চিত্রকলায় `মহামারীর` দলিল
`আমাদের দিন যায় ধমকে ধমকে
আমাদের দিন যায় গমকে গমকে
আমাদের দিন যায় মারি ও মড়কে
আমাদের দিন যায় কূলে একা, নাহি ভরসা!`
সংক্রামক রোগগুলি তখনই বৃহত্তর জনমানুষের জন্য ভোগান্তির সৃষ্টি করে যখন তা মহামারীর আকার নেয়। বর্তমান করোনা ভাইরাস মহামারীর আগেও হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের নানা মহামারীর অভিজ্ঞতার এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। বর্তমান সময়ে মানবসভ্যতার নানা বিকাশমানতায় জল, স্থল, প্রাণ প্রকৃতি ও জনঘনত্বের ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীব্যাপী নতুন নতুন মারি ও মড়কের প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ঈসায়ী সন গণনার আগে থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন কালপর্বে প্রাণঘাতী মহামারী মোকাবেলায় বিপর্যস্ত হয়েছে মানব সমাজ। মধ্যযুগীয় ইউরোপ ও বিশ্বের অন্যন্য অংশে প্লেগ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, কলেরা, বসন্ত, ফ্লু ইত্যাদি মরণ রোগ ব্যাধি মোকাবেলা করেছে। বিভিন্ন মহামারীর সময় আক্রান্ত হয়েও বেঁচে যান বিশিষ্ট বিশ্বব্যক্তিত্বদের মধ্যে- ওয়াল্ট ডিজনি, গ্রোচো মার্কস, টি এস এলিয়ট, কাফকা, ডি এইচ লাওরেন্স, বেলা বার্টক, এজরা পাউন্ড, আমেলিয়া এরহার্ট, মহাত্মা গান্ধী , আমাদেও দে সৌজা, নিক্কো পিরোসমানী, মর্টন স্ক্যামবার, কেইসার ভিলহেম প্রমুখ। তবে অনেক খ্যাত ও প্রতিশ্রুতিশীল চিত্র শিল্পীও মহামারীতে অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন।
এসবের মধ্যে প্লেগজনিত মৃত্যু মানুষের মনোজগতে ও বাস্তবেও মারাত্মক ভীতির প্রভাব ছড়িয়ে দিয়েছিল। এই অতিমারী মৌলিকভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনকে বদলে দিয়েছিল। অসহনীয় অতিমারিজনিত ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ তখনকার সামাজিক ইতিহাস হিসাবে নানা ভাবে গ্রন্থিত হয়েছে। এমনকি চিত্র শিল্পীরাও তৎকালে কিংবা পরবর্তীতে মহামারীর বাস্তবতা উপলব্ধিতে শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেছে। এসবের বেশ কিছু সেই জমানার মহামারীর বিপর্যয়ের ইতিহাস অভিজ্ঞতার সারমর্ম হিসাবে উত্তর প্রজন্মের কাছে আজকে উপস্থিত।
২০২০ সালে শুরু হওয়া `কোভিড ১৯` বৈশ্বিক মহামারী যা চলমান, এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে `দালিলিক চিত্র` হিসাবে আমরা কিছু শিল্পকর্ম প্রয়াস আজকের আলোচনা ও পর্যবেক্ষণে নিয়ে আসতে চাই। দেখতে চাই চিত্রশিল্পীরা কিভাবে বৈশ্বিক রোগ ব্যাধি জনিত মহামারীকে চিত্রকলায় দালিলীকরণ করেছে।
সেই অতীত আমলে মহামারীর উৎপত্তি ও বিস্তার সম্পর্কে নানা জল্পনা প্রচলিত ছিল। সে সবের মধ্যে বেশির ভাগ ছিল ধর্মীয়, কুসংস্কার ও অনুমান কেন্দ্রিক। কেউ কেউ মনে করতো নির্দিষ্ট গ্রহ, নক্ষত্র, ধূমকেতুর প্রভাবের কারণ প্লেগ। একপক্ষ বিশ্বাস করতো আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ এবং ভূমিকম্প এর কারণ। অন্যপক্ষ এ সবকিছুর জন্য মানব জাতির পাপের প্রতিফল বলে মনে করছে।
ইতিহাসের নানা অধ্যায়ে মানুষ তার আবেগ অনুভূতির প্রকাশে শিল্পকে আশ্রয় করেছে। মহামারীর কারণে বিপর্যস্ত বিশ্বের নানা প্রান্তে এই বিষয়কে আশ্রয় করে শিল্পকর্ম রচিত হয়েছে। নানা মাধ্যমে মহামারী, মৃত্যু উপজীব্য শিল্পকর্ম গণভোগান্তির দলিল হয়ে ওঠেছে।
পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ
পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধের সময় ৪৩১-৪০৪ খ্রি: পূ: এক মহামারীর বিস্তার ঘটেছিল। বর্তমান লিবিয়া, ইথিওপিয়া, মিশর থেকে গ্রিসের রাজধানী এথেন্স পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়েছিল। এই রোগে তখন সেই অঞ্চলের এক তৃতীয়াংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। রোগের মূল উপসর্গ ছিল জ্বর, চুলকানি, গলা ও জিহ্বা দিয়ে রক্তক্ষরণ, ত্বক প্রদাহ ও ক্ষত। ধারণা করা হয় যে তা টাইফয়েড জ্বর জাতীয় কোন রোগ। কথিত আছে যে এথেনিয়ানরা স্পাটার্নদের কাছে এই মহামারীর জন্য যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল।
