ঘুম ও বিপ্লব: হাইসাম আল ওয়ারদানীর বই
[মিশরের লেখক গল্পকার হাইসাম আল ওয়ারদানীর বই "কিতাবুন নাউম" বা ঘুমের বই একটি দার্শনিক, কাব্যিক গ্রন্থ। হাইসাম ভিন্ন স্বাদের এই বইতে ঘুমের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন একদম নতুন আঙ্গিকে পাশাপাশি মরিস বাঁশো, জাক লাকা, ন্যান্সি এবং ওয়াল্টার বেনজানিমের মতো বিখ্যাত দার্শনিকদের ঘুম সম্পর্কিত আলাপও এনেছেন। এত আলাপের পরেও ঘুমকে তিনি কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় আনেননি। ঘুমের সাথে গতানুগতিক স্বপ্নের বর্ণনায় তিনি যাননি। বরং ঘুমিয়ে যাবার পূর্ব মূহুর্তকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ঘুমের প্রভাব আমাদের ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন, রাজনৈতিক জীবন এবং আধ্যাত্মিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। ঘুম যেন একটা নিরাপদ গুহা যেখানে মানুষ কয়েক ঘণ্টার জন্য পালিয়ে বাঁচে। দিনের কর্মব্যস্ততা যতটুকু ক্ষতি করে ঘুম তা ফিরিয়ে দেয়। ঘুম নিয়ে এমন আশাবাদী কথা বলার পর হাইসাম এটাও বলেছেন এই ক্ষতিপূরুণের জন্য যে দীর্ঘসময় ঘুমের মাধ্যমে আমাদের জীবন থেকে প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে সেটাও ক্ষতি। দশ বছর আগে আরবে যে বসন্ত এসেছিল সেই বিপ্লবে আরবরা আশা করেছিল সকল দুর্নীতিবাজ একনায়কতন্ত্রের অবসান হবে। কিন্তু পাঁচ বছরের মধ্যেই এই গণজাগরণ মুখ থুবড়ে পড়ে। এই জাগরণ আর বিপ্লবকে হাইসাম তুলনা করেছেন ঘুম আর জাগ্রত অবস্থার সাথে। তাই তিনি এই স্থবির অবস্থাকে ব্যর্থতা বা পরাজয় না বলে পুনর্গঠনের সময় বলে উল্লেখ করেছেন। ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষের দেহমনে যে গুরুত্বপূর্ণ মেরামত সাধিত হয় তা তাকে নতুন জীবন দান করে। তাই ঘুম মানে নিজেকে জাগ্রত অবস্থার জন্য প্রস্তুত করা। ওয়াল্টার বেনজামিনের 'সামগ্রিক জাগরণ' ধারণার অর্থ যেমন বিপ্লব তেমনি এই জাগরণের বিপরীত হলো ঘুমন্ত অবস্থা।]
কিতাবুন নাউম থেকে কিছু অংশের অনুবাদ
রাত নেমে আসার সাথে সাথে দুনিয়া পাল্টে যায়। এক পৃথিবীর বিদায়ের মূহুর্তেই হাজির অন্য এক পৃথিবী। এই অন্য জগতের অন্ধকার ঢেকে দেয় অনেককিছু। সীমারেখাগুলো শিথিল হয়। মলিন হয় । এক দুনিয়ার তীব্র আলোর ঝলকানিতে যা ঝলসে গিয়েছিল অন্য দুনিয়ার অন্ধকার তাতে প্রলেপ লাগায়্ দিনে যে বাহিনী শ্রম ব্যয় করে নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে থাকে রাতে ভিন্ন এক শক্তি তাদের উপর কাজ করে। নীরবে নিঃশব্দে ধ্বংসপ্রায় প্রাণে শক্তি জোগায়। রাতের এই বাহিনী প্রাণগুলোকে ফিরিয়ে আনে নিজেদের