সবকিছুই রাজনৈতিক: পল ক্রুগম্যান
নোবেলজয়ী আমেরিকান অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতা, বিশেষ করে আলোচিত ‘জোম্বি আইডিয়া’র ব্যাপারে।
সম্প্রতি প্রকাশিত তার ‘আর্গুয়িং উইথ জোম্বিস: ইকোনোমিকস, পলিটিকস, অ্যান্ড দ্য ফাইট ফর অ্যা বেটার আমেরিকা’ বইটিতে এ নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। এরই প্রেক্ষিতে, ই-মেইলে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিক হোপ রিজ। জেএস টিওআর ডেইলির সূত্র ধরে চলুন সেই সাক্ষাৎকারের পাঠ নেওয়া যাক-
আপনি লিখেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অস্তিত্বকে খণ্ডন করতে গিয়ে রিপাবলিকানরা আজকের দিনে প্রচুর মিথ্যে জিনিস ‘বিশ্বাস করে, কিংবা বিশ্বাসের ভান করে।’ রিপাবলিকরা যা বলে তা সত্যি বিশ্বাস করে কি করে না- এ কথা আপনি কিভাবে জানেন? এর কি কোনো মূল্য আছে?
পল ক্রুগম্যান : ক্ষমতায় থাকা লোকেদের মাথা সাধারণ অতটা পরিষ্কার থাকে না; রাজনৈতিক সুবিধার্থে কি বলা উচিত এবং নিজে সত্যিকার অর্থে কি বিশ্বাস করেন- এ দুটির মধ্যে জোরালো কোনো পার্থক্য তারা তৈরি করতে পারেন না। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট : বিপাবলিক রাজনীতিকরা যা বলেন, সচেতনভাবেই সেগুলোর বেশিরভাগ তারা নিজেরাই বিশ্বাস করেন না; সত্যকে পাশ কাটিয়ে, রাজনৈতিক ফায়দা নিতেই এমন কথা বলেন তারা। আর সেই কথাগুলো তাদের মুখে মানায়ও না; বোঝাই যায়, জেনেশুনেই তারা মিথ্যে বলছেন। তাই তারা ‘সত্যিকার অর্থে কি বিশ্বাস করেন’- আমি তা জানি না ঠিকই, তবে এই না জানায় কিছু যায়-আসে না।
অটিজমের জন্য টীকা দায়ী, জলবায়ু পরিবর্তন বলে কিছু নেই, ধনীরা যত ধনী হবে গরিবদের ততই লাভ- এ ধরনের ‘জম্বি আইডিয়াগুলো’ বাস্তব তথ্যপ্রমাণের সামনে উধাও না হয়ে উল্টো ছড়িয়ে যাচ্ছে কেন?
পল ক্রুগম্যান : টাকার কারণে। যারা বলেন, তাদের করের টাকা তাদের পেছনেই ব্যয় হয়, কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন একটা ধাপ্পাবাজি- এসব বলার জন্য ধনীদের কাছ থেকে টাকা পান তারা। যখন কোনো একটা বিষয়ের ওপর কোনো মানুষের রুটি-রোজগার নির্ভর করে, তখন সেই বিষয়কে ঠিকঠাক বোঝা সেই মানুষের পক্ষে সত্যি কঠিন।
‘রিপাবলিকান সমর্থক’ এবং ‘কংগ্রেসে থাকা রিপাবলিকান’দের মধ্যে আপনি পার্থক্য করেছেন। এই পার্থক্যকরণটি জরুরি কেন? দায়িত্বরত রিপাবলিকানরা কি নিজ দায়িত্ব ঠিকমতো সামলাচ্ছেন?
পল ক্রুগম্যান : নিজেদের রিপাবলিকান মনে করা প্রচুর সাধারণ মানুষও ‘জম্বি আইডিয়া’কে সমর্থন করে না। কিন্তু দলের নীতির বিরোধিতাও তারা খুব একটা করে না; কেননা, নীতি সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই তাদের। তাছাড়া প্রতিনিধিরাও অনেককেই ভুল বোঝান। শ্বেতাঙ্গ কর্মজীবী ভোটারেরা রিপাবলিকান পার্টির প্রোগ্রামগুলোর ওপর এত বেশি নির্ভরশীল- তাদেরকে যে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে, তারা সেটা টেরও পান না।
নিজেদের প্রতিনিধিদের কোন বিষয়গুলো রিপাবলিকান ভোটারদের জানা থাকা উচিত? নিজেদের মূল স্বার্থের জায়গায় প্রতিনিধিরা এই যে প্রতারণা করছেন, এ বিষয়ে তাদের রিপাবলিকান ভোটাররা জবাবদিহি করাতে পারবেন- এমন কোনো আশা দেখেন আপনি?
পল ক্রুগম্যান : সোশ্যাল সিকিউরিটি, মেডিকেয়ার ও মেডিএইড, জীবনের নিরাপত্তা এবং আরও যেসব বিষয়ে রিপাবলিকান পার্টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলো যদি ভোটাররা বুঝতে পারেন, তাহলে তাদের কেউ কেউ ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রার্থী বদলে নেবেন, এমন আশা করা যায়। কিন্তু তথ্য-বিভ্রান্তির এই কুয়াশায় এটি সত্যি খুব কঠিন।
আপনি বলেছেন, ‘প্রতিজন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টকেই আগের জনের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো দেখায়।’ তার মানে ট্রাম্পের পর তার চেয়েও বেশিমাত্রায় ডানপন্থী- এমন কাউকে আশা করা উচিত আমাদের?
পল ক্রুগম্যান : দেখুন, এটিই রেওয়াজ। পরবর্তী রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টটি ট্রাম্পের চেয়েও স্মার্ট তরিকায় গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সম্পর্কে নিজের মত প্রকাশ করবেন- এই ভয়ই আমি পাচ্ছি।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক জনগণই মূলত সোশ্যাল সিকিউরিটি এবং ইন্ডিভিজুয়াল রিটায়ারমেন্ট সেভিংসের ওপর জীবনধারণ করেন; অন্যদিকে এক চতুর্থাংশ জনগণ পুরোপুরিই সোশ্যাল সিকিউরিটির ওপর নির্ভরশীল। এই লোকগুলোর ওপর ‘জম্বি আইডিয়া’ কী রকম প্রভাব ফেলছে?
পল ক্রুগম্যান : ঋণ ও ছোট সরকারের প্রতি এই আচ্ছন্নতার অর্থ হলো, সোশ্যাল সিকিউরিটি সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ জিনিস; বেশিরভাগ বয়স্ক আমেরিকানের কাছে এটি ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠতে পারে।
নিজেকে জনপ্রিয় দাবি করে এ ক্ষেত্রে কীভাবে রক্ষা পাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প?
পল ক্রুগম্যান : জনগণের কিছু ব্যাপক বিস্তৃত আবেগ, বিশেষ করে বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে খেলা করেন তিনি; সুতীব্র বুদ্ধিজীবিরোধিতাও তার একটা খেলা। তাছাড়া, ধনীদের প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই- এই ভানও তিনি ধরেন। এসবের কারণে অনেক কর্মজীবী আমেরিকান তাকে নিজেদেরই লোক ভাবেন; অথচ আসলে তিনি তা নন।
আপনার মতে, কংগ্রেসে থাকা রিপাবলিকানরা যত বেশি ‘রাজনীতি সচেতন’ হয়ে উঠেছেন, ‘সত্যের প্রতি তাদের কোনো রকম আগ্রহ’ ততই কমছে। এর কারণ কী?
