এসো আমাদের ভালুক দাদু
ল্যাপ কিংবদন্তিতে বলগা হরিণকে বর্ণনা করা হয়েছে সফেদ চামড়ার পবিত্র প্রাণী হিসেবে। এই অঞ্চলের কিংবদন্তি অনুসারে, এ প্রাণী দৌড়ায় না, অদৃশ্য পাখার সাহায্যে উড়ে চলে। তার নিশ্বাস পরিণত হয় উদ্দাম বাতাসে।
এ অঞ্চলের মানুষের কাছে সোনালি শিংওয়ালা এই প্রাণীটি তাদের রক্ষক ও পথপ্রদর্শক।
এই কদিন আগেও উত্তর ইউরেশিয়ার বহু মানুষের বিশ্বাস ছিল যে তাদের সৌভাগ্য নির্ভর করে প্রাণীদের রক্ষাকারী আত্মার ওপর। ইয়াকুতরা বিশ্বাস করত কুকুরের মাথা, গরুর খুর ও লম্বা কানঅলা একটা কাল্পনিক বুনো প্রাণীর মধ্যে এই আত্মার বসবাস। অনেকের আবার বিশ্বাস ছিল শিকারের সাফল্য নির্ভর করে প্রাণীদের প্রজননের হর্তাকর্তা ভালুকের মেজাজ-মর্জির ওপর। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করত যে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করে দুটো হরিণী। এ দুই হরিণী থেকেই বুনো গৃহপালিত, উভয় ধরনের বলগা হরিণের সৃষ্টি হয়েছে।
আরও একটি আত্মায় বিশ্বাস করত মানুষ—ম্যামথ। তাদের বিশ্বাস ছিল, মাটির তলায় এই বিশালদেহী প্রাচীন হাতির চলাচলের কারণেই পৃথিবীতে পাহাড়-পর্বতের সৃষ্টি হয়েছে।
কখনও কখনও এই আত্মাগুলোকে মহাজাগতিক প্রাণী বলে মনে করা হতো। এখনও স্লাভ জাতির কিছু মানুষ এই কিংবদন্তিতে বিশ্বাস করে। যেমন, পোলরা এখনও 'পোলার স্টার'কে 'এলক স্টার' বলেই ডাকে। সাতটি তারা নিয়ে গঠিত সপ্তর্ষিমণ্ডল বা 'গ্রেট বিয়ার' এই সেদিনও 'এলক' নামে পরিচিত ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলে।
এসব কিংবদন্তি আমাদেরকে সেই সুদূর অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যখন প্রকৃতি দাপিয়ে বেড়াত অতিপ্রাকৃত সব প্রাণী। তাদের ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করত মানুষের ভাগ্য। এসব আত্মাদের তুষ্ট করে চলতে হতো শিকারিদের। মেনে চলতে হতো কিছু সুনির্দিষ্ট বিধিনিষেধ। তাদের শিকারের প্রস্তুতিপর্ব ছিল রহস্যের চাদরে মোড়ানো। এ সম্পর্কে মুখ খোলার অনুমতি ছিল না তাদের—যে প্রাণী শিকার করতে যাচ্ছে, তার নাম মুখে নেওয়াও ছিল নিষেধ।
শিকারের সাথে সশ্রদ্ধ আচরণ করতে হতো শিকারিদের। সাইবেরিয়া ও উত্তর আমেরিকার অনেকেই ভালুককে 'বুড়ো', 'দাদু', 'প্রভু' বা 'পবিত্র প্রাণী' বলে ডাকত। কোনো ভালুককে গুলি করার আগে প্রাণীটির সাথে বন্ধুর মতো কথা বলত তারা, যাতে ওটার তরফ থেকে কোনো বাধা না আসে। অস্তিয়াকরা কোনো ভালুককে গুহা থেকে বাইরে বের করে আনার পর বলত, 'রাগ কোরো না, দাদু! আমাদের বাড়িতে এসে অতিথি হও।' ভালুকটাকে মারার পর তারা ওটার আত্মার কাছে প্রার্থনা করত, ওটা যেন শিকারির ওপর খেপে গিয়ে প্রতিশোধ না নেয়। এমনকি প্রাণীটিকে হত্যার দায় অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করত তারা।
বলগা হরিণ কীভাবে ক্ষুধার্ত মানুষদের ওপর করুণা করে তাদের জীবন বাঁচিয়েছিল, এ নিয়ে ল্যাপ অঞ্চলে একটা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। এ কিংবদন্তি অনুসারে, ক্ষুধার্ত মানবজাতির কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বলগা হরিণ তাদেরকে পরামর্শ দেয়, তারা যেন তাকে শিকার করে উদরপূর্তি করে। সেই থেকে মানুষ বলগা হরিণ শিকার করে আসছে। তবে পবিত্র হরিণটি দলের মাদি ও নেতা হরিণকে শিকার করতে মানা করে দিয়েছিল। এ আদেশ অমান্য করলে বুনো হরিণ শিকার বন্ধ হয়ে যাবে। নিয়ন্ত্রিত শিকারের মাধ্যমে এসব প্রাণীদেরকে নির্বিচার বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখে ল্যাপ অঞ্চলের লোকেরা। সেইসাথে নিজেদের ভবিষ্যৎ খাদ্যের আধারও সুরক্ষিত রাখে।প্রাচীন শিকারিরা বন্য প্রাণীর প্রাচুর্য নিশ্চিত করার কয়েকটি জাদুকরি পদ্ধতির ওপর বিশ্বাস রাখত। উত্তর ইউরেশিয়া ও উত্তর আমেরিকার অনেক গোত্রের বিশ্বাস ছিল যে শিকার করা প্রাণীদের হাড় বা মাথার খুলি ভাঙা নিষেধ।
