আর মাত্র ১ বিলিয়ন বছর
এখন থেকে আর মাত্র ১ বিলিয়ন বছর। বাতাসের অক্সিজেন হঠাৎ কমতে কমতে এতোটাই নিচে নেমে আসবে যে বায়ু নির্ভর জটিল জীবন পৃথিবীতে আর টিকে থাকতে পারবে না। মানুষের টিকে থাকার তো প্রশ্নই আসে না। আমাদের ঘিরে থাকা বায়ুমন্ডলের ২১ ভাগ হচ্ছে অক্সিজেন। অক্সিজেন সমৃদ্ধ প্রকৃতি বড় ও জটিল জীবতাত্ত্বিক গঠণের প্রাণীর জন্য আদর্শ স্থান। অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকলে এসব জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। পৃথিবীর ইতিহাসের শুরুটাতে অক্সিজেনের মাত্রা অনেক কমই ছিল- ভবিষ্যতের পৃথিবী সেদিকেই যাচ্ছে।
জাপানের তোহো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজুমি ওজাকি এবং আমেরিকার জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ক্রিস রিনহার্ড পৃথিবীর পরিবেশগত জীবতাত্ত্বিক এবং ভূতাত্ত্বিক মডেলিংয়ের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের অবস্থানগত পরিবর্তন ঘটবে। পরবর্তী আনুমানিক ১ বিলিয়ন বছর বায়ুমন্ডল অক্সিজেন ধরে রাখবে তারপর পৃথিবীর নাটকীয় ভাবে ২.৪ বিলিয়ন বছর আগের গ্রেট অক্সিজেন ইভেন্ট বা মহাঅক্সিজেন সঙ্কটের মতো বায়ুমন্ডলে ধস নামবে।
ওজাকি বলেছেন, সায়েন্টিফিক মডেলিং-এ বিশ্বাস থাকলে জেনে রাখুন অক্সিজেন সমৃদ্ধ বায়ুমন্ডল কোনো স্থায়ী অবস্থা নয়।
এই পরিবর্তনের একটি বড় কারণ সূর্যের বয়স বাড়ছে, সূর্য আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠবে এবং অধিক পরিমাণ শক্তি (এনার্জি) সূর্য থেকে অবমুক্ত হবে। গবেষকরা দেখাচ্ছেন এই পরিস্থিতিতে বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাই অক্সাইড অধিক পরিমাণ তাপ শোষণ করবে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ভেঙ্গে পড়বে।
ওজাকি ও রিনহার্ড হিসেব করে দেখিয়েছেন কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা এতো নিচে নেমে যাবে বৃক্ষসহ যত সালোকসংশ্লোষন নির্ভর জীব আছে তার কোনোটিই টিকে থেকে অক্সিজেন উৎপন্ন করতে পারবে না। 'ফটোসিথথেটিক অর্গানিজম'-গুলোর দলবন্ধ বিলুপ্তির কারণ হবে অক্সিজেনের 'মহাকাব্যিক ঘাটতি'। অক্সিজেনের মাত্রা কতোটা হ্রাস পাবে আমরা কল্পনাও করতে পারছি না।
গবেষকরা আরো দেখিয়েছেন একদিকে চলবে কার্বন ডাই অক্সাইড ভাঙ্গন আর সেইসঙ্গে চলবে প্রায় অক্সিজেন শূন্যতার সাথে মিথেনের মাত্রার বৃদ্ধি- এই বৃদ্ধি অবিশ্বাস্যরকম, এখন বায়ুমন্ডলে যে মাত্রার মিথেন রয়েছে তার চেয়ে অন্তত ১০ হাজার গুণ বেশি বেড়ে যাবে। বায়ুমন্ডলে এই পরিবর্তন যখন ঘটতে শুরু করবে প্রায় অক্সিজেনহীন অবস্থায় পৌঁছতে মাত্র ১০ হাজার বছর লাগবে।'
ওজাকি বলেছেন পরিবশের এই নাটকীয় পরিবর্তনের সাথে জীবমন্ডল (বায়োস্ফেয়ার) খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না। এরপর যে পৃথিবী থাকবে তার প্রাণিকুল হবে মাইক্রোবিয়াল মানে অনুজীবের মতো, প্রাচীনতম কালের বায়ু বিমুখ ব্যাকটেরিয়া আড়াল থেকে উঠে এসে রাজত্ব করবে। পার্থিব ভূ-খন্ডের জীবনের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে। তেমনি বিলুপ্ত হবে জলীয় ও সামুদ্রিক জীব। ওজন স্তর ধসে যাবে। এই স্তর অর্থাৎ অক্সিজেনের দেয়াল ধসে পড়ার পর পৃথিবী ও মহাসমুদ্রসহ সকল জলরাশিকে উচ্চমাত্রা অতিবেগুনি রাশি এবং জলন্ত সূর্যের মুখোমুখি করে দেবে।
জাপান যুক্তরাষ্ট্র যৌথ গবেষণাটি নাসা-র প্ল্যানেট হ্যাবিটেবিলিটি- গ্রহে বাসযোগ্যতা প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত হয়েছে যার একটি উদ্দেশ্য অন্য গ্রহে জীবনের সন্ধান।
হিউ রস অক্সিজেনের গুরুত্বের উপর একটি সার সংক্ষেপ তৈরি করেছেন; একজন প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ্য মানুষ না খেয়ে ৪০ দিন বেঁচে থাকতে পারবেন, না ঘুমিয়ে কাটাতে পারবেন এক সপ্তাহ, পানি ছাড়া টিকে থাকবেন ৩ দিন। কিন্তু বাতাস ছাড়া ৫ মিনিটও নয়। কিন্তু যে কোনো বাতাস হলে চলবে না। আমাদের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ রেখে অনুপমভাবে তা মিশ্রিত ও তৈরি হয়। এই তৈরিতে অক্সিজেন যদি কম থাকে মৃত্যু অনিবার্য।
ইলেকট্রোলাইসিস: পানিতে বিদ্যুত চালনা করে অক্সিজেন উৎপাদন
এই জাপান-আমেরিকান সমীক্ষার সার কথা হচ্ছে সূর্য যেহেতু উত্তপ্ত হওয়া অব্যহত রাখবে, কার্বন ডাই অক্সাইড ভাঙ্গতে থাকবে, উদ্ভিদের জীবন সংহার করবে- ফলে পৃথিবীর জন্য অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। সরবারহ লাইনের সুইচ অফ করার প্রয়োজন হবে না, আপনা-আপনি থেমে যাবে প্রকৃতির সব অক্সিজেন প্লান্ট।
ব্র্যাড লুইস লিখেছেন আমি প্রথম ৪৫ সেকেন্ড নিঃশ্বাস বন্ধ করে ছিলাম, তারপর আমার দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে গেল। আমার ফুসফুস ফুটো বেলুনের মতো হয়ে গেল। সম্ভব হলে আমি আমার কান দিয়ে অক্সিজেন টেনে নিতাম। অক্সিজেনের অভাব বোধ করতে থাকি-এটা বলি তখনই আমার অক্সিজেন মৃত্যুর অভিজ্ঞতা শুরু হলো।
বাতাসে স্বাভাকি অবস্থার চেয়ে অক্সিজেন কমে যাওয়াটা বিপদজনক। মানুষের স্বাভাবিক শ্বসন পক্রিয়ায় যে পরিমাণ অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় যদি পরিমাণ তার ৮০ ভাগ হয় তাহলে ১২ ঘন্টার মধ্যে শ্বসন প্রণালীর নালীসমূহ অস্বস্তিকর অবস্থায় পৌঁছবে এবং গোটা শরীরে অস্বস্তি সরিয়ে দেবে। শরীরে মারাত্মক পানি জমা বা শোথ দেখা দেবে। পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন না ঘটলে তা মৃত্যু ডেকে আনবে।
স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষের রক্ত সংবহনতন্ত্রে ধমনীতে অক্সিজেনের মাত্রা থাকে ১২ থেকে ১৪ কিলোপাস্কাল। ২০০৯ সালে মাউন্ট এভারেস্টের আরোহীদের সবচেয়ে কম অক্সিজেনের মাত্রা সনাক্ত হয়েছে এবং তা হচ্ছে ৩.২৮ কিলোপাস্কাল। হিমালয়ের ডেথ জোনে মানুষের মৃত্যুর বিষয়টি এই হিসেবে আরো স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়।
হিমালয়ের ডেথট্র্যাপে মৃতদেহ
পৃথিবীর বায়ু মন্ডলের একটি হিসেব জানা জরুরী। হিসেবটি কালালুক্রমিক পর্যায়:
প্রথম পর্যায়; সময়কাল ৩.৮৫ থেকে ২.৪৫ বিলিয়ন বছর আগে, এসময় পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কার্যত কোনো অক্সিজেনই ছিল না।
দ্বিতীয় পর্যায়: ২.৪৫ থেকে ১.৮৫ বিলিয়ন বছর আগে, এসময় অক্সিজেন উৎপাদিত হতে শুরু করে কিন্তু তার পুরোটাই সমুদ্র এবং সমুদ্রগর্ভের পাথর শুষে নেয়।
তৃতীয় পর্যায়: ১.৮৫ থেকে ০.৮৫ বিলিয়ন বছর আগে; সমুদ্র থেকে অক্সিজেন গ্যাস বেরিয়ে আসতে শুরু করে। কিন্তু একটি অংশ শুষে নেয় পৃথিবীর মাটি ও অন্যান্য ভূস্থলভাগ আর বাকীটা ধীরে ধীরে ওজন স্তর নির্মাণ করে।
চতুর্থ পর্যায়: ০.৮৫ বিলিয়ন বছর আগে থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত; অক্সিজেন আধার সমূহ পূর্ণ হয়েছে জীব ও উদ্ভিদ জগত ব্যবহার করছে, বাণিজ্যিক কাজে লাগছে।
গ্রেট অক্সিডেশন ইভেন্ট বা গ্রেট অক্সিজিনেশন ইভেন্ট পৃথিবী এবং জীব জগতের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘটনা ঘটে দ্বিতীয় পর্যায়ে ২.৪ বিলিয়ন থেকে ২.০ বিলিয়ন বছর আগে। তখন অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। অভ্যুদয়কে এই ঘটনা বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন ৩৫ ভাগে পৌঁছে। অক্সিজেন নির্ভরশীল নয় এমন বহু কিছুর এ সময় বিলুপ্তি ঘটে।
মহাসাগরের মহাযোগান
'তুমি যে ক'ফোটা পানি খাও, যতটুকু বাতাস গ্রহণ করো তুমি শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের সাথে যুক্ত। তুমি পৃথিবীর কোন জায়গায় অবস্থান করছো তাতে কিছু এসে যায় না। বায়ুমন্ডলের অক্সিজেনের সিংহভাগ সমুদ্রই যোগান দেয়'। -সিলভিয়া আর্ল
সমুদ্রের প্ল্যাঙ্কটনে
সমুদ্রের পৃষ্ট দেশ ফটোসিনথেটিক প্ল্যাঙ্কটনে(আনুবীক্ষণিক জীবানু) পরিপূর্ণ থাকে। খালি চোখে দেখাই যায় না, কিন্তু পুরো আমাজন বনাঞ্চল যত অক্সিজেন উৎপন্ন করে তার চেয়ে অনেক বেশি অক্সিজেন আসে সমুদ্রের প্লাঙ্কটন থেকে। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন পৃথিবীতে যে কোনো সময় যে পরিমাণ অক্সিজেন থাকে তার অর্ধেকের বেশি আসে সমুদ্রের প্ল্যাঙ্কটন শৈবল থেকে। কেউ কেউ মনে করে এ পরিমাণ ৫০ তেকে ৮০ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে। সমুদ্রের প্রক্লোরোকক্কাস ক্ষুদ্রতম সালোক সংশ্লেষী ব্যাকটেরিয়া বায়ু মন্ডলের ২০ ভাগ অক্সিজেন সরবরাহ করে। এটাও স্মরণ রাখতে হবে সাগরে উৎপাদিত অক্সিজেনের বৃহাদাংশই সামুদ্রিক জীবের শ্বসনে ব্যবহ্নত হয়। মৃত প্রাণী ও উদ্ভিদের পচনেও বেশি মাত্রার অক্সিজেন লাগে; ক্ষতি পূরণের জন্য সেসব স্থানে সমপরিমান অক্সিজেন আসে না--এই ঘাটতি কারণেই সাগরে কোথাও কোথাও লো জোন সৃষ্টি হয়। সেখানে অক্সিজেনের মাত্রা এতোটা কম থাকে যে প্রাণী কুলের টিকে থাকা অসম্ভব। এজন্য এই অঞ্চলগুলো ডেড জোন নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
জলভাগেই অক্সিজেন স্বল্পতা একদিকে অন্যদিকে ব্যাপক কার্বণ ডাই অক্সাইড সঞ্চালন জীবনের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। ১৯৮৬ সালে ক্যামেরুনের লেইক নাইয়ুসে ১৭০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে আসে ৫০০০ জন। এখানে কার্বন ডাই অক্সাইডের ফাঁদ সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে ক্যামেরুনের লেইক মনাউনে ১৩৭ জনের মৃত্যু ঘটে।
এক বিলিয়ন বছর পর অক্সিজেনের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক গুদাম সাগর ও মহাসাগর ছড়াবে কেবল মৃত্যুর বিষবাষ্প।