স্টার্টআপ জোয়ারে ভাসছে পাকিস্তান
চলতি বছর প্রযুক্তি ভিত্তিক নব-উদ্যোগে (স্টার্টআপ) এক অসামান্য অগ্রগতি লক্ষ্য করছে বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ পাকিস্তান।
দেশটির নবীন প্রযুক্তি খাতে ২০২১ সালে যে পরিমাণ বিনিয়োগ এসেছে তা আগের ছয় বছরে আসা পুঁজির সমান। দ্রুত লগ্নীর এ প্রতিযোগিতায় নেমেছেন যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিনিয়োগকারীরা। তহবিল সংগ্রহের প্রায় অর্ধেক চুক্তিতে জড়িত হয়েছেন মাইক্রোসফট কর্প ও লিঙ্কডইন কর্পের সাবেক এক অভিজ্ঞ কর্মকর্তা। তার মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে নতুন গতি।
পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত এই কর্মকর্তার নাম আতিফ আওয়ান। যুক্তরাষ্ট্রে প্রযুক্তিখাতের প্রভাবশালী সংস্থাগুলোর সাথে এক দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন তিনি। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পরবর্তীকালে আমেরিকান স্টার্টআপগুলোর সহায়ক বিনিয়োগকারী হয়ে ওঠেন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির অগ্রণী বিনিয়োগকারীই ছিলেন।
কিন্তু, এরপর তিনি পাকিস্তানের ছোট্ট শহর লোধরানে বাবা-মার কাছে বেড়াতে আসেন। এসময় স্থানীয় স্টার্টআপগুলোর উদ্যোক্তারা আওয়ানের সাথে দেখা করে বিনিয়োগ ও ব্যবসা প্রসারে তার পরামর্শ চান। ৪১ বছর বয়সী আওয়ান তখন পাকিস্তানে প্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্টআপের সম্ভাবনা বুঝতে পারেন।
তিনি গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানে ফিরে এসে প্রতিষ্ঠা করেন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড - ইন্দাস ভ্যালি ক্যাপিটাল। সম্ভাবনাময় স্টার্টআপে বিনিয়োগ করে মূলধন সমর্থন দেওয়াই ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ব্যবসা। বিনিময়ে তারা নতুন উদ্যোগের নির্দিষ্ট পরিমাণ মালিকানা লাভ করে।
পাকিস্তানে ব্যবসার সামগ্রিক পরিবেশ নিয়ে এখন আশাবাদী আতিফ আওয়ান বলেন, "আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো, মুঠোফোনের ব্যবহার বেড়েছে। সবকিছুই স্টার্টআপ বিকশিত হওয়ার উপযুক্ত অবস্থানে রয়েছে।"
পাকিস্তানের প্রতিবেশী ভারতে স্টার্টআপ উদ্যোগগুলি বিপুল সফলতার মুখ দেখছে, পাচ্ছে নিত্যনতুন বিনিয়োগ। সে তুলনায় নিরাপত্তাজনিত কারণ, বিদ্যুৎ সংকট ও দুর্বল ডিজিটাল অবকাঠামোর কারণে পাকিস্তানের পরিবেশ নিয়ে অনীহা ছিল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের। এসব বাধা অতীতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করেছে।
তবে একইসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ দেশটিতে ফিনটেক ও খুচরা ব্যবসার উদ্যোগে রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনা। কারণ ২০ কোটি জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের বয়স ৩০ এর নিচে। এখনও সিংহভাগ কেনাকাটা হয় নগদে, ব্যাংক হিসাবধারী জনসংখ্যাও বেশ কম। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী। গত পাঁচ বছরে পাকিস্তানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিনগুণ বেড়ে ১১ কোটিতে উন্নীত হয়েছে।
বাণিজ্যিক তথ্য পরিবেশক ক্রাঞ্চবেজ ও ইনভেস্ট-টু-ডেটার তথ্যানুসারে, চলতি বছরে দেশটির স্টার্টআপগুলোয় ৩০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ এসেছে। বৈশ্বিক তুলনায় এটি সামান্য হলেও পাকিস্তানের জন্য এটিই রেকর্ড। আগামী দিনগুলোতে তহবিল প্রবাহ আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
তাছাড়া, আগ্রহ দেখাচ্ছে বিখ্যাত বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলোও।
আলফাবেট ইনকর্পোরেশন এবং অ্যামাজন ডটকম ইনকর্পোরেশনে প্রথম দিককার বিনিয়োগকারী সংস্থা- ক্লেইনার পারকিনস। সিলিকন ভ্যালির এই প্রভাবশালী সংস্থা চলতি বছর পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো বিনিয়োগ করেছে। বড় বিনিয়োগকারীর তালিকায় আরও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ভিফাই পার্টনার্স ম্যানেজমেন্ট এলএলসি, সিঙ্গাপুরের ওয়েভমেকার পার্টনার্স এলএলসি এবং আমিরাতের জেইন ক্যাপিটাল লিমিটেড।
ক্লেইনার পারকিনসের একজন অংশীদার মামুন হামিদের মতে, "দ্রুত বিকাশমান একটি বিশাল বাজারে পরিণত হওয়ার সব উপাদান পাকিস্তানের রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য স্থানের তুলনায় দেশটিতে তরুণ জনসংখ্যা বেশি থাকায় আমাদের প্রত্যাশা তারা নতুনভাবে কেনাকাটা করার অভ্যাসও অনেক দ্রুত রপ্ত করবে।"
বৈশ্বিক অঙ্গনেও রমরমা ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ব্যবসা। পাকিস্তান পাচ্ছে তারই সুবিধা।
গবেষণা সংস্থা প্রেকিনের তথ্যমতে, চলতি বছর অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত স্টার্টআপে নতুন বিনিয়োগের চুক্তিমূল্য ছিল ৫২ হাজার ২৪১ কোটি ডলার। যা ২০২০ সালের পুরো সময়ের চেয়ে ৬৬ শতাংশ বেশি এবং ২০১৯ সালের দ্বিগুণ।
মহামারির সময়ে বেড়েছে দাপ্তরিক কাজে জুম মিটিং এবং ইমেইলের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ নথির আদানপ্রদান। যা প্রযুক্তি খাতে নতুন উদ্যোগে বিনিয়োগের আস্থা সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি চীনে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সরকারি বিধিনিষেধের কারণে সেখানকার অনেক বিনিয়োগকারী এখন সম্ভাবনাময় অন্যান্য বাজারের দিকে মুখ ফেরাচ্ছেন। ফলে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে শুরু করে ভারতে বিপুল বিনিয়োগ করছে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এবং বেসরকারি সম্পদ ব্যবস্থাপক ফার্মগুলো।
অনেকে বলছেন, বাজারের এই চাঞ্চল্য উপচে পড়ে মূলধন প্রবাহ বেড়েছে পাকিস্তানে। অন্যদের মতে, বিনিয়োগের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার দিক দিয়ে তা আসাটাই যৌক্তিক।
চলতি বছর পাকিস্তানী স্টার্টআপগুলোর ৪০ শতাংশ তহবিল সংগ্রহে জড়িত বিনিয়োগ সংস্থা- ফাতিমা গোবি ভেঞ্চার্সের জেনারেল পার্টনার আলী মুখতার বলেন, "গত পাঁচ থেকে সাত বছর ইন্টারনেট অর্থনীতি বিস্ফোরিত হয়েছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধির এটাই মূল কারণ।"
যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি থেকে শুরু করে লন্ডন ও নিউইয়র্কের মতো শহরের প্রবাসী পাকিস্তানীরা মেধা ও তহবিল সরবরাহে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন বলেও জানান তিনি।
মরগান স্ট্যানলি, ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোং এবং বিএনপি পারিবাস এসএ'র মতো প্রভাবশালী বিনিয়োগ সংস্থার উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে অনেক পাকিস্তানী নিজ দেশে ফিরে উদ্যোক্তা হয়েছেন। সম্ভাবনা উপলব্ধি করে অল্পসংখ্যক বিদেশিও পাকিস্তানে স্টার্টআপ উদ্যোগ শুরু করেছেন।
তাদেরই একজন হলেন ইসলামাবাদ ভিত্তিক ফিনটেক কুইস্টপে ইনকর্পোরেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জর্ডান অলিভাস। ৩২ বছরের এ মার্কিন নাগরিক বলেন, "পাকিস্তানেই আছে বিশ্বের সর্বশেষ অব্যবহৃত জনসংখ্যা। শুধুমাত্র জনসংখ্যার আকার এবং গড় বয়সের দিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় এটি ভালো বাজারে পরিণত হবে।"
আরও বিনিয়োগের সুযোগ ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, "চলতি বছরের আগপর্যন্ত পাকিস্তানে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের অর্থ প্রবাহ সেভাবে আসেনি।"
এ খাতের রপ্তানি সম্ভাবনা অনুধাবন করে পাকিস্তান সরকারও নীতি-সহযোগিতা বাড়িয়েছে। ব্যবসার পরিবেশ স্থানীয় বিনিয়োগকারী বৃদ্ধি এবং অফিস স্পেস শেয়ারের সুযোগ থেকেও লাভবান হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানে স্টার্টআপ বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে 'বাজার টেকনোলজিস প্রাইভেট'। গত আগস্টে এক ডজনের বেশি বিনিয়োগকারীর থেকে ৩ কোটি ডলারের রেকর্ড তহবিল সংগ্রহ করে কোম্পানিটি। কিন্তু, বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বিনিয়োগকারীদের মাত্র একজন কোম্পানিটির কর্মকর্তাদের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করেছিলেন।
বাজার টেকনোলজিসের উদ্যোক্তা দুই প্রাণচঞ্চল তরুণ- হামজা জাওয়াইদ ও সাদ জাংদা। প্রথমজন আগে দুবাইয়ে ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোং – এ চাকরি করতেন। দ্বিতীয়জন ছিলেন রাইড শেয়ারিং কোম্পানি কারিম ইনকর্পোরেশনে। অফিসের ভবন পুরনো হলেও, ভেতরটা ঝা চকচকে কাজের আধুনিক পরিবেশ দুস্তর। ক্যাজুয়াল পোশাকেই সেখানে কাজ করছেন এক ঝাঁক তরুণ কর্মী। অনলাইন মার্কেটপ্লেসে মুদি দোকানগুলোকে যুক্ত করেছে এই উদ্যোগ।
অথচ মাত্র কয়েক বছর আগেও পাকিস্তানে প্রযুক্তির নব-উদ্যোগ নিয়ে যথেষ্ট তহবিল মিলত না। ঝুঁকির আশঙ্কায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ফিরিয়ে দিত উদ্যোক্তাদের ঋণ আবেদন। অপরদিকে, মূলধন সচ্ছল অধিকাংশ বড় ব্যবসায়ীরা এ খাতের উদ্যোক্তাদের সাথে কথা বলার আগ্রহই দেখাতেন না।
এব্যাপারে আইটুআই ভেঞ্চার্স বিনিয়োগ তহবিলের প্রতিষ্ঠাতা কুলসুম লাখানি বলেন, "২০১২ সালেও আমাদের কাছে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের উৎস ছিল শূন্য। পাকিস্তানে এ ব্যবসা করতে হলে নিজস্ব নেটওয়ার্ক থাকতে হতো। কিন্তু, সেই অবস্থা থেকে আজ আমরা দ্রুত স্টার্টআপ-সহায়ক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে দেখছি।"
আতিফ আওয়ান বলেন, "এর আগে যা চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় হয়েছে, এবার তা বৃদ্ধি পাচ্ছে পাকিস্তানে, তবে আরও দ্রুতগতিতে। এই পথচলা কেবল শুরু হয়েছে।"
- সূত্র: ব্লুমবার্গ