শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি থেকে জন্ম নেওয়া সংকট এরপর কোনদিকে মোড় নেবে

চলতি সপ্তাহে শ্রীলঙ্কায় সরকারি দলের সমর্থক, নিরাপত্তা বাহিনী ও বিক্ষোভকারী জনতার মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ৮ জন নিহত হয়েছে, আহত কয়েক শ'। এতে দেশটিতে কয়েক মাস ধরে চলা খাদ্য ও জ্বালানি সংকট আরো তীব্র রূপ নিল। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেও ক্রমে আরো বেশি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন।
দেশব্যাপী জারি করা কারফিউ বৃহস্পতিবার (১২ মে) সকাল পর্যন্ত বাড়িয়েছেন তিনি।
এর আগে গত সোমবার সরকার সমর্থকরা প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভকারী জনতার ওপর হামলা চালায়। এতে ক্ষুদ্ধ বিরোধীরা পাল্টা হামলা করে আগুন লাগায় শাসক দলের আইনপ্রণেতার বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন বিভিন্ন সম্পত্তিতে।
ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়েছেন গোতাবায়ার ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে। এতে মন্ত্রিসভাও ভেঙ্গে যায়। ফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ অন্যান্য ঋণ দাতাদের সাথে চলতি বছরের জন্য বকেয়া ৮৬০ কোটি ডলার আরো দেরিতে কীভাবে দেওয়া সম্ভবপর হয়- সে আলোচনা চালিয়ে যাবে কার্যত এমন সরকারও নেই। অথচ দেশটির আর্থিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করতে এবং সরকার যেন ২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যাকে নিত্যপণ্য সরবরাহ করতে পারে সে স্বার্থেই দাতাদের সাথে একটি চুক্তি করা অত্যন্ত জরুরি।
রাজনৈতিক আবহ ক্রমশ ঘোলাটে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। অন্যদিকে বিরোধীরাও তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনে সাফ অসম্মতি জানিয়েছে। বিরোধীদের যুক্তি, সংবিধান সংস্কার করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত না করলে তারা জাতীয় সরকার গঠনে অংশ নেবে না।
কলম্বো-ভিত্তিক ন্যাশনাল পিস কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক জেহান পেরেরা মন্তব্য করেন, "ভবিষ্যতে কী হবে সে সম্পর্কে দেশবাসীকে একটি সময়সীমা জানানো উচিত প্রেসিডেন্টের। পরিস্থিতি আরো শোচনীয় হওয়ার আগে একমাত্র এ উপায়েই তিনি একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজের ভুল সংশোধন করতে পারবেন।"
এমন সঙ্গীন অবস্থায় শ্রীলঙ্কার সম্ভাব্য রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বেশকিছু দৃশ্যপট আলোচনা করেছে মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গ।
যা যা হতে পারে:
১. প্রেসিডেন্ট অভিসংশিত হতে পারেন
শ্রীলঙ্কার সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টকে অপসারণ বেশ কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। এজন্য প্রথমে প্রেসিডেন্টকে দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনের অযোগ্য এমন একটি প্রস্তাবনা পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাশ হতে হবে। এরপর বিষয়টির তদন্ত করবে সুপ্রিম কোর্ট। বিচারকেরা যদি তদন্তের ফলাফল নিয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছান, তাহলে সাংসদদের আবার ভোটাভুটি করতে হবে।
এদিকে শ্রীলঙ্কার সরকারি দল পিপলস ফ্রন্ট পার্টি জানিয়েছে, এখনও পার্লামেন্টে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। গত সপ্তাহে নিজেদের মনোনীত নতুন ডেপুটি স্পিকারকে নির্বাচিত করে তারা সে দাবির সত্যতাও প্রমাণ করেছে।
২. বিরোধীদের সাথে প্রেসিডেন্টের জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন
প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে মাহিন্দা রাজাপাকসে সরে দাঁড়ানোয় বিরোধী দলগুলোকে সাথে নিয়ে আবারো জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের চেষ্টা করতে পারবেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। তবে প্রেসিডেন্টের হাতেই সিংহভাগ ক্ষমতা থাকায় বিরোধী দলগুলি বারংবার এমন প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়েছে।
এ বাস্তবতায় শ্রীলঙ্কার বার কাউন্সিল ও প্রভাবশালী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটি পরিষদ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এই সরকার ১৮ মাস দেশ শাসন করবে। এই সময়ে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত করতে একটি সংশোধনী তৈরি করবেন আইনপ্রণেতারা। তবে সব দলমতের নিরঙ্কুশ সমর্থন ছাড়া এধরনের সরকার গঠন হলে তা অস্থিতিশীলই হবে।
৩. প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট ভেঙ্গে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিতে পারেন
শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের মেয়াদ পাঁচ বছর। সংবিধান অনুসারে, মেয়াদের মাঝামাঝি সময়েই কেবল এটি ভেঙ্গে দিতে পারেন প্রেসিডেন্ট। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই মধ্যমেয়াদ আসবে। তবে তার আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনপ্রণেতারা একটি প্রস্তাবনা পাশ করে নিজেরাই পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেওয়ার আবেদন করতে পারেন।
সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন বিরোধী দলীয় নেতা এই সমাধানের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে নতুন নির্বাচন হবে বেশ ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। এতে বিরোধী জোট জিতলেও, প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষমতার লাগাম থাকবে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার হাতেই।
তিনি যে দলকে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে ঘোষণা করবেন, সেই দলেরই একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন। মন্ত্রীদের নাম ঘোষণা আর বহিষ্কারেও থাকবে তারই বেশিরভাগ কর্তৃত্ব। তিনি নিজেই নিজেকে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন।
আর ঠিক একারণেই নির্বাচন না চেয়ে বরং প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার ডালপালা ছাঁটার একটি প্রস্তাব এনেছে বিরোধী দলগুলো।
৪. প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ, দেশ ছেড়ে পলায়ন
বিক্ষোভকারী জনতা ও বিরোধী দলগুলোর এটাই প্রধান দাবি। তাদের স্লোগান স্পষ্ট বলছে, "গোতা তুমি চলে যাও"। শ্রীলঙ্কা জুড়ে সহিংসতা যখন দিন দিন বেড়েই চলেছে, তখন এই সম্ভাবনাকে আর উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গোতাবায়া পদত্যাগ করলে, যিনি পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন মূল ক্ষমতা চলে যাবে তার হাতে। দ্বিতীয় ক্ষমতাধর হবেন পার্লামেন্টের হাউজ স্পিকার।
সংবিধান অনুসারে, প্রেসিডেন্ট পদত্যাগের এক মাসের মধ্যে এক গোপন ব্যালটের মাধ্যমে তার পরবর্তী উত্তরসূরি নির্বাচন করতে হবে পার্লামেন্টকে।
৫. সামরিক অভ্যুত্থান:
শ্রীলঙ্কায় কর্তৃত্ববাদী শাসনের ইতিহাস থাকলেও কেউ যদি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায় তাহলে তা রাজাপাকসেদের টিকিয়ে রাখতেই করবে এমন সম্ভাবনাই বেশি। গোতাবায়া ও মাহিন্দা এ দুই ভাই মিলে গত ১৭ বছরের মধ্যে ১৩ বছর শ্রীলঙ্কা শাসন করেছেন। ২৬ বছর ধরে চলে আসা তামিল বিদ্রোহ দমনের কৃতিত্ব রয়েছে গোতাবায়ার। তিনি দুই ডজনের বেশি বর্তমান ও সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব পদে নিয়োগ দিয়েছেন।
গোতাবায়ার ঘনিষ্ঠ মিত্রদের মধ্যে রয়েছেন শ্রীলঙ্কার সেনাপ্রধান জেনারেল শেভেন্দ্রা সিলভা। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে, এই জেনারেলের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
এরমধ্যেই বিদেশি কূটনীতিকদের শেভেন্দ্রা সিলভা জানিয়েছেন যে, সেনাবাহিনী সংবিধান রক্ষা করবে এবং "রাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রয়োজন অনুসারে সব রকম সহযোগিতা দেবে।"
সূত্র: ব্লুমবার্গ