কুর্দি প্রত্নসম্পদ চোরাচালানির সাক্ষাৎকার
সামি গুনেরি গুলেনার নামের একজন তুর্কি প্রত্নসম্পদ চোরাকারবারি বলেছে: আমি ১০ টন ওজনের মূর্তি একটি সুইয়ের ছিদ্রের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে বের করে আনতে জানি।
চোরাকারবারিদের দক্ষতার বর্ণনা দিতেই মূলত সামির এই উদ্ধৃত ব্যবহার করা।
ছয়জন প্রত্নসম্পদ গবেষক ম্যাথু সারজেন্ট, জেমস মোরন, আলেকজ্ন্দ্রা ইভান্স, বিলিয়ানা লিলি, এরিখ নেমেথ এবং স্টিফেন ড্যানজেল প্রত্নসম্পদ পাচার ও বিক্রি নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের গবেষনা ও অনুসন্ধানের ক্ষেত্র ইরান, ইরাক সিরিয়া ও তুরস্ক। তাদের গবেষনালব্ধ প্রকাশনাটির নাম Tracking and Disruption in the illicit antiquities trade with open source data. এই প্রকাশনার তৃতীয় অধ্যায়ের নাম স্মাগলিং নেটওয়ার্কস অ্যান্ড সেলস চ্যানেলস।
সাক্ষাৎকার দেবার জন্য কোনো চোরাচালানি এগিয়ে আসবে কিংবা জিজ্ঞেস করলেই প্রশ্নের জবাব দেবে এটি অমূলক প্রত্যাশা। তবুও এই গবেষকরা একজন কুর্দি চোরাচালানির আস্থা অর্জন করেছেন। নাম, পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তাকে সাক্ষাৎকারে সম্মত করিয়েছেন। তারা কজন ডিলারের সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন। এই চোরাচালানি ইরান-তুরস্ক ও ইরাক-তুরস্ক সীমান্তে পনের বছর ধরে চোরাচালানিতে জড়িত। তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক ও ইরান এই চারদেশের সীমান্তঘেষা কুর্দিস্তানে কৌশলগত দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। বিশেষ করে ইরাকের অস্থিতিশীলতা ও প্রত্নসম্পদের ব্যাপক লুন্ঠন চোরাইবাজারে গতিশীলতা এনে দেয়।
তাদের একজন কুর্দি সহযোগী এই চোরাচালানির সাথে তাদের যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দেন।
বর্ণনার সুবিধের জন্য আমরা ধরে নেই তার নাম সোলায়মান বারজানি। আমরা তাকে সোলায়মান সম্বোধন করব। সোলায়মানের অনেক ধরনের ব্যবসায়ের একটি হচ্ছে প্রত্নসামগ্রী কেনা ও বেচা, আর এর সাথে চোরাচালানের একটি সম্পর্ক রয়েছে। প্রথম সাক্ষাৎকারের সিডিউলটি সে বাতিল করতে বাধ্য হয়। ইরানি এক ব্যবসায়ীর সাথে আটকে যাওয়ায় সোলায়মান আসতে পারেনি। ইরানি ব্যবসায়ী ইরাক থেকে সস্তায় আখরোট কিনে ইরানে নিয়ে বিক্রি করেন। সোলায়মান এখানেও মধ্যস্থতাকারী। শুরুতে সে ইরান ও ইরাকের মধ্যে ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও অন্যান্য বাণিজ্যিক পণ্য দু'দেশের মধ্যে বেচাকেনা করত। যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করার পর ২০০৩ সালে চোরাচালানির সাথে জড়িত হয়--এই ব্যবসাটির বিষয় তার অজানা ছিল না, কিন্তু বড় পদে নিজের কোনো স্বজন না থাকায় তাকে বিপদে পড়লে সাহায্য করবে এমন কেউ না থাকায় সে চোরাচালানিতে যোগ দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখে।
২০০৩ সালের মে মাসে সোলায়মান ইরাকে অবস্থানকারী তুর্কি বন্ধুর কাছ থেকে ফোন পেল: সাদ্দাম হোসেন সরকারের পতন ঘটার পর সে দেশে লুট হওয়া প্রত্ন নিদর্শন যদি কারো হাতে থেকে থাকে তাহলে বড় দাম দিয়ে তা কিনে নেবার জন্য কজন তুর্কি ব্যবসায়ী প্রস্তুত আছেন। স্থানীয় টেলিভিশনে দেখিয়েছে বাগদাদ জাদুঘর ও নিনেভেহ জাদুঘর থেকে কমবেশি ১৫০০০ প্রত্নসামগ্রী লুণ্ঠিত হয়েছে। লুটপাটের এই ঘটনাগুলো সোলায়মানের জানা ছিল। দ্রুত সে বাগদাদে তার কজন বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করল। বাগদাদের আশারয়ের উপজাতির একজন নেতার সাথে সম্পর্কিত একজন বিক্রেতাকে পেয়ে গেল। সাফল্যের সূচনা এখানেই। পরের ক'মাসে ইরান ও তুরস্কের কজন দালাল এবং বেশ কিছু সংখ্যক ডিলারের সাথে তার পরিচয় হলো। সাংবাদিক সেজে তার কাছে ক'জন বিদেশি খদ্দের এলো। ক'জন আমেরিকান সৈন্যও এলো দোভাষী সাথে নিয়ে। চোলাচালানি হিসেবে তার নাম বহুল প্রচারিত হতে বেশি সময় লাগেনি।
সব মিলিয়ে কটা প্রত্নসামগ্রী বিক্রি করেছে জিজ্ঞেস করা হলে সোলায়মান বলল, 'সত্যি বলতে কি আমার জানা নেই। তারপর তাকে আরও চাপ দেওয়া হলে সংখ্যাটা কমবেশি ষাট বলে জানায়। ২০০৩-এ হাতে খড়ি হলেও সোলায়মান জানে ১৯৯২ সালে ব্যবসাটা খুব ভালো ছিল, কেউ কেউ এ সময়ে মিলিয়নিয়ার হয়ে গেছে। ২০০৩, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে চোরাচালানিরা খুব ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে। সোলায়মান সতর্ক, বড় লোভের ফাঁদে পা দেয় না। নিজেকে সে মোটামুটি মানের একজন চোরাচালানি মনে করে, তবে এই লাইনের অন্যদের চেয়ে সে খোঁজখবর বেশি রাখে বলে দাবি করে।
আমেরিকান সৈনিকরাই ইরাকে লুটতরাজের পথ সুগম করে দিয়েছে, তারা যখন দোভাষী নিয়ে চোরাই মাল কিনতে এসেছে, তারা কি সত্যিই কিনতে না মালামালের মজুত সনাক্ত করে পুনরায় লুটরাজ করতে চাচ্ছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সোলায়মানের এক বন্ধু ২০১৪ ও ২০১৫ তে প্রত্নসামগ্রী কেনাবেচা করে ২ লক্ষ ডলার লাভ করেছে।
ইরাকের নাবাখ আল হাজার, নিমরদ এবং নিনেভেহর প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা থেকে লুট করা বহু জিনিসপত্র ক্রমেই বাজারে আসতে শুরু করে। এ সব সামগ্রীর দাম এক হাজার ডলার থেকে ২ লাখ ডলার পর্যন্ত।
২ লাখ ডলারে কি বিক্রি করেছে জিজ্ঞেস করলে সোলায়মান বলল,'সাদ্দাম হোসেনের ব্যক্তিগত ডেগার। এটা অনেক পুরোনো এবং খাটি সোনার তৈরি।
২ লাখ ডলার যার বিক্রয় মূল্য তা কতদামে কিনেছে জিজ্ঞেস করা হলে সোলায়মান হেসে জবাব দিল,'দুঃখিত, এটা বলা যাবে না।'
চোরাই বাজারে যে সব নতুন পণ্য আসছে তা সরাসরি খননকারীর হাত থেকে দালালের হাত ঘুরে আসছে। তবে অধিকাংশ সময়ই চোরাচালানিদের নজর থাকে বহু পূর্বে খনন করে উদ্ধার করা সামগ্রীর উপর। সোলায়মান মনে করে যত আগে খনন করে পাওয়া গেছে দাম ও তত বেশি বেড়েছে। তবে সে জানে জাদুঘরের প্রত্নসামগ্রীই সবচেয়ে বেশি দামি, কিন্তু জাদুঘরের চোরাই মাল কেনা থেকে সে নিজেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে, কারণ তাতে বহুদেশিয় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে- বড় ধরনের শাস্তিও হয়। সোলায়মান জানায় ইতালি ও ফ্রান্স তাদের এবং অন্যদেশের জাদুঘর থেকে চুরি কিংবা লুট করে নেওয়া সামগ্রী সনাক্ত করতে বিশেষ দক্ষ। এ ধরনের সামগ্রীতে জাদুঘরের বিশেষ কোড মুদ্রিত থাকে। ইতালির বিশেষ পুলিশ ক্যারাবিনিয়ারির দক্ষতার সূত্র ধরে সোলায়মান বলল, ঝুঁকির কারণে কখনো সে জাদুঘরের জিনিস কিনতে চায় না।
যখন আইএসআইএস ক্ষমতাশালী হয়ে উঠল তখন সে আইএস নিয়ন্ত্রিত ইরাকি অঞ্চলের দালালদের সাথে যোগাযোগ করে। আইএস আসার আগেই তাদের সাথে সোলায়মানের যোগাযোগ ছিল। এই দালালদের জন্ম ও বড় হওয়া এই অঞ্চলেই। আইএস নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর তাদের অবৈধ ও চোরাই সামগ্রী বেচে টাকা আনতে এই দালালদেরই ব্যবহার করল। এদিকে দালালদের বেচাকেনা নিরুপদ্রপই থেকে গেল কারণ তারা আইএস যোদ্ধাদেরও খাজনা হিসেবে লভ্যাংশ দিতে শুরু করল। এদিকে আইএসআইএস তাদের আগ্রহী যোদ্ধাদের প্রত্নস্থান খনন করার অনুমোদন কার্ড দিল- খননের কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই। তারা যেখানে ইচ্ছে সেখানেই খনন করতে পারবে।
প্রত্নসম্পদের এই দালাল শ্রেণীর কেউই আইএসআইএসভুক্ত নয়; সোলায়মান জানায়, তবে তারা তাদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলে। আইএস নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার বাইরে এবং তুরস্ক, লেবানন এবং ইরানে প্রত্নসম্পদ পাচার করতে হলে আইএস তাদের কাছ থেকে রফতানি শুল্ক আদায় করে থাকে। সোলায়মান জানায় ব্যবসায়ের প্রশ্নে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকলেও প্রতিবেশী দেশসমূহের চোরাচালানিদের সাথে অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্ক থাকে--এটা অনেকটা বর্ধিত পরিবারের মতো। খননকারী, দালাল, চোরাচালানি এবং বণিক সবাই একই সৌহার্দ সূত্রে গাথা, তাদের সাথে যোগ হয় সে সব দেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী, ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং যেখানে আইএস আছে তাদের নিবেদিত সদস্য। দালালদের সাথে স্থানীয় ও উপজাতীয় সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের একটি সমঝোতামূলক যোগাযোগ থাকে। তারাই উপজাতীয় সংগ্রহসূত্রগুলো চোরাচালানিদের দেয় এবং প্রয়োজনে মাল ও অর্থের জিম্মাদার হতেও দ্বিধা করে না।
সোলায়মান জানায় আর্থিক লেনদেন ঘটে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত চ্যানেলের মাধ্যমেই, তারাও এই প্রক্রিয়ায় বিশ্বস্ত পার্টনার।
