‘মের্কেলকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল, পরবর্তীকালে যা হয়ে ওঠে তার পরম শক্তির উৎস’
জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে দীর্ঘ সময় দায়িত্বে থাকা অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের রাজনৈতিক জীবন নিয়ে লেখা অধিকাংশ আর্টিকেলগুলোতেই বলা হয়েছে, তার জীবনের অন্যতম বড় রাজনৈতিক শক্তি হচ্ছে 'তাকে প্রায়শই অবমূল্যায়ন করা হয়'। তবে এখানে তিনি কোনো অনন্য ব্যক্তি নন; মেরকেলকে রাজনীতিতে নিয়ে আসা হেলমুট কোহলও এক সময় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, "আমি অবমূল্যায়িত হয়ে, আমার জীবনযাপন করছি।"
অবশ্য মের্কেল এবং কোহলের মাঝে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। মেরকেল এসেছেন কমিউনিস্টপন্থী পূর্ব জার্মানির একটি প্রোটেস্ট্যান্ট পরিবার থেকে; অন্যদিকে, কোহল এসেছিলেন ক্যাথলিক রাইনল্যান্ড থেকে। রাজনীতিতে আসার আগে মেরকেল ছিলেন ধ্যানেজ্ঞানে একজন পুরোদস্ত বিজ্ঞানী; আর কোহল তখনই ছিলেন পুরোদস্তুর ঝানু এক রাজনীতিক।
কিন্তু বিগত ৩০ বছরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির উত্থানপতনের মাঝে কোহল ও মের্কেল দু'জনই জার্মানির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠার সম্মান অর্জন করেছেন। জার্মানির আধুনিক রাজনৈতিক প্রতিফলন কিংবা বিশ্বে জার্মানির অবস্থান, যে কারণেই হোক না কেনো- এ দু'জন রক্ষণশীল নেতার নেতৃত্ব জার্মানরা স্বাগতই জানিয়েছে সবসময়।
এর কারণ হতে পারে, বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নাৎসিদের ওপর জার্মান জাতির তিক্ততা। তবে, কারণ যাই হোক না কেন, এটি জার্মানির জন্য কাজ করেছে এটাই শেষ কথা। যদিও কোহল তহবিল কেলেঙ্কারির বোঝা মাথায় নিয়ে রাজনীতি থেকে সরে গেছেন; তার এই প্রস্থানই মের্কেলের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের পথকে সুগম করেছিল। কোহলের আশু প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মের্কেলই তাকে চূড়ান্ত ধাক্কাটি দিয়েছিলেন। তবে রাজনীতি থেকে কেলেঙ্কারি মাথায় নিয়ে সরে দাড়ালেও, জার্মানি এবং ইউরোপের শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখায়; কোহল আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে পেয়েছেন দৃঢ় স্থান।
ইউরোপের প্রকৃত নেতা এবং পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী হিসেবে পরিচিত মের্কেল, ইতোমধ্যেই অনেক বড় সম্মাননা অর্জন করছেন। তবে বেশকিছু বিতার্কিক প্রশ্নও রয়েছে তার শাসনামলে নেওয়া কিছু পদক্ষেপ নিয়ে; যেমন- ইউরোজোনের ঋণ সংকটে তার কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি, রাশিয়া থেকে নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন বন্ধ করতে তার অস্বীকৃতি, তার সময়ে সামরিক ব্যয় বাড়াতে জার্মানির ক্রমাগত অনীহা এবং এবং মধ্য ইউরোপে স্বৈরাচারী দক্ষিণপন্থীদের উত্থানের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে তার ব্যর্থতা।
কিন্তু যখন লাখ লাখ সিরিয় নাগরিক তাদের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে পালাতে শুরু করে, ইউরোপের নিরাপত্তার প্রশ্নেও তখন মের্কেল সীমান্ত বন্ধে অস্বীকৃতি জানান। জার্মান ভাষায় "উইর শ্যাফেন দাস", যার অর্থ হলো, "হ্যাঁ আমরা পারি" –তখন এই নীতিবাক্যটিই তার নেতৃত্বের মূল মন্ত্র হয়ে উঠেছিল।
