একুশের হত্যাকাণ্ড: জাস্টিস এলিস রিপোর্ট

প্রথম শহীদ মিনার
একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণের তদন্তের দায়িত্ব পড়ে জাস্টিস টমাস হার্বার্ট এলিসের উপর। জাস্টিস টমাস হার্বার্ট এলিস (টি এইচ এলিস নামেই বেশি পরিচিত) ১১ অক্টোবর ১৮৯৪ ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারের ফার্সলে নামের ছোটো শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। ম্যানচেস্টার গ্রামার স্কুল ও অক্সফোর্ড বিশ্বাবদ্যালয়ের কুইনস কলেজে পড়াশোনা করে ১৯১৯ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৩৮ সালে তিনি যশোরের অতিরিক্ত দায়রা সেশনস জজ ছিলেন। তিনি সিভিল সার্ভিসের বিভিন্ন পদে চাকরি করে ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত সালে কোলকাতা হাইকোর্টের এডিশনাল জজ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত ঢাকা হাইকোর্টের জজ ছিলেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৪ তিনি ঢাকা হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস ছিলেন। ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ থেকে ২২ ডিসেম্বর ১৯৫৪ তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসের দায়িত্ব পালন করেন। অবিবাহিত টি এইচ এলিস ১২ ডিসেম্বর ১৯৮১ মানচেন্টার শহরে মারা যান।
তাকে গভর্নর পদ থেকে সরিয়ে দেবার কাহিনীটি কোতুহলোদ্দীপক। তিনি গভর্নর হবার পর ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকার একজন সাংবাদিক ঢাকায় এসে তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এটি যখন প্রকাশ হয় দেখা যায় সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ভূমিকায় লিখেছেন, বিশ্বাস করুন, পাকিস্তান স্বাধীন হবার বহুবছর পরও দেশটির অর্ধেকের বেশি অংশ শাসন করেন একজন ইংরেজ।

এই বক্তব্যটি সরকারকে বিব্রত করে এবং সরকার তাকে সরিয়ে দিয়ে পাকিস্তান ফেডারেল কোর্টের অবাঙ্গালি বিচারপতি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিনকে গভর্নর নিয়োগ করে।
একুশের ঘটনার তদন্ত যেভাবে শুরু:
১.
একুশের ঘটনার একুশ দিন পর ১৩ মার্চ ১৯৫২ সরকার নির্দেশ দিল ঢাকা হাইকোর্টের একজন বিচারক একুশের গুলিবর্ষণের তদন্ত করবেন। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি তদন্তকারী বিচারক নির্ধারণ করে দেবেন। তদন্তকারী কাজ দুটো:
ক. পুলিশের গুলিবর্ষণ জরুরি ছিল কি না তা নির্ধারণ
খ. পুলিশের বল প্রয়োগ যথার্থ কি না তা নির্ধারণ
প্রধান বিচারপতি তদন্তের জন্য জাস্টিস টি এইচ এলিসকে নিযুক্ত করেন। এলিস ২৭ মে ১৯৫২ প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে সরকার যা প্রত্যাশা করেছ তা-ই হয়েছে। গুলিবর্ষণ যথার্থ। প্রতিবেদনে প্রাপ্ত ফলাফলের সাথে সরকার সন্তুষ্ট হয়ে একমত পোষণ করে। প্রতিবেদন ও সরকারের ঐকমত্যের সিদ্ধান্ত অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঢাকা বিভাগের কমিশনার ও পূর্ববঙ্গের মহা পুলিশ পরিদর্শকের কাছে পাঠানো হয়। একইসঙ্গে তা ঢাকা গেজেটের এক্সট্রা-অর্ডিনারি সংখ্যায় প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়।
৩১ জানুয়ারি ১৯৫২ সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে সমগ্র পূর্ববঙ্গ জুড়ে আন্দোলন চালিয়ে যাবার লক্ষ্যে এই অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়। সংবাদ মাধ্যমে কমিটি জানায়, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ হবে এবং হরতাল পালিত হবে। এ সময় পূর্ববঙ্গ লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির অধিবেশন চলবে এবং একই দিনে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভা ডাকে। এ অবস্থায় ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এস এইচ কোরাইশি, সিএসপি) শান্তিভঙ্গ ও জন নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার আশঙ্কায় ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেল পাঁচটায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা জারি করেন। এতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্বানুমতি ছাড়া পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ড্রাম পিটিয়ে শহরের সর্বত্র ১৪৪ ধারায় ঘোষণা দেওয়া হয়। মাইক্রোফোনে প্রচারণা ভ্যানে চড়েও করা হয়। লিফলেটও ছাড়া হয়। জরুরি অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৭.৩০ এ কন্ট্রোল রুম চালু হয়। কন্ট্রোল রুমে খবর এল হরতাল চাপিয়ে দেওয়ার জন্য জোর করে দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া, গাড়ির গতিরোধ করা এবং বাস, ট্যাক্সি, রিকশা ও ঘোড়ার গাড়ি থেকে বল প্রয়োগ করে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত বিকাল ৩.২০ মিনিটে মেডিক্যাল কলেজ গেটে পুলিশ গুলি চালায়। এতে একজন ঘটনাস্থলে মারা যায় এবং তিনজন পরে জখমজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে। মৃত ব্যাক্তিদের একজন ছাত্র, নাম আবুল বরকত।
২.
তদন্তানুষ্ঠানের আদেশ পাবার পর হাইকোর্টের বিচারক টি এইচ এলিস একটি নোটিশ জারি করেন। ২১ ফেব্রুয়ারির পুলিশের গুলিবর্ষণ-সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক লিখিত (টাইপ করা হলে ভালো) প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য জনগণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য ছাত্র সংগঠন, প্রাদেশিক সরকারের সংস্থা বা অন্য যে কোনো পক্ষকে আহ্বান করা হয়। এতে সাক্ষীদের পূর্ণ নাম ঠিকানা প্রদান করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। প্রাদেশিক সংবাদপত্রসমূহে এবং রেডিও পাকিস্তানে নোটিশটি প্রচার করা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এ নোটিশ প্রচারণার পর তদন্তকারী বিচারক ২৮টি পত্র পান যার মধ্যে একটি ২২ ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে। কিন্তু তা তদন্তের শর্তাবলির মধ্যে না থাকায় বিবেচনায় আনা হয়নি। ১১টি পত্রে বলা হয় পুলিশের গুলিবর্ষণ প্রয়োজন ছিল না। একটি পত্র আসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়কের কাছ থেকে এবং একটি পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের সাধারণ সম্পাদকের কাছ থেকে। তদন্ত কমিটির কার্যপরিধির বিরোধিতা করে তারা তদন্তে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত জানায়। অস্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে বলা হয় গুলিবর্ষণ সম্পর্কে যারা ভালো জানেন সেই ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক দলের নেতারা জেলে। দেরিতে পাওয়া একটি চিঠিতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ জানিয়েছে বর্ধমান হাউস থেকে আসা একটি কার থেকে পুলিশের কাছে গুলি করার লিখিত আদেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশের গুলিবর্ষণ প্রত্যক্ষ করেছে এমন দাবিদার একজনই জগন্নাথ কলেজের ছাত্র দেওয়ান হারুন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। তিনি প্রথমে পাঁচজন সাক্ষী ও পরে আরও সতের জন সাক্ষীর নাম দেন। ভাষা আন্দোলনের নামে ছাত্রদের অরাজকতার কারণে ২১ ফেব্রুয়ারি বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এমন ১৬ জন কমিটির কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন। এদের কেউ বাসকন্ডাক্টর, ড্রাইভার, রিকশাওয়ালা। তারা ভেবেছেন কমিটি ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে ক্ষতিপূরণ দেবে। গুলিবর্ষণের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে পূর্ব পাকিস্তান সরকার ২১ জনের তালিকা পেশ করে।

৩.
সাক্ষীদের ৫টি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। প্রথম শ্রেণীতে ২২ জন। এদের মধ্যে ২১ জন কর্মকর্তা ও ১ জন ফটোগ্রাফার। ২য় শ্রেণীতে ৩ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, তৃতীয় শ্রেণীতে ১০ জন ছাত্র, এর মধ্যে ৭ জন মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে থাকেন এবং ৩ জন বাইরে। চতুর্থ শ্রেণীতে ১৪ জন সাক্ষী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত বা হাসপাতালের সাথে সম্পর্কিত। পঞ্চম শ্রেণীতে ১৪ জন বিভিন্ন পেশার। কমিটি ১৪ জনকে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে চিহ্নিত করেন। তারা হচ্ছেন:
ক. জনাব মো. ইদ্রিস, এসপি, ঢাকা
খ. জনাব এ জেড ওবায়েদুল্লাহ, ডিআইজি, ঢাকা
গ. জনাব মো. সিদ্দিক দেওয়ান, ডিএসপি, ঢাকা
ঘ. জনাব মোহাম্মদ ইউসুফ, বিশেষ পুলিশ সুপার, আই, বি
ঙ. জনাব আব্দুল গোফরান ঘটনাকালীন ওসি, লালবাগ
চ. জনাব মীর আশরাফুল হক, পুলিশ পুলিশ ইন্সপেক্টর এবং দুজন ম্যাজিস্ট্রেট
ছ. জনাব এস এইচ কোরাইশি, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা
জ. জনাব নুরুদ্দিন আহমদ, এসডিও, সদর দক্ষিণ, ঢাকা
ঝ. দুজন সাক্ষী সরকারি চাকরিজীবী নন, তারা হচ্ছেন জনাব মোহাম্মদ কামাল এবং দেওয়ান হারুন মো. মনিরউদ্দিন।
৪.
২১ ফেব্রুয়ারির ঘোষিত হরতাল একটা ঝামেলার সৃষ্টি করবে পুলিশ প্রশাসন তা আগাম অনুধাবন করে। সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশ যার যার অবস্থান নিয়ে নেয়। সিটি ডিএসপি সিদ্দিক দেওয়ান বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। সিটি অ্যাডিশনাল এসপি মাসুদ মাহমুদ সকাল থেকে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং পুলিশ আউটপোস্টগুলো দেখছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দেখলেন ছাত্ররা বাস, ট্যাক্সি, রিকশা ও কার থেকে জোর করে যাত্রীদের নামিয়ে আনছে এবং এগুলোর চাকার বাতাস বের করে ফেলছে। তিনি গাড়ি চলাচল অব্যাহত রাখার পদক্ষেপ নিলে তাকে যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করা হয় এবং তিনি ছাত্রদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে ওঠেন। পৌনে আটটায় ঢাকায় এসপি মো. ইদ্রিস খবর পান বহুসংখ্যক ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসে জড়ো হয়ে যাত্রীদের যানবাহন থেকে নামতে বাধ্য করছে। তিনি সোয়া আটটায় ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছলেন এবং যাত্রীদের ওপর ছাত্রদের বলপ্রয়োগ করার দৃশ্য স্বচক্ষে অবলোকন করলেন। তিনি ছাত্রদের বিরত করতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। যেসব জায়গায় আরও গন্ডগোলের আশংকা করলেন সেসব জায়গায় পুলিশ বসালেন। সকাল ৯টায় তার নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একজন ডি.এস.পি. দুজন ইন্সপেক্টর, দুজন সাব-ইন্সপেক্টর, একজন সার্জেন্ট, চারজন হেড কনস্টেবল এবং চৌত্রিশজন কনস্টেবল প্রস্তুত ছিল। মেডিক্যাল কলেজ গেট এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে একজন করে হেড কনস্টেবল ও দশজন কনস্টেবল মোতায়েন ছিল।
সকাল দশটা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাউন্ডে প্রচুর লোকের সমাগম হয় এবং একটি জনসভা করার প্রস্তুতি তখন চলছিল। এ সময় পরিস্থিতি খুবই উত্তেজক হয়ে উঠায় ঢাকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এস এইচ কোরাইশিকে তা জানানো হলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওনা হন। ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিনি দেখতে পান কম্পাউন্ডের গেটে বহু লোকের জমায়েত, তারা পুলিশকে গালাগাল দিচ্ছে এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে বললেন বিষয়টি 'ভাইস-চ্যান্সেলরকে জানাতে। তার পরামর্শ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন ছাত্রদের বুঝিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙা থেকে বিরত রাখে। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আসার কিছুক্ষণের মধ্যে ভাইস-চ্যান্সেলর ড. এস.এম. হোসেন ইংরেজি বিভাগের প্রধান এবং কলা অনুষদের ডিন ড. আই এইচ জুবেরী এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্ট ড. এম ও গণিকে সাথে নিয়ে এলেন। প্রায় এক হাজারের মতো ছাত্র ছিল। তিনি যখন তাদের সামনে গেলেন ছাত্ররা তাকে বলল, ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য তাদের মিছিলের নেতৃত্ব দিতে হবে ভাইস-চ্যান্সেলরকে। তিনি ছাত্রদের বরং একটি সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে যেতে বললেন। ছাত্ররা মিছিলে তার নেতৃত্ব ও সভায় সভাপতিত্ব এবং সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করার প্রতিশ্রুতি দাবি করে বসলে, তিনি রাজি হলেন না। তবে ছাত্ররা যদি আইন অমান্য না করে তাহলে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিলেন। কয়েকজন ছাত্র নেতাও ছাত্রদের নিরস্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। স্পষ্ট হয়ে উঠছে আইন অমান্য করে তারা ১৪৪ ধারা ভাঙবেই।

৫.
বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাউন্ডে অনুষ্ঠিত সভা ভাঙল ১১ টায়। ড. জুবেরীর ভাষ্যমতে ছাত্ররা ভয়ংকর উত্তেজিত হয়ে উঠল। মিছিল করে তারা বিশ্ববিদ্যালয় গেটে গেল এবং গ্রেফতার হবার জন্য ৫ থেকে ১০ জনের ছোট ছোট দলে রাস্তায় নামল। পুলিশের মতে ২৫ থেকে ৩০ জনের দল। আসলে সভাটা ছিল একটা লোক দেখানো ব্যাপার। আইন অমান্য করার সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি আগে থেকেই নেওয়া। কোন কোন ছাত্রের নেতৃত্বে দলগুলো বেরোবে আগেই তার তালিকাও করা ছিল। এরা ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য বেরিয়ে এলে পুলিশ গ্রেফতার করল, তবে ছাত্রীদের উপেক্ষা করা হলো। কোনো কোনো ছাত্র থানায় যাবার জন্য নিজে থেকেই লাফিয়ে পুলিশের গাড়িতে উঠে পড়ল। ততক্ষণে মোট ৯১ জনকে গ্রেফতার করা হলো। পুলিশের হাতে যে কটা গাড়ি ছিল তাতে এর বেশি সংখ্যক লোককে জায়গা দেওয়ার সুযোগ ছিল না। পুলিশের জন্য ব্যাপারটা ছিল খুব বিব্রতকর। পুলিশের এ নাজুক পরিস্থিতি বুঝতে পেরে জনতা আরও যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠল এবং ইটপাথর ছুড়তে শুরু করল। গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের সাথে কিছুসংখ্যক কনস্টেবল পাঠিয়ে দিতে হলো।
