ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রথম ফুটবলার!
১২ই জানুয়ারি, ১৯৯১। লিভারপুলের ড্রেসিংরুমে ফুটবল খেলোয়াড় জিমি কার্টারের হাতে সাত নম্বর লেখা নতুন শার্ট তুলে দেন ম্যানেজার কেনি ডালগ্লিশ। আয়ান কীগান, ক্যালাঘানসহ এনফিল্ড হার্টসে থাকা কাছের সবার সাথে আনন্দের এই সময়কে ভাগাভাগি করে নেন মাত্র দুই দিন আগেই ইংলিশ চ্যাম্পিয়নের সাথে চুক্তি সম্পন্ন করা কার্টার। মাত্র ২৫ বছর বয়সেই উইঙ্গার হিসেবে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি।
লিভারপুলের ড্রেসিং রুমে সেদিন নিজের সাত সংখ্যার নতুন শার্ট নিয়ে দারুণ সময় কাটছিলো খেলোয়াড়ের। কে জানতো তখন যে, একদিন এই জার্সিই ক্লাবের ইতিহাসে নিজের জায়গা করে নেবে? তবে জার্সির ভবিষ্যৎ ছাড়াও আরো একটি ব্যাপার জানতো না অনেকেই। আর সেটি হলো জিমি কার্টারের ভারতীয় বংশোদ্ভূত হওয়ার গল্প।
"এটা সম্ভবত আমার জীবনের অন্যতম সেরা মুহুর্ত ছিলো, যেটার স্বপ্ন আমি ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি" নিজের আনন্দোচ্ছ্বাস এভাবেই ব্যক্ত করেছিলেন জিমি। লিভারপুলের ড্রেসিংরুমে তখন সবাই আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় উপস্থিত। তাদের গায়ে জিমি কার্টারের নতুন শার্ট। একই শার্ট জিমির হাতেও। নিজের হাতের শার্টের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন সেসময় জিমি।
"কেনি মাত্রই এসে স্টক নিউইংটনে বেড়ে ওঠা আমার মতো দুবলা-পাতলা ছেলেটার হাতে ৭ নম্বর লেখা শার্ট তুলে দিয়েছে, এটাই ভাবছিলাম শুধু। এর চাইতে ভালো কিছু হতেই পারতো না। অবিশ্বাস্য!" বলেন জিমি।
তবে কপালে আরো কিছু ওঠানামা ছিলো এই খেলোয়াড়ের। ডালগ্লিশের পর লিভারপুলে আসেন গ্র্যামে সোনেস। এসেই জিমি কার্টারকে পেছনের তাকে সরিয়ে দেন এই ম্যানেজার। তবে হার মানেননি জিমি। আর্সেনালে খেলতে শুরু করেন তিনি। সাথে আগস্ট, ১৯৯২-এ গানার্সে যোগ দিয়ে প্রিমিয়ার লিগে খেলা প্রথম ব্রিটিশ এশিয়ান হিসেবে সবার সামনে উঠে আসেন। খেলোয়াড়ের এই রেকর্ড পরবর্তী ১১ বছরে আর কেউ ভাঙতে পারেনি।
তবে জীবনের এতোটা পথ আর খেলার এতোটা মাঠ পাড়ি দেওয়ার পরেও ৫৫ বছর বয়সী জিমি কার্টার আজও পেছন ফিরে তাকালে সবার অবাক হওয়া চেহারাটাকেই দেখতে পান। গায়ের রঙ আর নামের কারণে কেউ কখনো আন্দাজই করতে পারেনি যে জিমি কার্টার একজন ভারতীয়!