এসব হাড়গোড় তারা তাইগা বনাঞ্চলের গহীনে নিয়ে রেখে আসত, অথবা গাছে ঝুলিয়ে রাখত। তাদের বিশ্বাস ছিল, হাড়গোড় আর খুলি এভাবে রেখে দিলে প্রাণীগুলো আবার প্রাণ ফিরে পাবে। অনেক গোত্রই শিকার করে আনা ভালুকের মাংস খাওয়ার পর, কিছু আচার পালন করে ওটার কঙ্কাল নিয়ে রেখে আসত তাইগাতে।
তবে এত সব সতর্কতাও নেওয়ার পরও সন্তুষ্ট থাকতে পারত না প্রাচীন শিকারিরা। শিকারের পর শামানদেরও ডাকত তারা। পবিত্র আত্মা ও মানুষেরর সাথে মধ্যস্থতা স্থাপনকারীর ভূমিকায় থাকত এই শামানরা। কখন কোথায় শিকারে বা মাছ ধরতে যেতে হবে, কীভাবে অসুস্থদের চিকিৎসা করতে হবে, এসব বাতলে দেওয়া ছিল তাদের দায়িত্ব। এমনকি আবহাওয়ার পূর্বাভাসও দিত তারা।
প্রত্যেক শামানই নিজের জোড় হিসেবে একটা প্রাণীকে বেছে নিত। এই প্রাণী তার প্রতিনিধিত্ব করত, তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করত, তার সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখত। অনেকেরই বিশ্বাস ছিল যে, শামান এই প্রাণীর বংশধর বা এই প্রাণীর দয়া-দাক্ষিণ্যে বেঁচে আছে। সেই প্রাণীটিকে নিজের প্রতীক বানিয়ে নিত সে। কামা নদীর উপত্যকা ও সোভিয়েত রাশিয়ার পার্ম অঞ্চলে পাওয়া প্রাণীর চামড়ায় তৈরি পোশাক ও পাখির পালক পরা শামানের চিত্রাঙ্কিত ব্রোঞ্জের ফলক পাওয়া গেছে। এসব ফলক ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে তৈরি।
মাঝে মাঝে হরিণের শিং দিয়ে বানানো 'মুকুট' পরত শামানরা, আর হরিণের খুরের মতো দেখতে জুতো পায়ে দিত। অস্তিয়াকদের মাঝে শামান-ভালুকরা নানা আচার অনুষ্ঠানে ভালুকের মুখোশ পরত। নেকড়ে উৎসবের দিন নেকড়ের মুখের চামড়ায় তৈরি মুখোশ পরত চুকচি-র শামানরা। বিশ্বাস করা হতো, একটা প্রাণীর প্রাণশক্তি থাকে তার নাসারন্ধ্রে, এবং সেই প্রাণীর নাসারন্ধ্রওয়ালা মুখোশ পরলে ওটার মতোই শক্তিশালী হয়ে ওঠে একজন শামান। শামান সেই মুখোশ পরে জন্তুর মতোই আচরণ করত, ভালুকের মতো গর্জাত, হরিণের মতো লাফাত।
এক শামানকে নিয়ে একটা ইয়াকুত কিংবদন্তি আছে। এ গল্প অনুসারে, শামানটি এলকের জাদুর চুল চুরি করে নিয়ে আসে। দৈব ক্ষমতাসম্পন্ন এই চুল বন্য প্রাণীদের রক্ষা করত। চুলগুলোকে শামান আদিবাসীদের শিকারের অঞ্চলে ছড়িয়ে দিলে ওগুলো শিকারে পরিণত হয়। উত্তর সাইবেরিয়ার অ্যাংগাসান গোত্রের লোকেরা বিশ্বাস করত পৃথিবী এক মাদি এলক, এবং মানুষ সৃষ্টি হয়েছে তার গায়ের পশম থেকে।
তুর্কিভাষী যাযাবররা পশুর চুলে যে অলৌকিক শক্তি আছে বলে বিশ্বাস করে, সেসব বিশ্বাস ঘোড়ার সাথে জড়িত। তাদের মহাকাব্যগুলোতে বাতিররা (ক্ষমতাধর জমিদার বা যোদ্ধা) প্রায়শই ঘোড়ার চুলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বিপদ থেকে বেরিয়ে আসে। আগুন লাগানো চুলগুলো ঘোড়ায় পরিণত হয়।
