপর নিজে বিক্রি করলেন ওই কয়লা। অভিজাত বাঙালি সমাজের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। জমি অধিগ্রহণের জন্য এ সম্পর্ককে কাজে লাগাতেন। আর আইনি সুবিধার জন্য কৌশলে সমর্থন দিতেন ব্রিটিশদের।
ভাগ্যদেবীর সাহায্যও পেয়েছেন দ্বারকানাথ। আফিম যুদ্ধ শুরু হওয়ার ফলে ব্রিটিশদের আসাম কয়লা-ষড়যন্ত্র ভেস্তে যায়। তাছাড়া যুদ্ধজাহাজ চালানোর জন্য হুট করেই জরুরি ভিত্তিতে কয়লার প্রয়োজন পড়ে ইংরেজদের। অগত্যা তাদেরকে এসে ধরনা দিতে হয় কার অ্যান্ড টেগোরের কাছে।
এছাড়াও কয়লার নতুন বাজার পেয়ে যান দ্বারকানাথ। টেইলর দেখলেন কয়লার আগুনে ধোঁয়া একেবারেই কম হয়। এই কয়লা তিনি কলকাতার বাসাবাড়িতে বিক্রি শুরু করেন।
বেঙ্গল কোল কোম্পানি গঠন ও কয়লাশিল্প নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করার পর থেকে দ্বারকানাথ এ শিল্প থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অবশ্য একটা শেষ চেষ্টা করেছিলেন তিনি। রানিগঞ্জ থেকে হাওড়া পর্যন্ত কয়লা পরিবহণ সহজ করতে তিনি রেললাইন তৈরির চেষ্টা করেন। কিন্তু এ কাজে সফল হলে দ্বারকানাথের প্রতিপত্তি কতটা বেড়ে যাবে, তা ভেবে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে ওঠে ব্রিটিশরা। কাজেই তড়িঘড়ি করে দ্বারকানাথের উদ্যোগ ভেস্তে দেয় তারা। সেই রেললাইন নির্মাণ হয় তার মৃত্যুর দশ বছর পর।
বিস্মৃত দ্বারকানাথ
দ্বারকানাথের কয়লাখনি ও কলকাতার অন্যান্য শিল্পোদ্যোগ তার পরিবারের সম্পদ ও প্রতিপত্তির ভিত নির্মাণ করে দিয়েছিল। এসব ব্যবসার লাভ থেকেই তৈরি হয় জোড়াসাঁকোর প্রাসাদোপম বাড়ি। অথচ তার সবচেয়ে বিখ্যাত উত্তরসূরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখাজোখায় পিতামহের কথা বলতে গেলে উল্লেখই করেননি।
কয়লা ব্যবসার সঙ্গে যে নিষ্ঠুরতা ও দুর্নীতির দাগ লেগে থাকে, তা থেকে গা বাঁচিয়ে চলার জন্যই হয়তো রবীন্দ্রনাথ সবসময় পিতামহের প্রসঙ্গ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন।
- সূত্র: ইকোনমিক টাইমস