মহামারির পরও থাকুক মাস্ক পরার অভ্যাস
ভারতে মহামারি আঘাত হানার পর এক বছর পার হয়েই গেল, এরমধ্যে আমার জন্য সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল নিজের সুস্বাস্থ্য। পথেঘাটে চলতে যতো জনের সঙ্গে দেখা হয় আমার মতো তাদের বেশিরভাগই গত ১২ মাস ধরে মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে তুলেছেন। অনেকে পড়তেই চান না, কী কারণে সেটা বোধগম্য নয়। আমি কিন্তু মাস্কের পাশাপাশি নিয়মিত বিরতিতে হাত ধোয়াকেও প্রায় আধ্যাত্মিক কর্তব্যের মতো পালন করি। আর এসবের সুফলও পেয়েছি হাতেনাতেই, বিশ্বাস করুন গত এক বছরে আমি একবারও সর্দির কবলে পড়িনি।
দিল্লির মতো দূষিত বাতাসের মহানগরে বাস করেও সর্দিকাশি না হওয়াটা সত্যিই বিস্ময়কর। বিশেষত যখন ভৌগলিক অবস্থানের কারণেও শহরটিতে ঋতু বদলায় আকস্মিকভাবে, সঙ্গে যানবাহন- মানুষের ভিড় ও ধুলি দূষণ তো আছেই।
এইবেলা বলে রাখা ভালো, আমার আগে থেকে কোনো মাস্ক প্রীতি নেই। আর উত্তর ভারতের প্রখর উত্তাপের ঘেমো গ্রীষ্মকালে মুখে কিছু পরে থাকাটাই আসলে অস্বস্তিকর। তারপরও আমি আশা করছি, এই মহামারির উপদ্রুপ বিদায় নেওয়ার পরও সকলে এই মাস্ক পরার অভ্যাসটি ধরে রাখবেন।
এখনকার মতো সর্বক্ষণ পরবেন সেটা আশা করছি না, সেটা বাড়াবাড়ি পর্যায়েও চলে যায়। কিন্তু, বিশ্বব্যাপী সকল শহরবাসী যদি পূর্ব এশিয়ার মানুষের মতো মাস্ক পরার অভ্যাসটি রপ্ত করে ফেলেন সেটা কি জনস্বাস্থ্যের জন্য চমৎকার অগ্রগতি হবে না? প্রতি শীতেই হানা দেয় ফ্লু, তখন যদি সকলে বিমানে ভ্রমণের সময় বা জন-সমাগম স্থলে মাস্ক ব্যবহার শুরু করেন সেটা কি রোগটির বিস্তার নিয়ন্ত্রণে কাজে আসবে না? একবার এই দৃশ্য কল্পনা করুন, আর ভাবুন মানুষ আরও সচেতন হয় উঠেছে- তখন দেখবেন পরিবর্তনটাও দিব্যদৃষ্টিতে সহজেই আন্দাজ করতে পারবেন।
করোনাভাইরাসের মতো শ্বাসযন্ত্রকে আক্রান্ত করা ভাইরাস আগামীতেও দেখা দেবে, বিজ্ঞানীরা বলছেন এধরনের বায়ুবাহিত ভাইরাসের ঝুঁকি আছে পুরো মাত্রাতেই। তাই মহামারি শেষেও যদি কেউ অন্যদের সামনে হাঁচিকাশি দেওয়ার বদলে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় নিয়ম করে মাস্কটি সঙ্গে নিয়ে বের হন- তাহলে সেটা খুব সাধারণ অথচ বড় মাপের উন্নতি আনবে নিশ্চয়।
আমার এই আশাটি পৃথিবীর কোনো কোনো স্থানে পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই সেটা আমি ভালো করেই জানি। বিংশ শতক ছিল একইসঙ্গে বৈশ্বিক রাজনীতির মেরুকরণ ও মতভেদে বিভাজনের শতক, তারপরও যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু দেশের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তাচেতনায় বিশ্বাসী মানুষ যেভাবে মাস্ক না পরাকে তাদের রাজনৈতিক দর্শনের প্রতীক হিসেবে জাহির করেন- তা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।
অথচ, মহামারির উৎস সার্স কোভ-২ ভাইরাস প্রতিরোধের যে সহজ উপায়টি আমরা সকলেই মেনে চলতে পারি সেটাই হলো মাস্কের ব্যবহার। এটা না বুঝতে পারার মতো কঠিন কোনো বিষয় নয়। তবুও, মানব জাতির একাংশ মনে করছে মাস্ক না পরে বরং অন্যের মুখের উপর হাঁচিকাশি দিয়ে ফেলাটাই হচ্ছে ভদ্রতার পরিচয়!
যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষও সবসময় বাস্তবজ্ঞান সম্মত কাজ করেছেন সেই দাবি করা যাবে না। গেল মার্চে দেশটির শীর্ষ সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. অ্যান্থনি ফাউচি আমেরিকানদের "মাস্ক নিয়ে সবসময় ঘোরাফেরার দরকার নেই" বলেও জানান। তার উপর ট্রাম্প প্রশাসন ও রিপাবলিকান দলের রাজনৈতিক চাপ ছিল নিঃসন্দেহে, পরবর্তীতে তিনি সেই ভুল সংশোধন করেছেন, কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হবার হয়েই যায়। মিশ্র বার্তায় মাস্ক পরার ব্যাপারেই সন্দিহান হয়ে ওঠে নাগরিকদের একটি বড় অংশ। এধরনের অসম বার্তা কখনোই সুফল দেয় না।
তবুও বলব, যারা নিয়ম করে পরেছেন তাদের জন্য গেল বছর মাস্কই ছিল সবচেয়ে ইতিবাচক প্রাথমিক সুরক্ষা মাধ্যম। নিজের ব্যাপারে অন্তত এটা নিশ্চিত দাবি করেই বলতে পারি। গেল বছর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশজুড়ে পৃথিবীর সবচেয়ে কড়াকড়ি রকমের লকডাউন ঘোষণা করেন। বাজার বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধ হয় অনেক জরুরী পণ্য সরবরাহ, প্রথমদিকে প্রয়োজনীয় জিনিষ কিনতেই মানুষকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল। কিন্তু, আমার কিন্তু মাস্ক কেনা নিয়ে ঝামেলা হয়নি। কারণ, দিল্লির নিজের ফ্লাট বাড়িতে বেশ আগে থেকেই অনেকগুলো এন৯৫ মাস্ক আমি কিনে রেখেছিলাম।
দিব্যদৃষ্টিতে মহামারি আসছে দেখে আমি মাস্ক কিনেছিলাম- এমন কিন্তু নয়। সত্যিই এমন ক্ষমতা থাকলে হয়তো মাস্ক না কিনে বাজার-সদাই করে রাখতাম বেশি করে। আবার ভাইরাসের খবর শোনার সাথে সাথে মাস্ক মজুতকারী হয়ে উঠেছিলাম ব্যাপারটা তেমনও নয়।
আমার কাছে প্রচুর মাস্ক জমা থাকার কারণ ছিল- এগুলো আমি কয়েক বছর আগের এক শীতকালে বেশি করে কিনে রেখেছিলাম। না ফ্লু' থেকে রক্ষা পেতে নয়, বরং তার চেয়েও ভয়ঙ্কর দিল্লির ধোঁয়াশা থেকে বাঁচতে। শীতে দিল্লির বায়ুদূষণ পরিস্থিতির চরম অবনতি হয় সেকথা সকলেই জানেন, তখন এমনকি খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়াও বিপজ্জনক। হবেই বা না কেন বায়ুদূষণের বিচারে দিল্লিই যে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত মহানগর। তাছাড়া, ভারতবাসী হিসেবেই বলি- বিশ্বের দূষিততম শহরগুলোর দুই-তৃতীয়াংশই আছে ভারতে। দিল্লির আশেপাশের উত্তরাঞ্চলীয় সমভূমিতেই এর বেশিরভাগের অবস্থান। তাই শীতকালে স্বাভাবিকের চেয়েও দশগুণ বেশি দূষিত বাতাসের বিপদের মুখে সচেতন মানুষেরা নিজের ফুসফুস রক্ষা করতে মাস্ক পরাকেই শ্রেষ্ঠ উপায় বলে মনে করেন।
সত্যি বলতে কী প্রথম কয়েকবার যখন দিল্লির রাস্তায় মাস্ক পরে বেরিয়েছি তখন নিজেকে বোকা বোকা লাগতো। আসলে মহামারি পূর্ব সেসব দিনগুলোতে আমার চারপাশের মানুষজন কেউই মাস্ক পড়তেন না। তারা নির্ভাবনায় একে-অন্যের পাশে দাঁড়িয়ে ফুসফুস ভরে ধূসর- বিষাক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতেন।
তাই আমার শহরবাসী যে এখন মাস্ক পরছেন আর সেটা যে প্রতিনিয়ত চোখে পড়ছে এটাও আমার আনন্দের আরেক উৎস। কারণটাও বোধগম্য, মহামারি না থাকলেও দিল্লিতে মাস্ক ছাড়া বসবাস আপনার জন্য প্রাণঘাতীই হবে। একই যুক্তি, বিশের অন্যান্য দূষিত নগর কেন্দ্রগুলোর জন্যেও প্রযোজ্য।
- লেখক: মিহির স্বরূপ শর্মা ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক। তিনি নয়াদিল্লি ভিত্তিক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো এবং সংস্থাটির অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রকল্পের প্রধান। তিনি 'রিস্টার্ট: দ্য লাস্ট চান্স ফর দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনমি' শীর্ষক এক সমাদৃত গ্রন্থের লেখক।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত