আমি জিপসি, আমি আন্দালুসিয়ার যাযাবর, আমার গান শুনো!
'জিপসি আমি, ঠিক সে অনুযায়ী
করেছি তার সঙ্গে আচরণ।
খড়ের মতো হলুদ রেশমি বড়
সেলাই-ঝুড়ি দিয়েছিলাম তাকে।
প্রেমে পড়তে চাইনি আমি তার
কারণ স্বামী যদিও তার ছিল
বলল তবু সে কুমারী মেয়ে
যখন তাকে নিচ্ছি নদীর ধারে।'
দুনিয়াজুড়ে তল্পিতল্পা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো বেদুইন গোষ্ঠী জিপসির ইতিহাস বড় রোমাঞ্চকর। এশিয়া থেকে ইউরোপ-আমেরিকা, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সব জায়গায় ছুটে চলে জিপসি কারাভান। তাদের নিয়ে আছে শ্রুতি, আছে পৌরাণিক কত গাল-গল্প। তাদের ধর্ম কী? পিতৃভূমি কোথায় ওদের?
জিপসিরা বলে আমরা 'রোমা, রোমা মানে জানো? শুধুই মানুষ। আর দেশ? পুরো বিশ্বটাই আমাদের। এই প্রকৃতি ফুল-ফল মানুষের জন্যই তো!
জিপসিদের গান থেকে পাওয়া যায় জীবন সম্পর্কে তাদের ধারণা। জিপসিরা গায়:
যদি তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়ে থাকো জিপসি, তবে ভয় কী?
ওই তো চাষীর খামারে ঘোড়া দেখা যাচ্ছে।
যদি জিপসি শিশুর খিদে পেয়ে থাকে, তবে ভয় কী?
ওই তো গোলাবাড়িটার কাছে মুরগি দেখা যাচ্ছে!
যদি জিপসি জোয়ানদের তৃষ্ণা পেয়ে থাকে, তবে ভয় কী?
তাদের জন্য অনেক অনেক পানীয় আছে।
অ্যান্ড ইফ দেয়ার ইজ নট ইন দি জিপসি হ্যান্ড
দেয়ার আর ওয়েলদি গার্গিওস ইন অল দি ল্যান্ড!
জিপসিরা যতই বলুক মানুষ পরিচয়টাই তাদের একমাত্র পরিচয়, শুধু 'পিতৃভূমি' কেন পুরো ভুবনটাই মানুষের, তা অতো সহজে মানা যায় না, যায়ওনি। ইতিহাসবিদ আর নৃতাত্বিকরা তাই কালি ও কলম নিয়ে বসেছেন। কেউ বলেন তোমরা ভারতীয়, কেউ বলেন তোমরা প্যালেস্টাইনের আরব, কেউ বলেন, নাহ তোমরা 'ইজিপসিয়ান'। সে মতে কিছু দলিল-প্রমাণও হাজির হয়। যিশু খ্রিস্টকে শূলে চড়িয়ে লটকে রাখা হয় যে তিনটি পেরেক মেরে সে পেরেকের কারিগর ছিল জিপসি। কথা ছিল চারটি পেরেক বানিয়ে দেয়ার। তিনটি বানানোর পর যিশুকে সে পেরেকে গাঁথা হবে শুনে জিপসি কারিগরের আর সাহস হয়নি চতুর্থটি বানানোর। জ্বলন্ত লোহায় জল ঢেলে দেন কারিগর। কিন্তু সে লোহা থেকে গড়িয়ে পড়তে থাকে খুন। লাল রক্ত। কারিগর ভয়ে ছুটতে থাকেন। ছুটতে থাকে পেরেকের লোহাও। কারিগর আরবের পাহাড়ে আশ্রয় নেন শেষমেষ। অন্যদিকে পেরেক না পেয়ে যিশুকে তিনটি দিয়েই গেঁথে ফেলা হয়। দুই হাতে দুটি আর পা দুটোকে এককরেআরেকটি পেরেক মারা হয়। সেই যে পাপ করেছিলেন কারিগর সেই পাপ আজও তার বংশধরদের পৃথিবীময় তাড়িয়ে চলেছে। উচ্চারণের সুবিধার্থে 'ইজিপসিয়ান' শব্দের শুরু ও শেষের তিনটি অক্ষর ফেলে দিয়ে দুনিয়া তাদের ডাকা শুরু করল 'জিপসি'।
তাদের এ ভবঘুরে জীবন বড় বেদনার। সভ্য দুনিয়ার কাছে তারা আজও 'আবর্জনা'। হিটলারের নাৎসি বাহিনী তাই ইহুদিদের সঙ্গে জিপসিদেরও ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গণহত্যা চালায়। কিন্তু জিপসিরা শেষ হয়ে যায়নি। প্রতিকুল পৃথিবীতে তারা আজও চালিয়ে যাচ্ছে টিকে থাকার সংগ্রাম। ধনী আর সভ্যসমাজ জিপসিদের যতই বলুক নোংরা ও আবর্জনা, জিপসিরা নিজেদের বাদশাহই মনে করে। জিপসিরা কটাক্ষের জবাব দেয় সুরে-সঙ্গীতে:
মি হ্যাজ ডেসপ্রিসিয়াডো পর পব্রে
ই চুয়াত্রো প্যালাসিওস টেঙ্গো,
এল আসিলিও, এল হসপিটাল্
লা কারসেল ই এল সিমেনটেরিও!