আন্তোনিন বা গ্যালেন প্লেগ
মারকুস আওরেলিয়োস আন্তোনিনোস এবং তাঁর সহ সম্রাট লুসিওস ভেরুস প্লেগ আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। প্রাচীন রোমে প্রতিদিন প্রায় ৩০০০ জনের মতো এই মহামারীতে মারা যেত। এই মহামারী রোম সাম্রাজ্যকে রীতিমত জাহান্নামে পরিণত করেছিল। প্রায় ১০ শতাংশ রোমান সাম্রাজ্য বিনষ্ট হয়েছিল এই মহামারিতে। প্রকৃতপক্ষে, ওই সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য এই অদৃশ্য ঘাতকের সামনে সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েছিল। গ্যালেন নামের এক গ্রিক চিকিৎসক এই মহামারী প্রাদুর্ভাবের দালিলীকরণ করেছিলেন। নিমন্ত্রণ পেয়ে তিনি ১৬৮ সালে রোমে ফিরে আসেন। সম্রাট আন্তোনিনোসের নামানুসারে এই মহামারীর নামকরন হয়। আন্তোনিন গ্যালেন প্লেগ নামেও পরিচিত। এই প্লেগ মহামারী হয়েছিল রোমের মতো অত্যন্ত প্রাচীন জনপদে। পরে যা এশিয়া মাইনর, মিশর, গ্রীস এবং ইতালিকে সংক্রমিত করেছিল। এবং ধারণা করা হয় তা গুটি বসন্ত বা হাম জাতীয় কিছু ছিল, যদিও তার সত্যাসত্য অজানা! এই অজানা রোগটি তৎকালে রোমে এসেছিলো মেসোপটেমিয়া থেকে ১৬৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। অজান্তেই এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল যাতে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়।
জাপানিজ গুটিবসন্ত মহামারী
জাপানে গুটিবসন্ত মহামারী শুরু হয়েছিল ৭৩৫-৭৩৭ সালে, যাকে `টেনপিয় যুগে`র মহামারীও বলা হয়ে থাকে। তখন শাসক সম্রাট ছিল `সুমো টেন্ন`। এই মহামারী জাপানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল। তখন পুরো জাপানি জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু হয়। এই মহামারী সামাজিক অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয়ভাবে- সর্বত্র প্রভাব ফেলেছিল। গুটি বসন্তের তীব্র সংক্রমণ সেই থেকে নিমূর্ল হওয়ার অাগে এই ১৯৭৯ সাল অবধিও মহামারী হিসাবেই টিকে ছিলো।
ওই সময়কালে অল্প কিছু কালজয়ী শিল্পকর্ম রয়েছে গুটি বসন্তের লক্ষণ সমেত এক `ভুতুড়ে দেবতা`র প্রতিকৃতি।
রোমের প্লেগ মহামারী
১৪ শতকের আগে বেশ কয়েকটি মহামারী ইউরোপে সংঘটিত হলেও তা খুব ভালোভাবে তথ্য সংকলিত বা বলা যায় সংরক্ষিত হয়নি। ফলে ঐ সময়ে শিল্পের ভাণ্ডারে তেমন নিদর্শনের সংরক্ষণ নেই! তবে পরবর্তীতে মহামারী সংক্রান্ত চিত্রাঙ্কনের চেষ্টা করা হয়েছে।
কথিত যে এই প্লেগ হান্নিক সাম্রাজ্যে শুরু হয়ে পরে জার্মান ও রোমান সাম্রাজ্যে বিস্তার লাভ করে। লক্ষ্যণীয় যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় তা ছিল গুটি বসন্তের প্রাথমিক রূপ। এতে তখন পাঁচলক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করেছিল।
একটি খোদাইচিত্রে অত্যন্ত নৈপুণ্যের সাথে দেখানো হয়েছে একজন দেবদূতকে, যে কী না মারিতে মৃত্যুর মুখ থেকে উদ্ধারকর্তা হিসাবে আক্রান্তের জীবন বাঁচাতে দরজায় উদ্যত ভঙ্গিতে ধাবমান।
রোমের প্লেগ মহামারী, যুলেশ এলিয়ে দেলাউনে (১৮২৮-১৮৯১০)। ১৮৬৯ সালে তেলরঙে আঁকা। যা প্যারিসের মোজে দি অরসোতে রক্ষিত।
এই চিত্রকর্মের প্রাথমিক রেখাচিত্র করা হয় ১৮৫৭ সালে। যা পূর্বে ১৪৭৬ সালে প্লেগ মহামারীকে উপজীব্য করে আঁকা ফ্রেস্কোচিত্র থেকে অনুপ্রাণিত। এই ফ্রেস্কোটি রোমান গির্জা সান পিয়েত্রো, ভিকোলি, পেসকারা, আব্রোজ্জো ইতালিতে করা। সেই সময় দেলাওনা এই ফ্রেস্কো চিত্রটি এঁকেছিলেন। আঁকার সময় মহামারী ছিলোনা কিন্তু তা ছিল শিল্পীর দৃষ্টিতে সাহিত্যিক ব্যাখ্যার একধরণের পক্ষান্তকরণ। যেখানে জ্যাকোবাস দি ভার্জিনের গোল্ডেন লিজেন্ড এর গল্পটি সেইন্ট সেবাস্তিয়ান বলেছিল। সেখানে উল্লেখ আছে যে- `এবং এরপর সেখানে একজন উত্তম দেবদূত আবির্ভুত হলেন, যিনি একজন খারাপ দেবদূতকে বল্লম দিয়ে ঘরের দরজায় আঘাত করতে নির্দেশ দিচ্ছে। প্রতিটি ঘরে যতজন লোক মারা গিয়েছে ঠিক ততটি আঘাত করবার জন্য।`
চিত্রস্থিত কেন্দ্রীয় শূন্যস্থান ঘিরে কয়েকটি অশ্বারোহী মার্বাস অরেলিয়াসের মূর্তি স্তম্ভ, উলম্ব খিলান রয়েছে পশ্চাদ্পটে।
চিত্রকর্তা তাঁর অধিকাংশ প্লেগের আক্রান্তকে সাজিয়েছে নিচে বাম দিকে। আর ডান দিকে বিস্তর আলোতে দুজন স্বর্গদূত আপাতদৃষ্টে যেন সংঘর্ষে লিপ্ত হতে যাচ্ছে। নীচের ডান কোনায় উপরের দিকে একটি তাকে এসকুলাপিয়াসের (রোমান দাওয়াইয়ের দেবতা) মূর্তি আংশিক দৃশ্যমান, ঠিক তার পাদদেশে দুজন যেন বর চাইছে। উপরের বাম কোনে সাদা সুতির আঙরাক্ষা বিশেষ পরিধান সজ্জিত খ্রিস্টীয় পুরোহিতদের একটি শোভাযাত্রা ক্রসকে অনুসরণ করছে।
এই জীবন ও মৃত্যু, পৌত্তলিক এবং খ্রিস্টানরা এই চিত্রকর্মের প্রতিকীকরণ ও কল্পকাহিনীর বিরোধিতা করেছিল। এতদসত্বেও ১৮৬৯ সালে প্যারিসের `স্যালুনে` সর্বাধিক প্রশংসিত ও মন্তব্যকৃত শিল্পকর্ম ছিল এটি।
অব্যাহত অযাচিত মৃত্যুর ভয়ংকর জনচেতনায় গভীর রেখাপাত করে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। আশ্চর্যজনকভাবে এই অবধারিত মৃত্যু উৎসবে (!) দাঁড়িয়ে মানুষের চেতনায় আঁকা হয় শিল্পকর্ম। `দি ব্ল্যাক ডেথ ওয়াজ লাইফ`। প্রতিদিনকার উদ্বেগ। মৃত্যু যেন সকলকেই একটু অবিচ্ছেদ্য বিষয় হিসাবে শাসাচ্ছে! শিল্পও তাই। সে সব মৃত্যু ও আশংকার গহন তিমিরাচ্ছন্ন আচ্ছাদনে ঢাকা সময় আঁকা ছবিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে এভাবেই।
লন্ডনের প্লেগ মহামারী
১৩৪৪ সালের ব্ল্যাক ডেথের পরবর্তী প্লেগ মহামারীতে ১৬৬৫ সালে লন্ডনে প্লেগের প্রকোপটি দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছিল। লন্ডনের সাথে কার্যত সবরকম যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়েছিল ১৮ মাসে প্রায় এক লক্ষ মানুষকে। যা তখনকার জনসংখ্যার এক চতুর্তাংশ।
ওয়াল্টার জর্জ বেল খোদাই শিল্পী। প্লেগ আক্রান্ত লন্ডনের মানুষের উপর মহামারীর প্রভাব প্রদর্শন উপজীব্য করে তার ৯টি কাঠ খোদাই চিত্র উল্লেখযোগ্য। যেখানে আক্রান্ত, ক্ষতিগস্থ, এবং যারা চিকিৎসা দিয়েছে আর ধনিদের শহর ছেড়ে পালানোর চিত্রাবলী অঙ্কিত হয়েছে। এ ছিল শিল্পকর্মে সাধারণ নাগরিকদের অবস্থা, নগরের পরিস্থিতি এবং কিভাবে লন্ডনে জনমানুষ তথা সমাজ চলমান ছিল তারই সে সময়কার চিত্রায়ন।
অন্য একটি বিখ্যাত শিল্পকর্ম লন্ডন মহামারীকে প্রতিনিধিত্ব করে যার শিল্পী স্যামুয়েল এ। ১৭৪৭ সালে তিনি প্লেগ আক্রান্ত হয়ে মৃতকে শবযানে তোলার দৃশ্য অঁাকেন।
একদিকে চিত্রশিল্পীরা দেশে দেশে যেমন মহামারীর বিষয়বস্তু ঘিরে অংকনরত, ঠিক বিপরীতে শিল্পীদের কেউ কেউ আক্রান্ত ও সংক্রমিত হচ্ছেন। অনেকেই বেঁচে গেলেও কারো কারো পক্ষে মৃত্যুর হাতছানি উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
জাফ্ফায় বোনাপার্তের প্লেগ উপদ্রুতদের পরিদর্শন
চিত্রশিল্পী আন্তোইন জেন গ্রোসকে প্রচারের জন্য নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এই শিল্পকর্মের বরাত দিয়েছিলেন। এই দৃশ্যচিত্রে নেপোলিয়নকে উপদ্রুতদের সাথে দেখা যায়। যা ১৭৯৯ সালের ১১ মার্চ জাফ্ফার ঘটনা বলে মনে করা হয়। তখনকার জেনারেল বোনাপার্ট আর্মেনিয়ান সেন্ট নিকোলাস মঠে তাঁর অসুস্থ সৈন্যদের সাথে দেখা করেছিলেন। বোনাপার্ট সম্পর্কে এমন অভিযোগ আছে যে, জাফ্ফায় আক্রান্ত জনা পঞ্চাশেক সৈন্যকে প্লেগ ক্ষতিগ্রস্থ সিরিয়ার অভিযান থেকে, বাদ দেওযার জন্য তাদের খাবারে আফিমের মারাত্মক ডোজ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
১৮০৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর এই চিত্রটি স্যালুন দে প্যারিসে প্রদর্শিত হয়েছিল। তাছাড়া ১৮ মে নেপোলিয়নকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা উপলক্ষে ২ ডিসেম্বর নটরডেম দে প্যারিসে তার রাজ্যাভিষেকে প্রদর্শিত হয়েছিল।
আন্তোইন জেন গ্রোস (১৭৭১-১৮৩৫) একজন ফরাসি চিত্রশিল্পী, তিনি ছিলেন স্বাধীন শিল্পী, ফরাসি বিপ্লবের সময়ে দেশত্যাগে বাধ্য হলে তিনি ইতালির জেনোয়াতে চলে যান।
গ্রোস নেপোলিয়নের সৈন্যদের সাথে ভ্রমণ করেছেন। নেপোলিয়ন সহ পরবর্তীতে ফরাসি সৈন্যাধ্যক্ষ ও অনেক সমাজপতিদের প্রতিকৃতি এঁকেছেন। পরবর্তীতে ইতিহাস আশ্রিত প্রচুর চিত্রকর্ম রয়েছে তার। এই চিত্রটিও তেমনি ঐতিহাসিক ও উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব বহন করে।
এই চিত্রকর্মটি বর্তমানে ল্যুভর জাদুঘরে রক্ষিত। ৫.২৩ মিটার X৭.১৫ মিটার চিত্রটি মাপের তৈলচিত্রটি ১৮০৪ সালে আঁকা।
সেইন্ট রোজালিয়ার জন্য দুই দেবদূতের গোলাপ শিরোমাল্য
শিল্পী এন্থনি ভ্যান ডাইকের চিত্রকর্ম সেইন্ট রোজালিয়ার জন্য দুই দেবদূতের গোলাপ শিরোমাল্য। ১৬২৪ সালে আঁকা ১৫৫x১৩২ সেন্টিমিটার আকারের তৈলচিত্র। একই বিষয়বস্তু নির্ভর তাঁর আঁকা আরও পাঁচটি শিল্পকর্ম ইতালির পালেরমোতে ঐ সময়ে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন থাকাকালীন অবস্থায় এঁকেছিলেন।
এই চিত্রটি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের হিউস্টনের মেনিল সংগ্রহশালা ১৯৬৪ সালে ক্রয় করেছিল। ২০১১-১২ সালের জন্য লন্ডনের ডালউইচ পিকচার গ্যালারিতে তা ধার হিসাবে প্রদর্শিত হয়েছিল। বর্তমানে তা লন্ডনের এপসলে হাউসের সংগ্রহে রয়েছে। অন্য একটি আছে ইতালির পালেরমোতে। উলেখ্য যে পালেরমোতে কোয়ারেন্টাইন থাকা অবস্থায় ১৬ টি ছবি এঁকেছিলেন ডাইক।
এই ছবি সম্পর্কে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত যে, পালেরমোতে তখনই তাঁর আসা যখন প্লেগ সংক্রমণ হওয়ার পরপর শহরের অধিকাংশ লোকই মৃত্যুবরণের পথে। ঠিক সেই সময়কালেই মন্তে পেল্লেগ্রিনো গুহায় সেইন্ট রোজালিয়ার অস্থির সন্ধান পাওয়া যায়। সেই সেইন্ট সম্পর্কে কথিত যে তিনি মধ্যযুগে একজন মঠ আশ্রমিক হিসাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁর অস্থি নিয়ে পালেরমো শহরে শোভাযাত্রা প্রদক্ষিণ করার পরপরই কীনা প্লেগ মহামারীর উপদ্রবের সমাপ্তি হয়েছিল! সেই থেকে সেইন্ট রোজালিয়াকে শহরের ত্রাণকর্তা বা রক্ষক হিসাবে ঘোষণা করা হয়। তাছাড়া ভ্যান ডাইক রোজালিয়াকে উপজীব্য করে মোট পাঁচটি চিত্র রচনা করেছিলেন, যাতে সেইন্টের আশীর্বাদের সুবাদে পালেরমোতে প্লেগের দ্রুত পরিসমাপ্তি হয়।
শিল্পী এন্থনি ভ্যান ডাইক একজন ডাচ চিত্রশিল্পী (১৫৯৯-১৬৪১), জন্ম এন্টওয়ার্পেন, বেলজিয়াম। তিনি কোর্ট পেইন্টার ছিলেন ইংল্যান্ড, ইতালি ও নেদারল্যান্ডসে। ইতালির পালেরমোতে আঁকা তাঁর সেইন্টদের নিয়ে শিল্পকর্ম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৬৪১ সালে ৪২ বছর বয়সে তিনি লন্ডনে মারা যান।
অকাল সমাধি
শিল্পী আন্তোনিয়ে য়োসেফ ভিয়েটজ (১৮০৬-১৮৬৫)। অকাল সমাধি ১৮৫৪ সালে অংকিত তাঁর তৈলচিত্র। ১৬০x ২৩৫ সেন্টিমিটার মাপের শিল্পকর্মটি বেলজিয়ামের রয়েল মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টসে সংরক্ষিত অাছে।
কলেরা মহামারী নিয়ে তার এই চিত্রকর্ম। ১৮৩১-১৮৩২ সালে শুধুমাত্র ইংল্যান্ডেই কলেরায় মারা যায় ৩১০০০ জন। তাছাড়া ইউরোপের ভুখন্ড ব্যাপী কলেরা মহামারী ও পরবর্তী প্রাদুর্ভাব ব্যাপক ধ্বংসাত্মক হয়েছিল। মহাদেশ জুড়েই `কলেরা ফোবিয়া`র কারনে ও অতি উদ্বেগ জনিত তাড়াহুড়ো করে মৃতের সৎকারের কারণে `অকাল সমাধির` ঝুঁকি তৈরী হয়েছিল। কেননা তখন অতিমারীতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিমিত্তে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মৃতদেহ সৎকারের প্রয়োজনীয়তা তীব্রতর হয়ে পরে। আর তাতেই অব্যবস্থাপনা ও সৃষ্টি হয়। এই অনাকাঙ্খিত বিষয়কে কেন্দ্র করে `রম্য নকশা` আশ্রয়ী চিত্র হিসাবে `ইনহিউম্যান প্রিপিসিটি` বা `অকাল সমাধি` অঁাকেন তিনি।
শিল্পী ভিয়েটজ একজন দুর্দান্ত প্রতিকৃতি শিল্পী ছিলেন। তাছাড়াও উদ্ভট, ভয়ার্ত, নাটকীয়, বিরক্তিকর কল্পনাযুক্ত বিষয় ও মৃত্যু তার চিত্রসমূহে একটি সাধারণ বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছিল। অকাল সমাধি একটি ভূগর্ভস্থ সমাধিগৃহের মেঝেতে রাখা কফিন, চিত্রের সম্মুখ ভূমিতে কলেরা আক্রান্ত আবৃত ব্যক্তি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠছে, যেহেতু কফিনের কোনটি উন্মুক্ত তাই তাকে যেখানে রাখা হয়েছে সেখান থেকে পালাতে চাইছিলো, ভয়ে সে তার হাত বাড়িয়ে মরিয়া হয়ে সাহায্য চাইছে। তবে এই দুঃস্বপ্নদর্শনসম বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে ভিয়েটজের পক্ষে কৌতুকপূর্ণ করুণ হাস্যরসের এক অপ্রত্যাশিত ব্যবহার রয়েছে।
কফিনের পাশেই একটা শিলালিপি যুক্ত তাতে উৎকীর্ণ - `কলেরায় মৃত্যু, আমাদের ডাক্তার কর্তৃক সত্যায়িত। সন্দেহ নেই, আমাদের ডাক্তার কর্তৃক স্বাক্ষরিত। দুর্ভাগা কলেরার শিকারকে সত্যি জীবিত সমাধিস্থ করা হয়েছিল!
এডগার এল্যান পো এর ১৮৪৪ সালে রচিত ছোটগল্প `অকাল সমাধি` শিল্পীর শিল্পকর্মের অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। তবে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই যে চিত্রটিকে রচনায় উদ্বুদ্ধ করে থাকবে তাতে সন্দেহ নেই।
ভিয়েটজ এমন এক শিল্পী যার কাজ এ জাতীয় বিপর্যয়জনিত মহামারীর ব্যবস্থাপনায় চোখ খুলে দেয়ার সামর্থ্য রাখে। ভবিষ্যতে মহামারীর সময় এই ডিজিটাল যুগেও শিল্প ও শিল্পী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ন হতে পারে। তারা কেবল শারীরিক দুর্ভোগকেই নয় সাথে সাথে ব্যবস্থাপনার মোকাবেলায় হাস্য কৌতুককেও বুদ্ধিমত্তার সাথে ব্যবহার করে মহামারীর সংক্রমণ ও মৃত্যু ভয়কে কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারে।
আসদোদ এর প্লেগ
ফরাসি চিত্রশিল্পী নিকোলাস পাওসিনের আঁকা বিখ্যাত শিল্পকর্ম আসদোদের প্লেগ। ইতালিতে ১৬২৯-১৬৩১ সালের মধ্যে সংঘটিত প্লেগ মহামারী উপজীব্য করে তাঁকে চিত্র রচনার জন্য বরাদ্দ দেন ফাব্রিসিও ভালগুয়ামেরা। ফাব্রিসিও ছিলেন সিসিলিয়ার একজন ব্যবসায়ী। ফাব্রিসিওকে এই চিত্রকর্মের মাধ্যমে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল।
সান্তা মারিয়া দেল্লা ছালুতে
১৬৩০ সালের গ্রীষ্মের শুরুতে, প্লেগ সংক্রমণ ভেনিসকে লন্ডভন্ড করে দেয়, এবং ১৬৩১ অব্দি এই তান্ডবে এক তৃতীয়াংশ ভেনিসবাসী মৃত্যুবরণ করে। শহরে ৪৬০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল। কিন্তু জলাধার ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সে সংখ্যা অনেক বেশি, যা ৯৪০০০ বলে ধারণা করা হয়। বার বার ধর্মোপাসনা, ধর্মপোচার সত্বেও সান রক্কো ও সান লরেন্সো জুসতিনিয়ানি গির্জার উৎসর্গীকৃত প্রার্থণা ও শোভাযাত্রা মহামারিটি রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল!
প্লেগ আক্রমণ পূর্ব ১৫৭৫-৭৬ সালের স্থাপত্য চিন্তার প্রতিধ্বনি ফের শুরু হলো। জন প্রতিনিধি পাল্লাদিয়ো`র উত্থাপনে ১৬৩০ সালের ২২ অক্টবর সিনেটে একটি নতুন গির্জার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করা হলো, যা `স্বাস্থ্যের সন্ত মেরি` বা সান্তা মারিয়া দেল্লা ছালুতে। তা নিছক প্লেগ বা পৃঠপোষক সন্তের জন্য নয় `কুমারী মেরির` প্রতি উৎসর্গকল্পে। যিনি বহু কারণে প্রজাতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে বিবেচিত।
১৬৩০ সালের ভেনিস প্লেগের যে ধ্বংসাত্মক প্রাদুর্ভাবের অভিজ্ঞতার পর শহরকে মুক্ত রাখার জন্য ভেনিস প্রজাতন্ত্রের ভোটাভুটিতে স্বাস্থ্যদেবতাকে উৎসর্গ করে একটি গির্জা তৈরির প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়। স্থপতি বালদাচ্ছারে লংগেনা তার নকশা করেছিলেন। চার্চের ভিতরে রাখা বেশিরভাগ বস্তু সামগ্রী `ব্ল্যাক ডেথ` বা প্লেগ মহামারী সম্পর্কিত।
গির্জার গম্বুজটি পরবর্তীতে ক্রমেই ভেনিসের দিগন্তরেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। যা শীঘ্রই শহরের প্রতীক হয়ে ওঠে। এমনকি শিল্পী কানালেত্ত্ব, টার্নার, জন সিঙ্গার,ভেনেসীয় চিত্রশিল্পী ফ্রান্সেসকো দুয়ার্দি প্রমুখ অনুপ্রাণিত হয়ে শিল্পকর্ম রচনা করেন।
মহামারীতে হারিয়ে যাওয়া শিল্পীমুখ
বলা যায় শিল্পী ও শিল্প সর্বদা ক্রিয়াশীল, এমনকি মহামারী ও কষ্ট দুর্ভোগের সময়েও। দ্যা ব্ল্যাক ডেথ বা গ্রেট প্লেগ নামেও পরিচিত, যে মহামারী অসংখ্য লোককে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলো জীবন থেকে। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইরোপে যখন প্রবল প্রতাপে তার ধ্বংসলীলা চালাচ্ছিল। অতঃপর আসে স্প্যানিশ ফ্লু, এভিয়ান ফ্লু, সোয়াইন, মার্স, কোভিড বা করোনা ইত্যাদি মহামারীর তান্ডব দেখেছে /দেখছে বিশ্ব। বর্তমান মহামারীর সময়ে আমরা ইতিহাসের পাতার কয়েকজন চিত্রশিল্পী সম্পর্কে বলতে চাই। যাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে এবং এবং তাদের অনিশ্চিত সময়েও শিল্পরচনা করেছিলেন, বা অনেকেই সেসব সম্পূর্ণ করার আগেই মহামারীতে মৃত্যুবরণ করেছেন!
১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে ঢালাও মৃত্যুর সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। প্রশ্ন উঠতে পারে তথাপি আরও বেশি শিল্পীরা কেন তাদের কাজের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাড়া দেয়নি? যদিও সর্বনাশা এই মহামারীর প্রকোপ কয়েকটি চিত্রে স্পষ্টতই বিশেষ হয়ে ওঠেছে।
প্রথম বিশযুদ্ধে প্রায় ৪০ লক্ষ লোক প্রাণ হারায়। আর স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা যায় ৫ কোটি মানুষ। স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা যান অস্ট্রিয়ান চিত্র শিল্পী ইগন সেইলা, আমেরিকান চিত্রশিল্পী মরটন সেমবার্গ, ফরাসি কবি ও শিল্প সমালোচক এবং কিউবিজমের সমর্থক গুইলিউম এপলিনিয়ার প্রমুখ। শিল্পী গুস্তাভ ক্লীমট হলেন এই রোগে আক্রান্তের আরেকজন। তিনি আক্রান্ত হওয়ার আগেই স্ট্রোক ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, এবং ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর মৃত্যু হয়।
তাঁর তখন ৫৬ বছর বয়স। তাঁর অভ্যাস ছিল এক বাটি জমাট আইসক্রিম খাওয়া নাস্তার সময়ে, ফলে তিনি মারাত্মকভাবে অতি ওজনজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। ক্লীমট নিজেই কৌতুকচ্ছলে বলেছিলেন, `সুতরাং সেখানে অন্তর্নিহিত শর্ত ছিলই।`
১৯১৮ সালের মহামারী ছিল আজকের করোনা ভাইরাসের বিপরীতধর্মী। সেই ফ্লু ছিল যুবক বয়েসীদের আক্রান্ত করার রোগ``অর্থাৎ ৩০ ও কৈশোর এই মধ্যবর্তী বয়েসীরা ছিল সবচে ঝুঁকিতে। ফলে সেই ফ্লুতে মারা যাওয়া অধিকাংশ লোকেরাই কখনও কোনও কিছু অজর্ন করার সুযোগ পাওয়ার আগেই মারা গিয়েছিলেন।
হানস হলবাইন দে যুনেহা
জার্মান চিত্রশিল্পী ও ডিজাইনার, ইংরেজি উচ্চারণে হানস হলবাইন ইয়ংগার (১৪৯৭-১৫৪৩) নামে বিশেষ পরিচিত। প্রতিকৃতি আঁকায় তাঁর দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি ম্যুরাল, ধর্মীয় চিত্রাবলী, কাঁচের জানালার নকশাকার হিসাবেও দক্ষ ছিলেন। ৩০ বছর বয়সে তিনি ইংল্যান্ডে চলে আসেন পেশাগত কাজের নিমিত্তে। তখন তিনি রাজচিত্রকর হিসাবে রাজা অষ্টম হেনরির নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৫৪৩ সালে লন্ডন প্লেগ মহামারীর সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৬ বছর।
টিটিয়ান (তিসিয়ানো ভেচেল্লিও)
ইতালিয়ান রেনেসাঁর চিত্রশিল্পী (১৪৮৮-১৫৭৬)। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাধর শিল্পী। চিত্রে তিনি প্রতিকৃতি, ভূ-দৃশ্যাবলী, ধর্মীয় ও পৌরাণিক বিষয় অবলম্বনেও চিত্রাঙ্কন করেছেন। কয়েক দশক তিনি ভেনিসীয় ঘরানার কুশলী শিল্পী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর বৃহৎ আকারের গির্জার বেদির পশ্চাদপটের জন্য আঁকা প্যানেল চিত্র `ভার্জিনের ধৃষ্টতা` (১৫১৬-১৫১৮)। যা ইতালির ভেনিসের বাজিলিকা দি সান্তা মারিয়া গ্লোরিওজা দেই ফাব্রি`তে রয়েছে। জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত চিত্র রচনায় যুক্ত থেকে তিনি প্লেগ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ৮৮ বছর বয়সে, ১৫৭৬ সালে। তাঁর শেষ কাজ `পিয়েতা`, এক দুঃখ ভারাক্রান্ত নাটকীয়, দুর্ভোগাক্রান্ত নিশাচর এক ভূদৃশ্য। যা ক্যানভাসে তেলরঙে আঁকা। ৩৮৯ x৩৫১ x১৩৪ ইঞ্চি মাপের এই শিল্পকর্মটি গ্যালেরিয়া দেল আকাদেমিয়া, ভেনিস এ সংরক্ষিত রয়েছে।
এডওয়ার্ড মুনখ`র আত্ম প্রতিকৃতি
স্প্যানিশ ফ্লুতে (১৯১৯) আক্রান্ত হয়ে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন নরওয়ের এই চিত্রশিল্পী এডওয়ার্ড মুনখ (১৮৬৩ -১৯৪৪)। `স্ক্রিম` চিত্রটি সম্পর্কে আমরা প্রায় সবাই জানি - চিত্রকেন্দ্র`র একটি মুখের উপর বেদনাদায়ক অভিব্যক্তিযুক্ত একটি লাল আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে। এই পুরো কাজ জুড়ে বিকৃতি এবং উদ্বেগের চিহ্ন, চিত্রশিল্পী এটিকে তার "সোল পেইন্টিং" বলে উল্লেখ করেছেন।
তাঁর স্বচিত্রনে জীবনভর ভয়াবহতা, স্প্যানিশ ফ্লুর ভিন্ন মাত্রার ভোগান্তির স্মৃতির আধার হয়ে ওঠেছিল। ১৯১৯ সালে `স্প্যানিশ ফ্লু আক্রান্ত অবস্থায়` ও নিরাময়ের পর শিরোনামে আঁকা তার প্রতিকৃতি উল্লেখযোগ্য। আক্রান্ত অবস্থায় আঁকা চিত্রে দেখা যাচ্ছে তিনি একটি গাউন ও জড়ানো কম্বল সহ উপবিষ্ট বেতের চেয়ারে। আর পিছনে দেখা যাচ্ছে অগোছালো বিছানা।
`স্প্যানিশ ফ্লু নিরাময়ের পর আঁকা` প্রতিকৃতি ও মহামারীর প্রাদুর্ভাবের ফলস্বরূপ শিল্পীর ভয়াবহ যন্ত্রণারই প্রতিনিধিত্ব করে। তাঁর শৈশব থেকেই মৃত্যু, অসুস্থতা, মনমরা ভাব, বিষণ্নতা যেন তাঁকে কখনও ছেড়ে যায়নি। বিশেষত বাল্যকালে পরিবারের সদস্যদের যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়া এবং নিজের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের বিষয় তাঁর চিত্রচর্চার কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করেছিল পুরো জীবন। তাঁর চিত্রকর্মে অন্ধকার, মৃত্যুদূতের চরিত্র বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। তিনি পরবর্তীতে আরও ২৪ বছর বেঁচেছিলেন। ১৯৪৪ সালে ৮০ বছর বয়েসে মারা যান।
গুস্তাভ ক্লিমট
অস্ট্রিয়ান চিত্রশিল্পী। ক্লিমট, (১৮৬২-১৯১৮) মহামারী সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা শিল্পী মুনখ এর মতো ভাগ্যবান ছিলেন না। কেননা মহামারীর সময় ভিয়েনাতে তিনি স্ট্রোকের শিকার হয়ে হাসপাতালে গিয়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন, এবং ১৯১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ৫৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। অস্ট্রিয়ান এই প্রতীকবাদী চিত্র শিল্পীর খ্যাতি তখন মধ্যগগনে। সে সময় তাঁর `সোনালী পর্যায়ে` চিত্রকর্মে স্বর্নপত্র ব্যবহার করছেন। তাঁর বিখ্যাত শিল্পকর্ম `দ্যা কিস` এ প্রেমিক যুগলকে আলিঙ্গনাবদ্ধ ও চুম্বনরত আঁকেন। এই চিত্রকর্মটি তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত। তাতে সোনার পাতা, প্লাটিনাম ও সিলভার ব্যবহৃত হয়েছিল।
রুবি লিন্ডসে
অস্ট্রেলিয়ান চিত্রশিল্পী ও ইলাস্ট্রেটর। রুবি (১৮৮৫-১৯১৯) মেধাবী ও প্রতিশ্রুতিবান শিল্পী মুখ তখন। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম নারী ইলাস্ট্রেটর ছিলেন। তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক চিত্রক ও গ্রাফিক শিল্পী। ১৯০৯ সালে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ উইল ডাইসনকে বিয়ে করেন। এই সাদা-কালো কিংবদন্তি দম্পতি রুবির ভাই চিত্রশিল্পী নরম্যান সহ সেই বছরেই লন্ডন চলে আসেন কার্যোপলক্ষ্যে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পর তিনি আয়ারল্যান্ড সফর করার পর স্প্যানিশ ফ্লুর শিকার হয়ে মারা যান। তখন তিনি মাত্র ৩৩ বছর বয়েসী। সমাহিত হয়েছেন লন্ডনের হেনডেন সিমেট্রিতে।
ইগন শিইলা
ইগন শিইলা (১৮৯০- ১৯৯১) অস্ট্রিয়ান চিত্রশিল্পী। শিইলা দম্পতিকে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয় তাঁর আঁকা `পরিবার` শিল্পকর্মের জন্য। যা তিনি মৃত্যুর আগে আঁকতে শুরু করেছিলেন। এখানে শিল্পী নিজেকে আঁকেন স্ত্রী এডিথের পেছনে বসা নগ্ন, হাড্ডি চর্মসার হতদরিদ্র করে। দেখতে অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্যকর, নগ্ন ভাবি মায়ের নির্মলতা প্রদর্শিত যেন। তাদের অনাগত সন্তানের মডেল শিইলার ভাগ্নে, টনি। যদিও শিইলা তাঁর উস্কানিমূলক, যৌনতা বিষয়ক কাজগুলোর জন্য বেশি পরিচিত। পক্ষান্তরে তাঁর `পরিবার` বেশ কোমল শান্ত প্রকৃতির চিত্রকর্ম। এটি তাঁর পারিবারিক হয়ে ওঠার স্থিতিশীলতার প্রতীক! যেখানে তাঁর অশান্ত ভাব ও বোহেমিয়ান অস্তিত্ব প্রহৃত। শিইলার অকাল মৃত্যুর কারণে আমরা কখনোই জানতে পারিনি যে তিনি আসলেই স্থির হয়েছিলেন কী না! নাকি এর পরিবর্তে `একটি যুগের পরিসমাপ্তি` হিসাবে বন্য শিশুর মতো চিরতরে স্থির হতে চেয়েছিলেন।
মাত্র ২৮ বছর বয়সে স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা যান তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর মাত্র তিনদিন পর। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম `পরিবার` আঁকা তখনও সমাপ্ত করতে পারেননি, আর তাঁর স্ত্রী ছিলেন ছয় মাসের গর্ভবতী, ভাবি মা। তাদের আর পরিবার হয়ে ওঠা হয় না! না চিত্রে, না বাস্তবে। তাঁর অনুপ্রেরণার অগ্রজ শিল্পী ক্লিমট একই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারী মারা যান। ক্লিমটকে তাঁর ভিয়েনাবাসী তরুণ প্রশংসক ও প্রাণিত ইগন শিইলা শৈশবে দেখেছিলেন, এবং তাঁর ক্লান্ত মুখের স্কেচ করেছিলেন।
আমরা যাইনি মরে আজও……..
বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষেরা মহামারীতে প্রাণ হারিয়েছেন, এমন পরিস্থিতিতে মগজ গুটিয়ে বসে থাকা সত্যিই কঠিন। এই মহামারীতে মারা যাওয়া লোকদের জন্য কি অনেক স্মৃতি সৌধ বা স্মৃতিস্তম্ভ হয়েছে বা হবে? তবে ইতিহাসের এরূপ প্রতিটি সময়কালে বিভিন্ন শিল্পকর্ম হয়েছে চিত্রীদের ব্যক্তিগত এষণায়। যা আমাদেরকে নানা উপায়ে যেমন প্রেরণা যোগায় তেমনি বিশেষ ক্রান্তিকালকে দৃশ্যগ্রাহ্য় করে অতীতকে অনুধাবন করায়। বর্তমান অতিমারিকালও শিল্পীদের কাছে পূর্বজদের থেকে ভিন্নতর হওয়ার কি কোন কারণ আছে? এই মুহূর্তে যদিও এই প্রশ্নের জবাব আমাদের মোটেই তাড়া করছে না। তথাপি আমাদের দলিলীকরণের একটি ভিন্নতর সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি এই মূহুর্তে বেশি প্রয়োজন। আমি নিশ্চিত নই কোন এক সময় হয়তো এই মহামারী উপজীব্য চিত্রকর্ম, নামি গ্যালারি, শিল্পী খ্যাতি, ও অনেক অর্থ সমাগমের সম্ভাবনাকে আদৌ ত্বরান্বিত করবে কিনা!
আমেরিকান লেখক ক্যাথরিন অ্যানি পোর্টারের `ম্লান ঘোড়া, ম্লান সওয়ারী` উপন্যাসিকায় অসুস্থতার শ্রেষ্ঠ কল্পিত বিবরণ রেখে গেছেন। ডেনবারে যখন ফ্লু আক্রান্ত হয় তখন পোরটার্রের ২৮ বছর বয়সে সব কালো চুল পড়ে গিয়ে গজালো সাদা চুল। সবচে উল্লেখযোগ্য লক্ষণ উপসর্গ হিসাবে দেখা দেয় প্রতিবন্ধী রঙ দৃষ্টি: `নীল রঙের আকাশের নিচে বরফের উপরে বর্ণহীন সূর্যের আলো ঝলকাতে দেখানো নিজের কাছেই বিস্ময়কর বিস্ময় বলে মনে হয়েছিল।` লক্ষ্যণীয় যে ৯০ পৃষ্ঠার একটি গল্পে `বিষাদ` শব্দটি ছয় বার উল্লেখিত হয়েছিল, যা ভাইরাসের অপশক্তির প্রকাশে হতাশাব্যঞ্জক ভাষ্য।
পোর্টারের আঁকা গল্পরঙ স্প্যানিশ ফ্লু আক্রান্ত শিল্পীর আঁকা চিত্রের চেয়ে কম শিল্পানুগ নয়। যখন তিনি লেখেন, `দেহটি একটি কৌতূহলী দানব`, বাস উপযোগী নয়, কিভাবে কারো পক্ষে আবাস ভাবা সম্ভব? তিনি দেখান যে, নিছক অস্তিত্ব কিভাবে ব্যাথাতুর যন্ত্রণার বোঝায় পরিণত হয়। অন্য ব্যক্তির বেদনা অনুভব করা কঠিন, কিন্তু শিল্পকর্মের মাধ্যমে মারাত্মক অসুস্থতার অভিজ্ঞতা বর্ণনা কম কঠিন কিছু নয়।
ফ্লু মহামারী আক্রান্ত শিল্পীদের মধ্যে নিরাময়প্রাপ্ত একমাত্র শিল্পী মুনখ`ই তার ভুগান্তির প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম ও স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁর সে সময়ে আঁকা চিত্রে। মহামারীতে মগজ ছেঁড়া-ছুঁড়ির মাত্রা, যুদ্ধদিনে এমন হত্যাযজ্ঞ কালে বেশিরভাগ শিল্পীর জন্য বিষয়টি নিশ্চয়ই নিদারুন দুঃশ্চিন্তা ও হতাশায় আক্রান্ত করে থাকবে। যার জন্য শিল্পী `পিটার ব্রুয়েজেল` কে প্রয়োজন, আরেকটি `মৃত্যু জয় উৎসব` আঁকতে, যদিও ১৯৯১ সালে ব্রুয়েজেলের সংখ্যা সীমিতই ছিল। শৈল্পিকভাবে ১৯১৮-১৯২০ মহামারীর বছরগুলি বস্তুত বিশাল এন্টিক্লাইমেক্সের মতো অনুভূতির, যেন `বেল ইপকের` বেলুন যাত্রার পর মাটিতে প্রত্যাবর্তনের ব্যাকুলতা।
পোর্টার তাঁর `ম্লান সওয়ারী`গল্প সম্পর্কে বলেছিলেন, `মৃত্যু, যা একটি পুরো যুগকে গ্রাস করেছে`, আর শেষ লাইনটি শ্লেষাত্মক কথায় চিত্রিত: `সেখানে হয়তো এখন সব কিছুর জন্য প্রস্তুত`।
বর্তমান ভাইরাসের প্রকোপ কমার সাথে সাথেই আবার উৎসব আয়োজন শুরু হবে, তবে অতি শীঘ্রই এই আতংকের পরিসমাপ্তি নিয়ে নিঃসন্দিহান নয়। আপাতত অদূর ভবিষ্যতে `মৃত্যু-নৃত্য`সমাপ্তির পর উৎসব আয়োজনে সকলের সহাস্য উপস্থিতি কাম্য।
`আমরা যাইনি মরে আজও - তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়:` - জীবনানন্দ দাশ