সোলায়মান যে সব মালামাল চোরাচালান করেছে তার মধ্যে রয়েছে মসুল, রাবুডা ও আলেপ্পো থেকে সংগৃহীত প্রত্ন নিদর্শন, প্রাচীন মুদ্রা, ভাষ্কর্য, স্বর্ণখচিত বাইবেল, স্বর্ণতীর-ডার্ট, বাইজেন্টাইন ও আর্মেনিয়ান আমলের দ্রব্য সামগ্রী, সিরামিক, জুয়েলারি মূর্তির মাথা ইত্যাদি।
সোলায়মান যে সব মুদ্রা বিক্রি করেছে সেগুলোর দাম ৫০ ডলার থেকে ৮০০ ডলারের মধ্যে, প্রত্নসামগ্রী সর্বোচ্চ ২ লাখ ডলার। মূল্যবান যে সব দ্রব্য সোলায়মান বিক্রি করেছে তার অধিকাংশই সাদ্দাম হোসেন ও তার পরিবারের মালিকানাধীন ছিল। সোলায়মানের এক বন্ধু সাদ্দামের সাবেক স্ত্রী সাজিদার একটি হীরার অলঙ্কার দশ লক্ষ ডলার বিক্রি করেছে। সোলায়মান একটি মূর্তির মাথা ৮০ হাজার ডলার বিক্রি করেছে। সোলায়মানের কথায় এবং গবেষকদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আইএসআইএস ক্ষমতাসীন হবার পর প্রত্নসামগ্রীতে বাজার ভরে গেছে, ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এসব দ্রব্যের দাম পড়ে গেছে। এসবের বাজার মূল্য নাটকীয়ভাবে কোথাও বেশি বা কোথাও অবিশ্বাস্যরকম কম এমন নয়- যারা সচেতনভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন চোরাকারবারি, দালালি, ডিলার কিংবা বিক্ষিপ্ত বিক্রেতা হিসেবে কাজ করে তারা লন্ডন কিংবা প্যারিস কিংবা নিউ ইয়র্কের বাজারে মূল্য কতো হবে তা অনুমান করতে পারেন। প্রযুক্তি সহায়তা নিয়ে বিশ্ববাজারও যাচাই করে নেওয়া যায়। তবে কখনো খামখেয়ালি ধরনের ক্রেতার দেখাও মেলে, তারা সস্তার জিনিস বিপুল অঙ্কের টাকায় কেনে, আবার গ্যাঙ্গস্টারের পাল্লায় পড়লে সামান্যতেই তা ছেড়ে দিতে হয়। গ্যাঙ্গষ্টাররা সহিংসতারও আশ্রয় নেয়।
টাকা পয়সার লেনদেনের প্রশ্নে চোরাচালানিরা ব্যাংক ব্যবসার উপর নির্ভরশীল বা আস্থাশীল কোনোটিই নয়। তারা হাওয়ালা পদ্ধতি লেনদেনের জন্য ব্যবহার করে এটা হুন্ডির একটি সংস্করণ। হাওয়ালাদার থাকেন ক্রেতার নিজ দেশে। তিনি টাকা গ্রহণ করার নিশ্চয়তা বার্তা প্রদান করলেই দ্রব্যটি ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রতি ট্র্যানজেকশনে হাওয়ালাদার সর্বোচ্চ এক মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হস্তান্তর করতে পারেন।
চোরাচালানির মাল সীমান্ত অতিক্রম করানোর প্রশ্নে সীমান্তরক্ষীদের ঘুষ প্রদানই সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। বৃদ্ধ ও হিজাব ঢাকা নারীদের আরব অঞ্চলে যথেষ্ট সম্মানের সাথে দেখা হয় বলে সীমান্তরক্ষীরা সাধারণত তাদের তল্লাসি করেন না। বৃদ্ধ ও পুরুষ ও নারীদের কেউ কেউ পেশাদার ক্যারিয়ার হিসেবে সীমান্তে অবৈধ পণ্য পারাপারের কাজ করে থাকে।
মূল বিক্রেতা, দালাল, ও চোরাচালানির সাথে চূড়ান্ত ক্রেতার যোগাযোগ হয়ই না বলা যায়।
প্রত্নসম্পদের চোরাচালানি কমেনি, অনেক বেড়েছে, ধরাও পড়ছে অনেক। এ কালের সবচেয়ে কুখ্যাত প্রত্নসামগ্রী চোরাচালানির সামাজিক পরিচিতি আর্ট ডিলার হিসেবে। ভারতীয় বংশোদ্ভুত নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক এই চোরাচালানির নাম সুভাষ কাপুর।