—আমার চার চারটে মস্ত প্রাসাদ রয়েছে। তোমরা অবশ্য বলো আমি ভিখারি, আমি তস্কর। কিন্তু আমার হাসপাতাল আছে, আমার জেলখানা আছে, আমার গির্জা আছে, আছে কবর!
যেহেতু ছুটে চলাই তাদের নিয়তি তাই তারা অর্জন করে নিয়েছে তেমন কিছু পরাবিদ্যা। লোহা পুড়িয়ে এটাওটা বানানো তো পুরনো কম্মো, জিপসিরা রপ্ত করেছে হাত দেখে ভবিষ্যৎ বলার দক্ষতাও। প্যারিস, ইস্তাম্বুল বা নিউইয়র্কের পথে দেখা পেয়ে যেতে পারেন কোনো ভবিষ্যৎদ্রষ্টা জিপসি রমণীর। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে কুড়ানো মূল্যবান পাথর বা বস্তুর গায়ে শৈল্পিক আঁকিবুকির কৌশল আর সৌন্দর্য দেখে পথিকের না থেমে উপায় নেই। পেট চালানোর দায়ে জিপসিদের কেউ নাচে-গায়। কেউ মিস্ত্রির কাজ করে। কেউ ঘোড়ার সওদাগর। কেউ ভালুকের বাজিকর। মেয়েদের কেউ কেউ নিজস্ব কৌশলে বানানো নানারকম ওষুধ ফেরি করে। এসব বিদ্যা আর খেলতামাশার জন্য ভারী কোনো যন্ত্রপাতির প্রয়োজন পড়ে না জিপসিদের। অতএব পেশা বা বিদ্যাগত কারণেও এক জায়গায় থিতু হওয়ার ঝামেলা নেই। স্বাধীন-স্বচ্ছন্দ জীবনে আর বাধা কোথায়?
জিপসি মেয়ে: তাদের পরনে থাকে রৌদ্রের উজ্জ্বল স্কার্ট, ঘাঘরা নেমে যায় গোড়ালি অবধি। পায়ে মোটা রুপোর মল। গায়ে থাকে ছোট ঢিলে চোলি। অথবা কখনো নিজস্ব সাজের দীর্ঘ জামা। সে জামা নাচের প্রয়োজনে নিচের দিক থেকে বড় হয়ে মেলে যায় ময়ূরের পেখমের মতো। রঙটা হবে অবশ্যই উজ্জ্বল ও ঝলমলে, বেশিরভাগ সময় লাল বা হলুদ। কারো গলায় থাকে বড় পুঁতির মালা, কারো মালায় মোহর কিংবা রুপোর মুদ্রা। কানে মস্ত রিং। কখনো শুধু দীর্ঘ জামা আর আরামদায়ক পাজামা ছাড়া থাকে না কিছুই। পোশাক আর গহনা যাই হোক, কোনো সুপুরুষের চোখ আটকে থাকতে চায় না ওসবে। এসব তুচ্ছ করে চোখের সামনে ফুটে বেরিয়ে আসে জিপসি নারীর আশ্চর্য সুন্দর গড়ন, সহজ স্বাভাবিক রূপ।আকর্ষণ করে উচ্চতা আর নির্মেদ দেহ। যাদুকরী কালো চোখ। কালো চুল। মুক্তোর মতো সাদা দাঁতের সারি। একবার জিপসি নারীর চোখে চোখ পড়লে হৃদয়জুড়ে তুফান উঠে, বেজে উঠে গান—তোমার কালো চোখ আমায় খেল...আমায় খেল!
