‘হোলি ল্যান্ড কনফেডারেশন’: অসলো শান্তিচুক্তি প্রণেতা এবার ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড নিয়ে কনফেডারেশনের প্রস্তাব দিলেন
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনের দুই রাষ্ট্রের সমাধান আজো বাস্তবায়িত হয়নি। ফিলিস্তিনিরা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত, শোষিত আর ক্ষুদ্ধ। ইসরায়েলেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেড়ে উঠছে ঘৃণা নিয়ে। তাই শান্তি আলোচনাকে ফিরিয়ে আনতে করা হয়েছে কনফেডারেট রাষ্ট্রের নয়া-পরিকল্পনা। এর ভিত্তিতে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারী ইসরায়েলিরা সেখানেই থাকবে, তবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের মর্যাদা দিতে হবে। তারপর ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন মিলে গঠিত হবে কনফেডারেশন।
এ প্রস্তাব চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন ও জাতিসংঘের কাছে দেওয়া হয়েছে।
১৯৯০ এর দশকের শুরুতে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত অবসানে সই হয়েছিল ঐতিহাসিক 'অসলো অ্যাকর্ডস'। এর অন্যতম রুপকার ইয়োশি বেইলিন গত দুই বছর ধরে 'হোলি ল্যান্ড কনফেডারেশন' নামক যৌথ (একক) রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাবটি প্রণয়নে কাজ করেছেন। একাজে তার সঙ্গী ছিলেন ফিলিস্তিনি অ্যাটর্নি ও জ্যেষ্ঠ শান্তি আলোচক হিবা হুসেইনি। ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের সমন্বিত একটি টিম তাদের পরামর্শক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। মহামারিকালে তারা নিয়মিত জুমে বৈঠক করেছেন।
প্রস্তাবনায় স্বাক্ষরকারী বা গ্যারান্টার হিসেবে রয়েছে জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সংশ্লিষ্ট সংস্থা-ফ্রিডরিখ এবাট স্টিফটুং ফাউন্ডেশন।
গত মঙ্গলবার মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরম্যানের কাছে পরিকল্পনা হস্তান্তরের আগে ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনা করেছেন বেইলিন ও হুসেইনি। একটি কপি বাইডেন প্রশাসনের আরেক পদস্থ কর্মকর্তা বারবারা লিফ'কেও দেওয়া হয়—তাকেই নিকট প্রাচ্য বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী করার কথা ভাবছে বাইডেন প্রশাসন।
একক রাষ্ট্র পরিকল্পনাকারী বেইলিন ও হুসেইনি আশাপ্রকাশ করেন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ উভয়েই তাদের প্রস্তাবনা গ্রহণ করবেন। কারণ বর্তমান ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের সাথে কোনোপ্রকার সম্পৃক্ততা না রেখে তারা এটি স্বাধীনভাবে প্রস্তুত করেছেন বলে দাবি করেন। আর সেজন্যই এটি জেরুজালেম বা রামাল্লায় প্রকাশিত না করে—নিউইয়র্ক আর ওয়াশিংটনে করা হয়েছে। অর্থাৎ, একে নিরপেক্ষ কাঠামো বলে দাবি করলেন তারা।
তারা বলেছেন, গত তিন দশক ধরে প্রকৃত শান্তি অর্জনের চেষ্টায় দেখা দিয়েছে চরম নিস্ক্রিয়তা। আর তাই সংঘাত নিরসনে একটি কার্যকর কাঠামোর অধীনে সমাধান প্রয়োজন। এজন্য কড়া সমালোচনার মুখে পড়বেন জেনেও এই প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন।
বেইলিন বলেন, "ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি উভয় জাতির জন্য যে সমাধানগুলি গুরুত্বের; তবে রাজনৈতিকভাবে বাস্তবায়ন জটিল- আমরা তাতে প্রাধান্য দিয়েছি। ফলে উভয়পক্ষের নেতৃত্বের জন্য এটি গ্রহণ করা সহজ হবে।"
অপরদিকে হুসেইনি বলেছেন, "দুই রাষ্ট্র সমাধানকে একেবারে বাতিল করতে এই পরিকল্পনা করা হয়নি। দুই পক্ষের মধ্যে যেন ফের আলোচনা শুরু করা যায়- আমরা তাই চেয়েছি। তাই সকলের প্রতি আমার অনুরোধ, আগে আপনারা প্রস্তাবনাটি সতর্কভাবে পড়ে নেবেন। বিস্তারিত না পড়েই আকস্মিক কোনো সিদ্ধান্ত বা প্রতিক্রিয়া জানাবেন না; বা এককথায় বাতিল করে দেবেন না।"
বেইলিন জানান, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) এর মধ্যে সই হওয়া অসলো অ্যাকর্ডস এবং ২০০৩ সালে সই হওয়া জেনেভা ইনিশিয়েটিভ— যে শান্তি পরিকল্পনাগুলো তিনি উভয়পক্ষের সাথে মিলে তৈরি করেছিলেন- সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে পারস্পরিক স্থায়ী স্বীকৃতির মডেল হিসেবে তিনি নয়া প্রস্তাবনাটি তৈরি করেছেন।
"হোলি ল্যান্ড কনফেডারশনে আমরা জেনেভা ইনিশিয়েটিভ চুক্তির সাথে আরেকটি স্তর যোগ করেছি। তা হলো- উভয়পক্ষকেই সবকিছু সহযোগী কাঠামোর অধীনে একসাথে করতে হবে"- উল্লেখ করেন বেইলিন।
তিনি বলেছেন, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ওপর ভিত্তি করে দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের ভিশন আমরা পরিত্যাগ করেছি। "এটা যেন তুমি এখানে থাকবে, আর ঐখানে আমার বাড়ি"- এমন সীমারেখা, যা এখন আর কাঙ্খিত ও বাস্তবায়নযোগ্য নয়।
"আমরা ভৌগলিকভাবে বেশ ছোট একটি এলাকার বিষয়ে কথা বলছি। এখানে যেকোনো সীমানাই কৃত্রিম হয়ে ওঠে। তাই আমরা যৌথভাবে সড়ক, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার ইত্যাদি সুপারিশ করেছি। এই ব্যবস্থায় একটি কনফেডারেশন রাষ্ট্রে বসবাস দুই জাতির মানুষের কাছেই কাম্য হবে।"
তার মতে, পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী ও ইসরায়েলের মূল সীমানার পার্থক্য যেহেতু একটি দেওয়ালের- তাই দুটি আলাদা রাষ্ট্রের চেয়ে একটি কনফেডরেশন রাষ্ট্রের আবেদনই বেশি হবে।
তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, কনফেডারেশন রাষ্ট্রের কাঠামো নির্ধারণে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব অন্তত এক বছরব্যাপী আলোচনা করবেন। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সীমা নির্ধারিত হবে অসলো ও জেনেভা চুক্তিতে স্বীকৃত সীমানা অনুসারে। এভাবে একটি রাষ্ট্র হিসেবেই কনফেডারেশন গঠনের আলোচনায় যোগ দেবে ফিলিস্তিন। পশ্চিম তীরের নির্ধারিত অংশ এবং গাজা মিলে গঠিত এ রাষ্ট্রকে প্রথমে 'স্বাধীন রাষ্ট্র' হিসেবে স্বীকৃতি দেবে ইসরায়েল।
তবে সেখানেই শেষ নয়, বরং যাত্রা শুরু হবে নতুন প্রক্রিয়ার। পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে উভয় রাষ্ট্রের আলোচনার ভিত্তিতে ইউরোপীয় ধাঁচের একটি সহযোগী কনফেডারেট রাষ্ট্রগঠনের আলোচনা শুরু হবে।
তবে এ পরিকল্পনার সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের থেকে যাওয়ার বিষয়টি। এরফলে তারা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হলে সেখানকার স্থায়ী অধিবাসীর মর্যাদা লাভ করবে।
অবশ্য তার পরিবর্তে সম-সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে ইসরায়লের অভ্যন্তরে বসবাসের অনুমতি দিতে হবে। অর্থাৎ, ভূমি বিনিময়ের পরিবর্তে জনসংখ্যা বিনিময়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
হুসেইনি বলেন, "ফিলিস্তিনের সার্বভৌম অংশে কোনো বসতি স্থাপনকারী বাস করলে এবং তিনি সেখানকার নাগরিক হতে চাইলে আলোচনায় ঐক্যমত্য হওয়া শর্তের অধীনে তা হতে পারবেন। একইভাবে ফিলিস্তিনি শরণার্থীরাও ইসরায়েল রাষ্ট্রে ফিরে এসে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি লাভ করবেন।"
- সূত্র: হারেৎজ