কে এই পুতিনের কথিত বান্ধবী অ্যালিনা?

ইউক্রেন আক্রমণের জেরে ইতোমধ্যেই পশ্চিমের কঠোর নিষেধাজ্ঞার অধীনে রয়েছে রাশিয়া। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এখন এই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় অ্যালিনা কাবায়েভার নামও যুক্ত করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অ্যালিনা কাবায়েভা একজন রুশ রাজনীতিবিদ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, সাবেক অলিম্পিক জিমন্যাস্ট এবং যদি গুজব সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী এবং তার কয়েকজন সন্তানের মা।
পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা শুধু রাশিয়ার জ্বালানি ব্যবসায় ক্ষেত্রেই নয় বরং প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছের মানুষদের লক্ষ্য করেও আরোপ করা হয়েছে। সেই তালিকায় রয়েছেন রাশিয়ার অলিগার্ক, রাজনীতিবিদ এবং প্রেসিডেন্টের সুনজরে রয়েছেন এমন কিছু সরকারি কর্মকর্তা।
গেল মাসে পুতিনের মেয়ে মারিয়া ভোরনসোভা (৩৬) কাতেরিনা টিখোনোভার (৩৫) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। প্রেসিডেন্টের সাবেক স্ত্রী লিউডমিলার সন্তান তারা।
তবে অ্যালিনা কাবায়েভার নাম আলোচনায় আসলেও এখন অবধি তিনি নিষেধাজ্ঞার বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছেন। জানা গেছে, সুইজারল্যান্ডে তার বাসভবন থেকে তাকে বহিষ্কারের দাবিতে চলতি বছরের মার্চে একটি অনলাইন পিটিশন স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
বিবিসির এক প্রতিবেদন নিশ্চিত করেছে, ইইউ কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ব্যক্তিদের সর্বশেষ তালিকায় রয়েছেন কাবায়েভা।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছেন, ক্রেমলিন থেকে প্রপাগান্ডা প্রচার এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে 'ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত' থাকার কারণে তাকে টার্গেট করা হতে পারে। তবে খসড়া নথিতে তাকে পুতিনের 'বান্ধবী' হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি এবং এখন অবধি ওই প্রস্তাবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষর করেনি ইইউ।
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বরাবরই নিজের ব্যক্তিগত জীবন গোপন রাখতে পছন্দ করেন। তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি সবসময়ই তা এড়িয়ে যান।
অ্যালিনা কাবায়েভার সঙ্গেও নিজের সম্পর্কের কথা স্পষ্টভাবে অস্বীকার করেছেন তিনি।
২০০৮ সালে মস্কোভস্কি করেসপন্ডেন্ট সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট পুতিন তার তৎকালীন স্ত্রী লিউডমিলাকে তালাক দিয়ে কাবায়েভাকে বিয়ে করার পরিকল্পনা করছেন। যদিও সেসময় দুজনেই এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এর কিছুদিন পরেই পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। সেই গুজবের বছর পাঁচেক পর পুতিন এবং লিউডমিলা বিবাহ বিচ্ছেদের ঘোষণা দেন।

রুশ প্রেসিডেন্ট যখন তাদের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করছিলেন, তখন কাবায়েভা নিজের সফল ক্রীড়া জীবন থেকে সবে রুশ রাজনীতিতে পা রাখছেন।
জিমন্যাস্টিক জগতে নিজেকে সেরা হিসেবে দাবি করেছেন কাবায়েভা। দলে আধিপত্য বিস্তারকারী শীর্ষস্থানীয় পারফর্মার ছিলেন তিনি। ২০০০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতিটি অলিম্পিকেই স্বর্ণপদক জিতেছে রাশিয়া।
১৯৮৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন অ্যালিনা কাবায়েভা। চার বছর বয়স থেকেই শুরু করেন রিদমিক জিমন্যাস্টিকস। তার প্রশিক্ষক ইরিনা ভিনার তার সম্পর্কে বলেন, "আমি যখন তাকে প্রথম দেখি, নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মেয়েটির মধ্যে রিদমিক জিমন্যাস্টিকসের গুরুত্বপূর্ণ দুটি গুণের বিরল সমন্বয় দেখেছিলাম আমি। প্রথমটি নমনীয়তা এবং দিত্বীয়টি তত্পরতা।"
কাবায়েভা 'রাশিয়ার সবচেয়ে নমনীয় নারী' হিসেবে পরিচিত।
১৯৯৬ সালে অন্তর্জাতিক ক্রীড়াঅঙ্গনে অভিষেক হয় তার। এরপর ১৯৯৮ সালে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপে জয়ী হয় তিনি।
২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকে প্রত্যাশিতভাবে হুপ পড়ে যাওয়ায় স্বর্ণ জিততে পারেননি কাবায়েভা। অলরাউন্ড ইভেন্টে কেবল ব্রোঞ্জ হাতেই বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। এর ৪ বছর পর এথেন্সে তিনি আবারও ভালো অবস্থানে ফিরে আসেন, সেবার স্বর্ণপদক জিতেই ঘরে ফিরেছিলেন কাবায়েভা।
অবসর পর্যন্ত তিনি অলিম্পিক পুরস্কার ছাড়াও ১৮টি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ পদক এবং ২৫টি ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ পদক জিতেছিলেন। তবে অন্যান্য রাশিয়ান ক্রীড়াবিদদের মতো, তিনিও ডোপিংয়ের কলঙ্ক থেকে রক্ষা পাননি। ২০০১ সালে মাদক পরীক্ষায় পজিটিভ আসার পর একটি ইভেন্টে তার পদক হারান।
২০০৭-১৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির হয়ে রাশিয়ার সংসদের নিম্নকক্ষে একটি আসন নিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
২০১৪ সালে ন্যাশনাল মিডিয়া গ্রুপের চেয়ার হন তিনি, প্রায় সব রাষ্ট্রায়ত্ত রাশিয়ান সংবাদমাধ্যমের বড় অংশীদার এই গ্রুপ।
এই মিডিয়া আউটলেটগুলোই ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ক্রমাগত রাশিয়ার জয়গান করছে, ইউক্রেনীয়দের ওপর নিজেদের শহর উড়িয়ে দেওয়ার দোষ চাপিয়ে রাশিয়ান বাহিনীকে রক্ষাকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করছে।
কাবায়েভার ধন-সম্পদও অনেক, কিছু ফাঁস হওয়া নথি বলছে তিনি বছরে ১২মিলিয়ন ডলার আয় করেন।
কবে প্রথম পুতিন ও তার প্রথম দেখা হয় তা জানা যায়নি। ২০০১ সালেও তাদের একসঙ্গে ছবি আছে, তাকে অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ সম্মাননা তুলে দিচ্ছিলেন পুতিন।

তাদের দুইজনের সন্তান আছে এমন গুজবও শোনা যায়।
এক সুইস সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালে লেক লুগানোতে কাবায়েভার এক পুত্র সন্তান হয়, ২০১৯ সালে একই স্থানে আরেক পুত্র সন্তান হয়। তবে সানডে টাইমস ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে মস্কোতে তার যমজ পুত্র সন্তান জন্ম নেয়।
তবে এ ধরনের সব খবরই অস্বীকার করে এসেছে ক্রেমলিন। ২০১৫ সালে পুতিনের মুখপাত্র বলেন, ভ্লাদিমির পুতিনের পুত্র সন্তান জন্মের খবরের কোনো সত্যতা নেই।
পুতিনের সঙ্গে সম্পর্কের এসব খবর চাউর হওয়ার পর থেকেই কাবায়েভা বেশ ক'বার আলোচনায় এসেছেন। ২০১১ সালে ভোগ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে দেখা যায় কাবায়েভাকে। ২০১৪ সালের সোচিতে অনুষ্ঠিত উইন্টার অলিম্পিকসের টর্চ বিয়ারার ছিলেন তিনি।
আরও সম্প্রতি, মস্কোতে জুনিয়র জিমন্যাস্টিকস ফেস্টিভালে দেখা যায় তাকে, সেখানে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার অবস্থানের প্রশংসা করেন তিনি। কিছু সংবাদমাধ্যম বলছে, সে সময় তাকে ওয়েডিং ব্যান্ড পরে থাকতে দেখা যায়।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই কাবায়েভাকে নিষিদ্ধের দাবি ওঠে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, খুব ব্যক্তিগত হয়ে যায় বিধায় কাবায়েভার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্র, এতে পরিস্থিতি আরও খারাপের আশঙ্কা থাকে।
তবে, গত এপ্রিলে হোয়াইট হাউজের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় কাবায়েভা নেই কেন জিজ্ঞেস করা হলে হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি মন্তব্য করেছিলেন, কেউ নিরাপদ নন।
- বিবিসি থেকে অনূদিত