ইউকিও মিশিমার উপন্যাস ‘স্বর্ণমন্দির’
বাংলা তর্জমায় মিশিমা ইউকিও-র উপন্যাস 'স্বর্ণমন্দির' পড়তে পড়তে এই উপন্যাসের বার্তাগুলো যখন পাঠক ধরতে চেষ্টা করবেন, তখন প্রতিনিয়তই তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে এই উপন্যাসের রচনাকাল এবং এর পরিপ্রেক্ষিত। উপন্যাসটা লেখা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের বছরগুলোতে যখন যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে জাপানের সমাজে জাতি হিসেবে আত্মবিশ্বাস ও নৈতিকতার ঐতিহ্যগত ধারণা ভয়ানকভাবে সংকটাপন্ন। পশ্চিমী সভ্যতার কাছে একরকম বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে একটা অনিশ্চিত, অজ্ঞাত ভবিষ্যতের আশঙ্কাতে সমাজ অস্থি্রতায় আক্রান্ত। দেশটার ইতিহাস যেন একটা নতুন পর্যায়ের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এর আগেও এভাবে নতুন ও পুরাতন পর্যায়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের জন্ম দেওয়া একটা সন্ধিক্ষণ জাপানে এসেছিলো বইকি। সেটা হয়েছিলো, উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এদো(১৬০৩ – ১৮৬৭) যুগের অবসান হয়ে মেইজি যুগের সূচনা উপলক্ষে। মেইজি (১৮৬৮ – ১৯১২) ও তাইশো (১৯১২ – ১৯২৬), পরপর এই দু'টো যুগ ধরেই জাপানের সমাজ নূতন ও পুরাতনের দ্বন্দ্বে বিহ্বল হয়ে ছিলো। দ্বন্দ্ব ছিলো সমাজে মানুষে মানুষে সম্পর্ক নিয়ে, অভিব্যক্তির ফর্ম নিয়ে, স্থাপত্য নিয়ে, আর্ট নিয়ে, সংগীত নিয়ে, শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা ও অধিকারের কাঠামো নিয়ে, ইতিহাসবীক্ষার দর্শন নিয়ে, এবং তার সঙ্গে, জাপান বলেই, জীবনদর্শনে 'মৃত্যু'-র স্থান নিয়ে। একদিকে ঐতিহ্যগত প্রথা ও রুচি, তার বিপরীতেপশ্চিম থেকে বন্যার স্রোতের মতো করে এসে প্রবেশ করতে থাকা নতুন জীবনধারার হাতছানি ও একাংশের তাতে সাড়া দেওয়ার পরিণতি। বলে রাখি, সেবার এই নতুন পর্যায়টা শুরুর পিছনেও কিন্তু ছিল কমোডর পেরির নেতৃত্বাধীন মার্কিন নৌশক্তির কাছে সামরিক আত্মসমর্পণ।
মেইজি ও তাইশো যুগে নতুন ও পুরাতনের দ্বন্দ্ব যেসব সাহিত্যিকদের উপন্যাসে অভিনিবেশ সহকারে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো, তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য নাৎসুমে সোসেকি ও তানিজাকি জুনইচিরো। যথাক্রমে এঁদের কোকোরো ও সাসামেয়ুকি পড়লে সেই সময়ের বিপন্নতাটাকে অনুভব করার যায়। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যে দ্বন্দ্বের পরিস্থিতির জন্ম হলো সেই নিয়ে প্রামাণ্য উপন্যাস লিখেছেন কাওয়াবাতা ইয়াসুনারি (মেইজিন, ইয়ামা-নো-ওতো), মিশিমা নিজে,এবং অনেক পরে ইংরিজিতে লেখা হলেও, এই সময়ের বিশদ বর্ণনা ও বিশ্লেষণ আছে কাজুও ইশিগুরো-র 'অ্যান আর্টিস্ট অব দা ফ্লোটিং ওয়র্ল্ড' উপন্যাসে। পরিবর্তন যদি মেনে নিতেও হয়, একটা সভ্যতার পক্ষে কি স্বাভাবিক ও যুক্তিযুক্তভাবে রাতারাতি অন্য একটা চেহারা ধারণ করা সম্ভব—এই নিয়ে চমৎকার উপন্যাস লিখেছিলেন কোবো আবে। উপন্যাসের নাম, 'তানিন-নো-কাও'।
এই সবগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী উপন্যাসের মধ্যেও, এই একই বিষয়ের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েও, সবার ওপরে মাথা তুলে বিরাজ করছে 'স্বর্ণমন্দির' (কিংকাকুজি)। বাকি উপন্যাসগুলোতে আক্ষেপ ও আশঙ্কার সুরটিই শেষ বিচারেমূল সুর হয়ে দাঁড়ালেও, স্বর্ণমন্দির এক অমোঘ আশ্বাসবাণী, সভ্যতা ও ইতিহাস বিষয়ে অনেক গভীরতরপ্রজ্ঞার বার্তা বয়ে আনছে। সেইসময় যা ছিলো মূলত জাপানি জাতির উদ্দেশ্যে, আজ তা পৃথিবীর যে কোনো জাতি বা সভ্যতার অবলম্বন হয়ে উঠতে পারে। এটাই তো মহান সাহিত্যের মুখ্য শর্ত।
এই পরিস্থিতিতে প্রাথমিকভাবে যে দু'টো প্রশ্ন ওঠে, তারা হলো: সৌন্দর্যের সাধক একটা সভ্যতার ধারাকে অক্ষুন্ন রাখতে সৌন্দর্যের যে নিদর্শনগুলো শ্রেষ্ঠ কীর্তি হিসেবে অনুপ্রাণিত করে, সেগুলোকে সংরক্ষণ করতে পারা কতখানি জরুরি, আর দ্বিতীয়টি, সৌন্দর্যের সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্কটা কেমন?
