সেন্ট পিটার্সবার্গে রহস্যময় শিল্পকর্ম রাশিয়ার পশ্চিমা বিরোধী প্রতিরোধের বার্তা দিচ্ছে

ইংরেজি অক্ষরগুলো পাশাপাশি মিলে তৈরি করেছে একটি শব্দ- 'জ্যামেস্টিম' (ZAMESTIM)। রুশ ভাষায় তার আক্ষরিক অনুবাদ দাঁড়ায়- 'আমরা প্রতিস্থাপন করব'। অজ্ঞাত কেউ এ শিল্পকর্মটি রেখে গেছে রাশিয়ার ঐতিহাসিক শহর সেন্ট পিটার্সবার্গের কেন্দ্রে।
প্রতিটি অক্ষর এমন একেকটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের আদ্যাক্ষর থেকে নেওয়া যারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দুনিয়ার ঘোষিত নিষেধাজ্ঞায় সাড়া দিয়ে দেশটি ছেড়ে চলে গেছে। ইন্সটলেশন আর্টটিতে কোম্পানিগুলোর লোগোও তুলে ধরা হয়েছে।
যেমন জারা থেকে নেওয়া হয়েছে 'জেড', অ্যাডিডাস থেকে 'এ' এবং ম্যাকডোনাল্ডসের 'এম'- এভাবে জ্যামস্টেইম পুরো শব্দটির উদ্দেশ্যও যেন তুলে ধরেছেন শিল্পী।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায় রাশিয়া। এর প্রতিবাদে রাশিয়া ছেড়েছে শত শত আন্তর্জাতিক কোম্পানি। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর বর্জনের এই জোয়ার যখন দেখা দেয়, তখন থেকে রুশ কর্মকর্তারা জনতাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। তারা ইতিবাচক সুরে বলছেন, স্থানীয় ব্যবসার মাধ্যমেই রাশিয়া এসব ব্র্যান্ডের পণ্যের অভাব দূর করবে। অর্থাৎ, স্থানীয় পণ্য প্রতিস্থাপন করবে বিদেশি ব্যবসার পণ্যকে।
আশাবাদ অবশ্য বিচ্ছিন্নতার কালো ছায়া দূর করতে পারেনি। বাজারে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের পণ্য ও সেবা না থাকা– রাশিয়ার আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ার দিকটি প্রকট করে তুলেছে।
সেন্ট পিটার্সবার্গে শিল্পের মাধ্যমে দেওয়া এ বার্তা যেন বিচিত্র এক অনুভূতির জন্মও দেয়। এ শহরের প্রতিষ্ঠাতা রুশ সম্রাট 'পিটার দ্য গ্রেট' চেয়েছিলেন রাশিয়াকে ইউরোপের সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে যুক্ত করতে। চেয়েছিলেন সংস্কার ও উন্নতি। নগরীর নকশাতেও সে উদ্দেশ্যের স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায়।

অতীতে এ শহরের জায়গায় ছিল জলাভূমি। শূন্য থেকে অসংখ্য খাল আর চোখ ধাঁধানো প্রাসাদ গড়ে রাশিয়ার আমস্টারডাম বা ভেনিসের সমতুল্য অসামান্য সুন্দর এ নগরী তৈরি করেন জার পিটার।
জারের আদেশ পালন করেন ইউরোপের সেরা সেরা শিল্পী ও প্রকৌশলীর দল। রাশিয়ার বুকে ইউরোপীয় চেহারা নিয়ে গোড়ে ওঠে সাম্রাজ্যের নয়া রাজধানী। এভাবে রাশিয়া চেয়েছিল ইউরোপের সাথে যুক্ত থাকতে। অথচ আজ তিন শতাব্দী পর এসে রাশিয়া ও পশ্চিমা দুনিয়ার মধ্যেকার দূরত্ব যেন সাত-সমুদ্রে রূপ নিয়েছে। দিন দিন এ বৈরিতা আরও বাড়ছে।
রুশ নাগরিকরা এনিয়ে চিন্তিত? বিবিসি জানতে চাইলে স্থানীয় অনেকেই দাবি করেন, এনিয়ে তাদের কোনো দুশ্চিন্তা নেই।
জ্যামস্টেইম ইন্সটলেশন আর্টের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বিবিসির রাশিয়া বিষয়ক সম্পাদক স্টিভ রোসেনবার্গ। তাকে দেখে এগিয়ে আসেন লুবভ নামের এক নারী। লুবভের মতে, "রাশিয়া ইউরোপ নয়। রাশিয়া রাশিয়াই।" ইউক্রেনে কী হচ্ছে না হচ্ছে– তার কোনো খবর রাখেন না বলেও দাবি করেন তিনি।
"যুদ্ধ রোজকার নিরানন্দ খবর হয়ে উঠেছে। আমি টেলিভিশন না দেখারই চেষ্টা করি। তাই বিষণ্ণতাও আমাকে কাবু করতে পারেনি।"
শিল্পকর্মটির পাশে দাঁড়িয়ে এরপর রাইসা নামের অপর এক নারীর সাথে কথা বলেন স্টিভ। রাইসা নিত্যদিনের সংবাদ জানেন রুশ টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দেখে।
তার মন্তব্যে ছিল রাষ্ট্রীয় সুরের প্রতিফলন। "সহিংসতার জন্য ইউক্রেনীয়রাই দায়ী। তারা একযোগে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। উগ্র এই জাতীয়তাবাদীরা আমাদের সীমান্তে অস্ত্র মোতায়েন করছে।"
রুশ গণমাধ্যম তাকে সত্যিকার খবর দিয়েছে- এবিষয়ে তিনি কতোটা নিশ্চিত স্টিভ এ প্রশ্ন করলে প্রত্যুত্তরে রাইসা বলেন, "আমি রাশিয়ার মানুষকে ভালো করেই চিনি। তাই আমি শতভাগ নিশ্চিত।"
রাশিয়াজুড়ে রাইসার মতো কতজন আছেন? রুশ জনসংখ্যার কত শতাংশ ইউক্রেনে তাদের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কথিত 'বিশেষ সামরিক অভিযান'কে সমর্থন করছেন?
সাম্প্রতিক কিছু জরিপ বলছে সে সংখ্যা অন্তত ৮০ শতাংশ। তবে বিবিসির রাশিয়া বিষয়ক সম্পাদক এনিয়ে সন্দেহ পোষণ করে লিখেছেন, রাশিয়ার মতো কর্তৃত্ববাদী দেশে জনমতের এ প্রতিফলন কতোটুকু সঠিক তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তাছাড়া সরকারি প্রতিক্রিয়ার ভয়েও হয়তো অনেকে পক্ষে মত দিয়েছে। এতে জরিপের সঠিক ফলাফল ব্যাহত হয়েছে।
স্টিভ আরও বলন, গত দুই মাস ধরে অনেক রুশ পথচারীকে থামিয়ে আমরা তাদের ইউক্রেন বিষয়ক সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এবিষয়ে তারা কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি। কেউ কেউ অবশ্য রাজি হয়। তাদের অধিকাংশই রাশিয়ার সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যেসব সংবাদ দিয়েছে, সেগুলোরই প্রতিটি শব্দের পুনরাবৃত্তি করেছে।
তাদের মতে, রুশ সেনারা 'ইউক্রেনকে স্বাধীন' করছে এবং সেখানে নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়ছে।

সেন্ট পিটার্সবার্গ নগরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রের মধ্যে দিয়ে হাঁটার পথে অনেক বিপরীত দৃশ্যেরও দেখা পান স্টিভ। শহরের একটি বিখ্যাত চত্বরের দেওয়ালে আঁকা ছিল যুদ্ধবিরোধী অনেক দেওয়ালচিত্র বা গ্রাফিতি। কোনো কোনোটিতে ছিল পুতিন বিরোধী স্লোগানও।
ভিন্ন ধরনের প্রতিবাদও করেছে অনেকে। এপ্রিলের শুরুর দিকে সেন্ট পিটার্সবার্গ নিবাসী শিল্পী সাশা স্কোচিলেঙ্কোকে রুশ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যে সংবাদ ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কর্তৃপক্ষের আনীত অভিযোগ অনুসারে, সাশা সুপারমার্কেটে বিভিন্ন পণ্যের প্রাইসট্যাগ বা মূল্য নির্দেশিকা সরিয়ে তার জায়গায় রেখে আসেন যুদ্ধ-বিরোধী নানান স্লোগান। বর্তমানে বিনা-বিচারে বন্দী রয়েছেন সাশা।
সাশার সঙ্গিনী সোনিয়া সুবোটিনা বিবিসির স্টিভকে বলেন, "এ ঘটনা প্রমাণ করে আমাদের দেশ থেকে বাকস্বাধীনতাকে মুছে ফেলা হয়েছে। এতে রাজনৈতিক দমনপীড়ন আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠার ইঙ্গিত মিলছে। যুদ্ধবিরোধী জনমতকে দমন করা হচ্ছে, এমন মানুষদের জেলে পোরা হচ্ছে।"

সুবোটিনা আরও বলেন, "এক সময় রাশিয়ায় যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। মানুষ প্রতিবাদ জানাতে ঘর থেকেও বের হতো। যদিও প্রতিটি বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। তারা গ্রেপ্তার হতেন বা পুলিশের মারপিটের শিকার হতেন, অনেককে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এখন সবাই প্রতিবাদের সাহস হারিয়েছে। নিজেকেও হারিয়ে ফেলেছি বলে মনে হয়। কিছু করা সম্ভব কিনা তা আমার একবারেই জানা নেই।"
তবে রাশিয়ার ক্ষমতাসীনরা সকল মানুষের কাছে ক্রেমলিন যেভাবে ইউরোপের সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছে তার প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন চাইছে। মস্কো থেকে তেমনতর পশ্চিমা দুনিয়া বিরোধী প্রচারণাও থেমে নেই। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল রাশিয়াতে যেমন করেই পড়ুক ক্রেমলিন তা নিজের মতো করেই দেখাতে চায়।
- সূত্র: বিবিসি