ছাত্ররা অ্যাসেম্বলি ভবনের দিকে যাবার পর ঢাকার অ্যাডিশনাল এসপি সিটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো সেখানে, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে আনা হলো গ্যাস স্কোয়াড। পুলিশ সজ্জায় কিছু পরিবর্তন আনা হলো, একজন ডি.এস.পিকে পাঠানো হলো মেডিক্যাল কলেজ গেটে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ৯১ জন অপরাধীকে গ্রেফতার করার পর পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটল।
'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', 'পুলিশের জুলুম চলবে না' এসব স্লোগান দিতে দিতে জনতা অ্যাসেম্বলি ভবনের দিকে রওনা হলো। এস পি ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনতাকে জানালেন, তারা আইন ভঙ্গ করেছে এবং এমনই তারা সবাই সরে না পড়লে তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য আইন প্রয়োগ করা হবে। কথায় কাজ হলো না। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ গ্যাস শেল ও গ্যাস গ্রেনেড নিক্ষেপ করল। এতে জনতা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লেও মেডিক্যাল কলেজ এলাকাতে আবার সংঘবদ্ধ হলো। বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ যে সীমানা দেয়ালে বিচ্ছিন্ন তা তখন ভেঙে ফেলায় রাস্তায় না এসেই সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজে ঢোকা যেত। ছাত্ররা তাই করল। গ্যাস নিক্ষেপে জনতা সাময়িকভাবে ছত্রভঙ্গ হলো। কিন্তু ততক্ষণে অ্যাডিশনাল এসপি মাসুদ মাহমুদ জখমপ্রাপ্ত। ছাত্ররা একটা জিপ পুড়িয়ে ফেলেছে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে এবং মেডিক্যাল কলেজ এলাকায় পুলিশের ওপর থেকে থেকে ইট-পাথর নিক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে।

পরিস্থিতি গুরুতর হওয়ায় ঢাকা রেঞ্জের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এ জেড ওবায়দুল্লাহকে জানানো হলে তিনি একটা নাগাদ এসে পৌঁছলেন। সেখানে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও এসপির সাথে তার দেখা হলো। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, ডি.আই.জি ও এসপির সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করে জনতা পুলিশের ওপর আক্রমণ বাড়াতে থাকে। গ্যাস নিক্ষেপের ফলে সাময়িকভাবে তারা পিছু হটে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। আবার শক্তি সঞ্চয় করে ফিরে এসে আক্রমণ শুরু করে। সমস্যাটা মেডিক্যাল কলেজের গেটের দিকে বেশি কেন্দ্রীভূত হওয়ায় সেখানে পুলিশ ফোর্স সংঘবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। বেলা দুটা থেকে আড়াইটার মধ্যে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করল। ছাত্র-জনতা সচিবালয় সড়কের পশ্চিম পার্শ্বে দোকানের পেছনে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো।
লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য মৌলবি আওলাদ হোসেন অ্যাসেম্বলিতে যাচ্ছিলেন। মাঝখানে তার গতিরোধ করে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল কম্পাউন্ডে নেওয়া হলো। সেখানে তাকে একটি বিবৃতি সই করতে বাধ্য করা হলো যাতে বলা হয়েছে, বাংলা হবে রাষ্ট্রভাষাসমূহের একটি এবং তিনি পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে দেখেছেন এবং কিছুসংখ্যক ছেলেকে আহত অবস্থায় পেয়েছেন। যদিও বিবৃতি অনুযায়ী কিছু ঘটতে তিনি দেখেননি। এ সময়ে ডি.এস.পি সিটি সিদ্দিক দেওয়ান জনতার হাতে প্রহৃত হন। পুলিশ বার বার টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করেছে, কিন্তু এতে কোনো ভালো ফল হয়নি, শিগগিরই আবার জনতা সংঘটিত হয়ে তাদের কাজ শুরু করেছে। একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য অনুযায়ী এটা ছিল পুলিশের সাথে এক ধরনের ইঁদুর-বিড়াল খেলা। নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড শেল-এ পানি ঢেলে তা অকেজো করে দিয়েছে আবার পুলিশ ও পথচারীর ওপর ঢিলবর্ষণ শুরু করেছে।
এ সময় মন্ত্রী হাসান আলী অ্যাসেম্বলির দিকে যাচ্ছিলেন, তার সাথে গাড়িতে ছিলেন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি এবং এমএলএ ও এমসিএ মওলানা আবদুল্লাহ আল-বাকী। জনতা তাদের গাড়ি থামিয়ে চাকা থেকে বাতাস বের করে দিয়ে অকেজো করে দিল। একজন ডান ও একজন বাম দরজা দিয়ে গাড়িতে ঢুকল এবং মন্ত্রীকে তার সঙ্গীসহ মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালে যাবার জন্য চাপ দেওয়া হলো। কথামতো মওলানা আবদুল্লাহ আল বাকী গাড়ি থেকে নেমে সেখানে যাবার জন্য তৈরি হলেন। কিন্তু মন্ত্রী ও তার আর্দালি তাকে পেছনে টানলেন। এই ঢিল ছোড়াছুড়ির মধ্যে যাওয়া নিরাপদ হবে না বলে মন্ত্রী মনে করলেন। পুলিশ মন্ত্রী ও তার সঙ্গীকে তাদের জিপে তুলে অ্যাসেম্বলির দিকে নিয়ে গেল। এ সময় গাড়িতে থাকাকালেই ঢিল লেগে মন্ত্রী আহত হলেন। এসময় বহু সংখ্যক পুলিশ আহত হয়। ডি.আই.জি, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি, অ্যাডিশনাল এসপি সকলে নিক্ষিপ্ত ঢিলে আহত হন। পুলিশের সদস্যরা জখমপ্রাপ্ত অবস্থায়ও তাদের দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকে।
৬.
বিকেল ৩টার দিকে পুলিশ দেখল পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ৩টার সময় পুলিশ আরেক দফা লাঠিচার্জ করল। এতে কোনো কাজ হলো না। পিছু হটে যাবার বদলে এবার জনতার ঢিল বর্ষণে পুলিশই বরং পিছু হটতে থাকল। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তাদের অনুমান-- সে সময় ঘটনাস্থলে জনতার সংখ্যা ৫০০-এরও বেশি। জনতা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ ও মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল দুদিক থেকে পুলিশের দিকে ধেয়ে আসছে। এরকম একটি ভয়াবহ অবস্থায় পুলিশ বিপজ্জনকভাবে ঘেরাও হয়ে আছে এবং পরাস্ত হতে যাচ্ছে দেখে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ডিআইজি এবং এসপি সম্মত হলেন পরিস্থিতি এত গুরুতর যে এখন গুলি করা আবশ্যক। শেষ ভরসা মনে করে জনতাকে চূড়ান্তবারের মতো সতর্ক করে দেওয়া হলো। এতে কাজ হলো না। শেষ পর্যন্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশনায় এসপি'র প্রত্যক্ষ আদেশে পুলিশ দাঙ্গাকারী জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করল। ফায়ারিং পার্টিতে ছিল তিনজন হেড কনস্টেবল ও ৬০ জন কনস্টেবল। তারা মেডিক্যাল কলেজ গেট ও হোস্টেল গেটের মাঝখানে বর্গাকার অবস্থায় পজিশন নিল। প্রতি ভাগে পাঁচজন করে হাঁটুতে ভর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ ও মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের দিকে তাক করা। কোথায় কতোজন পুলিশ নিয়োজিত করা হয়েছে এই পরিকল্পনা বিষয়ে ডিআইজি এবং এসপির বক্তব্যে কিছুটা গরমিল লক্ষ করা
গেলেও এসপির বর্ণনাকেই কমিটি অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছে। পুলিশের অন্য সদস্যদের নিয়ে এসপি তাদের বর্গের ভেতরে পজিশন নেন। এসপি দুদল পুলিশকে মাঠে এক রাউন্ড করে গুলি করার নির্দেশ দেন এবং আদেশমতো গুলি করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে অবস্থানরত জনতা কিছুটা পিছিয়ে যায়, মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের দিকের জনতা মুহূর্তের জন্য থামলেও আবার ঢিল ছুড়তে ছুড়তে এগোতে থাকে। এসপি তখন এই জনতার দিকে পজিশন নিয়ে থাকা দলকে গুলির নির্দেশ দেন। জনতা যখনই পিছু হটা শুরু করে এসপি গুলি বন্ধের আদেশ দেন। গুলিবর্ষণের পর পরীক্ষা করে দেখা যায় মোট ২৭ রাউন্ড গুলি বর্ষিত হয়েছে, এর মধ্যে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের দিকে ২২ রাউন্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের দিকে ৫ রাউন্ড। গুলিবর্ষণের সময় বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের পাশে একজন মৃত্যুবরণ করে, তাকে অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে সরানো হয়। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের দিকে দাঙ্গাকারীরা এত উত্তেজিত এবং মারমুখী ছিল যে সেদিকটায় গুলিতে ক্ষয়-ক্ষতি কী হয়েছে তা তাৎক্ষণিকভাবে নিরূপণ করা যায়নি। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল ৯ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সেদিন রাত আটটায় দুজন হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে, এদের একজন ছাত্র। তদন্ত চলাকালীন সময়ে একজন জখমির মৃত্যু হয়।
গুলির পরও ঢিল ছোড়া বন্ধ হয়নি। মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল কম্পাউন্ডে বসানো একটি মাইক্রোফোনে সরকার ও পুলিশের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা চলতে থাকে। জনতার উত্তেজনা তীব্রতর করার জন্য রক্তমাখা কাপড় প্রদর্শিত হতে থাকে। সাড়ে চারটা বা পাঁচটার দিকে অ্যাসেম্বলিতে একটি সমাবেশ ঠেকানোর জন্য পুলিশকে আরও এক রাউন্ড গুলি করতে হয়।

৭.
পুলিশ অফিসারদের সাক্ষ্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাক্ষ্য অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরকে সমর্থন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জুবেরী এবং ড. গণি যদিও বাইরে কী হয়েছে প্রত্যক্ষ করেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের ঘটনা দেখেছেন। তারা জানিয়েছেন, পুলিশ অফিসারগণ তাদের ওপর ঢিল ছোড়ার অভিযোগ তাদের কাছে করেছেন। এসব পুলিশ ঢিলে জখম হয়েছে এবং পুলিশের গাড়ি নষ্ট হয়েছে। ছাত্রদের ইট ছুড়তে, পুলিশ আহত হতে বা জিপ ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখেছেন কি না ৩৭ নম্বর সাক্ষী ড. জুবেরীকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, যখন গ্রেফতার করা হচ্ছিল তখন ঢিল ছোড়া হয়নি, কিন্তু টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপের পর পুলিশ ভাইস-চ্যান্সেলরের কাছে ঢিল ছোড়ার অভিযোগ করে।
আসলে ঢিল ছোড়া হয়েছে কি না তা নির্ধারণের জন্য ভাইস চ্যান্সেলর কী পদক্ষেপ নিয়েছেন জানতে চাওয়া হলে ড. জুরেরী বলেন যে, তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। তবে তিনি ছাত্রদের নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করেছেন। যদিও ভিসি ও ড. গণি ছাত্রদের ঢিল ছুড়তে দেখেননি বলে বলেছেন, তারা রাস্তায় অনেক ঢিল ফেলেছেন বলেও উল্লেখ করেছেন। একটি ঢিল ভিসির কাছে পড়ায় তিনি দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করেন। ডাক্তারদের সাক্ষ্যে ঢিল ছোড়ার ব্যাপারটি উল্লেখিত হয়েছে। তদন্তের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব ডাক্তার সাক্ষ্য প্রদান করেন তারা হচ্ছেন:
১. ডা. আফতাব উদ্দীন আহমদ, সিভিল সার্জন, ঢাকা
২. ডা. হাবিবুদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক, স্ত্রী ও ধাত্রীবিদ্যা
৩. ডা. আহমদ হোসাইন, ইলেক্ট্রো থেরাপিস্ট
৪. ডা. হাম্মাদুর রহমান, প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার
৫. ডা. শেখ আব্দুস শাকুর, প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার
৬. ডা. জিল্লুর আহমেদ চৌধুরী, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ
৭. ডা. আবুল মাসুদ খান মজলিস, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ।
৮. ডা. নওয়াব আলী, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ
৯. ডা. আব্দুস সামাদ খান চৌধুরী, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ
১০. ডা. আবু মুছা আব্দুল হক, প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার
ডাক্তার আবু মুছা আব্দুল হক সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন, রোগী দেখতে যাবার সময় মেডিক্যাল কলেজের কাছে তার গাড়ি থামানো হয়েছে। তিনি পুলিশের প্রতি ঢিল ছুড়তে দেখেছেন। এই সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ডাক্তার হচ্ছেন ভদ্রলোক, তার কথায় সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। তার বিবৃতি সত্য বলে গৃহীত হলে ২টার দিকে মেডিক্যাল কলেজ গেটের সামনে অবস্থা ছিল ভয়াবহ।
৮.