জিমি কার্টার তার কার্টার পদবী পেয়েছিলেন ১৭ শতকে ভারতে পাড়ি দেওয়া কার্টার নামক এক ব্যক্তির কাছ থেকে। ভারতে এসে ভালোবেসে ভারতীয় এক নারীকে বিয়ে করেছিলেন সেই ব্যক্তি। ফলে নামটা মিশে গিয়েছিলো বংশের সাথে। বাবা মরিস কার্টার মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবা-মাকে হারানোর পর ১৬ বছর বয়সে ভারতীয় নেভি-তে যোগ দেন। কানপুরে জন্ম নিয়ে উত্তর ভারতের লখনৌ-তে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। মরিস যে শুধু সমুদ্রকেই ভালোবাসতেন তা নয়, একইসাথে বক্সিং করতেও আনন্দ পেতেন।
"নেভিতে বক্সার ছিলেন তিনি এবং সেখানকার সবসময়ের সেরা বক্সারদের একজন হিসেবে তাকে জানে সবাই। নিজের ৩৮টি বক্সিং ম্যাচের মধ্যে একটিতেও হারেননি তিনি।" বাবাকে নিয়ে গর্বের সাথে বলেন জিমি। মরিসের এই পথচলা তাকে নিয়ে যায় ইংল্যান্ডে। সেখানে এক ব্রিটিশ নারীকে বিয়ে করেন এই নেভি। তবে দুই সন্তান জন্মের পর বিচ্ছেদ হয়ে যায় জিমির বাবা-মায়ের। কাস্টডি নিয়ে ছেলেদের পূর্ব লন্ডনের হ্যাকনিতে নিয়ে আসেন মরিস।
"আমাদের মা ইংরেজ ছিলেন বটে, তবে মাংস কিনতে না পারলে আমরা ঘরে ভাত-তরকারিই খেতাম। মাংস না থাকলে বাবা ডালের ঝোলের মধ্যে সেদ্ধ ডিম দিয়ে দিতেন, আর আমরা সেটা ভাত দিয়ে খেয়ে নিতাম। আমাদের বড় হওয়াটা এমনি ছিলো।" বলেন জিমি।
বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে চাকরির সুযোগ এসেছিলো বাবা মরিসের কাছে। তবে সন্তানদের জন্য সেসব পায়ে ঠেলেছিলেন তিনি। সকাল থেকে বিকাল, বিকাল থেকে রাত, ছেলেদের নিয়েই কেটে যেতো বাবা মরিস কার্টারের জীবন।
তবে আর্থিক সমস্যাই সবটুকু ছিলো না। ৭০ আর ৮০-র দশকে ভারতীয় হওয়ার জন্য প্রচুর লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে যেতে হয় কার্টার ভাইদের। বলিউডে পথের মানুষ থেকে ধনী হয়ে যাওয়ার যে গল্পগুলো দেখানো হয়, জিমির জীবনের সেটাই ছিলো সত্যি।
ভোর ছয়টার সময় বাবা জিমিকে বাইরে পাঠাতেন, পার্কের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় "ফুটবলার হওয়ার জন্য অনুশীলন করতে থাকা" শিশুদের কাছ থেকে বা অন্য কোনভাবে কোন খাবারের ব্যবস্থা করা যায় কিনা তা দেখতে। ফিরে আসার সময় কারো ঘরের সামনে দুধের কৌটা পড়ে থাকলে সেটাও তুলে আনতেন জিমি। বাবা মরিসের ছিলো জুয়ার নেশা। ছেলেদের খেলাধুলো করতে মানা করতেন বাবা। কারণ খেললে ক্ষুধা বেড়ে যায়। আর ক্ষুধা মেটানোর জন্য যে টাকা ছিলো সেটা ইতিমধ্যেই বাবা জুয়ায় ঘোড়ার পেছনে খরচ করে ফেলেছেন। তবে সবসময় যে টাকা শুধু খরচ হতো তা নয়। বাবা জুয়ায় জিতেও যেতেন কখনো কখনো। সেদিন ভালো তরকারি আর ভারতীয় মিষ্টি খেতে পেতেন জিমি আর তাই ভাই।
এভাবেই জীবন চলে যাচ্ছিলো। তবে একটু আশার আলো হয়ে এতকিছুর ভেতর থেকেও ১৪ বছর বয়সে জিমি জায়গা করে নেন ফুটবল টিমে। ক্রিস্টাল প্যালেস তাকে বেছে নেয় দলে।
"কেউ আমাকে বাজে কিছু বললে আমি চেষ্টা করতাম খেলার মাঠে তাকে খেলার মাধ্যমে প্রমাণ করে দিতে যে, তার ধারণা ভুল। আমি তাকে খেলার মাঠে হারিয়ে দিতাম। এটাই ছিলো আমার উত্তর"। বলেন জিমি। তবে এসব কোনকিছুই বাড়িতে বাবাকে বলতেন না জিমি। কারণ, গায়ের চামড়ার কারণে এমনটা হচ্ছে আমার সাথে সেটা ভেবে বাবা কষ্ট পেতেন। আর আমি কোনভাবেই বাবাকে কষ্ট দিতে চাইতাম না।
ক্রিস্টাল প্যালেস ১৯ বছর বয়সে জিমিকে মাঠে নামায়। মিলওয়ালের আগে কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সে খেলতেন তিনি। ২২ বছর বয়সে টেডি শেরিংহাম ও টনি ক্যাসকারিনোর সাথে লায়নে খেলার সুযোগ পান জিমি। তবে খুব কাছের মানুষ বাদে তখনো কেউই জিমির এশিয়ান হওয়ার কথা জানতো না।
"তখন আমি মিটওয়ালে দ্বিতীয় সুযোগ পেয়েছি। সেসময় ফুটবল এখনকার চাইতে অনেক আলাদা ছিলো। আর যেহেতু ব্যাপারটা খেলার ছিলো, তাই আমি আমার ভারতীয় বংশোদ্ভূত হওয়ার কথা বলার দরকার মনে করিনি।" জানান জিমি।
তবে এতকিছুর পরেও জিমিকে নানারকম বর্ণবিদ্বেষ সহ্য করতে হয়েছিলো। তবে বর্ণবিদ্বেষের কথাগুলো তাকে খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে আরো ভালো কিছু করতে সাহায্য করেছিলো বলেই মনে করেন জিমি।
জিমি কার্টারের পরেও ব্রিটিশ এশিয়ান হিসেবে প্রিমিয়ার লীগে খেলেছেন মাইকেল চোপরা (২০০৩) এবং জেশ রহমান (২০০৪)। তবে তাদের সবার পথিকৃৎ ছিলেন জিমি কার্টার।
বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ৪,০০০ পেশাদার ফুটবলার মধ্যে ১০ জন ব্রিটিশ এশিয়ান। একদম শূন্য থেকে এই পর্যন্ত ব্রিটিশ এশিয়ান ব্যাপারটিকে নিয়ে আসার পেছনে জিমি কার্টারের কি অবদান আছে? অবশ্যই!
তবে এখনো কৃষ্ণকায় ফুটবলারেরা ঠাণ্ডা পছন্দ করে না, এশিয়ান ফুটবলারেরা হালকা হয়- এমন অনেক কথা খেলার মাঠে চলে বলে জানান জিমি কার্টার। তবে পেছনে ফিরে তাকালে নিজের ভারতীয় পরিচয়কে আরো কেন সামনে আনেননি সেটা নিয়ে কিছুটা খুঁতখুঁতানি থেকেই যায় তার মধ্যে।
"আমি কখনো আমার পরিচয় লুকাইনি।" বলেন জিমি। তবে পরিচয়কে সবার সামনে তুলেও ধরেননি তিনি, যেটি আরো অনেকের মনে এশিয়ান ফুটবলারদের প্রতি থাকা ধারণাকে বদলে দিতে পারতো বলে মনে করেন তিনি।
১৯৯৯ সালে ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে অবসর নেন কার্টার। এরপর থেকেই রেডিও ধারাভাষ্যকার এবং ইংলিশ ফুটবল লিগে কাজ করছেন তিনি। লন্ডনের একটু বাইরেই হার্টফোর্ডসায়ারে স্ত্রী এবং দুই সন্তান নিয়ে জিমি কার্টারের সংসার। ফুটবল নিয়ে এখনো পাগলের মতো পড়ে থাকেন জিমি। তবে নিজের শিকড়কেও ভোলেননি তিনি। রান্নার পালা এলেই বাবার রেসিপি অনুসারে ডাল বানাতে ভোলেন না তিনি।
"আমি আমার এশিয়ান বংশোদ্ভূত হওয়া নিয়ে ঠিক আমার বাবার মতোই গর্বিত।" আনন্দমাখা স্বরে জানান জিমি।