সমস্যাসঙ্কুল পথে বন্দী হয়ে আছে ভারতের বৈদ্যুতিক গাড়ির স্বপ্ন
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে বেশি বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি করেছে ভারত। এপ্রিল থেকে বাড়তে বিক্রি বাড়তে থাকায় ইতোমধ্যেই গত বছরের মোট আয়ের সমপরিমাণ অর্থ আয় করা হয়েছে এখান থেকে। ভারতে বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্পের জন্য এটি এক আশার আলো।
তবে দিল্লিভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক কাউন্সিল অন এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটারের (সিইইডব্লিউ) তথ্য অনুসারে, এই আর্থিক বছরে ভারতে সর্বমোট ২০ মিলিয়ন অটোমোবাইল বিক্রির মধ্যে মাত্র ১.৬৬ শতাংশ জায়গা দখল করে আছে বৈদ্যুতিক গাড়ি। দেশটিতে বছরে ১ লাখ ২১ হাজার ৯০০ বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি হয়েছে। বৈদ্যুতিক গাড়ির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ৩.৫ বিলিয়ন ডলার স্কিম তৈরি করেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ ভারতে কার্বন নির্গমন কমাতে সাহায্য করবে বৈদ্যুতিক যানবাহন। বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বৈদ্যুতিক বিকল্পের আবেদনও বাড়ছে। ফলে ভারতে জ্বালানি আমদানির খরচ ২৪.৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
সিইইডব্লিউ'তে এনার্জি ফাইন্যান্স সেন্টারের পরিচালক গগন সিধু বলেন, 'এই পদক্ষেপ একদিকে জলবায়ু, অন্যদিকে অর্থনীতি সম্পর্কিত।'
স্বপ্ন
"আমাদের শুধু বৈদ্যুতিক যানবাহন তৈরি করাই বাকি আছে,' বলেন ওলা ইলেকট্রিকের চিফ মার্কেটিং অফিসার বরুণ দুবে।
সম্প্রতি ভারতে ৩২০ মিলিয়ন ডলারের একটি স্কুটার কারখানা গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে তারা। প্রতি বছর ১০ মিলিয়ন ইলেকট্রিক টু-হুইলার (বাইক বা স্কুটার) তৈরির পরিকল্পনা করেছে এই প্রতিষ্ঠান। সংখ্যাটি বিশ্বে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের প্রায় ১৫ শতাংশ।
দুবে বলেন, 'বিশুদ্ধ বাতাসের দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে কেউ বিতর্ক করছে না। প্রশ্ন হলো, কীভাবে আমরা সেই অবস্থায় পৌঁছাব।'
২০১৭ সালে ভারতের পরিবহনমন্ত্রী নিতিন গডকারি বলেছিলেন, তিনি ২০৩০ সালের শেষের দিকে ভারতীয় রাস্তায় শুধুই বৈদ্যুতিক যানবাহন চলতে দেখতে চান। এই অসম্ভব লক্ষ্যকে পরবর্তীকালে সংশোধন করা হয়। বর্তমানে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি, ৭০ শতাংশ বাণিজ্যিক যানবাহন, ৪০ শতাংশ বাস এবং ৮০ শতাংশ দুই ও তিন চাকার যানবাহনকে বৈদ্যুতিক করার পরিকল্পনা রয়েছে দেশটির।
সিইইডব্লিউ'র মতে, দুই ও তিন চাকার যানবাহনগুলো এ দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে। ব্যাটারিচালিত স্কুটার প্রস্তুতকারী ভারতের সবচেয়ে বড় কোম্পানি হিরো ইলেকট্রিক জানিয়েছে, তারা ২০২৭ সালের মধ্যে পেট্রোলচালিত দুই চাকার যানবাহন বিক্রয় বন্ধ করবে।
সোসাইটি অব অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারারসের তথ্য অনুসারে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ভারত প্রায় ১৭.৪ মিলিয়ন টু হুইলার এবং ২.৭ মিলিয়ন গাড়ি বিক্রি করেছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার অনেক জায়গায় টু হুইলারের সংখ্যা গাড়ির চেয়েও বেশি।
কোম্পানিটি জানায়, গত মাসে অনলাইনের মাধ্যমে দুইদিনে প্রায় এক লাখ স্কুটার বিক্রি করে তারা। ভারত একক আর্থিক বছরে যতগুলো ইলেকট্রিক টু-হুইলার বিক্রি করেছে, তার চেয়ে এই সংখ্যা বেশি।
বাস্তবতা
বাস্তবতা হলো, বৈদ্যুতিক গাড়ির বেলায় দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। এই অর্থবছরে ভারতে গাড়ি বিক্রির হার ৪ শতাংশেরও কম।
