দুনিয়াজুড়ে আসছে খাদ্য বিপর্যয়!

যুদ্ধ মানেই বিনাশ, সাধারণত বেশিরভাগ ক্ষয়ক্ষতি হয় যুদ্ধাঞ্চলে। তবু কখনো বিশ্বগ্রামের পথ ধরে সংঘাতের সুদূরপ্রসারী আঘাত দুনিয়ার দূর দূরতম প্রান্তে অনুভূত হয়। ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে পুতিন শুধু রণাঙ্গনে নয়, তার চেয়েও বেশি মানুষের জীবন ধবংসের মুখে ঠেলে দিয়েছেন- যা নিয়ে তিনি নিজেও একদিন হয়তো আক্ষেপ করবেন।
করোনা মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানির চড়া মূল্যস্ফীতির আঘাতে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ হয়ে উঠেছিল সমস্যাসঙ্কুল; যুদ্ধ এবার তার পায়ে কুড়াল মেরেছে। বন্ধ হয়েছে ইউক্রেন থেকে দানাদার শস্য ও তেলবীজ রপ্তানি; আর রাশিয়ার রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার হুমকিতে রয়েছে। অথচ বিশ্বব্যাপী মোট ক্যালোরির ১২ শতাংশ দেশদুটি রপ্তানি করে।
চলতি বছরের শুরু থেকে গমের দাম বাড়ে ৫৩ শতাংশ; তাপপ্রবাহের কারণে ভারত গম রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলে গত ১৬ মে নাগাদ দাম চড়েছে আরও ৬ শতাংশ।
খাদ্য একটি মৌলিক মানবিক চাহিদা। খাদ্য মূল্যস্ফীতি মানেই জীবনযাত্রার সর্বস্তরে ব্যয় বৃদ্ধির চাপ। তবে সামনে যে মহাদুর্যোগ তাকে শুধু জীবনযাপনের ব্যয় সংকট দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। গত ১৮ মে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেজ সতর্ক করে বলেছেন, আগামী মাসগুলোয় বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের এমন তাণ্ডব দেখা যাবে যা কয়েক বছর ধরে চলতে পারে। প্রধান প্রধান খাদ্যের উচ্চ মূল্যের ফলে অনাহারে থাকতে হবে এমন মানুষের সংখ্যা ৪৪ কোটি বেড়ে দাঁড়াবে ১৬০ কোটিতে। এরমধ্যে দুর্ভিক্ষের হুমকিতে থাকবে ২৫ কোটি আদম সন্তান। যুদ্ধ দীর্ঘদিন চলবে বলেই মনে হচ্ছে, আর তাই যদি হয়- তাহলে আরও কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যের শিকার হবে। বাড়বে রাজনৈতিক অসন্তোষ ও অস্থিতিশীলতা, শিশুরা অপুষ্টির শিকার হবে, ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হবে মানুষ।
দ্য ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন বর্তমান পরিস্থিতির এমন বিশ্লেষণ করে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রতি খাদ্য সরবরাহকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছে। সেখানে বলা হয়, খাদ্য সংকট এই যুদ্ধের একমাত্র অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হতে পারে না। এটি এড়ানোর পথ রয়েছে। পুতিনসহ অন্য বিশ্বনেতাদের অবশ্যই 'ক্ষুধা'কে একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, যার সমাধানও হতে হবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সম্মিলিত চেষ্টায়।
বিশ্বব্যাপী গম বানিজ্যের ২৮ শতাংশ সরবরাহ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। যৌথভাবে তারা মোট যব রপ্তানির ২৯ শতাংশ, ভুট্টার ১৫ শতাংশ এবং সুর্যমুখী তেলের ৭৫ শতাংশ সরবরাহ করে। লেবানন ও তিউনিসিয়ায় মোট দানাদার শস্যের অর্ধেক সরবরাহ করতো তারা; লিবিয়াক ও মিশরের ক্ষেত্রে যা দুই-তৃতীয়াংশ। ইউক্রেনের খাদ্য রপ্তানিতে যে পরিমাণ ক্যালোরি রয়েছে তাতে ৪০ কোটি মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটে। তবে যুদ্ধের কারণে দেশটি থেকে রপ্তানি একেবারেই বন্ধ। নৌপথে রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে ইউক্রেন নিজের সমুদ্রসীমায় জাহাজ-বিধ্বংসী মাইন স্থাপন করেছে, অন্যদিকে ওডেসা বন্দর অবরোধ করে রেখেছে রাশিয়া।
ইউক্রেনে আগ্রাসনের আগেই জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ২০২২ সাল বৈশ্বিক ক্ষুধা মোকাবিলায় এক অতি-চ্যালেঞ্জিং বছর হতে চলেছে বলে সতর্ক করেছিল। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গম উৎপাদক চীনে গেল বছর ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে গমের বীজ বপণ দেরীতে করতে হয়েছে। এতে চলতি বছরের ফলন স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হবে এমন কথা চীন সরকারই জানিয়েছে। নিজ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চীন এখন বিশ্ববাজার থেকে আরও বেশি গম কিনবে। দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির এই আগ্রাসী ক্রয়ে সীমিত সরবরাহ পেতেও মুশকিলে পড়বে স্বল্প আয়ের দেশগুলো।
খবর ভালো নয়, দ্বিতীয় বৃহৎ গম উৎপাদক ভারতেরও। দাবদাহে সেখানে এ বছর নষ্ট হয়েছে বিপুল জমির গম ফসল। বৃষ্টিহীনতা বিশ্বের 'রুটির ঝুড়ি' অন্যান্য প্রধান উৎপাদক অঞ্চলেও মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। আমেরিকার 'হুইট বেল্ট' খ্যাত গম উৎপাদনকারী অঞ্চল থেকে শুরু করে ফ্রান্সের বোঁজ অঞ্চল কেউই বাদ পড়েনি। হর্ন অভ আফ্রিকা অঞ্চলও চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াল খরায় পুড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের দুনিয়ায় সবাইকে স্বাগতম!
