উত্তমকুমার: এক বন্দুকবাজ বাঘের গল্প
[গত সংখ্যার পর]
আট
দর্জির দোকানে যাওয়ার জন্যে আবার উঠতে হল হারুণ আল রশিদের গাড়িতে। হারুণ আল রশিদ ড্রাইভারের সিটে, আমি তার পাশে আর আমাদের পেছনে বাঘ। হোটেল থেকে সামান্য এগিয়েই একটা ট্রাফিক সিগনালে আটকে পড়ল গাড়ি। আমাদের পাশেই একটা মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে, তাতে দুজন বসে। পেছনের জন আমাদের গাড়ির মধ্যে বাঘকে দেখে তার মোবাইল ফোন বের করে ছবি তুলল। সেই দেখে তার পেছনের একটা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল আরেকজন। সে ভিডিও করতে শুরু করল। তারপর এগিয়ে এল আরেকজন। সন্ধ্যাবেলা কলকাতার রাস্তায় একটা গাড়ির মধ্যে দুটো মানুষ আর পেছনে একটা বাঘ দেখে হই হই পড়ে গেল। বাঘের ছবি আর ভিডিওর জন্যে আমাদের গাড়ি ঘিরে ধরেছে অসংখ্য মানুষ।
তাদের মোবাইল ফোনের ঝলকানিতে ভয় পেয়ে বেচারা বাঘ হারুণ আল রশিদকে বলল, "সবাই এমন করছে কেন?" হারুণ আল রশিদ মুচকি হেসে বলল, "এ হল আরেকটা সার্কাস। আমার সার্কাসটার থেকেও বড়।" বাঘ দারুণ উৎসাহে বলল, "তাহলে এখানে একবার বন্দুক চালিয়ে দেখাব?" হারুণ আল রশিদ নিজের কাঁচাপাকা দাড়িতে আঙুল চালিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "আইডিয়াটা মন্দ নয় কিন্তু।"
ব্যস, এটুকুই শোনার যা অপেক্ষা ছিল। বন্দুকটা বাঘের পাশেই ছিল সিটের ওপর শোয়ানো। সেটা হাতে নিয়ে দরজা খুলে বাঘ গাড়ির বাইরে মানুষের ভিড়ে। এতক্ষণ গাড়ির বন্ধ কাচের ওপারে যাকে দেখার জন্যে এত মানুষের ভিড় হয়েছিল, সে বন্দুক হাতে বাইরে আসতেই এবার পালানোর জন্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল। ধাক্কাধাক্কিতে ৪-৫ জনের মোবাইল ফোন পড়ে রইল রাস্তার ওপর। আর পড়ে রইল দুটো চপ্পল। বাঘ বোঝার চেষ্টা করছে, হলটা কী!
হঠাৎ কোত্থেকে ভেসে এল মাইকের আওয়াজ। ট্রাফিক সিগনালের উলটোদিকে এসে দাঁড়িয়েছে একটা জালগাড়ি। সেখান থেকেই আওয়াজটা আসছে।
"বন্দুক মাটিতে রেখে হাত তুলে দাঁড়াও। আমরা তোমায় ঘিরে ফেলেছি। পালানোর চেষ্টা করবে না।"
বাঘ ভ্যাবাচাকা খেয়ে আমাদের দিকে তাকাল— "এমন মোটা গলায় কে কথা বলছে?"
কলকাতা পুলিশ এসে হাজির হয়েছে, গোলমালের খবর পেয়ে। এবার আমার জেলে যাওয়া আটকায় কে! তাই কোনোরকমে বললাম, "কপু।"
বাঘ বুঝতে না পেরে বলল, "কে?"