ড. গণি তদন্ত কমিটিকে জানান, গুলিবর্ষণের আগের সমস্ত ঘটনা অতিরঞ্জিত করে বলা হয়েছে এবং পুলিশ বিপদাপন্ন ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল তা প্রতিষ্ঠার জন্য জনতার সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে বলা হয়েছে। পুলিশের সাক্ষ্যে যেখানে এ সংখ্যা চার থেকে পাঁচ হাজার বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে ভিসির মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ছাত্রসংখ্যাই আড়াই হাজার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের সমস্ত ছাত্রও একত্রিত হয়ে জনতা গঠন করে থাকে তাতেও ঐ সংখ্যা দাঁড়ায় না। সকালে বাইরের দুজনকে কেবল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দেখা গিয়েছে। তারা হচ্ছেন জনাব শামসুল হক এবং জনাব অলি আহমদ। ড. গনি বলেন সকালে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যে সভা হয় সেখানে ১০০০ লোকের সমাবেশ ছিল। সভা শেষ হবার পর তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শান্তিপূর্ণভাবে সভাস্থল ছেড়ে চলে যায়।
পুলিশের দেওয়া সংখ্যা যথার্থ নাও হতে পারে বলে কমিটি মনে করে। চার থেকে পাঁচ হাজার লোকের সমাবেশের কথা বলা হয়েছে পৌনে দুটায়। কমিটি সংখ্যার তারতম্যকে গুরুত্ব দেয়নি; কারণ গুলি হয়েছে বিকাল তিনটা বিশ মিনিটে। কাজেই সভা ও গুলিবর্ষণের সময়ের ব্যবধানে জনতার আকার আরও বড় হওয়া সম্ভব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বলেন, বহিরাগতদের বের করার চেষ্টা করলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গড়াত। তাছাড়া, ক্যাম্পাসের ভেতর পুলিশ আহ্বান করে বহিরাগতদের বের করতে গেলে অবস্থা আরও জটিল আকার ধারণ করত। অন্য শিক্ষক দুজন তাকে সমর্থন করেন। ড. গণি বলেন, পুলিশ ঠিকমত গোড়াতে পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
ড. গণির কথা কমিটি তেমন পছন্দ করেনি।

৯.
তদন্তে বিচার্য একটি বিষয় হচ্ছে ২১ ফেব্রুয়ারি ৩.২০ মিনিটের গুলিবর্ষণ পরিহার করা সম্ভব ছিল কি না?
পুলিশের বক্তব্য হচ্ছে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছিল যে, বিকেল তিনটার মধ্যে ৩৯টি গ্যাস গ্রেনেড এবং ৭২টি টিয়ার শেল নিক্ষেপ করার পরও তারা দাঙ্গাকারী জনতাকে সামাল দিতে পারেনি। স্পষ্টত ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজকে নিজেদের নিরাপদ আশ্রয় মনে করেছে। ধাওয়া খেয়ে ভেতরে ঢুকেছে আবার একটু পরই বের হয়ে পুলিশকে আক্রমণ করেছে। এ কারণেই যেসব ছাত্রের সাক্ষ্য গৃহীত হয়েছে তাদের সবাই বলেছে তারা রেলিং-এর পেছনে তাদের শিক্ষাঙ্গনেই শান্তিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ছিল।
বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এক নম্বর সাক্ষী ঢাকার এসপি মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, লাঠিচার্জ কোনো কাজে আসেনি। জনতা যখন ইট বর্ষণ করতে করতে আমাদের দিকে এগোচ্ছিল এবং একপর্যায়ে আমরা সম্পূর্ণভাবে ঘেরাও হয়ে পড়লাম এবং আমরা পরাস্ত হতে যাচ্ছিলাম, সে সময় আমি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডিআইজির সাথে আলাপ করে গুলি করার সিদ্ধান্ত নিই। আমার নির্দেশে গুলি হয়। গুলি করার আগে আমরা বার বার জনতাকে সতর্ক করে দিই।
আমরা বলতে কী বুঝিয়েছেন জিজ্ঞেস করা হলে বলেন, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, ডিআইজি এবং তিনি নিজে। গুলি না করলে পুলিশ তাদের কাছে পরাস্ত হতো। এ পর্যায়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়: তাহলে কি বলতে চান আপনাকে ও আপনার বাহিনীকে রক্ষা করার জন্য গুলি করা জরুরি হয়ে পড়েছিল? জবাবে তিনি বলেন, এটাই কারণ, নতুবা আরও আগেই গুলি হতে পারত। গুলি করাটা মোটেও বাড়াবাড়ি হয়নি। এটা অনিবার্য ছিল। তখন গুলির আদেশ না দিলে আজ এখানে সাক্ষী দেবার জন্য হাজির থাকতে পারতাম না।
দু'নম্বর সাক্ষী ঢাকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এস. এইচ. কোরাইশি বলেন, বিকেল ৩টার দিকে জনতার সংখ্যা অবশ্যই ৫০০০ হবে। মোট পুলিশ ছিল ৫০ জন, তাদের কারো কাছে অস্ত্র ছিল, কারো কাছে টিয়ার গ্যাস। আমরা জনতাকে নিরস্ত করতে চেষ্টা করি। কিছুসংখ্যক পুলিশ জনতার হাতে মার খেয়েছে। লাঠিচার্জ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। এদিকে আহত পুলিশের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল, টিয়ার গ্যাসেও কোনো কাজ হচ্ছে না। ক্রমান্বয়ে জনতা মারমুখী হয়ে আরও তীব্র হারে ইট-পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। তাদের শেষবারের মতো সতর্ক করে দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। এ অবস্থায় আমার মতে পুলিশ গুলি না করলে পরাভূত হতো। এসপি গুলি করার জন্য আমার অনুমতি চাইলে আমি গুলি চালানোর অনুমতি দেই। আমার আদেশে এসপির কমান্ডে গুলি চালানো হয়। সবসুদ্ধ ২৭ রাউন্ড গুলি করা হয়। এসপির নির্দেশে গুলি চালানো বন্ধ করা হয়।