বলাবাহুল্য জলবায়ুর এ পরিবর্তন দরিদ্রদের ওপর শোচনীয় প্রভাব ফেলবে। যেমন উদীয়মান অর্থনীতির দেশে পরিবারপ্রতি ব্যয়ের ২৫ শতাংশ যায় খাদ্য ক্রয়ে, সাব-সাহারার আফ্রিকার দেশগুলোতে তা ৪০ শতাংশ। মিশরে রুটি মোট ক্যালোরির ৩০ শতাংশের যোগান দেয়। দরিদ্রদের সহায়তা দিতে এই অবস্থায় খাদ্য আমদানিতে সরকারি ভর্তুকি দরকার, কিন্তু আমদানি-নির্ভর অনেক দেশের সরকারের সেটি আরও বাড়ানোর সামর্থ্য নেই। বিশেষ করে, যাদের খাদ্য ও চড়া মূল্যে জ্বালানি দুই-ই আমদানি করতে হচ্ছে- তাদের ক্ষেত্রে আর্থিক সক্ষমতা যথেষ্ট কম।
সংকট আরও গুরুতর হওয়ার হুমকি দেখা দিচ্ছে। যুদ্ধের আগেই গত গ্রীষ্মে উৎপাদিত গমের বেশিরভাগ রপ্তানি করেছে ইউক্রেন। রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যে জাহাজে পণ্য পরিবাহী কোম্পানিগুলোকে বাড়তি খরচ ও ঝুঁকি নিতে হলেও, এখনও দানাদার শস্য রপ্তানি করতে পারছে মস্কো।
বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে নষ্ট হয়নি- ইউক্রেনের এমন অনেক সাইলো ভর্তি ভুট্টা ও যব রয়ে গেছে। এদিকে আগামী জুন থেকে শুরু হবে ফসল সংগ্রহের মৌসুম। সাইলোতে জায়গা না থাকায় এই ফলন রাখার আর জায়গা নেই। ফলে সেগুলি নষ্ট হয়ে যাবে। নিয়তির করুণ পরিহাস- বিশ্ব যখন খাদ্য পেতে অস্থির- তখন বিপুল শস্য পচতে থাকবে কৃষিজমিতে। তারপরের মৌসুমের জন্য ক্ষেত তৈরির জন্য দরকারি শ্রমিক ও জ্বালানি তেলের সংকটেও ভুগছে ইউক্রেন। রয়েছে বীজ ও কীটনাশকের সংকট। অর্থাৎ, পরের মৌসুমে ফলন আরও কমে যাবে।
দানাদার শস্যের দাম বাড়তে থাকলেও তার সুযোগ নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের কৃষকেরা সরবরাহে ঘাটতি পূরণের সুযোগ পাচ্ছেন না। এর আরেকটি কারণ, সকল পণ্যমূল্যের অস্থিতিশীল দশা। কৃষকদের ব্যয়ও সেকারণে বেড়েছে। সার ও জ্বালানির চড়া দামে মুনাফা সীমা কমছে তাদের। কৃষকদের প্রধানত খরচ করতে হয় এ দুটি খাতে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এবং তার ফলে বিশ্ববাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যে আগুন কৃষকদের নাভিশ্বাস ওঠাচ্ছে। কৃষকরা যদি এখন সারে খরচ কমান, তাহলে সবচেয়ে ভুল সময়েই কমবে বৈশ্বিক ফলন।
ফলন কমলে উদ্বিগ্ন রাজনীতিবিদেরা খারাপ পরিস্থিতিকে আরও বাজে রূপদানের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে কাজাখস্তান থেকে শুরু করে কুয়েত- খাদ্য রপ্তানিতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ২৩টি দেশ। এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছে মোট বৈশ্বিক ক্যালোরি বাণিজ্যের ১০ শতাংশ। সীমিত করা হয়েছে মোট সার রপ্তানির এক-পঞ্চমাংশ। এই বাণিজ্য বন্ধ হলে, নিশ্চিত দুর্ভিক্ষ হানা দেবে।
দুর্দশার জন্য একে-অন্যকে দোষারোপের ক্ষেত্র এখন প্রস্তুত। এখানে পশ্চিমা দুনিয়া পুতিনকে ইউক্রেনে আগ্রাসনের জন্য দোষ দিচ্ছে। আর রাশিয়া দায় চাপাচ্ছে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে। বাস্তবতা হলো, পুতিনের যুদ্ধ সরবরাহকে ব্যাহত করেছে আর নিষেধাজ্ঞা সংকটকে তীব্র করে তুলেছে। তাদের এ ধরনের কাদা ছোড়াছুঁড়ি কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকারই অজুহাত। একইসময়, অন্ন জুটবে না কোটি কোটি মুখে; অনাহারে মৃত্যুও হবে অনেকের।
তাই খাদ্য ও কৃষি বাজারকে উন্মুক্ত রাখতে সব দেশকে একযোগে কাজ করতে হবে। যেমন চলতি সপ্তাহেই বিশ্বের ৬০ শতাংশ পাম তেলের সরবরাহক ইন্দোনেশিয়া পণ্যটি রপ্তানির সাময়িক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। ইউরোপকে এখন ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানি যাতে করা যায় সে উদ্যোগও নিতে হবে। দেশটি থেকে রেলপথে রোমানিয়া বা বাল্টিক দেশগুলো হয়ে শস্যের চালান আনা সম্ভব। তবে সবচেয়ে ইতিবাচক পূর্বাভাসও বলছে, এভাবে মোট ফসল মজুদের মাত্র ২০ শতাংশ নিয়ে আসা সম্ভব।
আমদানিকারক দেশগুলোরও সহায়তা দরকার। নাহলে বিশাল আমদানি খরচের চাপে তারা নিঃস্ব হয়ে যাবে। শস্যের জরুরি চালান পাঠাতে হবে সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোতে। বাকীদের সহজ শর্তে আমদানিতে অর্থায়ন সাহায্য করতে হবে। আইএমএফ এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এতে দাতাদের ডলার বিশ্বজনতার কল্যাণে কাজে আসবে। পুরোনো দেনার সুদ-আসল মওকুফ করেও অনেক দেশের বাজেটে চাপ কমানো সম্ভব। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ কমলে, বাজেটে ওই সম্পদ খাদ্য নিরাপত্তার পেছনে বরাদ্দ রাখতে পারবে উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলি।
বিকল্প অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগও আছে। বিশ্বের মোট দানাদার শস্যের ১০ শতাংশ জৈবজ্বালানী বা বায়োফুয়েল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। ১৮ শতাংশ ভেজিটেবল অয়েল যায় বায়োডিজেল উৎপাদনে। এরমধ্যেই বায়োডিজেলে শস্য থেকে উৎপাদিত মিশ্রণ রাখার শর্ত শিথিল করেছে ফিনল্যান্ড ও ক্রোয়েশিয়া। অন্যদেরও উচিত তাদের অনুসরণ করা।
শস্যের আরেকটি বিশাল অংশ পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, শুস্ক পশুখাদ্যের ১৩ শতাংশই শস্যদানা। ২০২১ সালে চীন তার শুকরপালের জন্য ২ কোটি ৮০ লাখ টন ভুট্টা আমদানি করেছিল। এর পরিমাণ ছিল ইউক্রেনের মতো দেশের এক বছরের রপ্তানির চেয়েও বেশি।
রাশিয়া কৃষ্ণসাগরে অবরোধ তুলে নিলেও তাৎক্ষণিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে বিশ্ববাজার। ইউক্রেনে আটকা রয়েছে ২ কোটি ৫০ লাখ টন ভুট্টা ও গম, যা বিশ্বের সকল দরিদ্রতম দেশের বার্ষিক খাদ্য চাহিদার সমান।
তিনটি দেশের ভূমিকা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়াকে ইউক্রেনের বন্দরে বেসামরিক খাদ্যবাহী জাহাজ চলাচল করতে দিতে হবে। ইউক্রেনকে সামুদ্রিক মাইন অপসারণ করতে হবে এবং বিনিময়ে রাশিয়ার নৌযানকে বসফোরাস প্রণালী ব্যবহার করতে দেবে তুরস্ক।
বলা সহজ হলেও, এটি করা সহজ নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার অবস্থা ভালো নয়, মস্কো তাই ইউক্রেনের অর্থনীতিকে গলা টিপে ধরতে চাইছে। ইউক্রেনও নিজেদের বেছানো মাইন অপসারণে রাজি নয়। তাদেরকে রাজি করাতে ভারত ও চীনসহ অন্য দেশগুলোকে যথেষ্ট ঘাম ঝড়াতে হবে। খাদ্যবাহী জাহাজকে প্রয়োজনে যুদ্ধ জাহাজের বহর দিয়ে পাহারা দিতে হবে। এই প্রহরী জোট গঠন হতে পারে সকল দেশের সমন্বয়ে, কারণ বিশ্বের মুখে খাদ্য তুলে দেওয়া সকলেরই একান্ত কর্তব্য।
- সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট