ঘুম: অনূদিত কবিতা
যত ঘুম
জালালউদ্দীন রুমি
কারণ আমি ঘুমোতে পারি না
কারণ আমি ঘুমোতে পারি না
আমি রাতে গান নিয়ে থাকি
বসন্তের ফুলের মতো যার মুখাবয়ব
সেই আমাকে জ্বালাচ্ছে
আমার ঘুমও নেই, ধৈর্যও নেই
আমার সুনামও নেই, দুর্নামও নেই
সহস্র জ্ঞানের আলখেল্লা ভেসে গেছে
আমার সব সদাচরণ এখন সহস্র মাইল দূরে
আমার হৃদয় ও মন পরস্পরের উপর রেগে আছে
তারা ও চাঁদ পরস্পরের প্রতি ইর্ষাপরায়ণ
এই অসুখের কারণে এই বস্তুবিশ্ব
কঠোর থেকে কঠোরতর হয়ে উঠছে
চাঁদ বলছে, 'আমি আর কতকাল
সূর্য ছাড়া একা ঝুলে থাকব?'
(আংশিক)
আজ রাতে ঘুমেতে যেয়ো না
আজ রাতে ঘুমোতে যেয়ো না
তুমি যা সবচেয়ে বেশি চাও
রোদ সেকা হয়ে তা-ই আসবে
তুমি বিস্ময়ে দেখবে।
তুমি যদি ঘুমিয়ে পড়
তুমি যদি ঘুমিয়ে পড়,
তোমার চোখ থেকে ঘুম তুলে নেবো
তুমি যদি পর্বত হও, আমি তোমাকে আগুনে গলাব
তুমি যদি সাগর হও সব পানি আমি শুষে নেবো
তুমি যদি ধৈর্য ধরো,
আমি এসব থেকে তোমাকে মুক্তি দেবো।
শরীরের ঘুম আত্মার জাগরণ
প্রতিরাতে তুমি আমার আত্মা
শরীর থেকে মুক্ত করে দাও
প্রতিরাতে আত্মা খাঁচা থেকে বেরিয়ে যায়
মুক্ত আত্মা কারো প্রভুত্ব মানে না
সেও কারো প্রভু নয়
ঘুমের মধ্যে রাজারা রাজমহিমা টের পান না
কে তোয়াজ করল, কি হারালেন কি পেলেন
এসব চিন্তা মাথায় থাকে না।
হাফিজের কবিতায় ঘুম
যদিও আমি বুড়ো হয়ে গেছি
আমাকে শক্ত করে
তোমার বাহুতে আঁকড়ে ধরো
ভোরে ঘুম থেকে যখন জেগে উঠব
দেখবে আমি তখন যুবক একজন।
রাতের লিখন
লুইস গ্লিক
সে জানে সে আঘাত পাবে
তার বিছানায় সতর্ক সংকেত আসে
বিশ্রাম তাকে হুমকি দেয়, রাতের আলোর
চদ্মবেশী আলোতে যে মাংসে তার জীবনের
সারাৎসার তাকে প্রহরার ভান করে
সে তার বাহু ছড়িয়ে দেয়। দেয়ালে ভাসে
একই রকম এক আকৃতি, তার নিয়ন্ত্রণ নেই
এমন এক অন্ধকারের সাথে তাকে যুক্ত করে
নিজের অবয়বে জন্তুরা দেখে কে তার শত্রু,
সে ঘুমোতে পারে না, তাদের ছাড়া।
এ কেমন রাত
সের্গেই য়েসেনিন
এ কেমন রাত আমি ঘুমোতে পারি না
জ্বলজ্বলে চন্দ্রালোক অস্থিতিশীল করে রেখেছে
যেন আমি সম্মানের সাথে
আমার আত্মার ভেতর রেখে দিই
অপচিত যৌবনের পন্থাগুলো।
ওহ্ ঈষদুষ্ণ দিনগুলোর বন্ধু আমার
ফস্টিনস্টির ঘটনাগুলো অনুভবে নিয়ো না।
এই স্নিগ্ধ চন্দ্রালোক, রশ্মি বৃষ্টি ধারার মতো
আমার বালিশের উপর পড়তে দাও।
সত্যিকারের ভালোবাসা একবারই প্রকাশিত হয়
সে কারণেই তোমাকে এত দূরের মনে হয়
বরফ ঢাকা বীথিকায় পা ডুবিয়ে
হলদে ফুলের গাছ আমাদের ডাকছে?
আমরা এতো বছর আগে ভালোবেসেছি
তুমি আমাকে ভালোবাসো নি, আমি বেসেছি অন্যকে
আমরা নৈর্ব্যক্তিকভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম
সহজ প্রেমিক যুগলের দ্রুততর রোমাঞ্চ।
নাজিম হিকমতের কবিতা থেকে
কোনো ভাবেই তুমি রাতের ভার্না শহরে ঘুমোতে পারো না
ঘুমোবার কোনো উপায় নেই
কারণ তারার বৈভব এতো কাছে
এতো উজ্জ্বল; বালির উপর মৃত ঢেউয়ের শব্দ
নোনা আগাছার সাথে
ঝিনুকের আবরণ এবং নুড়ি
মোটরবোটের শব্দ সমুদ্রের হৃদস্পন্দনের মতো
ইস্তাম্বুল থেকে আসা স্মৃতি,
বসফরাস হয়ে যাবার সময়
আমার কক্ষ ভরে রেখেছে
রুমালে বাধা কিছু সবুজ চোখ
কিংবা রুমাল হাতে নিয়ে আছে
রুমালে বেগনি ফুলের সুবাস
প্রিয় আমার কোনোভাবেই, তুমি ভার্নায়
ঘুমোতে পারো না, কিছুতেই না
ভার্নায় বোর হোটেলে।
- (ভার্না : বুলগেরিয়ার শহর, বোর হোটেল : ভার্নার একটি হোটেল)
আজ যারা ঘুমিয়ে আছ
বিক্রম শেঠ
আজ যারা ঘুমিয়ে আছ তোমরা সবাই
ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে অনেক দূরে
বামে কোনো হাত নেই কিংবা ডানে
উপরে কেবল ধু ধু শূণ্যতা।
জেনে রেখো শুধু তোমরাই নও
তোমাদের অশ্রু ভাগাভাগি করে নেয় সমস্ত পৃথিবী
কেউ নেয় দুই বা এক রাতের ভাগ
আর কেউ তাদের জীবনের সবগুলো বছর।
সুশান্ত সিং রাজপুতের জন্য
ফারহান আকতার
ঘুমোও ভাই আমার ঘুমোও
শকুনেরা জড়ো হোক
কুমির করুক অশ্রু বিসর্জন
সার্কাসের বাজিকর কসরৎ করুক
আনত হোক, লাফাক ধুপধাপ
চিৎকার উঠুক ঊর্ধ্ব আকাশে
মানুষের অন্তরের অন্ধকার
আরো গভীর হোক
ঘুমোও ভাই আমার
ঘুমোও।
রুশ ঘুম নিরীক্ষা
স্যামুয়েল ইভান
আমি জেগে আছি
প্রেতাত্মা আমাকে আর ধরতে পারবে না
আমি জেগে আছি
ইবলিশ আমাকে আর খেতে পারবে না
দেখো আমি জেগে আছি
ঘুমের মধ্যেই তারা বসবাস করে
সে কারণে আমি জেগে আছি, আমি মুক্ত
যে আত্মা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়
যে ছায়া আমার পিছু পিছু আসে
যে দানব আমাকে অনুসরণ করে
যে মৃত্যু আমাকে হিম করে রাখে।
সবকিছু থেকে আমি মুক্ত।
- (আংশিক)
যে শহর ঘুমায় না
রাইনার মারিয়া রিলকে
আকাশে কেউ ঘুমিয়ে নেই, কেউ না, কেউ না,
কেউ ঘুমিয়ে নেই
চাঁদের জীবগুলো গন্ধে শুকে ঘুরঘুর করে তাদের কেবিনে
জ্যান্ত ইগুয়ানা বেরিয়ে আসে এবং যে মানুষ স্বপ্ন দেখে না
তাকে কামড়ে দেয়
আর যে মানুষ তার ভগ্ন আত্মা নিয়ে রাস্তায় নেমে
দেখা পাবে অবিশ্বাস্য কুমিরের
তারাদের প্রতিবাদের নিচে
শান্ত হয়ে বসে আছে
পৃথিবীতে কেউ ঘুমিয়ে নেই, কেউ না, কেউ না
কেউ ঘুমিয়ে নেই
দূরের সমাধিতে একটি মৃতদেহ আছে
তার হাটুতে লেগে থাকা গ্রামীণ চিহ্ন
তিন বছর ধরে গোঙ্গাচ্ছে
আজ সকালে যে বালকটিকে কবর দেওয়া হলো
এতো বেশি কেদেছে যে তাকে শান্ত করতে
একপাল কুকুর ডাকতে হলো।
আকাশে কেউ ঘুমিয়ে নেই, কেউ নেই, কেউ নেই
কেউ ঘুমিয়ে নেই।
- (আংশিক)