রণাঙ্গনে বিপুল সেনা হারাচ্ছে ইউক্রেন, আর কতদিন যুদ্ধে টিকতে পারবে দেশটি?

রাশিয়ান শেলিং-এ নিহত পোড়খাওয়া জেনারেলকে কবর দেওয়ার পরপরই গোরস্থানের লোকেরা নতুন আরেকটি কবর খুঁড়তে লেগে গেল। যেভাবে রণক্ষেত্রে ইউক্রেনের সৈন্যরা নিহত হচ্ছেন, তাতে এসব নতুন কবর বেশিদিন ফাঁকা থাকবে না।
কর্নেল অলেকসান্ডার মাখাচেক বিধবা স্ত্রী এলেনা এবং দুই কন্যা ওলেনা ও মিরোস্লাভা-অলেকসান্ডারকে রেখে মারা গেলেন। যু্দ্ধের প্রথম ১০০ দিনের মাথায় জিতোমিরের সামরিক গোরস্থানে কর্নেলের কবরটি ছিল ৪০তম। জিতোমিরের অবস্থান কিয়েভ থেকে ১৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে।
পূর্ব ইউক্রেনের লুহানস্কে ৩০ মে রাশিয়ান গোলার আঘাতে মারা পড়েন কর্নেল মাখাচেক। তার কবরের পাশেই আরেকটি কবর, সেখানে শায়িত আছেন ভিয়াশেস্লাভ ভরনিত্সকি। তিনি মারা গিয়েছিলেন ২৭ মে। আশপাশের বাকি কবরগুলোও অতিসম্প্রতি মারা যাওয়া সৈনিকদের। আর এটা কেবল একটি গোরস্থানের হিসাব।
এ সপ্তাহে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি জানিয়েছেন, যু্দ্ধে প্রতিদিন দেশটির ৬০ থেকে ১০০ জন সৈন্য নিহত হচ্ছে। এটি দেশটির জন্য কেমন ক্ষতি তার একটা তুলনা দেওয়া যাক। ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক ও প্রাণহানিকর ছিল। আর সে বছর দৈনিক গড়ে ৫০ জন মার্কিন সৈন্য যুদ্ধে প্রাণ হারাত।
শুক্রবার ৪৯ বছর বয়সী কর্নেল মাখাচেকের শেষকৃত্যে যারা স্যালুট জানিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন জেনারেল ভিক্টর মুজেঙ্কো। ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইউক্রেন সশস্ত্র বাহিনী চিফ অভ জেনারেল স্টাফ ছিলেস। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন ইউক্রেনের এ সৈন্যক্ষয় আরও মারাত্মক হতে পারে সামনে।
"যুদ্ধে এটা একটা সংকটপূর্ণ সময়, তবে এখনো এটি সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়নি," দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন মুজেঙ্কো।
"দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই ইউরোপের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত। সেজন্যই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এত বেশি হচ্ছে। এ ক্ষতি কমাতে ইউক্রেনের এখন শক্তিশালী অস্ত্র দরকার, যা রাশিয়ান অস্ত্রের সমতুল্য বা তার চেয়ে শক্তিশালী হবে। এতে করে ইউক্রেনের সমানে সমানে লড়াই করার সক্ষমতা তৈরি হবে।"
কিয়েভ দখলে ব্যর্থ হয়ে মস্কো এখন ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল দখলের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। সেজন্য এখানে শক্তিবৃদ্ধি করে আক্রমণ চালাচ্ছে রাশিয়ান বাহিনী। এর ফলে বেশি সংখ্যায় মারা পড়ছে ইউক্রেনীয় সেনারা।
রাশিয়ার এ পদ্ধতিকে 'মধ্যযুগীয় রণপন্থা' হিসেবে অভিহিত করেছেন ইউরোপে মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল বেন হজেস।
তিনি বলেন, যতক্ষণ না ইউক্রেন পশ্চিমাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুত অস্ত্র না পাবে, ততক্ষণ তাদেরকে এরকম ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
"ইরাক ও আফগানিস্তানে ২০ বছরে আমরা যা দেখেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাণঘাতী এ যুদ্ধক্ষেত্র। ইরাক-আফগানিস্তানে আমরা এত বেশি সংখ্যায় মৃত্যু দেখিনি," এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে এপিকে এসব কথা বলেন তিনি।
"ইউক্রেন প্রচুর সামরিক নেতা, সার্জেন্ট হারাচ্ছে। কারণ তাদেরকে সবসময় যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতে হয়, নির্দেশনা দিতে হয়। এর ফলে তারা সহজেই শত্রুর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন," বলেন হজেস।
মাখাচেক ছিলেন একজন মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার। তার দলের দায়িত্ব ছিল মাইনফিল্ড ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা। এসব তথ্য জানিয়েছেন তার শেষকৃত্যে অংশ নেওয়া ৩০ বছরের বন্ধু কর্নেল রুসলান শুতোভ।
"গোলাবর্ষণ শুরু হলে সে ও তার দল নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। তার দলে ছিল মোট চারজন। মাখাচেক তাদেরকে ডাগআউটে (পরিখা) আশ্রয় নিতে বলে। সে অন্য একটি ডাগআউটে আশ্রয় নেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার গর্তেই একটি আর্টিলারি শেল এসে পড়ে," বলেন শুতোভ।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ইউক্রেনের নিয়মিত সৈন্য ছিল আড়াই লাখ। আরও এক লাখ সৈন্যকে নিযুক্ত করার কাজও চলছিল। ১৪ সপ্তাহের বেশিদিন ধরে চলা যুদ্ধে মোট কতজন মারা গেছেন সে তথ্য জানায়নি ইউক্রেন সরকার।
কতজন ইউক্রেনীয় বেসামরিক নাগরিক বা দুপক্ষেরই কতজন সৈন্য মারা গেছে এ নিয়ে পরিষ্কার কোনো তথ্য নেই কারও কাছেই। সরকারি কর্মকর্তারা যখন যে সংখ্যা বলেছেন, তা হয়তো আসল সংখ্যার চেয়ে অনেক কম বা অনেক বেশি। এসব তথ্য নিশ্চিত করে জানাটা প্রায় অসম্ভব।
পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা মনে করছেন রাশিয়া কয়েক হাজার সেনা হারিয়েছে। এদিকে ইউক্রেনও যেহেতু সৈন্য হারাচ্ছে, তাই দেশটির এ হারানো সেনাদের স্থলে নতুন সেনা আনতে হবে। চার কোটি ৩০ লাখ মানুষের দেশ ইউক্রেন, তাই জনবলের বিশেষ অভাব নেই।
"কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে রিক্রুট করা, প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং পরে তাদেরকে রণাঙ্গনে পাঠানো," বলেন ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন মেরিন কর্নেল মার্ক কানসিয়ান।
"যদি এ যুদ্ধপরিস্থিতি দীর্ঘ হয়, তাহলে সৈন্যদের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে," বলেন কানসিয়ান।
ইউক্রেনীয় জেনারেল মুজেঙ্কো মনে করেন ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে জেলেনস্কির এ মন্তব্য ইউক্রেনীয় মনোবলকে আরও চাঙা করে তুলবে এবং পশ্চিমা অস্ত্র পেলে পাশার দান উল্টে যাবে।
"যুদ্ধক্ষেত্রে কী হচ্ছে সেটা নিয়ে ইউক্রেনীয়রা যতটা জানতে পারবে, তত বেশি প্রতিরোধ গড়ে উঠবে," বলেন তিনি।
"তবে হ্যাঁ, এটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্ষতি। কিন্তু আমাদের মিত্রদের সহায়তায় আমরা ক্ষতি কমিয়ে সফল আক্রমণ চালাতে পারব। এর জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী অস্ত্রের।"
- সূত্র: দ্য টাইমস অব ইজরায়েল