দ্বিতীয় প্রশ্নের ক্ষেত্রে এই উপন্যাসের লেখক মিশিমার অবস্থানটা কী, কাহিনী থেকে সেটা বুঝতে অনেক পাঠকেরই তেমন অসুবিধা হয় না। কাহিনীতে দুটি অল্পবয়েসি মেয়ের কথা আছে। একজন উইকো, অপরূপা সুন্দরী, এবং সুন্দরের স্মৃতি হিসেবেই কেন্দ্রিয় চরিত্র তরুণ মিজোগুচির হৃদয়ে তার স্থান অটুট থাকে। অথচ এই উইকোর চরিত্রের একটা মূল দিক হলো, পরিণতি জেনেও সে বিশ্বাসঘাতকতা করে তার প্রেমিকের মৃত্যু ঘটিয়েছিলো। তবু নিষ্কলুষ সৌন্দর্যের স্মৃতি হয়েই সে রয়ে গেছে। ঐ ঘটনায় উইকোর নিজের মৃত্যু সম্বন্ধেএকসময় মিজোগুচির মনে হয়েছিলো, মৃত্যুও সম্ভবত উইকোর কাছে হেলাফেলার ব্যাপার ছিলো। কোংগো মন্দিরে, দু'টো সৌধের মধ্যে সংযোগকারী অলিন্দে ওর যে রক্ত পড়ে ছিলো, সেও যেন, সকালে জানালা খোলামাত্র উড়ে যেতে গিয়ে প্রজাপতি জানালার ধারে যে রেণু ফেলে রেখে যায়, সেই জিনিসই বলে মনে হয়।
আর অন্য যে সুন্দরী মেয়েটিকে প্রথমে মিজোগুচি দেখেছিলো একটা মন্দিরের ভেতরে, এক পবিত্র প্রেমের প্রতিমা হিসেবে, প্রেমিকের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতকারের সময় বিশ্বস্ততার অভিব্যক্তি হিসেবে যে প্রেমিকের চায়ের পেয়ালায় নিজের স্তন উন্মুক্ত করে ক'ফোঁটা দুধ ফেলেছিলো সেই চায়ে, সে কিন্তু সেই ভাবমূর্তি বজায় রাখতে পারেনি। ঘটনাক্রমে একসময় তার স্মৃতি হয়ে উঠলো কুৎসিত। এই বৈপরীত্যের ব্যাখ্যা একটাই: উইকোর মৃত্যু হয়েছিলো, অন্য মেয়েটি মৃত্যুবরণ করতে পারেনি।
জাপানি জীবনদর্শনে মৃত্যুর স্থান সারা পৃথিবীর মধ্যে স্বতন্ত্র। বহু লেখক, কবি, সাধক ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন মৃত্যুকে সুন্দর জ্ঞান করে। মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পারলে প্রকৃতির সৌন্দর্য যেভাবে উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয় মৃত্যুপথযাত্রীর চোখে, সেই নিয়ে আকুতাগাওয়া রিউনোসুকে (রাশোমোন খ্যাত) তাঁর মৃত্যুকালিন বিবৃতিতে লিখেছিলেন, একদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতি এই ভালোবাসা আবার অন্যদিকে আত্মহননের ইচ্ছা, এই বৈপরীত্যে তুমি হয়তো হাসবে। কিন্তু প্রকৃতির সৌন্দর্য আমার এই অন্তিম সময়ের দৃষ্টিতে এত অপরূপ লাগছে বলেই এরকম হচ্ছে।
কাওয়াবাতা ইয়াসুনারি, ১৯৬৮ সালে তাঁর নোবেল বক্তৃতায় আকুতাগাওয়া রিউনোসুকে এবং ওসামু দাজাইয়ের আত্মহননের উল্লেখ করে, তারপর বলেছিলেন, "আমার আরেক বন্ধু, অল্পবয়েসে মারা গিয়েছিলেন, জাপানের প্রথম সারির চিত্রকর একজন, ইনিও বহুবছর ধরে আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন, 'অন্তিম সময়ের দৃষ্টি' নামে লেখাটায় এঁর সম্বন্ধে লিখেছিলাম, 'মৃত্যুর চেয়ে বড়ো আর্ট আর হয় না, মৃত্যুই তো আসল বেঁচে থাকা, এসব কথা তাঁর মুখে লেগে থাকতো বলে শোনা যায়'। বৌদ্ধমন্দিরে জন্মেছিলেন, বৌদ্ধ শিক্ষায়তন থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করেছিলেন, মৃত্যু সম্বন্ধে এঁর দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমের মৃত্যুসম্পর্কিত চিন্তাধারার চেয়ে পৃথক ছিলো বলেই আমি ধরে নিয়েছি। সম্ভবত চিন্তাশীল মানুষমাত্রেই মৃত্যু নিয়ে ভাববেই, আমার বিবেচনায় সেরকমই আরেকজন হলেন, সেই যে সাধক ইক্কিয়ু জেনজি (১৩৯৪ – ১৪৮১), যিনি দু'বার আত্মহত্যার প্রচেষ্টা করেছিলেন বলে জানা যায়।"