হারুণ আল রশিদ পাশ থেকে বলল, "এবার মনে হচ্ছে একটা ঝামেলা বাধবে।" বলতে বলতেই সে নেমে এল গাড়ি থেকে।
ওদিক থেকে আবার ভেসে এল মাইকের আওয়াজ।
"স্যর, আপনি বাঘটার থেকে দূরে সরে দাঁড়ান। আপনার প্রাণ সংশয় হতে পারে।"
বাঘ ততক্ষণে তার বন্দুক মাটিতে নামিয়ে রেখে দু-হাত তুলে দাঁড়িয়েছে। হারুণ আল রশিদ বাঘের পাশেই দাঁড়িয়ে রইল যদিও। দু-হাত চোঙের মতো করে মুখের সামনে ধরে সে চেঁচাল— "এই বাঘ কারও কোনও ক্ষতি করবে না। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।"
সেই শুনে বাঘও ঘটাঘট মাথা নাড়ল ওপরে-নিচে— "ভয় পাওয়ার কিছু নেই।"
এবার পুলিশের দিক থেকে আওয়াজ নেই। বোধ হয় নিজেদের মধ্যে শলা পরামর্শ করছে। একটু পরে আবার মাইকে আওয়াজ এল— "স্যর, আমাদের রুলবুক বলছে বাঘেদের থেকে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। তারা বনে থাকে। সুযোগ পেলেই মানুষকে ধরে নিয়ে যেতে চায়। তার ওপর আপনার বাঘের কাছে একটা বন্দুকও আছে।"
হারুণ আল রশিদ আবার এদিক থেকে চেঁচাল, "আসলে এটা বাঘ নয়, মানুষই। বাঘের পোশাক পরে আছে। আপনারা দেখেছেন কখনও বাঘকে বন্দুক নিয়ে ঘুরতে?"
এমন যুক্তিতে কাজ হল বোধ হয়। পুলিশরা আবার কিছুক্ষণ চুপ। জালগাড়ির পাশে দু-তিনজন দাঁড়িয়েছিল আলো-আঁধারির মধ্যে। সন্ধের অন্ধকার আর রাস্তার অস্পষ্ট আলোয় তাদের পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না ঠিক করে। এবার একজন পুলিশ আলোর মধ্যে এগিয়ে এল। বেশ শান্ত ভদ্র চেহারা। চোখে চশমা।
"ওটা যদি মানুষই হয়, তাহলে বাঘের পোশাকটা খুলে ফেলতে বলুন।"
হারুণ আল রশিদ বুদ্ধি করে বলল, "আসলে ও শুধু বাঘের ছালটাই পরে আছে, ভেতরে আর কিছু নেই। আপনি ভেতরের মানুষটাকে দেখতে চাইলে গাড়ির মধ্যে ঢুকে পোশাক বদলে আসতে পারে।"
পুলিশ অফিসার একটু ভেবে বলল, "ঠিক আছে। কিন্তু তাড়াতাড়ি।"
হারুণ আল রশিদ চাপা গলায় বাঘকে বলল, "তুমি গাড়ির মধ্যে গিয়ে ঢোকো।" তারপর আমার উদ্দেশ্যে বলল, "বাঘ গাড়িতে ঢুকলে এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনে তুমি বেরিয়ে আসবে।"
পরিকল্পনাটা আমার বেশ পছন্দ হল। আলো কম থাকার কারণে বাইরে থেকে আমায় দেখা যাচ্ছে না ভালো করে। তবু পুলিশের যদি সন্দেহ হয়? কিন্তু এখন আমাদের সামনে আর কোনও উপায়ও নেই। বাঘ এসে আবার উঠল গাড়ির মধ্যে। হারুণ আল রশিদ চাপা গলায় বলল, "সিটে না বসে গাড়ির মেঝেতে শুয়ে পড়ো।" বাঘ সামনের সিট আর পেছনের সিটের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল।
কথামতো আমি দশ পর্যন্ত গুনে সামনের সিট থেকে বেরিয়ে এলাম।
হারুণ আল রশিদ হাততালি দিয়ে উঠল।
"এই দেখুন, আমাদের বাঘ কেমন দিব্যি মানুষ হয়ে গেছে।"
ওদিক থেকে পুলিশ অফিসার এবার রাস্তা পেরিয়ে এগিয়ে এল। একটু সন্দেহের সুরে বলল, "বাঘ তো পেছনের দরজা দিয়ে গাড়িতে উঠেছিল। তাহলে সামনের দরজা দিয়ে মানুষ হয়ে বেরোল কী করে?"