মধ্যে। দিনের মধ্যভাগে যেমন শ্রমিক লোহা পেটায়, যে কাঠমিস্ত্রি টেবিল বানায় তেমনি রাতে কেউ ফল পাকায়। দৃঢ় পরিকল্পনা আঁটে। অন্ধকারের ডানার নীচে কাজ করে রাতের শ্রমিকেরা। এরা অপরিচিত অচেনা। এদের কোনোভাবেই সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব হয় না। দিনের শ্রমিকরা কে কি করছে তা সুস্পষ্ট। কিন্তু নিকষ অন্ধকাওে ভ্রæণের বেড়ে ওঠা বা ফুলের কোলে ফলের বৃদ্ধি পাওয়া কেউ দেখতে পায়না। রেশমের গুটির মধ্যে যেমন নিরাপদে বেড়ে ওঠে রেশম কীট তেমনি রাতও ঘুমন্ত প্রাণগুলোর জন্য সুরক্ষা বলয় তৈরি করে। আলোর তীব্রতা থেকে তাদের সরিয়ে আনে। অন্ধকারে ঘুমন্ত মানুষগুলো পরিশুদ্ধ হয় আর প্রস্তুত করে নিজেদের পরবর্তী দিনের উপযুক্ত করে। ভোরের আলো ফুটতেই এই দুনিয়া অদৃশ্য হয়ে যায় আর দৃশ্যমান দাপটের সাথে আলোর দুনিয়া।
পৃথিবীকে আমরা বিদায় জানাই এটা জেনেই যে আমরা ছাড়া পৃথিবী দিব্যি চলবে। আমাদের জন্য থেকে থাকবে না কোনো কিছুই। আমাদের অনুপস্থিতিতে কোথাও সামান্য লোকসান হবে না। সাধ্যমতো সবটুকু করার পরেও আমরা ব্যর্থতা নিয়ে চলে যাবো। আমাদের সব অর্জন বাতাসে মিলিয়ে যাবে। প্রতিদিন আমরা এগিয়ে যাচ্ছি একটা পরিসমাপ্তির দিকে। দুনিয়াকে বিদায় জানিয়ে আমরা বালিশে মুখ গুঁজি। পরিপূর্ণ আশায় বুক বেঁধে কোনো রকম দুঃখবোধ ছাড়াই আমরা বালিশে আশ্রয় নিই। অন্ধকারে আমাদের সাথে আকস্মিকভাবে আশা আকাঙ্খার দেখা হয়। ধীরে ধীরে সে আশাগুলো শক্তিশালী হতে থাকে। এই আশাগুলোই আবার আমাদের জাগিয়ে তোলে। আশা করি এই অন্ধকার শীঘ্রই কেটে যাবে। আমরা অপেক্ষা করি দিনের আলো ফোটার জন্য। আমাদের মনে নতুন সম্ভাবনা উঁকি দেয়। অন্ধকারে যেমন ফল পরিপুষ্ট হয় তেমনি এই গোপন আশাগুলোও পোক্ত হয়্। রাতে আমরা এই আশা নিয়ে ঘুমাতে যাই যে আগামীকাল ভোরে চোখ মেলেই দেখব সবকিছু ঠিকঠাক। রাত বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে অন্ধকার বাড়ে আর আশাগুলোও রঙীন আর মধুর হতে থাকে। এইটা বড় উপহার ঘুমের কাছ থেকে। প্রত্যেকটা ঘুম আশাগুলো পরিচর্যা করার সময়। ঘুম যেন একটা প্রশিক্ষণের সময়। কিন্তু এই আশাগুলো আসলে কি দেয় আমাদের?
একবার ভয় পাবার পরেই সীমাহীন বিশ্বাস জন্মে অজানা কোনো কিছুর উপর। অদৃশ্য এক জগতে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করে আমরা বিদায় জানাই যে দুনিয়াকে সে দুনিয়ার প্রতি আমাদের অনেক আস্থা আর বিশ্বাস। এই আস্থা হয় যখন আমরা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারাই এই দুনিয়ার উপর। ঘুমের মধ্যে যে আস্থা বিশ্বাস নিহিত থাকে তা অন্য কোনো আস্থা বিশ্বাসের মতো নয়। বরং এটা সব আশা আকাঙ্খার মূল। এখান থেকেই উৎসরিত হয় সকল স্বপ্ন আর আশা। এই আশা হলো সাঁতরিয়ে নদীর অপর প্রান্তে পৌঁছে কোনো অজানাকে আলিঙ্গন করা।
আমরা ঘুমের আগে আমাদের চোখ বন্ধ করি কিন্তু আমাদের কান থাকে খোলা। ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ, জানালা দিয়ে আসা রাস্তার কোলাহল আর বালিশে গাল ঠেকিয়ে হৃদয়ের ধুকপুক সবকিছুই স্পষ্ট শুনি। আমাদের ভিতরের গর্জন অচেতন অবস্থাতেও থামেনা। যখন ঘুমের অপেক্ষায় এপাশ ওপাশ করি বিছানায় তখনও আমরা এই শব্দগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন হইনা। বরং ভিতরের শব্দগুলোর দিকেই মনোযোগ আরো তীব্র হয়। আমরা তখন তাই শুনি যা শুনতে চাই। সব আওয়াজের মধ্যে থেকেও আমরা শুনি শুধু ভিতরের আলাপগুলোই। একসময় আমাদের পক্ষে আর ভিতর আর বাহিরের আওয়াজ আলাাদা করা সম্ভব হয় না। একসময় সে আশেপাশের আওয়াজ আর শুনতে পায় না কারণ সেই তখন বস্তুতে পরিণত হয়। এরপর তার কানের অন্য পথ খুলে যায় যে পথ দিয়ে তাকে পাঠানো বার্তা আসে। ঘুমন্ত ব্যক্তি তখন অন্য স্তরে উন্নীত হয়।
আমি কিন্তু চাইলেই জাগ্রত অবস্থা থেকে নিদ্রাবস্থায় স্বকীয়তা বজায় রেখে যেতে পারিনা। আবার ঘুমন্ত অবস্থা থেকেও ফিরতে পারব যেমন ছিলাম সে অবস্থাতেই। আমাকে অবশ্যই পরিবর্তিত হতে হবে সম্পূর্ণভাবে। জাগ্রত আমি যখন ঘুমাই তখন কিন্তু আমি কেউ না। যখন আমি ঘুমে তখন নতুন এক জগতে উন্নীত হই। আমি ঘুমাতে পারিনা সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ না করলে। আমাকে আমার সবকিছু ত্যাগ করে অবশ্যই বশ্যতা স্বীকার করে তবেই ঘুমাতে হবে। একইভাবে জাগতেও হবে সবকিছুকে ত্যাগ করে নতুনভাবে। নিদ্রাহীনতার ব্যধি কিন্তু বারযাখের দুনিয়ায় যেতে বাধা দেয়।
আমরা বলি বৃষ্টি হচ্ছে, বা বিপ্লব ঘটেছে অথবা বলি আমরা ঘুমিয়েছি। কিন্তু এগুলো কে করাচ্ছে? বৃষ্টি অবিরাম ঝরে পড়ছে বাইরে, এতে আমার কোনো অংশগ্রহণের প্রয়োজন নেই তাই আমরা বলতে পারিনা এটা আমার বৃষ্টি। কিন্তু বিপ্লব জামাআতবদ্ধ কাজ। এতে আমার অংশগ্রহণ থাকতেও পারে আবার নাও পারে তাই আমি অংশগ্রহণ করলে বলতে পারি এটা আমাদের বিপ্লব। আর ঘুম আমার ব্যক্তিগত অবস্থা। এই সময় আমি হারিয়ে যাই তাই ঘুমের ক্ষেত্রে বলতে পারি এটা আমার ঘুম। ঘুম আর বিপ্লব দুটোই জামাআতবদ্ধ অবস্থা এতে একাকী অবস্থার কোনো সুযোগ নেই। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় অনন্য। একটা ফোঁটার সাথে আরেকটির মিল নেই। ঘুমও ভীষণ রকম অনন্য কিন্তু এটার কোনো অবয়ব নেই।
আমরা জাগ্রত হবার পরেই ঘুম একটা অবয়ব পায় তেমনি বিপ্লবও একটা আকৃতি পায় তা শেষ হয়ে যাবার পর।
তাহলে আমার প্রেম তোমার জন্য কি?
তোমার প্রেম আমাকে তোমার চারপাশে ঘুরতে বাধ্য করেনা যেমন পতঙ্গ বাধ্য হয় আগুনের পাশে উড়তে। তোমার প্রেম আমাকে সাগরে নিমজ্জিত করে আর তীরে দাঁড়িয়ে সবাই সেই ডুবে যাওয়া অবলোকন করে।
আবার নীরবতার থাবা বসে তাদের শোবার ঘরে। যখন মেয়েটা জেগে থাকে তখন তাদের কণ্ঠভারে থরথর করে কাঁপে ঘর। আর এখন গাঢ় থকথকে শীতল নীরবতা চারিদিকে। মাঝেমধ্যে তার পাশ ফেরার শব্দ আর নির্জন রাস্তা চিরে কোনো গাড়ির ছুটে চলার শব্দ ছাড়া আর কোনো কিছুই তাকে বিরক্ত করছে না। দিনের বেলো তারা সারাক্ষণই কথা বলে। ঝগড়া করছে নাকি মিটমাট করছে, বাকবিতন্ডা নাকি বিতর্কে ফেটে পড়ছে তা কোনো বিষয় না। গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা কথা বলছে। কথায় তাদের জড়িয়ে রাখে এক সুতোতে। কিন্তু রাতে এই দীর্ঘসময় পাশাপাশি শুয়ে থেকেও তারা কোনো কথা বলছে না। ছেলেটার নিদ্রাহীনতার সমস্যা দীর্ঘদিনের। রাতের এই দীর্ঘসময় সে তার সঙ্গীর সাথে কোনো কথা বলতে পারেনা। রাতের পর রাত সে তাকিয়ে থাকে স্ত্রীর দিয়ে। বোঝার চেষ্টা করে প্রতিরাতে কোথায় চলে যায় সে। আধবোজা চোখের ফাঁক দিয়ে তার মধু রঙা মণিটা ওঠানামা করতে থাকে। তাদের যেমন ধরনের ভালোবাসার সম্পর্ক তেমনই তাদের কথোপকথন। ছেলেটা যখণ কিছু বলতো মেয়েটা শুনতো। আবার মেয়েটা বলার সময় শুনতো ছেলেটা। তাদের কথা পরস্পরের দেহে কাঁপন ধরাতো। যদি কিছু বলার না থাকতো মিথ্যামিথ্যি ঝগড়া খুনসুঁটিতে মেতে উঠতো। অথবা মেয়েটা অনর্থক প্রতিবেশীদের কোনো গুরুত্বহীন গল্পের ছলে কথা বলতো। ছেলেটার অনিদ্রাজনিত সমস্যাটা তীব্র হতে শুরু করল যখন থেকে মেয়েটা ঘুমের মধ্যে ডাকাডাকি শুরু করল। বিড়বিড় করে কথা বলার ফাঁকে সে খুব স্পষ্ট করেই অন্যদের নাম ধরে ডাকতো। এদের মধ্যে কেউ জীবিত কেউ মৃত। কাউকে ছেলেটা চেনে কাউকে চেনে না। হাসান! বাবা! সামির! আনওয়ার! সামিরা! উমমু সাইদ!
খুব অনুনয় বিনয় করে ডাকে সবাই ডাকে। সে শুধু ডাকেই কিন্তু তাদের ডেকে কিছু বলেনা। যেন আদালতে সাক্ষীদের নাম ঘোষনা দেয়ার দায়িত্ব পড়েছে তার। তাদের শোবার ঘরে যেন অনেক মানুষের আনাগোনা শুরু হয় প্রতিরাতে। মেয়েটার একান্ত জগতটা বের হয়ে আসে তাদের শোবার ঘরে। অথচ এই জগতে ছেলেটার কোনো অস্তিত্বই নাই। প্রত্যেক রাতে সে খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে যেন বউয়ের দুনিয়াতে তার যাবার অনুমতি মেলে। কিন্তু কখনোই তার নাম উচ্চারিত হয় না।
আমাদের ভ্রæর লোমগুলো ঘেমে যায়। মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ে। লবনাক্ত কোনো পদার্থ ঠোঁটে চলে আসে। হালকা গন্ধ বের হয় শরীর থেকে আর সেই সাথে অসংখ্য ছবি এসে ভীড় জমায় আমাদের দৃষ্টির সামনে। আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলো অসাড় হয়ে পড়ে। মাথা উন্মুক্ত হয়। আত্ম সীমাহীন শুন্যতায় ভেসে বেড়ায়। কাঁধের ব্যাথা হালকা হয়, আঙ্গুলের ক্ষত শুকায়। ডান গালে ভাঁজ পড়ে। কপালে ফুসকুঁড়ি আর বাহুতে গোটা হয়। হাঁটুর চামড়া কুঁচকে যায়। নতুন স্মৃতিরা এসে উঁকি দিয়ে যায়। চোখের নিচে কালি পড়ে। কোনো অসমাপ্ত পরিকল্পনা স্থির হয়। চোখের মণি কাঁপে তিরতির করে। চুল পড়ে বালিসে। মেজাজ ফুরফুরে সেই সাথে দৃষ্টিতেও আসে স্বচ্ছতা। চোয়ালের মাংশপেশি শিথিল হয়ে দাঁতে দাঁত ঘষা খায়। কিভাবে এতকিছু ঘটে তার কিছুই আমরা জানিনা। ঘুম থেকে জেগে এভাবেই প্রতিদিন আমরা নিজেদের পাই।