পশ্চিমের সাহিত্য আলোচকরা আর এত কিছুর মধ্যে যান না, তারা 'মিশিমার মধ্যে মৃত্যু নিয়ে অবসেশন ছিলো' এটুকু বলেই ক্ষান্তি দিয়ে থাকেন। যথারীতি এর ঠিক আগেই উল্লেখ করা দু'টি মেয়ের স্মৃতির ক্ষেত্রে মৃত্যুর একটা চূড়ান্ত ভূমিকা আছে বলে লক্ষ্য করা গেল বইকি।
যে ছেলে দু'টোর সঙ্গে মিজোগুচির বন্ধুত্ব হলো, তাদের একজন হলো ৎসুরুকাওয়া, সুন্দর স্বভাবের ছেলে, যে তার চারপাশটাকে উজ্জ্বল রাখতে পটু, ফিল্মের নেগেটিভকে পজিটিভে রূপান্তরিত করার মতো করে তার স্বভাবের সৌন্দর্য পরিস্থিতিকে আমূল শুধরে দিতে পারে। আর, কী আশ্চর্য, মৃত্যুও তাই তাকেই আলিঙ্গণে টেনে নিলো সেই তরুণ বয়েসেই। অন্য বন্ধুটি কাশিওয়াগি, তার চেহারা কুৎসিত, না আচরণে, না চিন্তায় সে বস্তুকে ছাপিয়ে কিছু দেখতে রাজি। উপন্যাসে এক জায়গায় মিজোগুচির থেকে আমরা জানছি,... "সূক্ষ্মরুচি কি কেবল কল্পনাশক্তির মধ্যেই থাকে?" আমিও বেশ উজ্জীবিত হয়ে উঠে সেই কথায় যোগ দিই। "তুমি যে বাস্তবতার কথা বলো, সূক্ষ্মরুচির বাস্তবতাটা কী?"
"সে হচ্ছে", শ্যাওলায় ঢাকা সেই পাথরের স্মৃতিস্তম্ভের মাথায় হাতের তালু দিয়ে থপথপ করে চাপড়ে দিলো কাশিওয়াগি, "পাথর কিংবা হাড়, মানুষের মৃত্যুর পরে যে অজৈব অংশটুকু থেকে যায়।"
অথচ তার আগেই আমরা জেনে গেছি, কীভাবে নিজের বাবার কফিনে শোয়ানো অবস্থায়, ফুলের নিচে প্রায় চাপা পড়ে যাওয়া মুখ দেখে মিজোগুচি টের পেয়েছিলো, পদার্থের কোনো সুনির্দিষ্ট বাস্তবতা নেই, সবটাই যে দেখছে তার মানসিকতা সম্ভূত। জীবনের কোনোরকম অতিরিক্ত মাত্রার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে কাশিওয়াগি দিব্যি বেঁচে আছে। নিজের জীবনের ঘটনাগুলোকে পর্যন্ত সে অসুন্দর করে বলতে ভালবাসে, কোথাও সৌন্দর্যসৃষ্টির বিন্দুমাত্র তাগিদ তার নেই বলেই মনে হয়।
এই উপন্যাসের সবটা জুড়েই সুন্দর, উজ্জ্বল ও শুভ, এই তিনকে প্রায় সমার্থকের মতো করে ব্যবহার করা হয়েছে। আরেকটু গভীরে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেই বুঝতে পারব, যে এটা করা হয়েছে সৌন্দর্যের শর্তগুলোর ইঙ্গিত দিতে। কোনোকিছু তখনই সুন্দর যখন তা আলোর আভাস দেয়, এবং শুভ প্রেরণার উৎস হয়। শৈশবে অশুভ কিছুর সঙ্গে মর্মান্তিকভাবে পরিচিত হওয়ার পরে অবচেতনে সৌন্দর্যতৃষ্ণা আকুল করে তুলতো মিজোগুচিকে। স্বর্ণমন্দির দেখে তার মনে হয়েছিলো, এই সেই স্বয়ম্ভূ সৌন্দর্য যার আশ্রয় চিরপ্রার্থিত হয়ে থেকে যাবে। কিন্তু সৌন্দর্য জিনিসটা যে নিজের অস্তিত্ব নিরপেক্ষভাবেই সম্ভব, এই চিন্তা মিজোগুচিকে অপ্রসন্ন ও উৎকণ্ঠিত করে তুলতো। সে বলছে,
আমার বাবা ছিলেন পাড়াগাঁর সহজ সরল পুরোহিত, বাকপটুত্ব বিশেষ ছিলো না, আমাকে কেবল এটুকু বলতে পেরেছিলেন, "স্বর্ণমন্দিরের মতো সুন্দর কিছু এ জগতে আর নেই"। আমি জানার আগেই সৌন্দর্য বলে জিনিসটার পৃথিবীতে অস্তিত্ব ছিলো, এহেন চিন্তা অবধারিতভাবে আমার মধ্যে অতৃপ্তি ও অপ্রসন্নতার জন্ম দিত। যদি এমন হয় যে সৌন্দর্যের অস্তিত্ব নির্ঘাত ছিলো, তাহলে আমি নামক জিনিসটির অস্তিত্ব সৌন্দর্যের থেকে বিচ্ছিন্ন বলে জ্ঞান করতে হবে।
কিন্তু মিজোগুচিকে তো চির-আশ্রয় পেতে হবে সৌন্দর্যের কাছে, যা অশুভ, সেহেতু অসুন্দর, তার থেকে পালিয়েই না সে এসেছে স্বর্ণমন্দিরের কাছে! একদিন সে কাশিওয়াগি ও দুটি মেয়ের সঙ্গে গেল কামেয়ামা পার্কে প্রমোদ সফরে। সেখানে সেই বোর্ডিং-হাউসের মেয়েটির শরীর স্পর্শ করতে গিয়ে দেখলো ছোটখাটো আকর্ষণ তার কাছে কোনো আবেদন রাখে না, স্বর্ণমন্দিরের সর্বগ্রাসী বিপুল সৌন্দর্য এসে পথরোধ করে দাঁড়ায়, তার আর জীবনের আকাঙ্খার মাঝখানে। সে ঠিক করলো তাহলে সে অশুভের মাধ্যমে, অসুন্দরের মাধ্যমেই না হয় জীবনে প্রবেশ করবে। সেই থেকে মাঝেমাঝেই কাহিনীতে আমরা দেখি যে সে বুঝে ওঠার চেষ্টা করছে, অবিমিশ্র সৌন্দর্য যেমন সম্ভব, সেভাবেই নেহাত 'অশুভ বলেও কিছু হওয়া কি সম্ভব?'
এভাবেই কাহিনীতে আনা হয় আরেকটি দ্বিত্ব: সুন্দর ও অসুন্দর, বা শুভ ও অশুভ। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, সুন্দর ও অসুন্দর কি পরস্পরের থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন, সংযোগ ও সহাবস্থানহীন? কাশিওয়াগি একবার বসন্তের এক মনোরম বিকেলে, নিরুদ্বেগ অবসরে মাঠের মধ্যে বসে মিজোগুচিকে বলেছিলো, "... আমরা যে হঠাৎ করেই নির্মম হয়ে উঠি, এই যেমন এখনকার মতোই এক ঝলমলে বসন্তের অপরাহ্নে, সুন্দর করে ছাঁটা লনের ওপরে, গাছের পাতার ফাঁক গলে আসা সূর্যের আলোর খেলা অলসভাবে দেখতে থাকার মতোই কোন মুহূর্তে সেটা ঘটে যায় বলে মনে হয় না?" আরেকবার খুব সকালে তুষারাবৃত স্বর্ণমন্দিরের অপরূপ মহিমার একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে অকুপেশন আর্মির এক মার্কিন সৈনিকের মনে কী করে যেন জেগে ওঠে অদ্ভুত নিষ্ঠুরতা। সে দুর্বল, ভীত কিশোর মিজোগুচিকে বাধ্য করে তার অন্তঃসত্ত্বা সঙ্গিনীর পেটের ওপর পা দিয়ে মাড়িয়ে যেতে। প্রাণচঞ্চল, উজ্জ্বল আলোকিত রাজপথে, চারদিকে খুশির, উপভোগ্যতার আবহে একটা অন্ধ কুকুরকে একদিন চোখে পড়েছিলো মিজোগুচির। ওর মনে হয়েছিলো, "এই উজ্জ্বল বাণিজ্যকেন্দ্রের দোকানপাটের থেকে একেবারে ভিন্ন কোনো জগতকে কুকুরটা নাছোড়বান্দা হয়ে নিজের ভেতরে আগলে নিয়ে চলছিলো... কুকুরটা হাঁটছিলো কেবলমাত্র ঘ্রাণশক্তির একটা অন্ধকার জগতে, সেটা মানুষজনের এই শহরের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে, এই বিজলির আলো, রেকর্ডের গান, হাসির আওয়াজগুলোই বরং ওই জেদি অন্ধকার গন্ধের জন্য বিপন্ন হয়ে পড়ছিলো। কেননা এই ঘ্রাণতন্ত্র অনেক বেশি অভ্রান্ত, কুকুরটার পায়ের নিচের সিক্ততায় যে প্রস্রাবের গন্ধ, সেটা মানুষের ভেতরের নাড়িভুঁড়ি আর অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের থেকে নির্গত মৃদু দুর্গন্ধের সঙ্গে অভ্রান্তভাবে যুক্ত হয়ে যাচ্ছিলো।"
অপরদিকে কুৎসিত কাশিওয়াগির মধ্যেও একটা দিক ছিলো, যা সুন্দর। এক চন্দ্রালোকিত রাতে স্বর্ণমন্দিরে বাঁশি বাজিয়ে সেই দিকটার সঙ্গে সে পরিচয় করিয়ে দিলো মিজোগুচির। কাশিওয়াগির সৌন্দর্য চেতনাতেও আমরা দেখছি ক্ষণস্থায়িত্বের শর্ত অটুট:
