মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের নেপথ্য কাহিনী

প্রায় এক দশক টিকে থাকার পর সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের শর্ত ভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটল। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে কাবু করতে অতর্কিত আক্রমণের মতো ছিল এই অভ্যুত্থান- পাঠ্যপুস্তকের জন্য এ হতে পারে এক আদর্শ উদাহরণ।
সোমবার জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল। এর মাঝেই স্থানীয়ভাবে তাতমাদাও নামে পরিচিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দিল। নভেম্বরের নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে এই পদক্ষেপ নেওয়ার দাবী সেনাবাহিনীর। আটক করা হয়েছে অং সান সু চিকেও। পদবীতে দেশটির স্টেট কাউন্সিলর হলেও কার্যত পক্ষে সু চি ছিলেন দেশের প্রধান শাসক। সু চি ছাড়াও দেশটির সিনিয়র কর্মকর্তা এবং শীর্ষ নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ব্যক্তিবর্গকেও আটক করা হয়।
২০০৮ সালে সেনাবাহিনী নির্দেশিত খসড়া সংবিধানকে ব্যবহার করে দেশটিতে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। কমান্ডার ইন চিফ সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং যিনি আগে থেকেই অসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, কার্যত এখন এক স্বৈরশাসকে পরিণত হলেন। তিনি "নিরপেক্ষ ভাবে একটি প্রকৃত, নিয়মানুবর্তী বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা"-র প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই সাথে আগাম নির্বাচনের ঘোষণাও দিয়েছেন। তবে নির্বাচনের তারিখ এখনো অনির্দিষ্ট।
কিন্তু কেন হলো এসব? আর এখনই কেন? সেনাবাহিনী ইচ্ছা করেই এমন এক সংকটের সৃষ্টি করেছে যাতে তারা আবারও দেশ এবং সংবিধানের তথাকথিত রক্ষাকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। সেই সাথে সর্বকালের জনপ্রিয় রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষকেও ঠেলতে চাইছে ধ্বংসের মুখে।
তবে সম্ভবত বেশ দেরী হয়ে গেছে। আপাতদৃষ্টিতে দখলকৃত ক্ষমতাকে বিশেষ প্রাপ্তি বলে মনে হলেও বিষয়টি এত সরল নয়।
এক দফা ক্ষমতায় থাকার পর এবারের নির্বাচনে সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির ফল ২০১৫ সালের অভূতপূর্ব জয়কেও ছাড়িয়ে গেছে। নভেম্বরে করোনা মহামারির মাঝেও ৭০ শতাংশ ভোটার ভোট প্রদান করে। এর মধ্যে এনএলডি প্রায় ৮০ শতাংশ ভোট পায়। কার্টার সেন্টার এবং পিপলস অ্যালায়েন্স ফর ক্রেডিবল ইলেকশনস সহ আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় পর্যবেক্ষকেরা নির্বাচনকে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ ঘোষণা করে। প্রশাসনের জন্য জনগণের পক্ষ থেকে ছিল প্রশ্নাতীত সমর্থন।
সাংবিধানিকভাবে দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে আছে অশেষ ক্ষমতা। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র এবং সীমান্ত সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ও সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এমনকি সেনাবাহিনীর জন্য জাতীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে সংসদে ২৫ শতাংশ সিট বরাদ্দ থাকে। সংবিধানের মূল ধারাগুলো সংশোধনের ক্ষেত্রেও সেনাবাহিনীর ভেটো প্রদানের ক্ষমতা আছে। অন্যদিকে, তাতমাদাওদের অর্থনৈতিক স্বার্থেও কোনো হস্তক্ষেপ করা হয় না। বৃহৎ সামরিক বাজেট ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকানা থেকে আছে তাদের স্থিতিশীল আয়ের ব্যবস্থা। দেশের অভ্যন্তরে তারা যেকোনো বাণিজ্যিক প্রকল্পকেই কোনো আইনি বাধা ছাড়া আত্মবিশ্বাসের সাথে টেক্কা দিতে সক্ষম।
কিন্তু যদি হাতে ক্ষমতা থাকেই তাহলে আবার কেন ক্ষমতা দখল? এমনকি তাতমাদাওদের এই অভ্যুত্থানের ব্যর্থতা তাদের অবস্থানকে আরও নামিয়ে দিতে পারে।
অং সান সু চি এবং জেনারেল মিন অং হ্লাইং এর মধ্যকার সম্পর্ক এমনিতেই কর্কশ। ২০১৫ সালের পর থেকে বিশেষ কিছু জনসভা ছাড়া তারা কদাচিৎ সাক্ষাৎ করেছে।
তবে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের বাইরেও রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধ। প্রায় তিন দশক ধরে এনএলডি তাতমাদাও এবং নিরাপত্তা সংস্থার দ্বারা নিপীড়নের শিকার। দলটির শ'খানেক সদস্যদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন, হত্যা এবং নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে।

