প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলি যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিযোগিতার নয়া-ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে

কোথাও প্রবাল প্রাচীরের কোলে গড়ে ওঠা জনবসতি, কোথাওবা আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে সৃষ্টি হওয়া দ্বীপপুঞ্জ। দক্ষিণ প্রশান্ত সাগরের সুনীল সুবিশাল ব্যাপ্তিতে এক টুকরো ডাঙ্গার মতো তাদের অবস্থান। মহাসাগরের বুকে এক চিলতে মাথা উঁচু করা জনবিরল এই দ্বীপগুলির খনিজ সম্পদ নেই তেমন। বরং পর্যটনের জন্যই তারা বেশি পরিচিত।
এমন বিরান দ্বীপমালা ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠবে- সাদা চোখে দেখে কারো মনে হবে না। কিন্তু, তেমনটাই হচ্ছে। এসব ভূখণ্ড হয়ে উঠেছে বিশ্বের শীর্ষ দুই শক্তিধর রাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কূটনীতিক প্রভাব বিস্তারের ময়দান; যেখানে বিজেতা পাবে আধিপত্যের পুরস্কার।
বিগত কিছুদিনে এই প্রতিযোগিতা নতুন করে সামনে আসে। এ সময় দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ৮ দেশে ১০ দিনের এক তাৎপর্যপূর্ণ সফর সম্পন্ন করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক নিরাপত্তার সম্পর্ক স্থাপনসহ অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতার চুক্তি প্রস্তাব নিয়ে হাজির হন ওয়াং। আর তাতে সফল হলে দক্ষিণ প্রশান্তে বেইজিং এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে বিস্তার লাভ করবে।
ওয়াং এর সফর এবং প্রস্তাবিত চুক্তির খবর প্রকাশ পাওয়ার পর দক্ষিণ প্রশান্তের দেশগুলোর ওপর দীর্ঘদিন একক আধিপত্য ধরে রাখা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ব্যতিব্যস্ততা দেখা মেলে তাদের প্রতিক্রিয়ায়। চীনকে ঠেকাতে গত সপ্তাহে এই অঞ্চলের জন্য সহায়তা বাড়ানোর ঘোষণা দেয় ওয়াশিংটন। নিজ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অঞ্চলটিতে পাল্টা সফরে পাঠাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া।
তবে দুই পরাশক্তির প্রতিযোগিতার এই দিকটিকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে বলছেন না প্রশান্তের দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর সরকার-প্রধানেরা। বরং জলবায়ু পরিবর্তনসহ তাদের সামনে থাকা নানান সমস্যার সমাধানে সকলের সহযোগিতার দিকে আলোকপাত করছেন তারা।
যেমন ফিজির প্রধানমন্ত্রী ভোরকে বাইনিমারামা উল্লেখ করেন, "যেসব দেশের জনপদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে ডুবছে- তাদের জনতার কাছে ভূরাজনীতিক দ্বন্দ্ব তেমন গুরুত্ব রাখে না।"
গত সপ্তাহে ১০ দেশের সাথে চীনের আরও বৃহৎ আঞ্চলিক চুক্তির বৈঠকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো চুক্তির প্রতি তাদের খোলামেলা সমর্থন দেয়নি। তবে ওয়াং এর সফর একটি দিক স্পষ্ট বার্তা দেয় যে- এই অঞ্চল নিয়ে চীনের কৌশলগত লক্ষ্য রয়েছে। এবং তাতে করে দ্বীপ দেশগুলি বড় পরাশক্তিদের মল্লযুদ্ধের মধ্যে পড়বে।
একের পর এক দ্বীপে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা
ওয়াশিংটন ও ক্যানবেরার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যায়, বেইজিং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের সরকারগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করছে। চীন বড় অবকাঠামো নির্মাণের চুক্তি করে তাদেরকে হাতে রাখতে চায়। তবে মূল লক্ষ্য, মাঝারি পরিসরে হলেও নিরাপত্তা চুক্তি সই- যার মাধ্যমে চীনা সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা যাবে।
এতে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে বিদ্যমান মার্কিন সামরিক ঘাঁটির সমান্তরালে চীনের গণমুক্তি ফৌজ ও নৌবাহিনীর মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হবে। বর্তমানে মাইক্রোনেশিয়া, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ প্রজাতন্ত্র এবং পালাউ প্রজাতন্ত্রে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি আছে। নিরাপতা চুক্তির আওতায় এসব দেশের আকাশপথ ও জলসীমায় অবাধে বিচরণ রয়েছে মার্কিন বাহিনীর।
অস্ট্রেলিয়াও এই অঞ্চলে তাদের নৌশক্তিকে মোতায়েন রেখেছে। প্রতিবেশী দ্বীপগুলির সরকারের সাথে ক্যানবেরাও নিরাপত্তা চুক্তি করেছে। এর মাধ্যমে শান্তিরক্ষা ও সামরিক প্রশিক্ষণ- উভয় ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়।
অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি আমেরিকার আরেক ঘনিষ্ঠ মিত্র- নিউজিল্যান্ডেরও রয়েছে ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর সাথে আঞ্চলিক ও দ্বিপাক্ষিক উভয় ধরনের নিরাপত্তা চুক্তি।
এজন্যই গত সপ্তাহে এ অঞ্চল নিয়ে যৌথ বিবৃতি দেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। "প্রশান্ত মহাসাগরে আমাদের (পশ্চিমা) আদর্শের বিপরীত কোনো দেশের (চীন) সামরিক উপস্থিতি গভীর উদ্বেগের" বলে উল্লেখ করা হয় সেখানে।