সাব-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুর রহমানকে জিজ্ঞেস করা হয় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার কারণে জনতার ওপর গুলি চালানো হয়, না পুলিশকে রক্ষা করার জন্য-- নাকি উভয় কারণেই। তিনি জবাবে জানান, পুলিশকে পরাস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য।
ডিআইজি বলেন, এসপি'র গুলি করার আদেশ যথার্থ হয়েছে। জখমপ্রাপ্ত সিটি ডিএসপি মোহাম্মদ সিদ্দিক দেওয়ান বলেন, পরিস্থিতি এতই খারাপ হয়ে যায় যে, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট গুলি করার আদেশ দেন। ঘটনাস্থলে তিনি কেবল একজনকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যেতে দেখেন। সদর দক্ষিণের মহকুমা প্রশাসক নূরুদ্দিন আহমদ অনেক আহত পুলিশ দেখেছেন এবং এসপির কলার বোন অঞ্চল থেকে রক্তপাত হতেও দেখেছেন, লাঠিচার্জের ফলে দু-তিন মিনিটের জন্য পরিস্থিতির একটু পরিবর্তন হয়, জনতা অল্প সময়ের জন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে আবার চারদিক থেকে এসে জড়ো হয়। সমস্ত রাস্তায় ছিল ছড়ানো ছিল।
ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের স্পেশাল এসপি মো. ইউসুফ, লালবাগ থানার ওসি আব্দুল গোফরান ও পুলিশ ইন্সপেক্টর মীর আশরাফুল হকের সাক্ষ্যে একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি হতে দেখা যায়। মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, চারদিক থেকে ঢিল আসছিল। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট গুলির সিদ্ধান্ত দেন। প্রথম দফায় এক রাউন্ড এবং সব মিলিয়ে ২০ থেকে ২৫ রাউন্ড গুলিবর্ষণ হয় বলে আমার ধারণা। আব্দুল গোফরান বলেন, রেঞ্জ ডিআইজি এবং এসপিসহ অনেকে ঢিলের আঘাতে আহত হয়। আশরাফুল হককে জিজ্ঞেস করা হয় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট যখন গুলির আদেশ দেন তখন তিনি কতদূরে ছিলেন। জবাবে তিনি বলেন, ডিএমকে গুলির আদেশ দিতে শোনেননি।
কমিটি নিরপেক্ষ সাক্ষী মোহাম্মদ কামাল এমএ প্রদত্ত বিবরণী বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় আনে। জনৈক মৌলবি নজিবুল্লাহর সাথে দেখা করার জন্য তিনি আড়াইটায় অ্যাসেম্বলি ভবনের দিকে রওয়ানা হন। তার মতে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের কাছ থেকে হাজার খানেক লোক স্লোগান দিয়ে পুলিশের ওপর ঢিল মারতে মারতে এগোচ্ছিল। ফুলার রোডে একটি সুবিধামতো জায়গায় তিনি দাঁড়িয়েছিলেন কারণ জনতার ভেতর দিয়ে এগোনো তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি পুলিশের গুলিবর্ষণের শব্দ শুনতে পান এবং একজনের মাথায় গুলি লাগতে দেখেন। তার মনে হয়েছে তার গন্তব্যের দিকে এগোলে পুলিশ কিংবা জনতার হাতে জখম হবেন। প্রথমবার গুলিবর্ষণে যে একজনের মৃত্যুর কথা পুলিশের সাক্ষ্যে এসেছে, মোহাম্মদ কামালের সাক্ষ্যে মাথায় গুলি লাগা ব্যক্তি এই একজনই বলে কমিটি মনে কর। ৬৪ নম্বর সাক্ষী দেওয়ান মো. মনির উদ্দিন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। তিনি তার প্রথম বিবৃতিতে বলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি জানাতে সর্বদলীয় ভাষা কমিটির আহ্বানে ঘটনার দিন সকাল সাড়ে দশটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হন। তদন্ত কমিটির সামনে উপস্থিত হবার পর বলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি, তবে চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল কলেজের আউটডোর বিভাগে গিয়েছিলেন। তিনি পুলিশকে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে দেখেছেন, সেখান থেকে তারা গুলি করলে হোস্টেলের বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন মৃত্যুবরণ করে এবং সাত-আটজন আহত হয়।
তারপর কী হয় জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এর আধঘণ্টা বা কিছু বেশি সময় পর আমি কিছুসংখ্যক পুলিশকে হোস্টেলে ঢুকে হোস্টেলের ভেতর দিয়ে যে রাস্তাটি গেছে সেখানে পজিশন নিতে দেখি। তারপর তারা গুলি চালায়। তখন লোকজন হোস্টেল ও কলেজ প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়েছিল। তিনি নিজেও মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়েছিলেন। পুলিশ সেখানে কতবার গুলি করেছে তা তিনি গুনে দেখেননি। তিনি বারান্দায় একজনকে নিহত ও সাত-আটজনকে আহত অবস্থায় পান। আরও কিছু প্রশ্নোত্তরের পর বলেন, নাক, কান ও গলা বিভাগের ভাঙা দেয়ালের মধ্য দিয়ে তিনি দেওয়ানজি বাজার, নাজিমুদ্দিন রোড ও আগামসি লেন হয়ে সোজা বাড়ি চলে যান। তদন্ত কমিটির কাছে তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।
১০.
গুলিবর্ষণের দায়িত্ব মূলত তিনজন কর্মকর্তার ওপর বর্তায়-- ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, ডিআইজি এবং এসপি। যেসব পুলিশ কনস্টেবল গুলি চালিয়েছে তাদের সাক্ষ্যের বিষয়টি পর্যালোচিত হয়। কনস্টেবলরা যদি আত্মরক্ষার্থে কোনো আদেশ ছাড়া গুলি করত তা হলে তাদের পরীক্ষা করার বিষয়টি প্রয়োজনীয় হতো। এক্ষেত্রে যেহেতু তারা আদেশপ্রাপ্ত গুলি করেছে, আদেশদাতারা ঘটনার সময় যে গুলির আদেশ দিয়েছেন তা যথার্থ কি না বিবেচ্য।
গুলিবর্ষণের অযৌক্তিকতা দেখিয়ে যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাদের সাক্ষ্যে বস্তুগত কোনো উপাদান ছিল না। হোস্টেলের দেয়ালে গুলির চিহ্নের উল্লেখ করে বলা হয় পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে হোস্টেল কম্পাউন্ডে প্রবেশ করে গুলি করে।
জাস্টিস এলিস ব্যক্তিগতভাবে পরিদর্শন করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে পুলিশ যে অবস্থান থেকে গুলি করে সেখান থেকে গুলিবিদ্ধ স্থান গুলির আওতায় আসতে পারে। সদ্য যোগদানকারী ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এস এইচ কোরাইশির ফৌজদারি কার্যবিধি ১৪৪ ধারা জারিসহ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অনভিজ্ঞতার বিষয়টি উত্থাপিত হয়। জাস্টিস এলিস ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের স্বল্প অভিজ্ঞতার কথা স্বীকার করে নিয়ে বলেন, তাই বলে তার কার্যক্রম অপরিণত নয়। লাঠিচার্জ, টিয়ার নিক্ষেপসহ সকল সম্ভাব্য পদক্ষেপ গ্রহণের পর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। এসপি ও ডিআইজির সাক্ষ্যে গুলিবর্ষণের আর কোনো বিকল্প ছিল না বলে সুপ্রতিষ্ঠিত। গুলিবর্ষণ বাড়াবাড়ি রকমের হয়েছে কি না তা পর্যালোচনায় জাস্টিস এলিস বলেন, পুলিশের যদি হত্যা করার উদ্দেশ্য থেকে থাকত তা হলে ২৭ রাউন্ড গুলিতে মাত্র ৪ জন নিহত হতো না। নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতো।
২৭ রাউন্ড গুলিতে ৯ জন আহত হয় যার মধ্যে ৪ জন মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া অনেকেই গ্যাস, লাঠিচার্জ কিংবা মাটিতে পড়ে যাওয়া জনিত কারণে আহত হয়েছে।
পুলিশের ইস্পাতের হেলমেট না থাকার বিষয়টি জাস্টিস এলিস দুঃখের সাথে লিপিবদ্ধ করেন। কাপড়ের টুপি মাথায় দিয়ে এ ধরনের মারমুখী জনতা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। পুলিশ যদি সেদিন যথাযথভাবে সজ্জিত থাকত তা হলে এ দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি হয়তো পরিহার করা সম্ভব হতো। কিছুসংখ্যক সমিতি ও সংস্থা তদন্ত কমিটি বয়কট করায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং বলেন, তাদের অংশগ্রহণে তদন্ত আরও পরিপূর্ণ হতে পারত।
শেষ পর্যন্ত তদন্তের ফলাফল: গুলিবর্ষণ অনিবার্য ছিল এবং ঘটনার দিন বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পুলিশ যে বল প্রয়োগ করেছে তাও যৌক্তিক ছিল।

জাস্টিস এলিস জানতেন না, জানার কথাও নয় এই একুশের হবে বিশ্বায়ন, একুশ হবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও ভাষা শহীদ দিবস।
পুলিশের গুলিবর্ষণের যৌক্তিকতা নির্ধারণের দায় ম্যাজিস্ট্রেট থেকে শুরু করে জাস্টিস পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের বিচারকদের। পুলিশ রেগুলেশনে কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কে তদন্ত করবেন এবং দায়-দায়িত্ব নির্ধারিত করবেন তা সুনির্দিষ্টভাবে বিবৃত। তবে তদন্ত প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বলা হয় যে গুলিবর্ষণ না করে পুলিশের আর কোনো উপায়ই ছিল না। গুলিবর্ষণ ছিল সার্বিক ঘটনাক্রমের একটি অনিবার্য পরিণতি। অর্থাৎ গুলিবর্ষণ যৌক্তিক। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালের গুলিবর্ষণের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে। প্রতিবেদনে শেষ পর্যন্ত বলা না হলেও ইঙ্গিত করা হয়েছে পুলিশ অত্যন্ত সহনশীল একটি ভূমিকা পালন করেছে নতুবা চারজনের জায়গায় বহু মৃতদেহ পড়ে থাকত।