তবে এক দিক থেকে, সোমবারের অভ্যুত্থান দুই এলিটের মধ্যকার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব বলেই মনে হবে। দু'জনেই বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী এবং মিয়ানমারের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বামারের সদস্য। এমনকি দুইজনের মানসিকতাও এক; দু'জনেরই জন্ম হয়েছে যেন কেবল শাসন করার জন্য।
তবে একটা বিষয়ে খটকা লাগবে। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও অং সান সু চির দল আইনি, অর্থনৈতিক কিংবা সাংবিধানিক ভাবে সামরিক ক্ষমতা হ্রাস করা থেকে বিরত ছিল।
ক্ষমতায় থাকাকালীন দমনকারী আইন প্রত্যাহার, রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিদান এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় এনএলডিকে অ্যাক্টিভিস্টদের সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। সুশীল সমাজ, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীদের বিষয়ে উদাসীনতার জন্য পশ্চিমা বিশ্লেষক এবং মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংগঠক- দুই পক্ষ থেকেই সু চিকে দায়ী করা হয়।
পাঁচ বছর ধরে সামরিক বাহিনীর কারণে এক অনিশ্চিত জীবন যাপনের কথা আমার কাছে বহু এনএলডি সদস্য স্বীকার করেছে। জেনারেলদের হস্তক্ষেপ এড়াতে প্রশাসন এবার গণতান্ত্রিক এজেন্ডা গ্রহণ করবে বলেই ধারণা করা হয়েছিল।
এরপরই নভেম্বরের নির্বাচনে এনএলডি জয়লাভ করে। সেই সাথে হাতে পায় দ্বিতীয় মেয়াদে দীর্ঘকালীন কর্তৃত্ব। তাতমাদাওদের কাছে মনে হচ্ছিল ক্ষমতার পাল্লা ভারসাম্য হারিয়ে এখন এনএলডির দিকে ঝুঁকছে। সেনাবাহিনীর অশেষ ক্ষমতার জন্য নিশ্চিতভাবেই তা হুমকিস্বরূপ। সামরিক জান্তার পায়ের মাটি সরে যাওয়ার আগেই অভ্যুত্থানটি ছিল এক প্রতিরোধমূলক আঘাত।
বিশেষ করে ব্যক্তিগতভাবে জেনারেল মিন অং হ্লাইং এর জন্য অভ্যুত্থানটির প্রয়োজন ছিল। এবছর হ্লাইং-এর অবসরে যাওয়ার কথা। পাঁচ বছর আগে ক্ষমতার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য তিনি অবসরের বয়স ৬০ থেকে বাড়িয়ে ৬৫ করেন। কূটনীতিকরা আমাকে ব্যক্তিগত ভাবে বলেছেন যে, ক্ষমতা ছাড়ার বিষয়ে হ্লাইং উদ্বিগ্ন ছিল। কেননা অবসরে যাওয়ার পর তাকে বহু কারণে আদালতের সম্মুখীন হতে হবে। বিশেষত রোহিঙ্গা মুসলিমদের জাতিগত নির্মূলে নেতৃত্ব দানের অভিযোগে হ্লাইংকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হতে পারে।
তবে বিভিন্ন র্যাংকের সেনা সদস্যদের মধ্যে অভ্যুত্থান কতোটা জনপ্রিয় তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। নভেম্বরের নির্বাচনে সৈন্যদের থেকে সু চি সমর্থন পেয়েছিল। ধারণা করা হয় অধিকাংশ সৈন্যই এনএলডিতে ভোট দিয়েছিল। এ সম্পর্কে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো তথ্য না থাকলেও উদাহরণ হিসেবে দেশটির পূর্বাঞ্চলের কথা ধরা যায়। জাতীয় এবং স্থানীয়ভাবে এখানে এনএলডি জয় লাভ করেছে। শান প্রদেশের কেংটুং যেখানে সামরিক বাহিনীর হাজারো ট্রুপ এবং আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডের বাস, সেখানেও দলটি জয়লাভ করেছে।
অভ্যুত্থানটি ট্রুপের সদস্যদের মধ্যে মনোবল এবং সংহতি হ্রাস করতে পারে। কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর সাথে সশস্ত্র সংঘাতের কারণে বহু সাধারণ সেনাসদস্য হতাহতের শিকার হয়। নানাবিধ অসন্তোষের কারণে সেনাবাহিনীতে বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। অভ্যুত্থানের পর জেনারেলরা কি পুরো সামরিক বাহিনীর সমর্থন পাবে কি না তা নিয়েও আছে সংশয়।
গতানুগতিক স্বৈরশাসকদের নোংরা খেলার সম্প্রসারণ করে নতুন জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং বিরোধীদের সরিয়ে সাময়িকভাবে হয়তো ক্ষমতা লাভ করলেন। কিন্তু, তাতমাদাওদের মাঝে এখন অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাই বেশি। সেনা সদস্যদের পাশাপাশি পুরো জাতির সামনে দাঁড়ানোর মতো চ্যালেঞ্জও অপেক্ষা করছে জেনারেলদের সামনে। বিশেষত জাতি যখন কিছু সময়ের জন্য হলেও গণতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছে, তাদের সমর্থন পাওয়াও কঠিন হতে পারে। পুরো দেশকে নিজেদের প্রিটোরিয়ান আকাঙ্খার মধ্যে টেনে এনে, মিয়ানমারের জেনারেলরা প্রকৃতপক্ষে নিজেদের স্বার্থ বিরোধী কাজই করছে।
- অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা