আমার গলায় পেঁয়াজের মালা!
দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি দেশে যে সবজিটির চাষ হয় তার নাম পেঁয়াজ। এত দেশে চাষ হওয়া মানে পেঁয়াজ খাওয়া মানুষের সংখ্যাও নিশ্চয় কম নয়। তবু সবজি হিসেবে পেঁয়াজের নাম নেয় কজন। পেঁয়াজের ঝাঁঝ আর গন্ধ বড় কটু, চোখে জল এনে দেয়—এসব বলে বলে দুর্নাম করেন ভদ্রলোকেরা। অথচ পেঁয়াজের সমৃদ্ধ ইতিহাস আর মর্যাদার দিকে লক্ষ করে হলেও আমাদের বলা উচিত—পেঁয়াজ জিন্দাবাদ!
প্রাচীন রেসিপিতে পেঁয়াজের জয়: আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতার নিদর্শনের তিনটি লাল মাটির বিশেষ টুকরো সংরক্ষিত রয়েছে। এতে লিপিবদ্ধ রয়েছে পৃথিবীর প্রাচীনতম খাবারের রেসিপি। এই লাল মাটির টুকরোগুলোতে ঠিক কী লেখা রয়েছে সে রহস্য একজন ফরাসি বিশেষজ্ঞ উদ্ধার করেছেন অন্তত চার হাজার বছর পর ১৯৮৫ সালে এসে।
জিন বুটিরিও পেশাগত দিক থেকে একজন প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে খ্যাতিমান ব্যক্তি। তার দ্বিতীয় খ্যাতি অসাধারণ রান্নার হাতের জন্য। তাকে কয়েকটি রান্নার আবিষ্কারকও ধরা হয়। জিন বুটিরিও যখন মেসোপটিমিয়ার প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতার মাটির টুকরোগুলো গভীরভাবে দেখলেন তখন তার মনে হলো এতে,'অত্যন্ত সুস্বাদু খাবারের রেসিপি লেখা রয়েছে। বোঝা গেল সেই প্রাচীনকালেও খাবারদাবার ও রান্নাবান্নাকে একটি বিশেষ বিদ্যা বলে ধরা হতো।'
জিন বুটিরিওর মতে এইসব রেসিপিতে একটি সবজির কথা বেশ গুরুত্বসহকারে রয়েছে। সেটি হলো পেঁয়াজ! মেসোপটিমিয়া সভ্যতার মানুষেরা শুধু যে পেঁয়াজ সম্পর্কে ধারণা রাখত তা নয়, বরং পেঁয়াজের সঙ্গে সমগোত্রীয় অন্যান্য সবজি ও মশলাপাতির কথাও তাদের লেখায় পাওয়া গেছে। আছে রসুন ও পেঁয়াজের সবুজ পাতা আর ফুলের কথা। ব্যাবিলনীয় সভ্যতা-পরবর্তী খাদ্য-অভ্যাসের কথা তো আমাদের জানা। এমন খুব কম খাবারই রয়েছে যেখানে সামান্য হলেও পেঁয়াজের ব্যবহার নেই।
পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের প্রধান খাবার গম, রুটি বা এ জাতীয় কিছু। কিন্তু জাতিসংঘের এক তথ্যমতে দুনিয়ার ১৭৫টির বেশি দেশে পেঁয়াজের চাষ হয়। মানুষের প্রধান খাদ্য গমও এতটি দেশে চাষ হয় না। সহজ কথায় সেই আদিকাল থেকে পেঁয়াজের প্রতি মানুষের যে আগ্রহ তা এই সবজিটি আজও ধরে রাখতে পেরেছে। মানুষের বেশিরভাগ খাদ্যেই থাকে পেঁয়াজের অংশগ্রহণ। বিশেষ বিশেষ খাবারের সঙ্গে খাদ্যরসিক পেঁয়াজকে ভালোবেসে আলাদা মর্যাদা দিয়ে পাতে তুলে নেন। বিশ্বের বেশি ব্যবহৃত খাদ্য যে পেঁয়াজ এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
বিখ্যাত খাদ্য-ইতিহাস বিশেষজ্ঞ লারা কেলি বলেন,'গবেষণায় পেয়াজের জিন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এই সবজিটির উদ্ভব মধ্য এশিয়ায়। মানুষের জিহ্বা মেসোপটমিয়ান সভ্যতার উত্থানের অনেক আগে থেকে পেঁয়াজের স্বাদের সঙ্গে পরিচিত।' একদল গবেষকের মতে ইউরোপ পেঁয়াজ খাচ্ছে তাও কয়েক শ বছর হয়ে গেছে। এর অর্থ হলো, বর্তমান দুনিয়ার সব অঞ্চলের বাসিন্দাই পেঁয়াজের সঙ্গে শত শত বছর ধরে পরিচিত।
পেঁয়াজ ফুল দেখতে বেশ সুন্দর। ফুলের দিকে তাকালে মনে হয়, মানুষ বুঝি পেঁয়াজের আগে তার ফুলের প্রেমে মজে ছিল। তারপর এর খাদ্য-উপযোগিতা আবিষ্কার হলে ব্যাপক চাষবাসের শুরু হয়। পেঁয়াজ চাষ জনপ্রিয় হওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ এটি সহজে চাষযোগ্য। তেমন বাড়তি কোনো খাটুনি নেই। পোঁকাও ধরে না। খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি ছাড়াও পেঁয়াজের রয়েছে দারুণ পুষ্টিগুণ।
খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে বর্তমান সিল্করুট ধরে পেঁয়াজের বাণিজ্যের কথা ইতিহাস মারফত জানা যায়। কাছাকাছি সময়ে মেসোপটমিয়া সভ্যতার মাটির টুকরোগুলোতে পেঁয়াজের খাদ্যপ্রণালী লেখা হচ্ছিল। লারা কেলি ব্যাবিলন সভ্যতার লিখিত এই রেসিপি ধরে রান্নার আয়োজন করেছিলেন। এসব খাবার বানানোর তরিকার একটিতে লেখা ছিল মুরগি বা অন্য কোনো মাংসের সঙ্গে পানি, দুধ, লবণ, চর্বি, দারচিনি, সরিষা, সবুজ পেঁয়াজ, সুজি, লিক (এটাও পেঁয়াজ গোত্রেরই), রসুন, আটা, নোনাজল, সয়াবিন, পুদিনা ও বনজ ফুলের মিশ্রণে তৈরি একটি বিশেষ খাবারের কথা।
ক্ষমতায় রাখে ভালোবাসার পেঁয়াজ: খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে পেঁয়াজের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যেরকম জমজমাট ছিল এখন তা নেই। এর কারণ, বর্তমানে প্রায় সব দেশেই পেঁয়াজের চাষ হয়। নিজেদের চাহিদা তাই নিজেরাই মিটিয়ে নেয়। অন্যদিকে গম বা অন্যান্য ফসল সব দেশে চাষ করা হয় না বলে এর ব্যবসা বেশ জমজমাট। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশে পেঁয়াজের ঘাটতি ও আমদানি নিয়ে যে উত্তেজনা তার পেছনে রাজনীতিকে ইঙ্গিত করেন বিশেষজ্ঞরা। স্রেফ চাহিদার কারণে যে এ মাতামাতি নয় তা প্রায় স্পষ্ট।
ভারত এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দিতে যথেষ্ট। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার আগে দেশের বাজারে পেঁয়াজের মূল্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে যাবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন। এর প্রমাণ আমরা বাংলাদেশিরা দেখতেই পাচ্ছি। অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানী বন্ধ করেছে বহুবার। মোদির শপথগ্রহণের এক মাসের ভেতরেই এমন ঘটনা ঘটেছিল।