জিপসি মেয়েকে নিয়ে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার (১৮৯৮-১৯৩৬০) রয়েছে বিখ্যাত কবিতা। লোরকা তার জিপসি-গীতিকা বইয়ের 'তন্দ্রাচারী গাথা' কবিতায় লিখেছেন:
সবুজ তোমাকে চাই ও সবুজ।
সবুজ বাতাস। সবুজ বিটপ।
সাগরের পিঠে চরছে জাহাজ
আর পর্বতচূড়ায় অশ্ব।
কোমরের চারপাশে ছায়া নিয়ে
রেলিংয়ে স্বপ্ন দেখছে মেয়েটি,
সবুজ শরীর, সবুজ অলক,
আর চোখজোড়া ঠান্ডা রুপার।
সবুজ তোমাকে চাই ও সবুজ।
জিপসি চাঁদের নিচে সবকিছু
তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটির দিকে।
মেয়েটি সেসব খেয়ালই করে না।
বৃষ্টিজলের আধারের কাছে
জিপসি মেয়েটি খেয়ে যায় দোল।
সবুজ শরীর, সবুজ অলক,
আর চোখজোড়া ঠান্ডা রুপার।
চাঁদের সুচালো তুষারখণ্ড
ধরে আছে তাকে পানির ওপর।
চাঁদ হয়ে এল এতই নিবিড়
যেন তা গ্রামের চত্বর কোনো।
বেহেড মাতাল সিভিল গার্ডরা
সশব্দে ঘুষি মারে দরজায়।
সবুজ তোমাকে চাই ও সবুজ।
সবুজ বাতাস। সবুজ বিটপ।
সাগরের পিঠে চরছে জাহাজ
আর পর্বতচূড়ায় অশ্ব।
সৌন্দর্যের টান চুম্বকের চেয়ে তীব্র। রূপের আকর্ষণ এড়ানো মুশকিল যে কোনো সুপুরুষের পক্ষে। ফলে জিপসি তরুণীর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে পথিক। চলন্ত কেউ ফিরে ফিরে তাকায়। এ রূপ মানুষকে নির্লজ্জ্ করে তুলে বড্ড। জিপসি নারী তার বিশেষ মুদ্রায় নেচে নেচে বলে:
সি মিরি চুমুয়া সান কুসতি তো হা
তু নাস্তি হ্যাচ বোকালো, দেরাই আজা!
—যদি আমার চুমু খেতে ভালো লাগে তোমার, তাহলে আর বেশি দিন না খেয়ে কাটাতে হবে না,—হে বন্ধু আমার!
জিপসি পুরুষ: নারীর মতো সমান দর্শনীয় জিপসি পুরুষ। দীর্ঘ মজবুত গড়ন। চোখেমুখে আদিম তীক্ষ্নতা। পায়ে থাকে বুট। দেশভেদে মাথায় থাকে টুপি বা অন্য কিছু অথবা কিছুই থাকে না। তবে সবার হাতেই থাকে কোনো না কোনো বাদ্যযন্ত্র। হয়তো বেহালা, হয়তো অন্যকিছু। পরিযায়ী মন আর সঙ্গীতসাধনা জিপসি পুরুষকে করে তুলে আরো আকর্ষণীয়। জিপসি নারী-পুরুষের নৃত্য আর বেদনাভরা অদ্ভুত সুর এড়ানো যায় না মোটেও।
জিপসি পুরুষের কথা ও গান উঠে এসেছে আন্দালুসিয়ার কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কবিতায়। লোরকা ও তার ভাই ফ্রান্সিসকো খচ্চরচালকের পেছনে বসে যাচ্ছিলেন কোথাও। খচ্চরচালক গলা ছেড়ে ধরলো জিপসি গান—'আর কুমারী কন্যা ভেবে তাকে/ নিয়ে গিয়েছিলাম নদীর ধারে/ অথচ সেই মেয়ের ছিল স্বামী...!' স্পেনের প্রাণস্ফুর্তি ভরা এ কবি এরপরই লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা 'অসতী স্ত্রী'। কবিতার প্রথম তিন চরণ কিন্তু খচ্চরচালকের ওই গাওয়া গানই রইল। লোরকা চরণ তিনটিকে তার বাদবাকি কবিতার মতোই নিজের মনে করলেন। বেমালুম ভুলে গেলেন খচ্চরচালকের কথা। জিপসিদের গানে আর তার কবিতায় ঘটে গেল স্বতঃস্ফূর্ত মিলন।
লোরকার কবিতার মধ্য দিয়ে জিপসি তরুণের কথা পড়ে নেওয়া যাক:
আর কুমারী কন্যা ভেবে তাকে
নিয়ে গিয়েছিলাম নদীর ধারে
অথচ সেই মেয়ের ছিল স্বামী।
সান্তিয়াগোর রাত ছিল সেই দিন
আর ছিল প্রায় অঙ্গীকারের দায়।
নিভে গিয়েছিল পথের বাতি
জোনাকিরাও উঠল জ্বলে জ্বলে।...
... ... ...
...জিপসি আমি, ঠিক সে অনুযায়ী
করেছি তার সঙ্গে আচরণ।
খড়ের মতো হলুদ রেশমি বড়
সেলাই-ঝুড়ি দিয়েছিলাম তাকে।
প্রেমে পড়তে চাইনি আমি তার
কারণ স্বামী যদিও তার ছিল
বলল তবু সে কুমারী মেয়ে
যখন তাকে নিচ্ছি নদীর ধারে।
ফ্লেমিঙ্কো বা জিপসি নৃত্য-গীত: স্পেনে জিপসিদের বসবাসের ইতিহাস পাঁচ শ বছরের পুরনো। কিন্তু জিপসিদের জীবন এখানেও নির্মেঘ নয়। একদিকে যাযাবর জিপসি অন্যদিকে হাজার বছরের স্থায়ী বাসিন্দাদের কর্তৃত্ববাদী সমাজ। যে সমাজ কখনো কখনো সীমাহীন কঠোর ও নিষ্ঠুর। জিপসিদের প্রতি নিদরদী।
আঠারো শতকের শেষের দিকে আন্দালুসিয়ার আলোহাওয়া আর ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলে উঠে আসা নৃত্য-গীত ফ্লেমিঙ্কোতে জিপসিরা ধরে রেখেছে সেসব বেদনা। হাত-পা এবং পেটের বিশেষ মুদ্রায় জিপসিরা সৃষ্টি করেছে অসাধারণ এক নৃত্য। নিদারুণ বেদনা আর প্রবোধের সঙ্গে মেধার স্ফূরণে সৃষ্ট এ শিল্পজগত দর্শক-শ্রোতাকে আপ্লুত করে। নিয়ে যায় এক ভিন্ন জগতে।
শুধু স্পেন কেন বিশ্বের কোথাও জিপসিরা শান্তিতে নেই। সংখ্যায় ইহুদিদের চেয়ে বেশি ছিল জিপসিরা। এদের প্রান্তিকিকরণ ও উন্মূলনের ইতিহাস বড় বেদনার। নাৎসিদের হাতে ইহুদিদের হত্যার কথা স্মরণ করে বিশ্ববাসী তবু ব্যথিত হয়। কিন্তু জিপসিদের যে ধ্বংস করে দেওয়া হলো বা এখনো হচ্ছে এ নিয়ে কোনো খবর কি আছে আমাদের কাছে? নেই! জিপসিরাই তাই তাদের গানে-সুরে-তালে-ছন্দে-নৃত্যে সে বেদনার কথা ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমাদের কাছে যা শিল্প তাদের কাছে তা ইতিহাস। বেদনার ইতিহাস। জিপসিরা যেন বিশ্ববাসীকে আহ্বান করছে, আমি জিপসি, আমি রোমা, খাঁটি মানুষ, আমি যাযাবর, আমার গান শুনো!
- কৃতজ্ঞতা স্বীকার: এ লেখায় ব্যবহৃত লোরকার কবিতা দুটির যে অংশ বিশেষ ছাপা হয়েছে তা নেওয়া হয়েছে প্রথমা প্রকাশনীর বই'ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকার নির্বাচিত কবিতা: রক্ত ও অশ্রুর গাথা' থেকে। কবিতাগুলো অনুবাদ করেছেন কবি সাজ্জাদ শরিফ। তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা। জিপসিদের যে গানগুলো উদ্ধৃত করা হয়েছে তার অনুবাদক শ্রীপান্থ। অনূদিত গানগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে 'জিপসীর পায়ে পায়ে' (দে'জ, কলকাতা) বই থেকে। লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।