ফেডারেশন অব অটোমোবাইল ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ভিনকেশ গুলাটি বলেন, সমস্যাটি চাহিদার পরিবর্তে কম সরবরাহ থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত। ভারতে বর্তমানে ২ হাজারেরও কম চার্জিং স্টেশন রয়েছে, যেখানে চীনে রয়েছে প্রায় ৯ লাখ।
এই সমস্যার সঙ্গে তিনি বৈদ্যুতিক গাড়ির খরচের বিষয়টিও উল্লেখ করেন। যেখানে ভারতে একটি গাড়ির গড় মূল্য প্রায় ৭ লাখ রুপি (প্রায় ৮ লাখ টাকা), সেখানে সবচেয়ে সস্তা বৈদ্যুতিক গাড়ির দাম শুরু হয় ১.২ মিলিয়ন রুপি (১৩ লাখ টাকা) থেকে।
ভারতের গাড়ি ক্রেতারা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও ব্যয়ের ব্যাপারে সতর্ক। এই কারণেই ভারতের সবচেয়ে বড় গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি মারুতি এখনো বৈদ্যুতিক গাড়ির বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। একই কারণে বিদেশি কিছু ব্র্যান্ড ভারতে তাদের দোকান বন্ধ করে দিয়েছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে বৈদ্যুতিক যানবাহনে ১১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করলেও গত মাসে ভারতে গাড়ি তৈরি বন্ধের ঘোষণা দেয় ফোর্ড।
এছাড়া, ভারতীয় গাড়ির বাজারে শিগগিরই প্রবেশ করতে যাওয়া টেসলা উচ্চ আমদানির শুল্কের অভিযোগ করেছে। গডকারি অবশ্য জানান, সরকার 'যেকোনো ধরনের সহায়তা' দেবে। টেসলা মূলত স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করবে এবং চীনে তৈরি গাড়ি ভারতে বিক্রি করবে না ।
আইএইচএস মার্কিটের প্রধান অটো সেক্টর বিশ্লেষক পুনীত গুপ্তা বলেন, ভারতে বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজার প্রসারিত হলে আরও বিদেশি সংস্থা আসতে পারে। তবে ২০৩০ সালের আগে এমনটি হতে পারে বলে মনে করেন না তিনি।
অবশ্য দেশটিতে এসব গাড়ির বিক্রি বেড়েই চলেছে। ভারতের সবচেয়ে বড় ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাতা টাটা মোটরসের যাত্রীবাহী গাড়ি বিভাগের সভাপতি শৈলেশ চন্দ্র বলেন, 'আমরা যেখানে ৩০০ গাড়ি বুকিংয়ের জন্য সংগ্রাম করতাম, সেখানে এখন প্রতিদিন তিন হাজার গাড়ির বুকিং পাচ্ছি।'
এদিকে, বৈদ্যুতিক যানবাহনে ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে টাটা মোটরস। আবুধাবি হোল্ডিং কোম্পানি এবং সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক জলবায়ু তহবিল টিপিজি রাইজ থেকে ১ বিলিয়ন ডলার লাভের পর এই ঘোষণা আসে। ২০২৫ সালের মধ্যে চার্জিং প্ল্যাটফর্ম এবং ব্যাটারি প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি বৈদ্যুতিক যানবাহনের ১০টি নতুন মডেল আনতে চায় তারা।
ভবিষ্যৎ
'বৈদ্যুতিক গাড়ির জগত একেবারেই আলাদা,' বলেন গুপ্তা।
গাড়িগুলো যানবাহন প্রস্তুতকারকেরা তৈরি করলেও এটি চালানোর জন্য ব্যাটারি তৈরি করে রাসায়নিক কোম্পানি। এক্ষেত্রে ক্রমাগত উদ্ভাবন নিশ্চিত করতে এসব কোম্পানিকে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তিনি বলেন, 'লাভজনকতার বিবেচনায় ভারত একটি জটিল বাজার। সুতরাং, খরচ বাঁচাতে এবং ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য পারষ্পরিক সহযোগিতা অপরিহার্য।'
এদিকে, বরুণ দুবে আশা করেন, সামনে আরও বড় পরিবর্তন আসবে। কিন্তু তথাকথিত বিপ্লব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আসবে অন্যান্য চ্যালেঞ্জ। ভারত এখনো আমদানিকৃত ব্যাটারির ওপর নির্ভরশীল, যার বেশিরভাগই আসে চীন থেকে। এছাড়া, ব্যাটারির বিকল্পের জন্য খনি (অ্যালুমিনিয়াম) উত্তোলনেও রয়েছে বেশ খরচ।
সিইইডব্লিউ'র সিধু বলেন, 'নিজেদের বাড়িতে থাকা ইলেকট্রনের রঙ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। কিন্তু এই বৈদ্যুতিক যানবাহন আমাদের চারপাশেই দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে প্রতি দশ জন ডেলিভারিম্যানের মধ্যে একজন বৈদ্যুতিক স্কুটার চালান।'
-
সূত্র: বিবিসি