‘এখন আমাদের স্থায়ী মহামারি মোকাবিলার প্রস্তুতি শুরু করা উচিৎ’
গেল বছর মহামারি নিয়ে একটি ভ্রান্ত এবং প্রায়শই উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচারিত এক অনুমান দ্বারা বিশ্ববাসী চালিত হয়। প্রায় সকলেরই ভাবনাকে প্রভাবিত করে; 'এক পর্যায়ে মহামারির অবসান হবে আর আমরা স্বাভাবিক জীবন-যাপন ফিরে পাব' এমন আভাসের বাণী।
আসলে এই যুক্তির ভিত্তি ভুলে ভরা। বাস্তবে সার্স কোভ-২ অন্যসব ভাইরাসের মতোই অভিযোজনের ক্ষমতা রাখে, বরং এই ক্ষমতা দেখানোয় সে নতুন রেকর্ড করছে, যার ফলে শঙ্কা জাগছে, সাধারণ ফ্লু'র মতো এটি হয়তো মানবজাতির চিরস্থায়ী অথচ অত্যন্ত মারাত্মক শত্রু হিসেবেও রয়ে যাবে।
অণুজীবের সক্ষমতা এক পর্যায়ে কার্যকর ওষুধের গুণে বা অন্য কোনো কারণে নিঃশেষিত হলেও, ততোদিনে আমাদের যাপিত জীবন ও প্রাত্যহিক সূচি অপরিবর্তনীয় ভাবে বদলে যাবে। পুরোনো জীবনে ফেরার পথই হয়তো খোলা থাকবে না, সামনে এগিয়ে যাওয়াটাই যেন একমাত্র উপায়। তবে কিসের দিকে এগিয়ে যাওয়া?- এ প্রশ্নের সন্ধান করাটাই গুরুত্বপূর্ণ।
অধিকাংশ জনসংখ্যা হার্ড ইম্যিউনিটি বা গোষ্ঠীবদ্ধ অনাক্রম্যতা অর্জন করলেই বেশিরভাগ মহামারি দূর হয়, কারণ তখন ক্ষতিকর রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব আশ্রয় নেওয়ার মতো মানবদেহ খুঁজে পায়না সহজে। কদাচিৎ পেয়ে গেলেও বংশবিস্তার করতে পারে না। তার প্রভাব দিনে দিনে এভাবে কমতে থাকে। এই হার্ড ইম্যিউনিটি দু'ভাবে অর্জিত হয়, সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠাদের দেহের প্রাকৃতিক সুরক্ষা কবচ এবং বাকি জনসংখ্যার মধ্যে কার্যকর টিকাদান।
তবে সার্স কোভ-২ জীবাণুর ক্ষেত্রে ঘটা সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ইঙ্গিত দিচ্ছে, আমরা হয়তো কখনোই এর বিরুদ্ধে গোষ্ঠীবদ্ধ অনাক্রম্যতা অর্জন করতে পারব না। এমনকি বড় সংখ্যায় নাগরিকদের টিকাদানে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা যুক্তরাষ্ট্রেও ইতোমধ্যে বেশ কিছু বড় আকারের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, যার ফলে দেশটি সম্পূর্ণ সুরক্ষিত হতে পারবে না বলেই অনুমান করা হচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের গবেষক ক্রিস্টোফার মুরে এবং লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের পিটার পিয়ট তাদের সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে এমন পরিণতির কথাই জানান।
অশুভ এই ভবিষ্যৎ সৃষ্টির প্রধান কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন ভাইরাসের এমন ধরনের আবির্ভাব যা আসলে সম্পূর্ণ নতুন ভাইরাসের মতো বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ও আচরণ করেছে। দ. আফ্রিকায় করা এক মানব ট্রায়ালে দেখা যায়, এর আগে যারা ভাইরাসের মাত্র একটি স্ট্রেইন দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর সেরে উঠেছিলেন- তাদের মধ্যে এটির অভিযোজিত বংশজের বিরুদ্ধে কোনো ইম্যিউনিটি কাজ করছে না এবং তারা সহজেই এর দ্বারা পুনরায় আক্রান্তও হচ্ছে। ব্রাজিলের যেসব অঞ্চলে এর আগেই বিশাল আকারে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে সেখান থেকেও ইতঃপূর্বে এমন রিপোর্ট আসে, ফলে ওই সব অঞ্চলে এখন আবার নতুন মহামারির শিকার হচ্ছে। ভাইরাসের একের অধিক স্ট্রেইন মিলেও ঘটছে মারাত্মক কিছু অভিযোজন।
এই অবস্থায় শুধুমাত্র নতুন ধরনগুলো প্রতিহত করতে সক্ষম টিকার প্রয়োগ এনে দিতে পারে স্থায়ী হার্ড ইম্যিউনিটি। প্রথম প্রজন্মের কিছু ভ্যাকসিন নতুন ধরনের বিরুদ্ধে এখনও কিছুটা কার্যকরী হলেও, ভাইরাসের অভিযোজনের সাথে সাথে তারা সংক্রমণ ঠেকানোর শক্তি হারাবে।
প্রতিষেধক উৎপাদক সংস্থাগুলো তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে নেই। তাদের বিজ্ঞানীরা আরও শক্তিশালী টিকা আবিষ্কারের আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। বিশেষত, ইতিহাসের অন্য যেকোনো প্রতিষেধকের তুলনায় এমআরএনএ প্রযুক্তিতে তৈরি টিকাগুলোকে অভিযোজিত ধরনের বিরুদ্ধে দ্রুত সক্ষম করে তোলাও সম্ভব হবে। কিন্তু, গবেষণাগারে আবিষ্কার ও উন্নয়ন হয়তো সবচেয়ে সহজ দিক, কারণ তারপরেই আছে এটি বিশ্বব্যাপী পরিবহন, বিতরণ আর নতুন করে টিকাদানের পাহাড়প্রমাণ চ্যালেঞ্জ। তার সঙ্গে যোগ করতে হবে, নতুন ভ্যাকসিনের সম্ভাব্য বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে নানা দেশের নিয়ামক সংস্থার অনুমোদন প্রক্রিয়া, জনমনের অনাস্থার মতো গুরুতর বিষয়।
সঙ্গত কারণেই টিকাদানের মতো জটিল প্রক্রিয়া পুরো পৃথিবীর সর্বত্র রাতারাতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ইসরায়েলের মতো বিশ্বের কিছু ভূখণ্ড সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে টিকা দিয়ে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রথম দুই-এক রাউন্ডে জয়ী হলেও, ভাইরাস তার বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় টিকাপ্রাপ্ত সুরক্ষিত জনসংখ্যাকে এড়িয়ে টিকাহীন মানব দেহে আশ্রয় নেয়। মানবকোষে আশ্রয় নেওয়া অবস্থায় সে নিজের আরএনএ পুনঃউৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করে। এই প্রক্রিয়ায় আসলে ভাইরাস নিজের অসংখ্য কপি তৈরি করতে থাকে, এবং তখন কিছু জৈব-রাসায়নিক সংকেতে ভুল হয়, যাকে জিন বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় 'কোডিং মিসটেক,' আসলে এই ভুলগুলো থেকেই আরও মারাত্মক অভিযোজিত ধরনের সৃষ্টি হয়।
এরপর কোনো জায়গায় একবার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেই সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে নতুন ধরনগুলো। এটাও অণুজীবের এক অনন্য অস্তিত্ব রক্ষার কৌশল। কারণ, প্রাদুর্ভাব চলাকালে মানুষ প্রথমেই নতুন ধরন নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ পায় না। যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিলের একটি ধরন ইতোমধ্যেই মারাত্মক কুখ্যাতি লাভ করেছে, কিন্তু একই অভিযোজনের সঙ্গে আংশিক মিল থাকা অণুজীবের বিস্তার আমি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, অরিগন এবং অন্যত্রও লক্ষ্য করেছি। আমার বিশ্বাস, ঠিক মতো খুঁজলে একই অভিযোজনের আরও গোষ্ঠীগত আত্মীয়ের সন্ধান মিলবে।
দরিদ্র দেশগুলোতে যেখানে টিকাদানের হার অত্যন্ত কম বা যেসব দেশে কোনো টিকার ডোজই দেওয়া যায়নি, সেখানে আরও প্রাণঘাতী ও সংক্রামক ধরন সৃষ্টি হয়েছে- এ বাস্তবতা আমাদের নিশ্চিতভাবে উপলদ্ধি করা উচিৎ। উন্নয়নশীল বেশিরভাগ দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী বেশি হওয়ায় সেখানে মৃত্যুহার মাত্রাতিরিক্ত না হলেও, আসলে এই দিকটি প্রাদুর্ভাবের ভয়াবহ অবস্থাকে ঢাকা দিচ্ছে।
গত মাসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, এপর্যন্ত দেওয়া টিকা ডোজের ৭৫ শতাংশ দেওয়া হয়েছে মাত্র ১০টি দেশে। অন্যদিকে, ১৩০টি দেশে একটিও ডোজের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়নি।
মনে রাখা দরকার অণুজীবের বিবর্তন কোনো অপ্রত্যাশিত বা আপনা থেকেই উদ্বেগজনক ঘটনা নয়, এক্ষেত্রে প্রায়শই দেখা যায় ভাইরাস মারাত্মক সংক্রামক হয়ে উঠলেও তুলনামূলক কম বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। কারণ সে বুঝতে পারে আশ্রিতের দেহকে মেরে ফেললে তারই ক্ষতি, এবং তাতে বংশবিস্তারের প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। সার্স কোভ-২ সেই পথ ধরলে এটি সাধারণ সর্দি-কাশির জন্য দায়ী আরেকটি ফ্লু'র ভাইরাস হিসেবে থেকে যাবে।
কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ে ভাইরাসটি সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে না। শনাক্ত হওয়া নতুন ধরনগুলো মারাত্মক সংক্রামক হয়ে উঠলেও তাদের জীবননাশের শক্তি কোনো অংশেই কমেনি, বরং বেড়েছে। মহামারি বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এর চাইতে আর খারাপ সংবাদ হতে পারে না।
বিবর্তনের দুটি ভিন্ন পথ সম্পর্কে আগে জানা দরকার, যার একটিতে ভাইরাসের সংহারক শক্তি বাড়লেও, বংশবিস্তারের ক্ষমতা হ্রাস পায়। অর্থাৎ এটি মারাত্মক রোগ ও মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম হলেও, এর প্রভাব একটি সমান্তরাল পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে। বিবর্তনের অন্য পথে, অভিযোজিত ভাইরাসের শক্তি কমবেশি না হলেও এর সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা বাড়ে। অর্থাৎ, এটি বেশি পরিমাণে রোগ ও মৃত্যুর সৃষ্টি করবে, যা সমান্তরাল না হয়ে বরং গাণিতিক হারে ঊর্ধ্বগামী হয়। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের গবেষক অ্যাডাম কুচারস্কি এমন একটি গাণিতিক মডেলের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।
তার পর্যবেক্ষণ, সার্স কোভ-২ দ্বিতীয় এই প্রক্রিয়াকে তার বিবর্তন পথ হিসেবে বেছে নিলে- সমগ্র মানবজাতি পড়বে পুনঃ পুনঃ প্রাদুর্ভাবের পর আবার ভাইরাসের হুমকি হ্রাস, কখনো সামাজিক বিধিনিষেধ, কখনোবা শিথিলতা, কখনো লকডাউন ও কখনোবা পুনঃউন্মুক্তকরণের সীমাহীন চক্রে। সাম্প্রতিকতম ধরনের বিরুদ্ধে এতে হয়তো ধনী দেশের নাগরিকদের বছরে কয়েকবার টিকা নিতে হবে, কিন্তু এভাবে কোনো স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে হার্ড ইম্যিউনিটি অর্জনের জন্য দরকারি দ্রুততার সাথে টিকা দেওয়া যাবে না।
আমি এ আলোচনায় পরাজয় ও নৈরাশ্যের পক্ষে যুক্তি দিতে আসিনি। ইতিহাসের সর্বব্যাপী পরিধিতে কোভিড-১৯ একটি সামান্য মাত্রার মহামারি। ইতঃপূর্বে ১৬ শতকে গুটিবসন্ত প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দুই আমেরিকা মহাদেশের আদি-অধিবাসীর প্রাণ কেড়ে নেয়। ষষ্ঠ শতকে 'ব্ল্যাক ডেথ' খ্যাত প্লেগের উপদ্রুপে ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোর জনসংখ্যা অর্ধেক হ্রাস পায়। সেই তুলনায় এপর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ হাজার জনের মধ্যে চার জনেরও কম মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে করোনাভাইরাস। তাছাড়া, আমাদের হাতে আছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অস্ত্র- যা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে কখনোই ছিল না।
তবে আশায় ভর করে বাস্তবতা বিমুখ হলেও চলবে না। টেকসই প্রতিরোধের সক্ষমতা অর্জন করতে হলে; ভাইরাসের স্থায়িত্বের সম্ভাবনাকে এখনই আমাদের পরিকল্পনায় যোগ করতে হবে। আশার কথা হলো; এই হুমকি মোকাবিলায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা আরও সক্ষম হয়ে উঠছি। যেমন; উন্নত বিশ্বে বর্তমানের লকডাউনগুলো আগের মতো করে তাদের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি করছে না। আর এক সময় বিজ্ঞানের আবিষ্কারে যুগান্তকারী সফলতা আসলে হয়তো আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতেও পারব। আমাদের ফিরে পাওয়া নতুন পৃথিবী হয়তো অনিরাপদ না হলেও- সেটা হয়তো আমাদের চিরচেনা দুনিয়া থেকে অনেকটাই ভিন্ন হবে।
- লেখক: ব্লুমবার্গে মতামত কলাম লেখক অ্যান্ড্রেয়াস ক্লুথ। এর আগে তিনি হ্যান্ডেলসব্লাট গ্লোবালের এডিটর ইন চিফ এবং দ্য ইকোনমিস্টে একজন লেখক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। তার লেখা একটি বহুল সমাদৃত গ্রন্থ- 'হ্যানিবল অ্যান্ড মি'
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত