কয়লা ধুলে নয় নাম বদলে হয় পরিচ্ছন্ন কয়লা!
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির বিচারে সারা বিশ্বে প্রথম দিকেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, ঝুঁকিগ্রস্ত দেশগুলিকে নিয়ে গঠিত ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম বা সিবিএফ-এর বর্তমান সভাপতির ভূমিকায় আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে সর্বাধিক পরিবেশদূষণকারী হচ্ছে খনিজ কয়লা, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এ কারণেই গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী দেশের বিভিন্ন স্থানের ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প প্রস্তাব বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলে তা প্রসংশিত হয়।
কিন্তু কয়লা থেকে কি আসলেই সরে আসছে বাংলাদেশ? তীব্র সমালোচনার মুখেও রামপাল ও মাতারবাড়ী প্রকল্পের নির্মাণকাজ এগিয়ে চলেছে। পায়রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়ে গেছে। যে দশটি প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে, তার মূল কারণ হিসেবে পরিবেশ নয়, বরং কয়েক বছর ধরে এসব প্রকল্পের নির্মাণকাজের কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় মন্ত্রণালয় সেগুলি বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছিল বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নাসরুল হামিদ।
তিনি আরও বলেন,'কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আলট্রা সুপার কিট্রিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে। পরিবেশের ওপর একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রভাব একটি ইটভাটার প্রভাবের চেয়েও কম।' তার এই বক্তব্যে আধুনিক কয়লা প্রযুক্তির পরিচ্ছন্নতার ইঙ্গিত রয়েছে। এই পরিচ্ছন্ন কয়লার উল্লেখ আমরা পাই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে, যেখানে গেলে পরিচ্ছন্ন কয়লার সামাজিক এবং প্রযুক্তিগত সুবিধা সমূহের বর্ণনা পাওয়া যাবে। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিবরণে জাতীয় তথ্য বাতায়নে বলা হয়েছে, তা একটি "পরিচ্ছন্ন কয়লা প্রযুক্তি সম্পন্ন পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎকেন্দ্র"।
কিন্তু কয়লা ধুইলে কি সত্যি ময়লা যায়? আর পরিচ্ছন্ন কয়লাই বা আসলে কী?
ক্লিন কোল বা পরিচ্ছন্ন কয়লা শব্দবন্ধ কোথা থেকে কীভাবে এলো, তার গল্প জানতে হলে যেতে হবে আমেরিকায়। এই কিছুদিন আগেও সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখে অসংখ্যবার "পরিচ্ছন্ন, সুন্দর" কয়লার কথা শুনেছি আমরা। কিন্তু পরিচ্ছন্ন কয়লা বলতে আসলে কী বোঝায়, এ নিয়ে কোনই মতৈক্য নেই। আশির দশকের মাঝামাঝি এসিড বৃষ্টি ঠেকাতে আমেরিকায় ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি "ক্লিন কোল প্রোগ্রাম" চালু করলে প্রথম এই কথা চালু হয়। তখন কয়লা পোড়ানোর কারণে নিঃসরিত সালফার ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরবর্তিতে মার্কারী বা পারদ দূষণের উৎস হিসেবেও চিন্হিত হয় কয়লার দহন। শুরুতে পরিচ্ছন্ন কয়লা বলতে এই দূষকগুলি কমিয়ে আনাকেই বোঝান হত ।
পরবর্তিতে এই পরিচ্ছন্নতার ধারণার সাথে যুক্ত হয় কার্বন ডাইঅক্সাইড দূষণ কমিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা। ২০০৯ সালে আমেরিকার এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি বা ই পি এ কার্বন ডাইঅক্সাইডকে একটি বায়ু দূষক হিসেবে ঘোষনা দেয়। বিদ্যুত উউত্পাদনের ক্ষেত্রে কয়লা সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি করে। এ ছাড়াও, কয়লা উত্তোলন এবং পরিবহন পরিবেশ দূষণের বড় কারণ। অতএব অন্যান্য দূষণের সঙ্গে সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইড দূষণ মুক্ত না হলে কয়লাকে পরিচ্ছন্ন বলা যাবে না।
পরিচ্ছন্ন কয়লার "ব্র্যান্ডিং"
"ক্লিন কোল" কথাটিকে ব্র্যান্ডিং করার কৃতিত্ব আর এন্ড আর পার্টনার্স নাম একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার। অত্যন্ত সফল এই সংস্থাটির তৈরি আরেকটি স্লোগান আমরা অনেকেই শুনেছি, তা হল "লাস ভেগাসে যা ঘটে, তা সেখানেই থেকে যায়"। ২০০৮ সালে আর এন্ড আর কয়লাকে আমেরিকায় "দেশী জ্বালানি সম্পদ" হিসেবে প্রচার করতে শুরু করে। এক সময়ের জনপ্রিয় গ্র্যামী বিজয়ী ব্যান্ড কুল এন্ড দি গ্যাং এর গান "সেলিব্রেট দা গুড টাইমস"-এর সুরে সুরে দেখা যায়, কয়লার মধ্যে একটি বিদ্যুতের প্লাগ ঢুকছে, সাথে ধারাভাষ্য: আমেরিকান জীবন ধারার শক্তির উৎস এই জ্বালানি।
আরেকটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায় বিভিন্ন বর্ণের বিভিন্ন বয়সের নারী ও পুরুষ, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলছেন, "আমি বিশ্বাস করি"। আমেরিকান প্রযুক্তি এবং জ্ঞান দিয়েই কয়লাকে পরিছন্ন করে তোলা যাবে, এই আস্থার কথা প্রচার করে সেই বিজ্ঞাপন। এই একই সময়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড ছেয়ে যায় কয়লার পক্ষে প্রচারনায়, যেখানে জ্বালানি হিসেবে কয়লাকে বাদ দিলে ব্ল্যাক আউট, বেকারত্ব আর বিদ্যুত বিল বেড়ে যাবার ভয় দেখানো হয়।
এই সময়ে ওয়াল স্ট্রিট কিন্তু কয়লার বিনিয়োগ কমিয়ে দিচ্ছিল। বিশ্বজুড়ে জ্বালানি হিসেবে কয়লার ক্ষতিকারক দিকগুলি বিষয়ে পর্যালোচনা চলছিল। আশা করা হচ্ছিল ২০০৮-এর শেষে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে অবশেষে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ সীমিত করবার ওপর আইনি সীমা আরোপ করা হবে। আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে তখন কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প থেমে যাচ্ছিল বা বাতিল হচ্ছিল একের পর এক।
সে বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারনায় কয়লা-বাদীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষনীয়। তারা সিএনএন-এর চার চারটি বিতর্ক স্পন্সর করে। জেনে অবাক হবেন না যে এই বিতর্কগুলির কোনোটিতেই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়নি! সুনীল আকাশের ছবি দিয়ে সাজানো কয়লার পক্ষে প্রচারণার ভ্যান নির্বাচনী প্রচারনায় উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। বিভিন্ন এলাকার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি বিজ্ঞাপন এবং বিলবোর্ড দেখা যায় প্রায় প্রতিটা রাজ্যেই।
এক পর্যায়ে যেকোন মার্কিন নাগরিকের পক্ষে কয়লা প্রচারণা এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। টক শোর ফাঁকে বিজ্ঞাপনে তারা তা শুনতে থাকে, জনসমাগমে গেলে কয়লার গুনগান সম্বলিত টুপি বা টি শার্ট ধরিয়ে দেয় কেউ বিনামূল্যে, নিদেনপক্ষে হাতে গুঁজে দেয় কয়লার পক্ষে বিভিন্ন তথ্য এবং দাবি ভিত্তিক ব্রশিওর। এমনকি ক্রিসমাসের সময় ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলে ত্রিশ জন সান্টা ক্লজকে দেখা যায় কয়লা পিণ্ডের মত দেখতে চকলেট বিলি করতে!
মজার ব্যাপার হল, কয়লার বিজ্ঞাপনগুলিতে কখনই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিংবা কয়লার খনি বা দূষণের ছবি দেখা যায়নি, দেখা গেছে অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, নীল আকাশ, সাদা মেঘ আর সবুজের সমারোহ। বিজ্ঞাপন দেখলে এমন ধারণা হতে পারে যে কয়লা শিল্প পরিবেশবাদীদের চাইতেও প্রকৃতিকে বেশি ভালবাসে।
"পরিচ্ছন্ন কয়লার" প্রচার যন্ত্রের নেপথ্যে
১৮৮০ সাল থেকে রাখা বৈশ্বিক তাপমাত্রার উপাত্তের ভিত্তিতে আমরা জানি, সেই সময়ের পর থেকে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বেড়ে গেছে, যার জন্য দায়ী গ্রিন হাউজ এফেক্ট। গ্রিন হাউজ গ্যাসগুলির তালিকায় কার্বন ডাইঅক্সাইড। ১৮৮০ সালের পর ২০২০ আর ২০১৬ ছিল উষ্ণতম বছর। নাসার তথ্য মতে, ২০০০ সালের পর থেকে ১৯৯৮ বাদে প্রতি বছর উষ্ণতার রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। ১৯৯০ সালে ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) প্রথম যে রিপোর্ট প্রকাশ করে, যেখানে জলবায়ুর ওপর মনুষ্যসৃষ্ট কার্বন ডাইঅক্সাইডের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়ে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, এই দূষণ যদি সামলানো না হয়, ২০২৫ সালের মধ্যে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা এক ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। দুঃখের বিষয়, ইতিমধ্যেই তাপমাত্রা সেরকম বেড়ে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের পক্ষে তথ্য-প্রমাণ ও জনমত যত জোরালো হতে থাকে, তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে এর বিরুদ্ধে সংশয় সৃষ্টিকারী প্রচারণা। ১৯৮৯ সালে আমেরিকার শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর বিরোধিতা করতে গঠন করে গ্লোবাল ক্লাইমেট কোয়ালিশন বা জিসিসি। জিসিসি ছিল নব্বইয়ের দশকে জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকারকারীদের প্রাণকেন্দ্র। ১৯৯৫ সালে আইপিসিসি তাদের দ্বিতীয় রিপোর্টে জলবায়ুর ওপর মানুষের প্রভাবের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করে। রিপোর্টের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল এর বৈজ্ঞানিক অনিশ্চয়তার বিশ্লেষণ। এই রিপোর্টের অন্যতম প্রধান আমেরিকান রচয়িতা বেনজামিন স্যানটারকে আক্রমণ করে জিসিসি। দাবি করে, স্যানটার বৈজ্ঞানিক অনিশ্চয়তা গোপন করে ইচ্ছাকৃত ভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন।
১৯৯৭ সালে জিসিসি বৈশ্বিক পরিবেশ রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রস্তাবিত কিয়োটো প্রটোকলের বিরুদ্ধে বিজ্ঞাপনী প্রচারণা চালাতে ১৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে । ২০০১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ যখন কিয়োটো থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেরিয়ে আসেন, তখন স্টেট ডিপার্টমেন্টের একটি মেমোতে বলা হয় জিসিসি ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে। কারণ এই সিদ্ধান্তের পেছনে জিসিসির একটা বড় প্রভাব ছিল।
অথচ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিষয়ে মার্কিন শিল্পপতিরা আরও আগে থেকেই ওয়াকিবহাল। ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে এক্সন-এর জলবায়ু গবেষকরা তাদের নির্বাহীদের এই বিষয়ে জানান। ২০১৫ সালে পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া ইনসাইড ক্লাইমেট নিউজের একটি প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি এক্সনের উল্টোপথে যাওয়ার কথা। ১৯৮২ সালের মধ্যেই নিজস্ব একটি উচ্চাভিলাষী গবেষণার মধ্য দিয়ে এক্সন জলবায়ু পরিবর্তনের মৌলিক বিষয়গুলির প্রমাণ পায়। কার্বন দূষণের কারণে বিশ্বে বিপর্যয়ের সম্ভাবনার কথা জানতে পারেন এক্সনের নির্বাহীরা। কিন্তু ৮০র দশকের শেষে ব্যবসায়িক স্বার্থে এক্সন এই গবেষণা গুটিয়ে নিয়ে বরং গ্লোবাল ক্লাইমেট কোয়ালিশন বা জিসিসি গড়ে তোলে, যা ২০০১ পর্যন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যায়।
এরই মধ্যে ২০০০ সালে চালু হয় আমেরিকানস ফর ব্যালেন্সড এনার্জি চয়েসেস বা এবিইসি নাম আরেকটি "অলাভজনক" প্রতিষ্ঠান যাদের উদ্দেশ্য ছিল জ্বালানি এবং পরিবেশ বিষয়ক নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার। ২০০৮ সালে এধরনের আরেকটি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনার্জি এন্ড ইকনমিক ডেভেলপমেন্টের সাথে মিলে এবিইসি গঠন করে আমেরিকান কোয়ালিশন ফর ক্লিন কল ইলেকট্রিসিটি (এসিসিই)। এবিইসি এবং সিইইডি, উভয়েই তাদের কয়লাপন্থী প্রচারনায় স্বপ্ন দেখায় নতুন পরিচ্ছন্ন কয়লার।
এই সবগুলি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে ছিল কয়লা শিল্প এবং এর সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান সবগুলি সংস্করণে পিবডি এনার্জির কাছ থেকে অর্থসাহায্য পায়, যা ছিল তখন বিশ্বের বৃহত্তম প্রাইভেট সেক্টর কয়লা কোম্পানি। সময়ের সাথে প্রচারণার বাজেট বেড়েই চলছিল। ২০০৬ সালে আমেরিকানস ফর ব্যালেন্সড এনার্জি চয়েসেস এর বাজেট ছিল সাত মিলিয়ন ডলার , যা ২০০৮ এ হয় ৩৫ মিলিয়ন। এসিসিই-তে রুপান্তরিত হবার পর সেই বাজেট বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ মিলিয়ন ডলারে। এই এসিসিই এখন পরিচিত "আমেরিকাস পাওয়ার" হিসেবে।
পরিচ্ছন্ন কয়লার প্রচারণার কৌশল
এত এত গবেষণা, গণ সচেতনতামূলক কার্যক্রম, বৈশ্বিক আলোচনা এবং আন্দোলনের পরেও কীভাবে "পরিচ্ছন্ন কয়লা" সফলভাবে টিকে গেল? এর মূল কৌশল হল পরিচ্ছন্ন বলতে কি বোঝায় তা আদৌ স্পষ্ট না কর। যেমন, এসিসিসি দাবি করত যে আধুনিক কয়লা বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট ৭০% বেশি পরিচ্ছন্ন। এরকম উপাত্ত শুনতে খুবই ভালো লাগে, আশাবাদ তৈরি হয় যে কয়লা শিল্পে প্রগতি হয়েছে। কিন্তু খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় ঠিক কি ধরনের দূষক কমে পরিচ্ছন্ন হয়েছে তা বলা হয়নি। প্রযুক্তির মাধ্যমে কয়লা দহন থেকে নিঃসৃত সালফার ডাইঅক্সাইড এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড সমূহের নিঃসরণ কমে এসেছে ঠিকই, কিন্তু কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ তখনও পর্যন্ত অপরিবর্তিত।
পরিচ্ছন্ন কয়লা ক্যাম্পেইনের পেছনে মূল ধারণা দুইটি। প্রথমত, কয়লা সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য, অতএব এর ব্যবহার বন্ধ করার কোনো মানে হয় না। বায়ু কিংবা সৌরশক্তি আমাদের শক্তি চাহদা মেটাতে সক্ষম নয়। দ্বিতীয়ত, দূষণের নিরসন ঘটবে ভবিষ্যতের প্রযুক্তির মাধ্যমে। এসিসিই দাবি করে, কয়লার দহনে উৎপন্ন কার্বন সরিয়ে নিয়ে মাটির নিচে আটকে রাখার প্রযুক্তি একে পরিচ্ছন্ন করে তুলবে। কিন্তু এই প্রযুক্তি তখন তো নয়ই, এখনও পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক কিংবা অর্থনৈতিক কোনদিক থেকেই এখনো নাগালের মধ্যে আসেনি।
মজার ব্যপার হল কয়লাবাদীরা কখনই এমন দাবি করে না যে তারা দূষণের সমাধান করে ফেলেছে, তারা "বিশ্বাসের" কথা বলে। সমস্যার সমাধান হয় নি, কিন্তু একদিন হবে। আশ্চর্য বিষয় হল ২০০৮ সালে বারাক ওবামা এবং হিলারি ক্লিন্টন, দুইজনকেই কয়লাবাদীদের ভাষা ব্যবহার করে কার্বন স্টোরেজ গবেষনার পক্ষে কথা বলতে শোনা গিয়েছিল। তারা কেউই নতুন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করার পক্ষে কিছু বলেননি, যদিও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তারা আইন প্রনয়ন করবেন বলে প্রস্তাব দেন।
এই বছর এপ্রিলে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০০৫ সালের কার্বন নিসরনের তুলনায় ২০৩০ এ ৫০-৫২% কমিয়ে আনবার সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। এসিসিই-র বর্তমান রূপ, আমেরিকাস পাওয়ার এর প্রধান নির্বাহী মিশেল ব্লাড ওয়ার্থ বলেছেন, চীন যখন আগামী দশ বছর কার্বন নিঃসরণ বাড়িয়ে যাবার পরিকল্পনা করছে, তখন আমেরিকার পরিবেশ কিংবা অর্থনীতি, কোন দিক থেকেই তা কমাবার কথা বলার কোন মানে হয় না।
"নৈতিক তেল" আর উষ্ণায়নের "গুজব"
আমেরিকার "পরিচ্ছন্ন কয়লা"র মতই কানাডায় দেখা গেছে নৈতিক খনিজ তেল বা এথিকাল অয়েলের পক্ষে প্রচারণা। প্রচারণার বক্তব্য শুনলে মনে হবে ফেয়ার ট্রেড কফি কিংবা সংঘর্ষ-মুক্ত হীরার মত "নৈতিক তেল" এমন একটা পণ্য, যা দামে বা গুনে একই রকম, কিন্তু নৈতিক দিক থেকে উন্নততর। এই প্রচারনায় আরো ইঙ্গিত দেওয়া হয় আমেরিকান স্বার্থ কানাডায় পরিবেশবাদীদের অর্থায়ন করছে।
পরিচ্ছন্ন কয়লার মতই আসলে নৈতিক তেল বলতে কিছুই নেই। আর এন্ড আর গ্রুপ যে 'পরিচ্ছন্ন কয়লা" ব্র্যান্ড তৈরি করে দিয়েছিল, পরবর্তীতে আমেরিকান কোয়ালিশন ফর ক্লিন কোল ইলেকট্রিসিটির হয়ে হওথর্ন গ্রুপ নাম একটি জনসংযোগ সংস্থা তার প্রচারণা চালিয়ে যায় । অন্যদিকে "নৈতিক তেল" কথাটা আসে এজরা লেভান্ট এর লেখা এই নামের একটা বই থেকে, যা কানাডার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার এর এক উপদেষ্টা তেল ও গ্যাস কোম্পানির অর্থায়নে একটি স্ট্রাটেজিক ক্যাম্পেইন হিসেবে গড়ে তোলেন।
এই ধরনের অনেক ক্যাম্পেইনের পেছনে পাওয়া যাবে রিচার্ড বারম্যানের মত ঘাঘু পি আর কনসালটেন্টকে। বারম্যান সফলভাবে আমেরিকায় পরিবেশ আন্দোলনকে রাশিয়ান ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করেন। মানুষকে বিভ্রান্ত করতে তৈরি করেন এনভায়রনমেন্টাল পলিসি এলায়েন্স বা ইপিএ, যার অদ্যাক্ষর পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সিরর সাথে মিলে যায়। বারম্যান শুধু পরিবেশ নয়, পশু অধিকার রক্ষায় হিউমেইন সোসাইটি, সড়ক নিরাপত্তায় মাদার্স এগেইনস্ট ড্রাংক ড্রাইভিং, পরিবেশবান্ধব গ্রিন বিল্ডিং কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রচারনা চালিয়ে "ডক্টর ইভল" নাম পরিচিত হয়ে ওঠেন।
শুধু আমেরিকায় নয়, বিশ্ব জুড়ে এই ধরনের বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিমুখ প্রচারণা আমরা দেখেছি, যেমন ২০০৯ সালে ক্লাইমেট গেট কেলেঙ্কারী। কোপেনহেগেন ক্লাইমেট আলোচনার আগে কোন এক অজ্ঞাত পরিচয় হ্যাকার ক্লাইমেট বিজ্ঞানীদের ইমেইল চুরি করে দাবি করা যে সেখানে দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞানীরা নাকি বানোয়াট তথ্য তৈরি করছিলেন এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন একটি গুজব মাত্র। এই হ্যাকিং ঘটবার আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে জলবায়ু বিজ্ঞানীদের অপদস্থ করে কোপেনহেগেন জলবায়ু আলোচনা বিরোধী আন্তর্জাতিক প্রচারণা শুরু করে। এর পর অনেকগুলি তদন্তে দেখা গেছে জলবায়ু বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ মিথ্যা ছিল। বানোয়াট হওয়া সত্ত্বেও ক্লাইমেট গেট ছিল ২০০৯ সালের একটি আলোচিত ঘটনা।
এই যুদ্ধে আছে রুপার্ট মারডকের মিডিয়া সাম্রাজ্য। মারডকের মিডিয়া অস্ট্রেলিয়ার বুশ ফায়ারের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের সংযোগ নিয়ে মানুষের মনোযোগ সরিয়ে নিতে প্রচার করে যে উগ্র পরিবেশবাদীরা নাকি ইচ্ছাকৃত ভাবে আগুন লাগিয়েছে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেসন স্ট্যানলির মতে, "নৈতিক তেল" কিংবা "পরিচ্ছন্ন কয়লা" নিয়ে আলাপ উঠলে যা হয়, তা হল এই বিষয়ে প্রকৃত আলোচনা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করে যে কোন যৌক্তিক দাবি করা হয় তা নয়, বিশ্লেষনী চিন্তাকে ব্যাহত করাই এই ধরনের প্রচারণার ভাষাতাত্ত্বিক কৌশল। অপতথ্য এবং কুতথ্য দিয়ে মানুষকে সন্দিগ্ধ করে তুললেই এই কৌশল সফল হয়।
আমাদের পরিচ্ছন্ন কয়লার গল্প
গত এক শতাব্দিতে চিকিৎসা কিংবা কম্পিউটার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য উৎকর্ষ ঘটলেও, কয়লা থেকে শক্তি তৈরির মূল প্রক্রিয়া খুব একটা পাল্টায়নি। আমাদের দেশে যে নির্মীয়মাণ আলট্রা সুপার-কিট্রিক্যাল প্রযুক্তির কথা বলা হয়েছে, সেটা কতটা পরিচ্ছন্ন?
আলট্রা-ক্রিটিকাল প্রযুক্তি বাষ্পের তাপমাত্রা এবং চাপে কাজ করে, যে কারণে এটি কয়লাকে আরও কার্যকরভাবে দহন করতে পারে। উচ্চতর তাপমাত্রা ব্যবহারের অর্থ হল এতে কম কয়লা ব্যবহার করে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এদিক থেকে অবশ্যই এর ব্যবহার পুরনো কয়লা প্রযুক্তির তুলনায় কম দূষণ করবে, কিন্তু নতুন নতুন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হলে মোটের ওপর কার্বন নিঃসরণ বেড়েই চলবে। আর এই প্রযুক্তি অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
সবচাইতে উন্নত আল্ট্রা সুপার-ক্রিটিকাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র কয়লার শক্তিকে ৪৮% বিদ্যুতে রুপান্তরিত করতে পারে, বাকিটা তাপ হিসেবে বেরিয়ে যায়। এর আগের পর্যায়ের সাব-ক্রিটিকাল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এই হার ৩৫%-এর মত। অতএব শুধুমাত্র ১০% এর বেশি কার্যকারিতাকেই কয়লার ক্ষেত্রে প্রগতি বিবেচনা করা হচ্ছে। এর আনুষঙ্গিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে মূল ভূমিকা পালন করে পরিবেশ রক্ষাকারী আইন। পরিবেশ রক্ষায় নির্ধারিত নীতি এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের অনুপস্থিতিতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রযুক্তির কাছ থেকে পরিচ্ছন্নতা আশা করা অর্থহীন।
আমেরিকার মতো নাটকীয় প্রচারণা এবং জনসংযোগ না দেখলেও "পরিচ্ছন্ন কয়লা"র গল্প আমরাও শুনছি। কয়লাকে নিরাপদ হিসেবে উপস্থাপন করতে ইয়কোহামা শহরের কথা উঠেছে। প্রশ্ন এসেছে, সেখানে শহরের মাঝখানে একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকায় সেখানকার মানুষ কি মারা যাচ্ছে?
জাপান বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর একটি। তারা নিশ্চয়ই তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। কিন্তু আমরা জানি কয়লার প্রসঙ্গে বিশ্বের ধনাঢ্য অর্থনীতিগুলির মধ্যে জাপান ব্যাতিক্রম। শিল্প বিপ্লবের জন্মস্থান ব্রিটেন ২০২৫ এর মধ্যে কয়লা শক্তির ব্যবহার বন্ধ করে দেবে, ফ্রান্স বলেছে তারা তা করবে ২০২২ এর মধ্যে। আমেরিকাতেও কয়লার ব্যবহার কমেছে এবং নতুন কোন পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি হচ্ছে না।
২০১১ সালের পূর্ব জাপানের ভূমিকম্প ও সুনামির কারণে ফুকুশিমা দাইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। এই দুর্যোগের পর পারমাণবিক শক্তি সংকট মোকাবেলা করতে অন্যান্য পদক্ষেপের সাথে জাপান ২২টি নতুন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিকল্পনা নেয়। এ ছাড়াও জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পগুলিকে সমর্থন করছে। ফলে জাপান দেশে এবং বিদেশে কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় জি -৭ অর্থায়নকারী।
জাপানের পরিবেশ নীতিতে পর্যাপ্ত গ্রিনহাউজ হ্রাস লক্ষ্যমাত্রার অভাব আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত। ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তির আওতায় জাপান ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকে ২০১৩ এর মাত্রা থেকে দুই শতাংশ কমিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু জাপানের উচ্চ-দূষণকারী কয়লা বিদ্যুতের দিকে ফিরে যাওয়া একটি বিপরীতমুখী সিদ্ধান্ত।
গত অলিম্পিকে জাপান গর্বের সাথে প্রচার করেছিল যে অলিম্পিকের সব বিদ্যুৎ আসবে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। সেই একই অলিম্পিকে অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে ম্যারাথন ইভেন্ট টোকিও শহর থেকে ৭০০ মাইল উত্তরে সরিয়ে নেয় আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি। এই জাপানেই ২০১৮ সালে এক হাজারের বেশি মানুষ হিট ওয়েভে মারা গিয়েছিল, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নেরই একটি দুর্ভাগ্যজনক ফলাফল।