চীনের তৎপরতা আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে তুলনা করছে। ওই সময়ে জাপানি সাম্রাজ্য একের পর এক প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ দখলে নিয়ে এক পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত দখলের পরিকল্পনা করেছিল। ছোট ছোট দ্বীপকে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের এই কৌশল পরে আমেরিকা গ্রহণ করে। এবং জাপানিদের হাত থেকে অনেক দ্বীপ দখল করে নিয়ে- এক পর্যায়ে সেগুলি ব্যবহার করে জাপানে বিমান হামলা চালাতে শুরু করে। এই কৌশলকে বলা হয় 'আইল্যান্ড হপিং'- যা প্রশান্ত মহাসাগরে লড়াইয়ের মোড় মিত্রশক্তির পক্ষে ফিরিয়ে আনে। মার্কিন নৌ ও বিমানশক্তি সমুদ্রে জাপানের আধিপত্যকে চুরমার করে দেয়।
আমেরিকা ও পশ্চিমা দুনিয়া চীনের সাথে পরবর্তী যুদ্ধের অনুমান করে। যুদ্ধ বাঁধলে চীন তখন একই কৌশল নেবে বলে আশঙ্কা করছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক শীর্ষ প্রতিরক্ষা চিন্তক সংস্থা- র্যান্ড কর্পোরেশনের জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ টিমোথি হিথ বলেন, "অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার বাণিজ্যিক ও সামরিক জাহাজগুলি যে নৌপথে চলাচল করে দ্বীপগুলি তার দুই পাশে অবস্থিত। চীন যদি এসব জায়গায় ঘাঁটি নির্মাণের সুযোগ পায়, তাহলে সেখান থেকে যুদ্ধজাহাজ ও বিমান মোতায়েন করতে পারবে। চীনা বিমান ও রণতরী আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার জাহাজগুলিকে (যুদ্ধের সময়ে) হুমকির মুখে ফেলবে।"
চীনের উপস্থিতি সামান্যতম জোরদার হলে গুপ্তচরবৃত্তির শঙ্কা করছেন এ বিশেষজ্ঞ। চীন নিজস্ব রেডার, সোনার বা সাইবার তৎপরতার মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার সামরিক তৎপরতার গোপন অনেক তথ্য জেনে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

বন্ধুত্ব পাতানোর আরেক কারণ তাইওয়ান
চীনের পক্ষ থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলির দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেওয়া নতুন ঘটনা নয়। ২০০০ এর দশকের শুরুতে আমেরিকা যখন মধ্যপ্রাচ্যের তথাকথিত 'হুমকি' মোকাবিলায় ব্যস্ত তখন বিদেশনীতি নিয়ে আগ্রহ বাড়ছিল চীনের। তখনই প্রশান্তের দ্বীপ দেশগুলির অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অংশীদার হওয়ার লক্ষ্য নেয় বেইজিং।
দ্বীপগুলি আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘে রয়েছে তাদের রাষ্ট্র-সদস্যপদ। তাইওয়ানকে তারা স্বীকৃতি দিলে তাতে 'এক চীন' নীতির পরাজয় ঘটবে। তাই এসব ক্ষুদ্র দেশের গুরুত্ব চীনের কাছে অপরিসীম হয়ে ওঠে। সাহায্য-সহায়তার বন্ধুত্বে তাদের তাইওয়ান থেকে দূরে রাখার কৌশল নেন চীনা কূটনীতিকরা।
এরমধ্যেই প্রশান্ত মহাসাগরের ১৪টি দ্বীপরাষ্ট্রের মধ্যে ৪টি তাইওয়ানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বাকিরা যাতে না দেয়- সেদিকটাও নিশ্চিত করতে চায় বেইজিং। চীনের তৎপরতার কারণে এর আগে ২০১৯ সালে তাইওয়ানকে দেওয়া স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে কিরিবাতি ও সোলোমন দ্বীপপুঞ্জ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আরও সাহসী পররাষ্ট্রনীতির পথে চলছে বেইজিং। বাড়িয়েছে বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন সহযোগিতা। এভাবে আন্তর্জাতিক স্তরে নিজের প্রভাব বাড়াতে চাইছে। তার প্রতিফলন প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতেও দেখা যাচ্ছে।
এরমধ্যেই সোলোমন দ্বীপপুঞ্জে প্যাসিফিক গেমস অনুষ্ঠানের জন্য একটি জাতীয় ক্রীড়া স্টেডিয়াম নিমার্ণ করে দিয়েছে চীন। পাপুয়া নিউগিনিতে মহাসড়ক, ফিজিতে সেতু—সবই হয়েছে চীনের বদৌলতে। এসব দ্বীপে নিয়মিত পা রাখছেন বেইজিং- এর শীর্ষ কূটনীতিকরা। এমনকী খোদ প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দুইবার অঞ্চলটি সফর করেন। চীন প্রশান্তের দ্বীপগুলির অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদারও হয়ে উঠেছে।
অস্ট্রেলীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক লোয়ি ইনস্টিটিউটের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছর ধরে অস্ট্রেলিয়া এ অঞ্চলে সহায়তা দানে প্রথম স্থানে রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিছু ক্ষেত্রে চীনের অবদান প্রচলিত দাতাদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
সোলোমন দ্বীপপুঞ্জের একজন রাজনৈতিক উপদেষ্টা- সেলসুস তালিফিলু সিএনএনকে বলেন, "সবাই মনে করে, চীন আমাদের জন্য আরও বেশি বেশি করবে। রাজনীতিকরা মনে করেন, চীনের সাথে সহজে চুক্তি করে- খুব দ্রুত মাঠপর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়। সে তুলনায়, সোলোমন দ্বীপপুঞ্জকে দীর্ঘদিন ধরে অন্য যেসব দেশ সহায়তা দিয়ে আসছে তাদের থেকে পেতে অনেক দেরি হয়ে যায়।"
- সূত্র: সিএনএন