হারুণ আল রশিদ কিছু বলার আগেই আমি বললাম, "আসলে এটা তো ম্যাজিকের গাড়ি, তাই।" তারপর হারুণ আল রশিদের দিকে দেখিয়ে বললাম, "এই ভদ্রলোক ম্যাজিক দেখান।"
হারুণ আল রশিদও ঘাড়-টাড় নেড়ে বলল, "হ্যাঁ, তাই তো, তাই তো।"
পুলিশ অফিসার তখন আমাদের সামনে। বুকের নেম ট্যাগে নাম লেখা পি চক্রবর্তী। হারুণ তাই দেখে বলল, "দেখুন অফিসার চক্রবর্তী, আমরা নিরীহ মানুষ। সার্কাসে খেলা দেখাই। বাঘের কমতি থাকার কারণে এঁকে বাঘ সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম।"
পুলিশ অফিসার হারুণ আল রশিদের দিকে এক মুহূর্ত সরু চোখে তাকিয়ে রাস্তা থেকে বাঘের নামিয়ে রাখা বন্দুকটা উঠিয়ে নিল।
"আপনারা নিরীহ মানুষ! তাহলে এই বন্দুকটা কেন আপনাদের কাছে? লাইসেন্স আছে এটার?"
হারুণ আল রশিদ আবার গলগল করে হেসে ফেলল— "ওহ! এটা বুঝি আপনার সত্যি বন্দুক মনে হচ্ছে?" পুলিশ অফিসারের হাত থেকে বন্দুকটা প্রায় কেড়ে নিয়েই হুশ করে একটা পাক খেয়ে নিল। ঘুরে সামনে আসতেই দেখা গেল তার হাতে আর বন্দুক নেই, একটা লম্বা ছড়ি হয়ে সেটা।
"এই দেখুন। ছিল বন্দুক, হয়ে গেল ছড়ি।"
পুলিশ অফিসার বেশ অবাকই হয়েছে বোঝা গেল। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করতে সম্মানে লাগছিল বোধ হয়। তাই একটু ব্যস্ত মুখে বলল, "ঠিক আছে, ঠিক আছে। কিন্তু আপনার গাড়ির তল্লাশি নিতে হবে। পুরো ব্যাপারটাই কেমন সন্দেহজনক।"
হারুণ আল রশিদ এবার গলাটা আরও মোলায়েম করল— "আপনার নাম কী স্যর?"
"কেন?" পুলিশ অফিসার থতমত খেয়ে উত্তরটা দিয়েই দিল— "প্রিয়ঙ্কর। প্রিয়ঙ্কর চক্রবর্তী।"
হারুণ আল রশিদ তারিফের গলায় বলল, "বাবা! বন্ড! জেমস বন্ড!" তারপর একটু মুকমুক করে হেসে নিয়ে বলল, "দেখুন প্রিয়ঙ্করবাবু। দেখতেই পাচ্ছেন আমি বাজিকর মানুষ। এই গাড়িটা আগাগোড়া ম্যাজিক। বছর তিনেক আগে একজন চোর চুরি করতে ঢুকে আর বেরোতে পারেনি এই গাড়ি থেকে। দুদিন পরে তাকে গোলোকধাঁধা থেকে বের করতে সে শুধু বলতে পেরেছিল, কিস্তাম।"
অফিসার প্রিয়ঙ্কর চক্রবর্তী ঢোঁক গিলে বলল, "কিস্তাম মানে?"
"কেউ জানে না। এখন সেই চোর থাকে কাঁকেতে। প্রতি বছর পুজোর আগে তাকে আমি দেখতে যাই একবার করে।"
পুলিশ অফিসার এবার শুকনো গলায় বলল, "একেবারে স্ট্রেট পাগলাগারদ! বলেন কী!"
হারুণ আল রশিদ একটু হেসে বলল, "অবশ্য সে তো চোর ছিল। আপনি তো পুলিশ। বুদ্ধিমান। আপনার কি আর তেমনটা হবে। আসুন, বরং তল্লাশি নিয়েই নিন গাড়ির।" বলতে বলতেই সে গাড়ির দরজা খুলে দিতে গেল।
অফিসার প্রিয়ঙ্কর চক্রবর্তী দু-পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, "ইয়ে, আমার একটা জরুরি কাজ আছে। একটু পরেই লালবাজার যেতে হবে।" তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "আপনি কিন্তু আর এভাবে বাঘের পোশাক পরে প্রকাশ্য রাস্তায় ঘুরবেন না।"
আমি একদিকে মাথা হেলিয়ে বাধ্য ছাত্রের মতো বললাম, "একদম না। আর হবে না।"
পুলিশ ফিরে গেল নিজের জালগাড়িতে। আমরা আমাদের গাড়িতে।
গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে হারুণ আল রশিদ বলল, "বড় বাঁচা বেঁচে গেছি।"
গাড়ি চলতে শুরু করার পরে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "চোরটা সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিল?"
আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে হারুণ আল রশিদ বলল, "কিস্তাম।"
নয়
দরজির দোকানে পৌঁছে আমরা গাড়ি থেকে বাঘকে নামালাম। সারা রাস্তা সে বেচারা গাড়ির মেঝেতেই গুটিসুটি মেরে শুয়ে ছিল।
দরজি হারুণ আল রশিদের বহুদিনের চেনা। তবু সে বাঘকে দেখেই বলল, "এ কী! আমি তো বাঘের জামাকাপড় বানাই না।"
বাঘ উত্তরে বলল, "গ্র-র-র-র!"
দরজির নাম কুশ। সে প্যারিসে তিন বছর থেকে ফ্যাশন ডিজাইন শিখে এসেছে। আর কে না জানে প্যারিসে থাকলে লোকজনের মন খুব নরম হয়ে যায়। বাঘের 'গ্র-র-র-র' শুনে কুশ তাই গলেই গেল।
সে মাপ নেওয়ার ফিতেটা গুছিয়ে গলায় মালার মতো ঝুলিয়ে নিল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, "আচ্ছা, আচ্ছা হয়েছে। আর অত আবদার করতে হবে না।" তারপর চোখের ওপর চশমা এঁটে খাতা বাগিয়ে ধরল— "কী কী সিলোতে হবে?"
আমরা কিছু বলার আগেই বাঘ আঙুল গুনতে শুরু করল— "সবুজ রঙের কোট। লাল রঙের টুপি। আর তার ওপর হলুদ পালক।"
কুশ তার চশমার ফাঁক দিয়ে বাঘের দিকে তাকিয়ে বলল, "তোমার গায়ের রঙের সঙ্গে বেগুনি কোট ভালো লাগবে কিন্তু।"
বাঘ ঘাড় নেড়ে বলল, "গ্র-র-র-র!"
কুশ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, "বেশ।" তারপর হারুণ আল রশিদের দিকে তাকিয়ে বলল, "কবে দরকার?"
হারুণ আল রশিদ বলল, "কাল সকালে। বিকালে আমাদের শো।"
কুশ এবার তার মুড়ে বন্ধ করে সামনের টেবলে রেখে দিল।
"এক রাতের মধ্যে আমি কী করে একটা কোট বানাব? তুমি কি পাগল!"
এবার বাঘের বদলে হারুণ আল রশিদ বলল, "গ্র-র-র-র!"
অনেক কথা কাটাকাটির পরে ঠিক হল, সারারাত কাজ করে কুশ বাঘের সবুজ কোট বানিয়ে দেবে। বদলে হারুণ আল রশিদের দারুণ আল সার্কাসের ফার্স্ট রো-তে ভি আই পি সিটে বসে কুশ বাঘের বন্দুক চালানো দেখবে।
লাল টুপি আর অলুদ পালক কেনার ভার পড়ল আমার ওপর। বদলে আমিও কুশের পাশে ভি আই পি সিটে বসে সার্কাস দেখার সুযোগ পাব।
* * *
হারুণ আল রশিদ সত্যিই জাদুকর। পরেরদিন সব খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বড় করে বিজ্ঞাপন বেরোল—
আজ বিকেল পাঁচটায় ময়দানের তাঁবুতে
হারুণ আল রশিদের
দারুণ আল সার্কাসে
এই প্রথমবার আসছে
উত্তমকুমার – সুন্দরবনের বন্দুকবাজ বাঘ
এই সুযোগ নষ্ট করবেন না
বিজ্ঞাপনের নিচে দেওয়া আছে অনলাইন কী করে টিকিট কাটতে হবে। বাঘের নাম উত্তমকুমার রাখার কারণেই হোক বা সে বন্দুক চালাতে পারে জেনেই হোক, বিজ্ঞাপন দেখে কলকাতার লোকে একঘণ্টার মধ্যেই পরের তিরিশদিনের টিকিট কিনে নিল। বাঘ তার হোটেলের ঘরে নরম সেই বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল। হঠাৎ দরজায় ঠক-ঠক-ঠক দুম-দাম-দুম-দাম! ঘুম চোখে উঠে দরজা খুলে দেখে দাঁড়িয়ে আছে হারুণ আল রশিদ। সঙ্গে কুশ। তার সবুজ কোট তৈরি।
"কই পরে দ্যাখো তো কেমন হয়েছে।"
* * *
সত্যি বলতে কী, বাঘকে দিব্যি মানিয়েছিল সেই সবুজ কোট। আমি, কুশ আর আগের দিনের সেই পুলিশ অফিসার প্রিয়ঙ্কর চক্রবর্তী একসঙ্গে ভি আই পি সিটে বসে দেখেছিলাম প্রথম দিনের সেই শো। সতীনাথ মুখোপাধ্যায় আমার বিশেষ পরিচিত। তাঁকে ফোন করে অনুরোধ করেছিলাম, উত্তমকুমারের প্রথম শোয়ে তিনি যদি ঘোষকের ভূমিকায় থাকেন। সার্কাসে ঘোষণা করতে হবে শুনে প্রথমে রাজি হননি। বলেছিলেন, "আমি সার্কাসে! না না। তাও আবার বাঘের খেলায়!" আমি এদিক থেকে লোভ দেখালাম, "বাঘের নাম কিন্তু উত্তমকুমার।" সতীনাথবাবু 'চিড়িয়াখানা' ছবিটা ছত্রিশবার দেখেছেন। তাই কিন্তু-কিন্তু করে বললেন, "আচ্ছা আচ্ছা, ক-টায় যেন বললে? পাঁচটা?"
পুরো তাঁবু কানায় কানায় ভর্তি। জিপসি নামের জেব্রার ট্রাপিজের খেলা হওয়ার পরে এল র্যাম্বো নামের গণ্ডার। খড়্গে দড়ি বেঁধে ট্রাক টেনে নিয়ে যাওয়ার খেলা দেখাল সে। এরপর সতীনাথবাবু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মেঘমন্দ্র কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, "কলকাতায় এই প্রথমবার সুন্দরবনের বাঘ উত্তমকুমার।" তারপর একটু থেমে যোগ করলেন, "বন্দুকের নিশানায় আমাদের হৃদয় জিততে এসেছে সে।" হাততালিতে ফেটে পড়ল পুরো তাঁবু।
বাঘ, যার নাম এখন উত্তমকুমার, সবুজ কোট গায়ে হাতে বন্দুক নিয়ে হাজির হল। হারুণ আল রশিদ আর তার এক সহকারী এসে পাঁচটা টেবলের ওপর পাঁচটা বোতল বসিয়ে দিয়ে গেল। বাঘ সোজা দাঁড়িয়ে প্রথমটা, হাঁটু গেড়ে দ্বিতীয়টা, হামাগুড়ি দিয়ে তৃতীয়টা, শুয়ে পড়ে চতুর্থটা আর তারপর মাথার ওপর ভর দিয়ে দুই পা দিয়ে পঞ্চম বোতলটা উড়িয়ে দিল।
গুড়ুম-ক্র্যাক! গুড়ুম-ক্র্যাক! গুড়ুম-ক্র্যাক! গুড়ুম-ক্র্যাক! গুড়ুম-ক্র্যাক!
উপস্থিত দর্শক প্রথমে বাক্যিহারা হয়ে গেল এমন নিশানা দেখে। তারপর হাততালিতে ফেটে পড়ল সবাই— "আহা!" "ক্যয়া বাত!" "সাবাশ!"
ওদিকে বাঘ তার বন্দুক বগলে ঘুরে ঘুরে দর্শকদের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাতে থাকল।
পরের দিন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় বড় করে লেখা হল— "বন্দুকবাজ বাঘ উত্তমকুমার – আর-এক মেগাস্টারের উত্থান"। সে খবর তো তোমরা সকলেই পড়েছিল সেদিন, নতুন করে আর কী বলব।
* * *
এরপর যা ঘটেছে, সে সম্পর্কে নতুন করে কিছুই বলার নেই। উত্তমকুমার নামে আমাদের গল্পের বাঘ সাফল্যের উঁচু গাছে চড়ে বসল এক লাফে। প্রতিদিন তার শোয়ে ভিড় উপচে পড়ত। তার ফেসবুক পেজে লাখ লাখ ফলোয়ার। ইনস্টাগ্রামে একটা ছবি দিলে লাইকের ভারে সার্ভার ভেঙে পড়তে চায়। টুইটারে সে এক লাইন লিখলে হাজার লাইন বাহবা পায়।
আর টাকাপয়সার তো লেখাজোকা রইল না। বড় বাড়ি হল। বড় বড় গাড়ি হল। এখন তার হাজারটা সবুজ রঙের কোট। এভাবেই দু-বছর কেটে গেল। তবু কোথায় যেন তাল কেটে যাচ্ছিল। বাঘের মনে শান্তি নেই।
একদিন সে আমায় ফোন করল।
"রোহণদা, তোমার সাহায্য দরকার।"
আর কে না জানে কেউ সাহায্য চাইলে আমি 'না' বলতে পারি না।
গেলাম তার বাড়ি।
বাঘ তখন ডাইনিং টেবলে বসে কামালের দাদির পাঠানো আচার দিয়ে খরগোশের মাংস খাচ্ছিল। আমি এসে পড়াতে আমাকেও একটা থালা টেনে বসাতে চাইছিল।
আমি আপত্তি জানিয়ে বললাম, "আমার আসলে খুব তাড়াতাড়ি হাঁটার অভ্যাস, ডাক্তার তাই খরগোশের মাংস খেতে বারণ করেছেন।"
বাঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "রোহণদা, আমি ক-দিন ধরেই ভাবছি, এবার কী?"
আমি প্রশ্নটা বুঝতে পারলাম না। তাই জিজ্ঞাসা করলাম, "এবার কী মানে?"
"মানে এবার আমি কী করব? আমি আগে বন্দুক চালাতে ভালোবাসতাম। এখন রোজ বন্দুক চালিয়ে চালিয়ে একঘেয়ে হয়ে গেছে ব্যাপারটা। আমি আগে হাততালি পেতে ভালোবাসতাম। এখন আমি হাত নাড়লেও লোকে হাততালি দেয়। আগে আমি রাস্তায় বেরোলে পুলিশ চলে আসত। এখন আমি রাস্তায় বেরোলে পুলিশ সেলফি তুলতে আসে।"
আমি চুপ করে থেকে বললাম, "একে বলে খ্যাতির বিড়ম্বনা। সব বিখ্যাত মানুষদেরই হয়ে থাকে।"
বাঘ করুণ চোখে বলল, "আমি বাড়ি যাব। আমায় সুন্দরবনে ফিরিয়ে নিয়ে চলো।"
"যদি হারুণ আল রশিদ রাজি না হয়? তুমি না থাকলে তার সার্কাস তো চলবে না আর।"
বাঘ বলল, "তাহলে আমি পালিয়েই যাব।" তারপর অনুনয়ের সুরে বলল, "কিন্তু আমি রাস্তা চিনি না তুমি আমায় পৌঁছে দাও।"
কিন্তু হারুণ আল রশিদকে লুকিয়ে এ কাজ করতে আমার মনে চাইল না। তাই তাকেও ডাকলাম বাঘের বাড়ি। সে আসার পরে তাকে বুঝিয়ে বললাম, "বাঘের আর বন্দুক চালাতে ইচ্ছে করছে না।"
অনেক তর্ক-বিতর্ক হল।
হারুণ আল রশিদ বলল, "কিন্তু তোমার আর বনে থাকার অভ্যাস নেই। কী করে থাকবে সেখানে?"
বাঘ বলল, "সেটা আমার বাড়ি।"
হারুণ আল রশিদ বলল, "আমার সার্কাস বন্ধ হয়ে যাবে।"
আমি বললাম, "এখনই যে টাকা তুমি কামিয়েছ, তা গুনে উঠতে পারোনি। তোমার বাড়িতে শুনেছি দুটো লোক পালা করে টাকা গুনছে গত দু-বছর ধরে। এখনও শেষ করতে পারেনি। তোমার আর সার্কাস চালানোর দরকার কী?"
টানা আট ঘণ্টা বাদানুবাদ হওয়ার পরে হারুণ আল রশিদ নিমরাজি হয়ে বলল, "বেশ। তোমায় জোর করে তো আর ধরে রাখতে পারি না। কিন্তু বনে গিয়ে তোমার খারাপ লাগলে জানিও। আমি আবার নিয়ে আসব। তোমার বাড়ি ঘরদোর এরকমই গোছানো থাকবে।"
বাঘ তার হাত ধরে বলল, "বন্ধু, এসব আমার আর কিছু কাজে লাগবে না। আমার বাড়ি-গাড়ি টাকাপয়সা সবই তোমার দৌলতে হয়েছে। এসব তুমিই নিও।"
দশ
হারুণ আল রশিদকে সব কিছু দিয়ে শুধু নিজের হলুদ পালকওয়ালা লাল টুপি, সবুজ কোট পরে আর বন্দুক কাঁধে বাঘ উঠে বসল গাড়িতে। হারুণ আল রশিদের পুরনো ছোট লাল গাড়ির বদলে এখন নতুন ঢাউস লাল গাড়ি। তার পেছনের সিটে দুটো বাঘের বসার জায়গা হয়ে যায়।
প্রথমে গাড়ি, তারপর নৌকা চড়ে আমরা বাঘের পাড়ায় গিয়ে পৌঁছলাম বিকেল নাগাদ। সেখানে অবশ্য এই কয়েক বছরে বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয়নি। শুধু বুড়ো বাঘ আর একটু বুড়ো হয়েছে, এই যা।
বাঘেরা প্রথমে উত্তমকুমারকে দেখে একটু অবাক হল। তারপর কাছে এসে গায়ের গন্ধ শুঁকল। তার সবুজ কোট টেনে দেখল। বাঘ তাদের বলল, "আমি গো। চিনতে পারছ না?"
তারা বলল, "চিনতে তো পারছি। কিন্তু হঠাৎ এখানে? কী ব্যাপার?"
বাঘ বলল, "আমি ফিরে এসেছি।"
তার নিস্পৃহ গলায় বলল, "ও! তাই?"
তারপর আবার তারা নিজেদের মধ্যে গল্পগাছা করতে লাগল। এমনকী আমরা দুটো মানুষ যে তাদের কাছেই দাঁড়িয়ে আছি, সেটাও তাদের নজরে পড়ল না যেন।
বাঘ আমাদের কাছে এসে বলল, "আমি আর এদেরও কেউ নই বোধ হয়।"
হারুণ আল রশিদ বলল, "তাহলে ফিরে চলো।"
বাঘ ঘাড় নেড়ে বলল, "আমি যে মানুষ নই। কী করে শহরে ফিরে যাব?"
তারপর নিজের মনেই বলল, "আমি তাহলে কী? আমি মানুষ নই। আমি আর বাঘও নই।"
তারপর হঠাৎ সামনের বড় গাছটার ওপরে উঠল সে। নেমে এল তার রেখে যাওয়া কালো ছাতাটা নিয়ে। সিরাজ মণ্ডল দিয়েছিল তাকে। সে দিয়ে গিয়েছিল পাখিদের, ঝড়-বৃষ্টি থেকে তাদের বাসা আড়াল করতে। পাখিরা উড়ে গেছে কবেই। ফাঁকা বাসার পাশ থেকে ছাতাটা তুলে নিল বাঘ।
তারপর তার পরনের সবুজ কোট আর হলুদ পালক আটকানো লাল টুপি খুলে দিল হারুণ আল রশিদের হাতে। বন্দুকটা দিল আমায়। তারপর ছাতাটা কাঁধে ফেলে সে বলল, "চলি।"
আমি অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, "কোথায় চললে?"
বাঘ উত্তর দিল না। দূরের ঘন বনের দিকে তাকাল একবার। আমরা সবাই মনে মনে জানি, কোথাও না কোথাও গিয়ে ঠিকই পৌঁছে যায় সবাই। নিরুদ্দেশ তো আর সত্যি করেই কেউ হয় না।
আমি আর হারুণ আল রশিদ উত্তমকুমার নামের সেই বাঘের পার্থিব কিছু সম্পত্তি হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম। আর সূর্যের পড়ন্ত আলোয় দেখলাম, একটা হলুদ বাঘ কালো রঙের একটা ছাতা মাথায় জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
তারপর আর বাঘের কোনও খবর পাইনি আমরা।
কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি, একদিন না একদিন সে ফিরে আসবেই। হয়তো বাঘেদের আস্তানায় বা মানুষের পাড়ায়। হয়তো হারুণ আল রশিদের সার্কাসের তাঁবুতে। বা সেই হোটেলের চৌবাচ্চায়। বা হয়তো কামালদের বাড়ির ছাদে, আচারের লোভে।
দাদির তৈরি লেবুর আচার বড় ভালোবাসত সে।
- [শেষ]
- [গল্পটি Shel Silverstein-এর Lafcadio, the Lion Who Shot Back থেকে অনুপ্রাণিত]