যুদ্ধ করছে ইউক্রেনের ট্রেনও!
ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা চালানোর পরপরই একটি অসাধারণ ব্যাপার চলে এসেছে প্রকাশ্যে: যুদ্ধে ইউক্রেনের রেলওয়ে ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনের বিস্তৃত পণ্য ও মালবাহী রেল নেটওয়ার্ক পরিণত হয়েছে জীবন বাঁচানোর ও কূটনীতির—এবং আত্মরক্ষার সম্ভাব্য—হাতিয়ারে।
১৭ মার্চ ইউক্রেনিয়ান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপদেষ্টা ওলেক্সি আরেস্তোভিচ রাশিয়ার বিরুদ্ধে 'সর্বাত্মক রেলযুদ্ধে'র ডাক দেন।
কেউ কেউ সম্ভবত এ আহ্বানকে গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। ইউক্রেন রেলওয়ের চেয়ারম্যান ওলেকসান্দর কামিশিন সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, প্রতিবেশী বেলারুশের রেলকর্মীরা সীমান্তের রেল সংযোগ নষ্ট করে দিয়ে রুশ বাহিনীর আগ্রাসন ও সামরিক সরঞ্জামের সরবরাহ ব্যাহত করার চেষ্টা করছে।
পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীরা ট্রেনযোগে জেলেনস্কির সঙ্গে দেখা করে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরই রুশ বাহিনীর আগ্রাসনে রেলকর্মীদের বাধা সৃষ্টি করার এই খবরটি আসে।
হামলা শুরুর পর থেকেই ইউক্রেনের রেল ব্যবস্থা আশীর্বাদ হয়ে এসেছে বেসামরিক নাগরিকদের জন্য। লাখ লাখ বেসামরিক ইউক্রেনিয়ানের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অঞ্চলে পালানোর প্রধান উপায় এখন রেল। মার্চের গোড়ার দিকে প্রায় দু-লাখ মানুষ ট্রেনে করে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ পশ্চিমাঞ্চলে সরে যায়।
কিছু কিছু দিক থেকে ইউক্রেন রেলওয়ের বর্তমান অবস্থা দেশটির সামগ্রিক পরিবর্তনেরই প্রতিচ্ছবি। রাশিয়া ও বেলারুশের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। অন্যদিকে পশ্চিমার দেশগুলো সঙ্গে সংযোগ শক্তিশালী হচ্ছে। শরণার্থীদের সরিয়ে নিতে সহায়তার জন্য পোলিশ স্বেচ্ছাসেবীরা উনবিংশ শতকের অচল রেললাইন আবার সচল করে তোলার চেষ্টা করেছে।
ইউক্রেনের রেলওয়ে ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত ভালো প্রতিরোধশক্তি দেখিয়েছে। গোটা দেশের শরণার্থী, ত্রাণ ও সামরিক বাহিনীকে বহন করে চলেছে রেলওয়ে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কিয়েভের নিপার নদীর দুই তীরে মেট্রো সার্ভিস চালানো যাচ্ছে না। কিন্তু তার মাঝেও জাতীয় রেলওয়ে শহরটির দক্ষিণ অংশে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ২৯ মার্চ তীব্র বোমাবর্ষণে জর্জরিত খারকিভেও রেলসেবা ফের চালু হয়েছে।
যাত্রীর চাপে ইউক্রেনের রেল কর্মচারীদের এখন নাজেহাল অবস্থা। কিন্তু তারপরও তারা সাধারণ মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
কিয়েভ ছেড়ে এক বছরের ছেলে পেত্রোকে নিয়ে এলভিভ শহরে পালিয়েছেন সেরহি ও ইরা। প্রথমে তারা কিছুতেই ট্রেনে উঠতে পারছিলেন না। শেষে এক প্রকৌশলী নিজের জায়গা ছেড়ে দিলে ট্রেন চালকের কম্পার্টমেন্টে জায়গা পান তারা। রেল কর্মীদের এই সৌজন্য ও বদান্যতায় এই দম্পতি যারপরনাই কৃতজ্ঞ।
কয়েক মাস আগেই ইউক্রেনের ট্রেনের গতি ছিল অনেক বেশি। কিন্তু এখন মাত্রাতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই ট্রেনগুলো চলে আগের চেয়ে অনেক ধীরগতিতে। ট্রেনে অসংখ্য মানুষকে পুরো পথ পাড়ি দিতে হয়েছে বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়তে চেয়েছে তাদের। বারবার নেমে পড়তে চেয়েছেন ট্রেন থেকে। তবু এই যুদ্ধাবস্থায় ট্রেনে চেপে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে পেরেই খুশি ইউক্রেনীয়রা।
মার্চের শেষ দিকে ট্রেনে শরণার্থীর চাপ কিছুটা কমেছে। গত মাসের শেষ দিকে প্রতিদিন আশি হাজার শরণার্থী বহন করেছে ইউক্রেনের রেল।
ইউক্রেন রেলওয়ে গত ২০ মার্চ ঘোষণা দেয় যে তারা আবার নিয়মিত টিকিট বিক্রি শুরু করবে। এর আগপর্যন্ত শরণার্থীদের সরিয়ে নেওয়ার কাজে নিয়োজিত ট্রেনগুলো বিনা পয়সায় সেবা দিচ্ছিল। তবে পশ্চিমাঞ্চলে সেবা দেওয়া ট্রেনগুলোতে এখনো বিনাপয়সাতেই যাতায়াত করা যাচ্ছে। অন্যান্য রুটের ট্রেনগুলোতে নিয়মিত ভাড়া আদায় করা হবে।
শরণার্থী সরানোর এই গোটা কাজ করতে হয়েছে তীব্র চাপের মধ্যে। শুধু রেলস্টেশনই নয়, গুরুত্বপূর্ণ সেতু ও রেলসংযোগও ভারী বোমাবর্ষণের শিকার হয়েছে। মারিউপোলের রেললাইন ও রেলস্টেশন তো সংস্কারের অবস্থাতেই নেই আর। এমনকি রেলওয়ে ম্যানেজমেন্টও বোমা ও গোলাবর্ষণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। তার জেরে ইউক্রেন রেলওয়ের চেয়ারম্যান ও তার সহকর্মীরা কিয়েভ অফিস ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তারা এখন তাদের অভিযোগ সরিয়ে নিয়েছেন চলন্ত ট্রেনে। এতে লাভ হয়েছে দুটো। এক, নিজেদের তারা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ রাখতে পারছেন। দুই, নেটওয়ার্কের যেসব অংশে মেরামত ও সহায়তা প্রয়োজন সেখানে যেতে পারেন।
এদিকে রেলকর্মীদের সংগঠন যুদ্ধ-সময়ের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কিছু অফিস কর্মীকে মাঠ পর্যায়ের কাজে পাঠিয়েছে।
সাবেক কন্ডাক্টর ভাদিম কিসকা ইউক্রেন রেলওয়েতে চাকরি শুরু করেন ১৯৮৮ সালে। ৫৩ বছর বয়সী সাবেক এই সোভিয়েত সেনা সদস্য ছিলেন পোলতাভা শহরের রেলকর্মীদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই তিনি শরণার্থীবাহী ট্রেনে কন্ডাক্টরের কাজ করার জন্য ফেরেন।
তিনি জানান, একেকটি কার-এর ৩৬ থেকে ৫২ জন যাত্রী বহনের ক্ষমতা থাকলেও এবার তিনি যতজন এঁটেছে, তত যাত্রী নিয়েছেন। অসংখ্য ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষকে অন্ধকারের মাঝে সেবা দেওয়া ছিল ভীষণ কঠিন কাজ। আতঙ্কিত, নার্ভাস ব্রেকডাউনের শিকার হওয়া মানুষগুলোকে মানসিক সমর্থন যেমন জুগিয়েছেন, তেমনি ওষুধও সরবরাহ করেছেন কিসকা।
সেবা অব্যাহত রাখার জন্য বিপদও হয়েছে ইউক্রেন রেলওয়ের। ইউক্রেনের অন্তত ৪০ জন রেলকর্মী কর্মরত অবস্থায় নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৪১ জন কর্মী। একবার তো কন্ডাক্টর নিহত হওয়ার পর একটি শরণার্থীবাহী ট্রেন যাত্রী তোলার সময়ই একটি খনিতে গিয়ে ধাক্কা মারে। তবে ইউক্রেন রেলওয়ে যে বিপুল কর্মযজ্ঞ সাধন করেছে এবং করছে, সে তুলনায় এহেন ক্ষতির সংখ্যা একেবারেই কম। তাছাড়া ইউক্রেন রেলওয়ে কর্মীসংখ্যাও বিপুল, প্রায় আড়াই লাখ। সেদিক থেকে দেখলে ইউক্রেন রেলওয়ে খুব বেশি কর্মী হারায়নি।
সব মিলিয়ে, চলমান সংঘর্ষে ইউক্রেনিয়ানদের জীবনরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে ইউক্রেন রেলওয়ে। অস্ত্র হাতে নিয়ে দেশের জন্য লড়ছেন না রেলকর্মীরা, কিন্তু অস্ত্র ছাড়াই দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছেন তারা।
ইউক্রেনের ভাষায় রেল কর্মীদের বলা হয় জালিজনিচনিক—যার অর্থ 'লৌহ-রাস্তার মানুষ'। চলমান যুদ্ধে দেশটির রেল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকটি মানুষ বুঝিয়ে দিচ্ছেন, শুধু শুধু তাদেরকে এ নাম দেওয়া হয়নি।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