কাশিওয়াগিকে গভীরভাবে জানার সূত্রে বুঝতে পেরেছিলাম, দীর্ঘস্থায়ী সৌন্দর্য ওর একেবারেই পছন্দ হতো না। তখন তখনই সমাপ্ত হওয়া সংগীত, কয়েকদিনের মধ্যে শুকিয়ে যাওয়া ইকেবানা (পুষ্পসজ্জা), ওর পছন্দ সীমাবদ্ধ ছিলো এগুলোতেই, স্থাপত্য কিংবা সাহিত্য, এসব ওর বাজে লাগতো। ... ফড়িঙের মতো ক্ষণস্থায়ী জীবনকালের প্রাণীদের মতোই সেই সৌন্দর্য জিনিসটা, জীবনের মতোই একেবারে বিমূর্ত, জীবনেরই সৃষ্ট। জীবনের সঙ্গে সংগীতের যতটা সাদৃশ্য, ততটা আর কিছুর সঙ্গে নয়, একইরকম সুন্দর হলেও, স্বর্ণমন্দিরের মতো জীবনের থেকে এতটা দূরে সরে থাকা, জীবনকে দৃশ্যতই তাচ্ছিল্য করা সৌন্দর্যও আর নেই।
স্বর্ণমন্দির সুন্দর, কিন্তু জীবন থেকে অনেক দূরে সরে থাকা, কেননা বহুযুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও তার বিনাশ নেই। এই স্থায়িত্ব কি তাহলে কোনোভাবে জীবনের সৃষ্ট সৌন্দর্যের পরিপন্থী? মিজোগুচির বয়ানে মিশিমা লিখছেন,
... যেমন ধরা যাক, গৃহস্থালীর কাজে সুবিধার জন্য ছুতোরের তৈরি করা একটা ড্রয়ার, কালপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে সময় ওই জিনিসটার অবয়বকে ছাপিয়ে গিয়ে, বহু দশক, বহু শতক পরে, উলটে সময়ই যেন জমাট বেঁধে ওই জিনিসটার অবয়ব ধারণ করে। শূন্যে একটা ছোট্ট পরিসর, প্রথমে বস্তু এসে জায়গাটা অধিকার করে রেখেছিলো, কিন্তু একসময় জমে যাওয়া সময়ের দ্বারা ওটি অধিকৃত হয়ে যায়। কোনোপ্রকার আত্মার দেহ ধারণ করে। মধ্যযুগের একটা রূপকথা, 'ৎসুকুমোগামি-কি', তার শুরুতেই লেখা আছে:
"মহাজাগতিক দ্বৈতশক্তি য়িন্ ও য়িয়াং বিষয়ক বিবিধ কথা থেকে জানা যায়, বস্তু শতবর্ষ অতিক্রম করে পরিবর্তিত হয়েআত্মা অর্জন করে, এবং লোকের মনকে বিভ্রান্ত করে, একে বলা হয় ৎসুকুমোগামি। এই কারণেই রীতি আছে, প্রত্যেক বছর লোকে বসন্তোদগমের ঠিক আগেটায় বাড়ির পুরনো বাসনপত্র বাতিল করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসার অপেক্ষায় থাকে, একে বলে বাড়ি পরিষ্কার করা। সেই অনুযায়ী, একশো বছর পরে পরে বছর না ঘুরতেই ৎসুকুমোগামি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়।"
বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হার হলো, সম্রাট মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণের কথা ঘোষণা করলেন, পুরো জাতি শোকে বিহ্বল হয়ে গেল এই পরিণতিতে। সেদিন সন্ধ্যায় মন্দিরের মঠাধ্যক্ষ সবাইকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে একটি জেন প্রশ্ন, অর্থাৎ কো-আন, মুমোনকান-এর যেটি চতুর্দশ ধারা, পাঠ করে শোনালেন। একটি সাংকেতিক কাহিনী, সেটির নাম: 'নানসেন বেড়াল কাটলো'। এক শান্ত পাহাড়ি মন্দিরের অধ্যক্ষ ছিলেন পুরোহিত নানসেন। সেই মন্দিরের দুই শিবিরের মানুষের মধ্যে তীব্র বচসা হয়েছিলো একটি সুন্দর বেড়ালছানাকে কা'রা পুষবে, সেই নিয়ে। পুরোহিত নানসেন বেড়ালছানাটার গলাটা চেপে ধরে, ঘাস কাটার কাস্তে বাগিয়ে ধরে বললেন, "সবাই যাতে রাজি এরকম একটা সমাধান পেলাম তো বেঁচে গেল, না পেলে কিন্তু কেটে ফেলব"। কারুর থেকে কোন উত্তর এলো না। পুরোহিত নানসেন বেড়ালটাকে কেটে, ফেলে দিলেন। সেই সন্ধ্যেয় কেউই অনেক ভেবেও কিনারা করতে পারলো না, এই কাহিনী কেন আজকের দিনে বিবৃত করলেন মঠাধ্যক্ষ।
পরে কাশিওয়াগি মিজোগুচিকে বলেছিলো:
... তোমার এত কাঙ্খিত যে নান্দনিকতা, সেটি উপলব্ধির দ্বারা সুরক্ষিত থেকে নিদ্রায় যেতে আকুল বলে কি মনে হয় না তোমার? সেই যে একবার 'নানসেনের বেড়াল মারা' নিয়ে কথা হয়েছিলো, এ তো সেই বেড়ালটা। অতুলনীয় সৌন্দর্য সেই বেড়ালটার। উভয় মহলের পুরোহিতরাই ঝগড়া করেছিলো, নিজেদের উপলব্ধির মধ্যে বেড়ালটাকে আশ্রয় দিয়ে, প্রতিপালন করে, আরামের মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে রাখবে বলে। আর তখন পুরোহিত নানসেন, ক্রিয়াশীল ব্যক্তি, চমৎকারভাবে বেড়ালটাকে কেটে ফেলে দিয়েছিলেন ...... সৌন্দর্য হছে এমনই জিনিস যা উপলব্ধির মাধ্যমে সুরক্ষিত থেকে নিদ্রা যায় ...... যা কিছু নান্দনিক, তোমার পছন্দের নান্দনিক জিনিস, সেটা মানুষের অন্তরের উপলব্ধির মধ্যে গচ্ছিত রাখা একটা অংশমাত্র, বাকিটুকুর মায়া।
নানা স্থাপত্যের অপরূপ সম্ভারে সমৃদ্ধ নগরী কিয়োতো অক্ষত রইলো, যুদ্ধেধ্বংস হলো না। কিন্তু সেই সৌন্দর্য অন্তরে পালন করার দৃঢ়তা হারিয়ে সমাজ ডুবতে থাকলো অস্থিরতার, নীতিহীনতার অন্ধকারে। বস্তুকে টিঁকিয়ে রাখা নয়, উপলব্ধিকে টিঁকিয়ে রাখাই সভ্যতার চরিত্রলক্ষণকে সুরক্ষিত রাখে, ধ্বংস হয়ে যেতে দেয় না। বরং চলিষ্ণুতা ও মৃত্যুর সঙ্গেই সৌন্দর্যের গাঁটছড়া অনেক দৃঢ়। স্বর্ণমন্দিরকে প্রথম দেখে মিজোগুচি যে মুগ্ধ হয়েছিলো, তার ভিত্তিতেও ছিলো সময়ের সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে এই সৌধের এগিয়ে যাওয়ার কল্পনা। সে এই চলিষ্ণুতার বর্ণনা দিয়েছিলো এইভাবে:
ছাদের চূড়োয় ... সেই স্বর্ণ-তাম্র ফিনিক্সের কথা আমি ভাবতাম ... এটি ওড়ে না বলে দেখে মনে হলে, ভুল হবে। অন্য পাখিরা শূন্যে ওড়ে, কিন্তু এই সোনালি ফিনিক্স তার ঝলমলে পাখনা মেলে দিয়ে অনন্তকাল সময়ের মধ্য দিয়ে উড়ে চলেছে। সময় এসে ওই পাখায় আছড়ে পড়ে, পিছন দিকে বয়ে চলে যায়। ...
সেভাবে ভাবলে, খোদ স্বর্ণমন্দিরটাকেই সময়ের সমুদ্র পেরিয়ে আসা একটা সুন্দর জাহাজ বলে আমার মনে হয় ... এই বহুমাত্রিক ত্রিতল হাউসবোটের সামনের পুষ্করিণীটিকে সমুদ্রের প্রতীক বলেই ভেবে নেওয়া যায়। অজস্র রাত্রি পার করে এসেছে এই স্বর্ণমন্দির। এক অনির্দিষ্ট সমুদ্রযাত্রা, কবে শেষ হবে জানা যায় না।
গ্রিক সভ্যতার মিথে ফিনিক্স পাখি কিসের দ্যোতক, আরেকবার মনে করিয়ে দিই। মৃত্যুতে ছাই হয়ে গিয়েও শেষ হয়ে যায় না এই পাখি, আবার সেই ছাই থেকেই নবজীবন পেয়ে ফের উড়ে যায়।
উপন্যাসের একেবারে অন্তিম অংশে গিয়ে স্বর্ণমন্দিরের স্থাপত্যশৈলি বিশ্লেষণ করে তার সৌন্দর্যের ব্যাখ্যাতীত রহস্য উন্মোচন করতে করতে মিজোগুচির মনে হয়,... সেইসব খুঁটিনাটি সৌন্দর্য, ওই থামগুলো, ওই রেলিং, ওই ঝাঁপ ফেলা দরজা, ওই কাঠের পাতের দরজা, ওই কাতোও শৈলির জানালা, ওই পিরামিডাকৃতি ঢালু ছাঁদ, ... ওই হোসুই-ইন, ওই চোওনদো, ওই কুকিয়োচো, ওই সোসেই, ... পুকুরে এসে পড়া ওই ছায়া, ওই ছোটো ছোটো দ্বীপ, ওই পাইনগাছ, ওই নৌকো বাঁধার ঘাট অবধি খুঁটিনাটির সৌন্দর্য খুঁটিয়ে দেখলে, সৌন্দর্য মোটেই খুঁটিনাটিতেই সমাপ্ত হয়ে, খুঁটিনাটির ভিত্তিতে উপসংহার টানার মতো নয়, যেকোনো একটা অংশেই পরেরটার সৌন্দর্যের ইঙ্গিত ধারণ করা আছে। খুঁটিনাটির সৌন্দর্য, তার নিজের মধ্যে অস্থিরতায় পরিপূর্ণ। সম্পূর্ণতার স্বপ্ন দেখতে দেখতে, পরিণতি না পেয়ে, পরবর্তী সৌন্দর্যের, তখনো অজানা সৌন্দর্যের প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে থাকছিল। আর ইঙ্গিতের পর ইঙ্গিত যুক্ত হয়ে, অস্তিত্বই নেই এমন সৌন্দর্যের আলাদা আলাদা নানা আভাস তৈরি হয়ে, সেটাই যেন স্বর্ণমন্দিরের অন্তর্লীন মোটিফ হয়ে উঠেছিলো বলে বলা যায়।
এই যে অন্তহীনতার শর্ত, কখনোই সম্পূর্ণতায় উপনীত হতে না পারার শর্ত, এটাই ছিলো সেই নান্দনিকতার অন্তর্নিহিত দর্শন। এর আগেই মিশিমা একবার আরো বিস্তৃত তাৎপর্যের বয়ানে ধর্মগ্রন্থ রিনজাইরোকু থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে রেখেছেন। সেখানেও অভ্রান্তভাবে সেই একই বার্তা—চূড়ান্ত বলে কিছু নেই, অন্তিম বলে কিছু নেই।
(কাশিওয়াগি) হঠাৎই বলে উঠলো,
"রিনজাইরোকু-র নির্দেশাবলীপরিচ্ছেদের সেই বিখ্যাত কথাগুলো তুমি জান? 'বুদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাত হলে বুদ্ধকে হত্যা কোরো, সর্বোচ্চ পিতৃপুরুষের সঙ্গে সাক্ষাত হলে সর্বোচ্চ পিতৃপুরুষকে হত্যা কোরো, ..."
আমি এর পরেরটুকু বলে চললাম।
"সিদ্ধিপ্রাপ্ত সাধকের সঙ্গে সাক্ষাত হলে সিদ্ধিপ্রাপ্ত সাধককে হত্যা কোরো ... সর্বপ্রথম নির্বাণলাভ হবে।"
আশ্চর্য, রিনজাইরোকু-র এই কথাগুলো কাওয়াবাতাও তাঁর নোবেল বক্তৃতাতে উদ্ধৃত করেছেন। কোনোভাবেই, পথশেষ হয়ে গেছে ভেবে চিন্তায়, কল্পনায়, অনুভবে নিজেদের একটা গণ্ডির মধ্যে আটকে রেখে যাত্রায় ইতি টানা চলবে না। মিজোগুচি গিয়েছিলো অর্থের বিনিময়ে নারীসঙ্গ করতে কিয়োতো শহরে। সেখানে নিজের চেয়ে বয়েসে একটু বড়ো একটি মেয়ে মারিকোর সঙ্গে তার পরিচয় হলো। শারীরিক উপভোগ্যতার পরে, ক্ষণিকের অসাবধানতায় মিজোগুচি যখন তাকে বলে বসে যে কিছুদিনের মধ্যে এমন কিছু ঘটতে পারে যাতে খবরের কাগজে হয়তো মিজোগুচির কথা বড়ো করে বেরোবে, মারিকো কিছুতেই সেকথা বিশ্বাস না করে, রসিকতা ভেবে শরীর কাঁপিয়ে হাসতে থাকে।
মারিকোর বিশ্বাস হয়নি। চোখের সামনে ভূমিকম্প হলেও, নির্ঘাত ওর বিশ্বাস হতো না। জগত ধ্বংস হয়ে গেলেও, কেবল এই মেয়েটা হয়তো টিঁকে থাকবে। কেননা, তার চিন্তার সঙ্গে যুক্তিতে মেলে, কেবল এরকম ব্যাপারই মারিকো বিশ্বাস করে... স্তন তখনো অনাবৃত, এই অবস্থায়মারিকো গুনগুন করে গাইতে শুরু করলো। করতে করতেই, সেই গুনগুনানি একটা মাছির ডানার আওয়াজের সঙ্গে মিশে গেলো। মাছিটা মারিকোর আশেপাশে উড়ে বেড়াচ্ছিলো, হঠাৎ করে মারিকোর স্তনে এসে বসাতেও, ও কেবল বললো, "সুড়সুড়ি লাগছে তো"। কিন্তু তাড়িয়ে দিলো না। স্তনের ওপরে বসা অবস্থায়, মাছিটা একেবারে সেঁটে বসেছিলো স্তনের সঙ্গে...
মাছি নাকি পচা জিনিস পছন্দ করে, তবে কি মারিকোর মধ্যে পচন শুরু হয়েছে? কিছুই বিশ্বাস না করা কি তবে পচন? একেবারে নিজস্ব একটা জগতে ও বাস করে বলেই কি মাছিটা মারিকোর কাছে এলো?
সময়ের সঙ্গে আসা অজানার প্রতি এই যে প্রতিরোধ, মনের দরজা বন্ধ রাখা, এটাই সভ্যতার প্রকৃত সংকটের উৎস হয়ে উঠতে পারে। জাপানি সভ্যতায় পচন ধরতে পারে। সভ্যতাকে প্রাণবন্ত, সজীব রাখার শর্ত হচ্ছে দ্বার অবারিত রেখে গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকা— এই কথাটা আরো এক জায়গায়, আরো স্পষ্ট করে উচ্চারণ করে রাখলেন মিশিমা, এরপরেই একটা পরিস্থিতির বিবরণ দিতে গিয়ে।
গতরাতের বৃষ্টিতে গাছপালা সব ভেজা। ঝোপঝাড়ের পাতার ডগায় প্রভূত পরিমাণ শিশিরে সূর্যোদয়ের আলোর রেশ প্রতিফলিত হয়ে, অসময়ে যেন ছোটো ছোটো গোলাপি ফল ধরেছে। শিশিরের ফোঁটাগুলোর মধ্যে সংযোগসাধন করা মাকড়সার জাল থেকেও আবছা লালের আভাস, জালগুলো কাঁপছিলো।
ধরাপৃষ্ঠের প্রকৃতি ও বস্তু যে এতটা সংবেদী হয়ে উর্দ্ধলোকের রঙকে ধারণ করে আছে, আমি একপ্রকার মুগ্ধতা নিয়ে তা প্রত্যক্ষ করলাম। বৃষ্টির আর্দ্রতা যে মন্দিরের ভেতরের উদ্ভিজ্জকে ছেয়ে আছে, সেও সবটাই উর্দ্ধলোক থেকে পাওয়া। দাক্ষিণ্য গ্রহণ করার মতো করেই যেন এরা সব ভিজে একশা হয়ে, পচন ও সতেজতা মিলেমিশে এক ঘ্রাণ বিকীর্ণ হচ্ছে, সেও কীভাবে প্রত্যাখ্যান করতে হয় এরা জানে না বলে।
এই অবারিত দ্বার গ্রহণই যে নৃতাত্ত্বিক বিবেচনায় জাপানি সভ্যতার ভিত্তি, সেকথা নৃতাত্ত্বিক ক্লদ লেভি-স্ট্রাউস লিখেছিলেন তাঁর একটা প্রবন্ধে। লিখেছিলেন:
Vis-à-vis the East and the West, therefore, Japanese culture occupies a unique place. In a distant past, Japan received a great deal from Asia. It received a great deal from Europe in a more recent past, and even more recently, from the United States. But all these borrowings were so carefully filtered, their finer substance so well assimilated that, up to now, Japanese culture has not lost its specificity. Nevertheless, Asia, Europe, and America can find in Japan images of themselves profoundly transformed. Today in fact, Japanese culture offers the East the model of social health and the West that of a mental hygiene, whose lessons it behooves those countries, borrowers in turn, to take to heart.
ইতিহাসের ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে, সময়ের সঙ্গে এই অন্তহীন চলিষ্ণুতা, নতুনকে গ্রহণ করতে করতে, এ আমাদের বাংলাভাষীদের কাছে অশ্রুতপূর্ব কোনো ধারণা নয়। আমরা রবীন্দ্রনাথের বলাকা কাব্যগ্রন্থ পড়েছি। আমাদের গদ্য সাহিত্যও পথের কাছে আশ্রয় খুঁজে নেওয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বইকি।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন – মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে, ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়ের বটতলায় কি ধলচিতের খেয়াঘাটের সীমানায়। তোমাদের সোনাডাঙা মাঠ ছাড়িয়ে, ইছামতি পার হয়ে, পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিলের পাশ কাটিয়ে, বেত্রবতীর খেয়ায় পাড়ি দিয়ে, পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে ... দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সূর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে, জানার গণ্ডি এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশে ...দিনরাত্রি পার হয়ে, জন্ম মরণ পার হয়ে, মাস, বর্ষ, মন্বন্তর, মহাযুগ পার হয়ে চলে যায় ... তোমাদের মর্মর জীবন-স্বপ্ন শ্যাওলা-ছাতার দলে ভরে আসে, পথ আমার তখনো ফুরোয় না ... চলে ... চলে ... চলে ... এগিয়েই চলে ...অনির্বাণ তার বীণা শোনে শুধু অনন্তকাল আর অনন্ত আকাশ ... সে পথের বিচিত্র আনন্দ-যাত্রার অদৃশ্য তিলক তোমার ললাটে পরিয়েই তো তোমায় ঘরছাড়া করে এনেছি! ...চল এগিয়ে যাই।
বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালি ছাপা হয়েছিলো ১৯২৯ সালে। মিশিমা ইউকিও-র কিংকাকুজি ১৯৫৬-তে।