মোদি সরকারের পেঁয়াজ নিয়ে এত সতর্কতার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বৃটিশ ব্যাংক এইচএসবিসি'র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষক ও অর্থনীতিবীদ প্রঞ্জল ভাণ্ডারী বিবিসিকে বলেছিলেন,'বাহ্যিকভাবে দিল্লির সাধারণ নির্বাচন আর পেঁয়াজের দামদরের মাঝে কোনো সম্পর্ক দেখা যাবে না। কিন্তু সত্য কথা হলো পেঁয়াজের মূল্য ভারতের নির্বাচনে বড় ভূমিকা পালন করে। এর বড় উদাহরণ, ১৯৯৮ সালে দিল্লির রাজ্যসভা নির্বাচনে বিজিপির পরাজয়ের পেছনে ছিল পেঁয়াজের বড় ভূমিকা।' এটাই সত্য কথা। এর আগের কংগ্রেস সরকার শুধু পেঁয়াজ রপ্তানী বন্ধ করেনি, বরং এত চাষের পরও দেশটি সেবার পেঁয়াজ আমদানীর বন্দোবস্ত করেছিল।
এশিয়ার পেঁয়াজের এতই দাপট যে সরকারকে টলিয়ে দিতে পারে।
পেঁয়াজপ্রিয় আরব: বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদন ও রান্নায় ব্যবহারের দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছে দুটি দেশ। ভারত আর চীন। বিশ্বে মোট উৎপাতি ৭ কোটি টন পেঁয়াজের প্রায় ৪৫ শতাংশের জোগানদাতাই এই দুটি দেশ। উৎপাদনে এশিয়া এগিয়ে থাকলেও পেঁয়াজের সবচে' বেশি ব্যবহারকারী দেশটি কিন্তু আরবের। জাতিসংঘের হিসাব মতে, ২০১১ সালে লিবিয়ার প্রতিটি নাগরিক গড়ে প্রতিদিন ৩৩.৬ কিলোগ্রাম পেঁয়াজ ব্যবহার করেছেন। এ হিসেবে এখন পর্যন্ত লিবিয়াকে সর্বোচ্চ পেঁয়াজ ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে ধরা হয়।
খাদ্য-ইতিহাস বিশেষজ্ঞ লারা কেলির এক লিবিয়ান বন্ধু তাকে বলেন,'আমরা প্রায় প্রতিটা খাবারেই পেঁয়াজ ব্যবহার করি। কেউ কেউ তো মনে করেন, পেঁয়াজের ম্যাকারনি বা ভার্মিসেলি (আরবি 'সোয়া' বা পাস্তা জাতীয় বিশেষ খাবার) আমাদের জাতীয় খাদ্য।'
লারা কেলি বলেন, পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশেও প্রচুর পেঁয়াজ খাওয়া হয়। এ দেশগুলো জাতিসংঘের হিসাবের আওতায় পড়েনি। যেমন সেনেগালের মানুষ 'ইয়াসা' খেতে খুব পছন্দ করে। ইয়াসা মানে একটি থালায় থাকবে রান্না করা মাংসের সঙ্গে খানিকটা শাকসবজি আর প্রচুর পেঁয়াজ। এটিই ওখানে জনপ্রিয় খাবার। এতে পেঁয়াজের পরিমাণ এত বেশি থাকে যে দেখে মনে হবে যেন পেঁয়াজ দিয়ে পেঁয়াজ রান্না করা হয়েছে।
ফারাওদের পেঁয়াজ কাহিনি: কুরআনের ঘটনা, নবী মুসা (আ.)-কে আল্লাহ আমালেকা সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। নবী বনি ইসরাইলের ১২টি গোত্র থেকে ১২জন নেতাকে আমালেকা সম্প্রদায়ের রণাঙ্গনের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠালে তারা আমালেকার এক যোদ্ধার হাতে আটক হন। আমালেকার শক্তিমত্তা সম্পর্কে বনি ইসরাইলের ধারণা যা হওয়ার হয়ে যায়। যুদ্ধ করার সাহস তারা হারিয়ে ফেলে। তারা নবীকে গিয়ে বলে,'আপনি ও আপনার প্রভু যান, উভয়ে গিয়ে যুদ্ধ করুন। আমরা এখানে বসলাম।' (সুরা আল–মায়েদা, আয়াত: ২৪) বনি ইসরাইলের এই কাপুরুষোচিত মন্তব্যে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়ে তাদের 'তিহ' বা সিনাই উপত্যকায় যাওয়ার নির্দেশ দেন। কারণ আল-কুদসের আশেপাশে থাকতে হলে আমালেকা সম্প্রদায়ের সঙ্গে লড়াই করেই টিকে থাকতে হবে। নিরুপায় হয়ে বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের লোকেরা তিহ বা সিনাই উপত্যকায় গিয়ে দেখল জায়গাটা একেবারে বসবাসের অনুপযোগী। পানীয় জল, খাদ্য এমনকি গাছ-লতাপাতাও নেই। শুষ্ক মরুভূমি। কোনো উপায় না পেয়ে তারা এবার নবীকে ধরল। যেকোনো উপায়ে খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য আবেদন করল। নবীর প্রার্থনার পর আল্লাহ আকাশ থেকে খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। আল্লাহ বললেন,'তোমাদের জন্য মান্না ও সালওয়া অবতীর্ণ করেছি।' (সুরা আল-বাকারা, আয়াত: ৫৭)
মান্না ও সালওয়া এক ধরনের স্বর্গীয় খাবার। কারো কারো মতে মাংস ও রুটি। কিন্তু এই স্বর্গীয় খাবারে কিছুদিন পর তাদের অরুচি ধরে। তাদের চাই সেই প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা মিশরীয় খাবার। সুতরাং তারা নবী মুসা (আ.)কে বলল,'...হে মুসা, আমরা একই রকম খাদ্যে কখনো ধৈর্য ধারণ করতে পারব না। সুতরাং তুমি তোমার প্রভুর নিকট আমাদের জন্য প্রার্থনা করো, তিনি যেন ভূমিজাত দ্রব্য শাক-সবজি, কাঁকুড়, রসুন, গম, মসুর ও পেঁয়াজ আমাদের জন্য উৎপন্ন করে দেন।' (সুরা আল-বাকারা, আয়াত: ৬১) একদিকে যুদ্ধ করে নাগরিক সুবিধা আদায়ে অপারগতা প্রকাশ অন্যদিকে স্বর্গীয় খাবারে অরুচি প্রকাশের কারণে নবী তাদের উপর অসন্তুষ্ট হন।
কুরআনের এ আয়াত থেকে মিশরীয়দের পেঁয়াজ প্রীতির কথা জানা যায়। পেঁয়াজের প্রতি মিশরীয়দের ছিল সীমাহীন দুর্বলতা। শুধু খাবার হিসেবে নয়, পেঁয়াজের ছিল তাদের নানামুখী ব্যবহার। এমনকি মৃত্যুর পরও তাদের সমাধিতে পেঁয়াজ দেয়া হতো। ফারাও রাজা চতুর্থ রামেসিসের সমাধিতেও পাওয়া গেছে পেঁয়াজ। খ্রিষ্টপূর্ব ১১৬০ অব্দে মৃত্যুবরণ করা রামেসিসের গলায় ছিল পেঁয়াজের মালা। তার দুই চক্ষে পাওয়া গেছে পেঁয়াজের অংশ। মৃতদেহের শরীরের নানা অংশে পেঁয়াজ গুঁজে দেওয়ার রীতি ছিল মিশরীয়দের মাঝে। অনেক মৃতদেহের বুক, কান ও পায়ের পাতায় দেখা গেছে পেঁয়াজের ব্যবহার। গবেষকদের মতে, পেঁয়াজের ঝাঁঝালো গন্ধ মৃতকে আবারো নিশ্বাস নিতে সাহায্য করতে পারে এমন বিশ্বাস ছিল তাদের। পিরামিডের দেয়ালে পেঁয়াজ নিয়ে শিল্পকর্মও পাওয়া গেছে।
আধুনিক পোলাও রান্নার যে কলাকৗশল বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ইবনে সিনা লিখে গিয়েছিলেন সেখানে কি পেঁয়াজের কথাও ছিল? পাঠক খুঁজে দেখতে পারেন বলতে পারবেন।