ছদ্মবেশী মানচিত্র নির্মাতা
উনিশ শতকের শেষ নাগাদ ভারতের নিয়ন্ত্রক ব্রিটিশরা উত্তরাঞ্চল বাদে প্রায় গোটা দেশের মানচিত্র তৈরি করে ফেলে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশ্রেণী হিমালয় পর্বতমালা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এখানে। মধ্য এশিয়ার ব্যাপারে অতি আগ্রহী রাশিয়ানরাও পথ রোধ করে রেখেছিল। চীনারা জানতো, রাশিয়ান বা ব্রিটিশরা এ অঞ্চলের মানচিত্র হাতে পেলে সেটা এ অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তৃত করার সুযোগ করে দেবে। তাই চীনের সম্রাট কোনও বিদেশি, বিশেষ করে ইউরোপীয় বে-আইনীভাবে তিব্বতে পা রাখলে প্রাণ দিয়ে মাশুল গুনতে হবে বলে আইন জারি করেছিলেন।
সম্ভবত সে আমলের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী মানচিত্র নির্মাণ প্রকল্প গ্রেট ইন্ডিয়ার সার্ভের ব্রিটিশ নেতৃবৃন্দ তাদের মানচিত্রের উপরের অংশ ফাঁকা ফেলে রাখতে রাজি ছিলেন না। স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে যখন যে মানচিত্র পাওয়া গেছে তারা কিনে নিয়েছেন। কিন্তু আরও নিখুঁত তথ্য চাইছিলেন তারা। ইংরেজ জরিপকারীরা তিব্বতে ঢুকতে না পারলে ইংরেজদের কাছে তালিম পাওয়া জরিপকারীদেরই কাজটা সারতে হবে।
যে মানুষটিকে তাদের দরকার ছিল তিনি তখন নেপাল-ভারত সীমান্তের কাছে জোহর উপত্যকায় এক স্কুলে পড়াতেন। ছিপছিপে গড়নের তিরিশ বছর বয়স্ক পণ্ডিত নয়ন সিংহ ছিলেন একজন বণিকের ছেলে। তিনি তাকে কিছু পরিমাণ তিব্বতি ভাষা শিখিয়েছিলেন। ১৮৬৩ সালে সিংহ গ্রেট ব্রিটেনের সার্ভের সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়ে প্রশিক্ষণ নিতে দেরা দুনে প্রতিষ্ঠানের উত্তরাঞ্চলীয় দপ্তরে হাজির হন।
টানা দুই বছর জরিপ কাজের বিভিন্ন সরঞ্জাম ব্যবহারের কায়দা নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি: থিওডোলাইট, সেক্সট্যান্ট, কম্পাস এবং থার্মোমিটার (উচ্চতা মাপার জন্যে)। কিন্তু সিংহের মূল যন্ত্র ছিল তার দুটি পা। দুই বছর ধরে তিনি ঠিক ২,০০০ কদমে এক মাইল হাঁটার মতো পদক্ষেপের কায়দা রপ্ত করেছেন, প্রতি পায়ে আন্দাজ ৭৯ সেন্টিমিটার (৩১ ইঞ্চি)।
১৮৬৫ সালে রওয়ানা হন সিংহ। শেষতক একটা সফরে থাকা কাফেলার সাথে শীতল পাথুরে মালভূমি হয়ে লাসার দিকে এগিয়ে যান। অক্টোবরের দিকে কাফেলা শিগাতসে পৌঁছায়। সিংহ এখানে সভয়ে জানতে পারেন পঞ্চন লামার কাছে হাজির করা হবে তাদের। এই ধর্মীয় গুরুর নাকি মানুষের হৃদয়ের গভীরে দৃষ্টি দেওয়ার ক্ষমতা আছে। গুপ্তচরকে লামার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু পঞ্চন সিংহাসনে আসীন জাঁকাল পোশাকের তরুণ সিংহের ছদ্মবেশ ধরতে পারলেও তার কোনও আভাস দিলেন না। তিনি স্রেফ সিংহকে আশীর্বাদ করে চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন।
কাফেলা লাসার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলল। সিংহ ২,০০০ কদমে এক মাইল হাঁটতে পারতেন বলে প্রতি হাজার কদমে বিশেষভাবে তৈরি জপমালা গুনছিলেন। গোপনে ফেলে আসা দূরত্ব এবং তার বর্তমান অবস্থানের স্থানাঙ্ক লিখে রাখছিলেন। চায়ের জন্যে গরম পানির তাপমাত্রা দেখার থার্মোমিটার ব্যবহার করে তিরিশটির বেশি জায়গার উচ্চতা মাপতে পেরেছিলেন তিনি।
১৮৬৬ সালের জানুয়ারিতে দেয়াল ঘেরা শহর লাসায় পৌঁছালেন মানচিত্র আঁকিয়ে। তার হিসাব মতে এখানকার উচ্চতা ৩,৪৭৫ মিটার (১১,৪০০ ফুট)-সঠিক উচ্চতা ৩,৬০০ মিটার (১১,৮০০ ফুট) বেশ কাছাকাছি। এখানে খাবারের জন্যে আগন্তুকদের কাছে ভিক্ষাপাত্র পেতে সাধারণ তর্থযাত্রীর মতো তিন মাস কাটান তিনি।
লাসায় অব্স্থান করার সময় সর্বক্ষণ বিপদের ভেতর ছিলেন সিংহ। তিনি চীনাদের প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ শহরে অবৈধ লোকদের শিরোচ্ছেদ করতে দেখেছেন। এপ্রিলের দিকে মানচিত্র আঁকিয়ে স্থির করলেন এটাই পালানোর উপযুক্ত সময়। একটা পশ্চিমগামী কাফেলায় যোগ দেন তিনি। ওরা তিব্বত থেকে বেরিয়ে আসার পথে তিনি সাঙপো নদী বরাবর ৮০০ কিলোমিটার (৫০০ মাইল) পথের মানচিত্র আঁকেন। একরাতে অন্ধকারে পিছলে বেরিয়ে গিয়ে দেরা দুনের পথ ধরেন।
ব্রিটিশ গোয়েন্দারা সিংহের অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশসহ ১,৯০০ কিলোমিটার যাত্রার (১,২০০ মাইল) প্রতিবেদন হাতে পেয়ে মহাখুশি হয়ে ওঠেন। তিনি 'এশিয়ার মানচিত্রে আমাদের সময়ের যেকারও চেয়ে অনেক বেশি ইতিবাচক জ্ঞান যোগ করেছেন' বলে ঘোষণা দেন তারা। সিংহকে ভারতীয় সাম্রাজ্যের একজন সহচর ঘোষণা করে পদক এবং আজীবন পেনশন বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু একটা সমস্যা ছিল: সিংহ কেবল মানচিত্র সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে আনেননি, বরং একটা নতুন প্রশ্নও আমদানি করেছিলেন। সাঙপো নদী পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্রে পরিণত হয়েছে? এই রহস্যের ফয়সালার লক্ষ্যে গোয়েন্দারা একটা দারুণ পরিকল্পনা ফাঁদলেন। সাংপো নদীতে রোজ পঞ্চাশটা করে গাছের গুড়ি ভাসাতে আরেক ভারতীয় দলকে হিমালয়ে পাঠাবেন তারা। দৈনিক পঞ্চাশটা গাছের গুড়ি ব্রহ্মপুত্রে দেখা দিলেই বুঝতে হবে এদুটো নদী এক।
এবার সফরের জন্যে তারা সত্যিকারের একজন সাধু বা লামাকেই কাজে নিলেন এবং গোপন মানচিত্র নির্মাণে তাকে সহায়তা করতে কিনথাপ নামে এক ভৃত্যকে দিলেন তার সাথে। ১৮৮০ সালে ওরা দুজন পাহাড়ের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে দেখা গেল এই লামা আসলে একজন দুর্বৃত্ত। মজুরির টাকায় মাতাল হতেন তিনি, অনেক সময় ভৃত্য কিনথাপকে মারধর করতেন। শেষে কিনথাপকে এক তিব্বতীয় গ্রামে দাস হিসাবে বিক্রি করে তিনি গায়েব হয়ে যান।
দুর্ভাগা কিনথাপ টানা দুই বছর গ্রামের সর্দারের সেবা করে কাটান। শেষে পালিয়ে সাঙপো নদীর পথ ধরেন তিনি। মনিবের পরিত্যক্ত কাজ শেষ করতে দৃঢ়প্রতীজ্ঞ। তার খোঁজে চারপাশে দাস পাকড়াওকারীরা থাকায় চার মাস একটা মঠে গা ঢাকা দিয়ে থাকেন কিনথাপ। এরপর জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে ৫০০টা গাছ কেটে দশ দিন ধরে রোজ টেনেহিচড়ে নদীর ধারে এনে দৈনিক পঞ্চাশটা করে গাছের গুড়ি পানিতে ফেলতে থাকেন, যাতে ভাটির দিকে নজর রাখা ব্রিটিশরা দেখতে পায়।
কিন্তু দীর্ঘ দুটি বছর কেটে গেছে, এবং ভারতের ব্রিটিশরা নজর রাখায় ক্ষান্ত দিয়েছে। ওরা নজর রাখলে গাছের গুড়িগুলো ঠিকই দেখতে পেতো, কারণ সাংপো নদী আসলেই ব্রহ্মপুত্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু দেখার কেউ ছিল না।
কিনথাপ অবশেষে চার বছরের অনুপস্থিতি শেষে ভারতে ফিরে এলে তার গোয়েন্দা কর্তারা তাদের পরিত্যক্ত একটা কাজে তার নিষ্ঠা দেখে অনুশোচনায় ভুগেছেন। তাকে সম্মানিত করা হয়। তার নাম এখনও ভারতীয় মানচিত্র নির্মাতাদের কাছে দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠার প্রতীক হয়ে আছে।
মানচিত্রের শক্তিতে অটল বিশ্বাসই কাউকে সেগুলোর বিষয়বস্তুকে গোপন রাখার কঠিন প্রয়াস নিতে আবার অন্যদের তার শূন্যস্থানগুলো পূরণে জীবনের ঝুকি নিতে তাড়িত করে।
২.
গোপন মানচিত্র
মানচিত্র তথ্যের যোগান দেয়। আর তথ্যই শক্তি। সুতরাং মানচিত্রের গুপ্তচরবৃত্তি, মিথ্যাচার এবং ছদ্মবেশের লম্বা ইতিহাস রয়েছে। হেনরি দ্য নেভিগেটরের আমলে পোর্তুগিজরা আফ্রিকা সম্পর্কে তাদের বিদ্যা গোপন রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ওলন্দাজ এবং ইতালিয় গুপ্তচররা সেগুলোর কপি চুরি করেছে। তেমনি ব্রিটিশ জলদস্যু স্যার ওয়াল্টার রালেইও- এবং সম্ভবত ক্রিস্টোফার কলোম্বাসও একই কাজ করেছেন। তার ভাই পোর্তুগিজ ম্যাপ ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। ষোলো শতকে রাশিয়ানরা কাউকে রাশিয়ার প্রত্যন্ত এলাকা সাইবেরিয়ার ম্যাপ বিক্রি করছে বলে সন্দেহ হলেই মৃত্যুদণ্ড দিতো।
১৮ শতকের শেষ নাগাদ পর্যন্ত হাডসন বে কোম্পানি কানাডিয় আর্কাইভস জনসাধারণের চোখে বাইরে রেখেছে। বিশ শতকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাশ্চাত্য বিশ্ব হামলা চালিয়ে কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা করতে পারে, এই ভয়ে আসল অবস্থান থেকে কয়েক শো মাইল দূরে বিভিন্ন শহর দেখিয়ে ম্যাপ তৈরি করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার আকাশ থেকে তোলা ফোটো-ম্যাপে এয়ার পোর্ট এবং কলকারখানার উপর হাতে রঙ করা ছবি বসিয়ে দিয়েছিল। অনেক সময় ব্রিটিশ ছদ্মমানচিত্র নির্মাতারা গোপন স্থাপনার উপর তুলোর গোল্লা বসিয়ে তারপর আবার ফটোগ্রাফের ফটো তুলতো যাতে তুলোর গোল্লাগুলোকে ল্যান্ডস্কেপের অংশকে ঢেকে রাখা মেঘের মতো দেখায়।
আজকের দিনে মার্কিন সরকার উপগ্রহ থেকে তোলা স্পর্শকাতর ছবির প্রকাশ সীমিত রাখার চেষ্টা করছে। আপনি কেবল চীনের মারাত্মক বিতর্কিত তিব্বত সীমান্তের হাইকার'স-স্কেল ম্যাপ যোগাড়ের চেষ্টা করেই দেখুন!
- সূত্র: দ্য রোড টু দিয়ার গ্রন্থ অবলম্বনে