আজ রোববারের জাতীয় নির্বাচনের পর তার ১৬ বছরের শাসনামল নিয়ে আরো অনেক মূল্যায়ন হবে। সামনে যিনি ক্ষমতায় আসবেন তিনিই এসব মূল্যায়ন করবেন, এবং অনেক বিশ্লেষকরাই এখন ভাবতে শুরু করেছেন, এর পরে কী হবে; মের্কেল-পরবর্তী যুগে জার্মান এবং ইউরোপীয় রাজনীতি কীধরনের অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে পারে, সেদিকে মনোনিবেশ করেছেন তারা।
দ্য ইকোনমিস্ট তাদের বিশ্লেষণের শিরোনাম করেছে 'মের্কেলের ফেলে আসা আগোছালো পরিস্থিতি।' মের্কেলের প্রস্থানে গার্ডিয়ানের দৃষ্টিভঙ্গি- 'সমস্যাগুলো কোনোভাবে ম্যানেজ করা হয়েছে, কিন্তু সমাধান করা হয়নি।' ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের জার্মান সংবাদদাতা লিখেছেন, 'মের্কেল একটি "ভালো ট্রান্স-আটলান্টিক সম্পর্ক দিয়ে যাচ্ছেন।'
তিনি একটি রক্ষণশীল, পুরুষ-শাসিত রাজনৈতিক দলে ১৬ বছর কাজ করে গেছেন। তবে, দুঃখ হয় তাদের জন্য, যারা তার কোমলতাকে দুর্বলতা ভেবে ভুল করেছেন, অথবা যাদের সামনে তিনি হিসাব মেলাতে না পেরে প্রত্যুত্তরের জায়গায় চুপ থেকেছেন।
তার বন্ধুরা বলেন, একান্তে তিনি একজন তীক্ষ্ণ হাস্যরসাত্বক মানুষ। আলোচনার বা বৈঠকের আগে তিনি একজন বিজ্ঞানীর মতো মনোযোগ দিয়ে তার সমস্ত কাজ গুছিয়ে নেন এবং ভ্লাদিমির পুতিন বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো প্রতিপক্ষের মোকাবেলায় তিনি কখনই হতাশ হননি। এর উদাহরণ হিসেবে জি-৭ গ্রুপের নেতাদের সঙ্গে মের্কেলের সেই ছবিটির কথা বলা যেতে পারে, যেখানে আলোচনার টেবিলে তিনি এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একে- অপরের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন যখন জানতে পেরেছিলেন মের্কেল কুকুর ভয় পান, তখন তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে তার 'ব্ল্যাক ল্যাব' কুকুরটিকে তাদের আলোচনার কক্ষে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। মের্কেল সেই বিড়ম্বনার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এই বলে, "আমি বুঝতে পেরেছি কেন তিনি এটি করেছিলেন; কারণ তাকে প্রমাণ করতে হবে তিনি একজন পুরুষ। পুতিন নিজের দুর্বলতাকেই ভয় পেয়ে একাজ করেছেন।"
কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে মের্কেল বলেছিলেন, "একজন ব্যক্তি তার কথা এবং আচরণ দিয়ে অন্য মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পারে; মন পরিবর্তন করতে পারে।" সে অনুসারে, তিনি সর্বদা তার কথার চেয়ে বেশি, কাজের দিকেই মনোনিবেশ করেছিলেন। বিদেশী সংবাদমাধ্যমে তিনি কখনও সাক্ষাৎকার দেন না বললেই চলে, এবং জার্মান মিডিয়ায় যতটুকু দেন, তাও খুব বেশি রোমাঞ্চকর নয়।
সততা, বিনয়, শৃঙ্খলা, দৃঢ়তা এবং ব্যক্তিত্বের এই বৈশিষ্ট্যগুলো একসঙ্গে কোথাও খুঁজতে গেলে হয়তো হতাশই হতে হবে। একজন নারী, একজন পূর্ব জার্মান এবং একজন বিজ্ঞানী হয়েও, তিনি অদম্য রাজনৈতিক প্রতিকূলতা পেরিয়ে জার্মান ক্ষমতার শীর্ষে উঠেছেন এবং সেখানে চার মেয়াদে টিকে থেকেছেন। এখানে আমেরিকা এবং অন্যান্য গণতন্ত্রের জন্য অনুধাবনের বিষয় হলো, ভদ্র লোকেরা ক্রমবর্ধমানভাবে রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছেন।
মের্কেলের শাসনামল অবশ্যই ত্রুটিহীন নয়। তবে তার এই দীর্ঘ সময়ের নেতৃত্ব এটিই প্রমাণ করে, রাজনীতির অর্থ- মানবতা বা অবিচলতাকে কমানো নয়; এবং অবমূল্যায়িত হওয়াই হয়তো রাজনৈতিক দীর্ঘায়ুর প্রকৃত চাবিকাঠি।
- লেখক: সার্জ স্কিম্যান; লেখক, হেরাল্ড ট্রিবিউনের সাবেক সম্পাদক
- সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস
- ভাষান্তর: জান্নাতুল তাজরী তৃষা