পল ক্রুগম্যান : জলবায়ু পরিবর্তনের অস্তিত্বকে নিজের পার্টি গ্রহণ না করতে মরিয়া হলেও, এই পরিবর্তনের তথ্যপ্রমাণকে রাজনীতি সচেতন নন- এমন একজন রিপাবলিকান মেনে নিতেই পারেন। ফলে পার্টির নীতি সম্পর্কে তারা যত অবগত হবেন, তাদের পক্ষে জম্বি আইডিয়াগুলো মেনে নেওয়া নয়তো পার্টি ছেড়ে দেওয়া ততই জরুরি হয়ে উঠবে।
কংগ্রেসে থাকা রিপাবলিকানদের ‘জম্বি আইডিয়া’কে প্রেসিডেন্টের ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়াটি কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছে?
পল ক্রুগম্যান : দিচ্ছে না আসলে। বড়জোর নীতিমালা হবে। এটি পার্টিজানশিপের শক্তিটিকেই গুরুত্ব দেয়, যেটি জম্বি মহামারিকে বরং ছড়িয়েই দিচ্ছে ।
আইওয়া ককাসের কি অবস্থা?
পল ক্রুগম্যান : কর্দমার মতোই পরিষ্কার! ককাস আসলে বাজে সফটওয়্যারে ভরা একটি ভয়ংকর প্রক্রিয়া; এর ফলাফল কাউকেই ম্যান্ডেট দেয় না।
২০১৬ সালের নির্বাচনে মিডিয়া পক্ষপাতিত্ব করেছে বলে শোনা যায়। এ ব্যাপারে আপনার কী মত? আপনি লিখেছেন, ‘কোনো কারণে সংবাদকর্মীরা পছন্দ করেন না, এমন একজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে এ রকম পক্ষপাতিত্ব বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে; যেমন ফেলেছিল ২০০০ সালে আল গোর ও ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের ক্ষেত্রে।’ আমরা কি মিডিয়ার কাছ থেকেই জানছি? আমরা কি একই ভুল বারবার করছি? রাজনীতিতে এখন যেসব কর্মকাণ্ড চলছে, তাতে মিডিয়ার প্রভাব কতটুকু?
পল ক্রুগম্যান : আপনি এখনও অনেক উভয়মুখিতার দেখা পাবেন; এই রাজনৈতিক অভিযোগটি মিথ্যে- এমন দাবির পক্ষে সংবাদসংস্থাগুলোকে এখনও ভুগতে হচ্ছে, এবং নীতিমালাগুলো কেমন কিংবা সেগুলো ঠিক আছে কি না- এর বদলে বরং নীতিমালার আইডিয়াগুলো কীভাবে ছড়ি ঘুরাচ্ছে- এখনও সেই সেকেন্ড-অর্ডার রিপোর্টিংয়ের ওপর তাদের জোর দিতে হচ্ছে। তাদের নীতিমালাগুলো হয়তো আগের চেয়ে ভালো হয়েছে; তবে জাতীয় নির্বাচন শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হতে পারব না।
আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কনস্পারেসি থিওরিগুলো কীভাবে প্রভাব ফেলছে?
পল ক্রুগম্যান : বহু লোকই বিশ্বাস করে, জলবায়ু পরিবর্তন একটি ধাপ্পাবাজি, এর মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গদের জায়গা দখল করতে চাচ্ছে উদারপন্থীরা... ইত্যাদি। এই (জলবায়ু পরিবর্তনের) আলোচনাকে অবমূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে এটি সত্যি প্রভাব ফেলে। আমার উদ্বেগের জায়গাটি হলো, এমনকি ডেমোক্রেটিক পার্টির কিছু লোকও এর মধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায়, বিশেষ করে যখন কোনোকিছু তাদের বিপক্ষে যায়। এই যেমন, বার্নি স্যান্ডার্সকে আঘাত করার জন্য আইওয়ায় ইচ্ছে করেই ডেমোক্রেটিকরা এ নিয়ে গোলমাল পাকিয়েছে।