বসন্তে ঘোড়ার লোম ছাঁটার পর সাইবেরিয়ার বুরিয়াত জনগোষ্ঠীর লোকের সাদা ঘোড়ার চুল পোড়ানোর জন্য উৎসবের আয়োজন করত। সাইবেরিয়ার আরেক গোত্র, তুভিনিয়ানরা তাদের গবাদি পশু বেচে দেওয়ার সময় প্রাণীগুলোর কিছু চুল কেটে নিয়ে পুড়িয়ে দিত। এই কাজের মাধ্যমে তারা চেষ্টা করত তাদের সৌভাগ্য যেন ওই বিক্রি করে দেওয়া প্রাণীগুলোর সাথে চলে না যায়।
তুর্ক-মঙ্গোলীয় মহাকাব্যগুলোতে যুদ্ধ-ঘোড়া দারুণ জনপ্রিয় এক চরিত্র। এসব মহাকাব্যে যুদ্ধের ঘোড়াগুলো জাদু-ক্ষমতার অধিকারী থাকে। ডানাওয়ালা এই ঘোড়াগুলো উড়তেও পারে। পতনশীল তারার মতো উড়ত এরা। পাখিদের ছাড়িয়ে মেঘ পর্যন্ত স্পর্শ করে ফেলত। জাদু ছাড়া এদেরকে থামানো যেত না। নানা অভিযানে অংশ নিত এসব যুদ্ধ-ঘোড়া। মনিবের রক্ষক, পথপ্রদর্শক, পরামর্শদাতা, নিরাময়কারী এবং ত্রাণকর্তা ছিল এরা। কোনো কোনো ঘোটকী তো মনিবের নার্স হিসেবেও কাজ করত। এসব ক্ষেত্রে ঘোড়ার মালিককে তার ঘোড়ার পালক ভাই মনে করা হতো। কোনো বাতির তার ঘোড়া হারিয়ে ফেললে তার শক্তিও হারিয়ে যেত।
অনেকেরই বিশ্বাস ছিল যে, এসব ঘোড়ার জন্ম সমুদ্রের ফেনা থেকে। এদের মতোই ডানাওয়ালা হরিণও জন্মায় সমুদ্রের ফেনা থেকে—এরাও উড়তে পারে। প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ছিল, ডানাওয়ালা হরিণও অতিলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। আজও ইউরোপের কিছু অঞ্চলে হরিণের সোনালি শিং লোকশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কেল্টরা হরিণের শিংওয়ালা এক দেবতার উপাসনা করত। গ্রিকদের শিকারের দেবী আর্টেমিস সবসময় একদল হরিণী পরিবেষ্টিত হয়ে থাকেন। সাইবেরিয়ার আলতাই অঞ্চলের এক সিথিয়ান সমাধিভূমিতে শিংবিশিষ্ট ডানাওয়ালা এক প্রাণীর চিত্র পাওয়া গেছে।
ইউরেশিয়ার মানুষ ধীরে ধীরে হরিণ ছেড়ে ঘোড়ার উপাসনা আরম্ভ করে। দীর্ঘকাল ধরে এই অঞ্চলে ঘোড়াকে হরিণের অবতার বলে বিশ্বাস করা হতো। প্রাচীন বৈদিক দলিলে পাওয়া তথ্যানুসারে, হিট্টি ও কেল্টরা তাদের ঘোড়াকে হরিণের মতো সাজপোশাক পরিয়ে রাখত।
আর্যরা বলির ঘোড়ার মাথা সাজাত হরিণের সোনালি শিং দিয়ে। আলতাইয়ে পাজিরিকদের সমাধিস্থলে ঘোড়ার দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। এসব ঘোড়ার মাথায় হরিণের মুখোশ পরানো ছিল। সিথিয়ানরা তাদের ঘোড়ার মাথায় বিশেষ ধরনের পটি পরাত। ফলে প্রাণীগুলোকে দেখাত ডানাওয়ালা সোনালি শিংবিশিষ্ট হরিণের মতো।
তুর্ক-মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীও একসময় হরিণের বদলে ঘোড়ার উপাসনা আরম্ভ করে। এই প্রচলন কবে কোথায় শুরু হয়, তা আমাদের সঠিক জানা নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, রাশিয়ার ইউরোপীয় অংশের দক্ষিণাঞ্চলে কর্মরত রাশিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিকরা খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের সভ্যতাগুলোর একটা সম্পূর্ণ স্তর আবিষ্কার করেছেন। এই সভ্যতার লোকেরা বুনো ঘোড়া শিকার করে তাদের পোষ মানাতে শুরু করেছিল। প্রায় একই সময়ে, ঘোড়া উপাসনাকারী একটা গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাচীন বসতি ও সমাধিস্থলে পাওয়া ঘোড়ার মূর্তি এবং ঘোড়ার খুলি ও হাড়গোড় রাখার অস্থি-সংরক্ষণাগার থেকে। সেই যুগেই ইউরোপীয় স্তেপ অঞ্চলে পাথরের রাজদণ্ডগুলোকে ঘোড়ার মাথার আকারে বানানো শুরু হয়। কাজটা করা হতো, খুব সম্ভব, গোত্রপ্রধানের ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে।