ভ্যাকসিন পাসপোর্ট কী এবং কিভাবে কাজ করে
সারা বিশ্বজুড়ে যখন লাখ লাখ মানুষ কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সুরক্ষা পেতে ভ্যাকসিন নিচ্ছে, তখন শীর্ষ রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ মনে করছেন একটি 'ভ্যাকসিন পাসপোর্ট' চালু করলে দেশগুলো আবার সচল হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এখন প্রশ্ন হলো- এই ভ্যাকসিন পাসপোর্ট কি? সহজ কথায় এটি একজন ব্যক্তি ভ্যাকসিন নিয়েছে কিনা তা বোঝার একটি যাচাইযোগ্য দলিল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যেই বিমান, জাহাজ ভ্রমণ বা কনসার্টে প্রবেশের ক্ষেত্রে ব্যক্তির ভ্যাকসিন নেয়া বাধ্যতামূলক করে দিচ্ছে। একই সঙ্গে এ ব্যাপারে অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো এগিয়ে আসছে। কিন্তু তাদের এই অভিপ্রায় নিয়ে উঠেছে বৈজ্ঞানিক ও নৈতিক প্রশ্ন।
১। ভ্যাকসিন পাসপোর্ট শুরু করতে চাওয়ার কারণ কি?
এই মুহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও এয়ারলাইনসগুলো ভ্রমণের ক্ষেত্রে প্রমাণ দেখতে চায় যে যাত্রীরা করোনা আক্রান্ত নয়। কিন্তু স্থানভেদে এসব বিধিনিষেধ ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতীয়মান হলেও, যাত্রীদের ভ্যাকসিন নিতেই হবে এমন কোন নিয়মানুগ আবশ্যিক শর্ত কোথাও দেয়া হয়নি। সহজভাবে বলতে গেলে 'ভ্যাকসিন পাসপোর্ট' বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া 'ইয়েলো কার্ড' (অতীতের সকল টিকাদানের প্রমাণাদি সংযুক্ত বুকলেট) এর আধুনিক ও নিরাপদ রূপ। ভ্যাকসিন পাসপোর্ট থাকলে ব্যক্তির টিকা নেয়ার অবস্থা বুঝা যাবে এবং এর থেকে সীমান্ত প্রতিনিধি ও ভ্রমণসঙ্গীরাও নিশ্চিত হতে পারবেন করোনা সংক্রমণ না হওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র মার্গারেট হ্যারিস-এর মতে, এই ধরনের একটি প্রমাণ চাওয়ার ফলে জাল বা নকল ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট তৈরির সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
২। টিকা নেওয়ার প্রমাণ থাকতে হবে কাদের?
বেশকিছু কোম্পানি ইতিমধ্যেই টিকা নেওয়ার প্রমাণ থাকা বাধ্যতামূলক করবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে আগামীতে এটি আরো বড় পরিসরে চালু হবে। মহামারীর শুরুর দিকে ক্ষতির শিকার হওয়া, যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাগা ক্রুইজেস তাদের যাত্রীদের কাছ থেকে টিকা নেওয়ার প্রমাণ চাইবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। অস্ট্রেলীয় এয়ারলাইন কান্তাস এয়ারওয়েজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অ্যালান জয়েস জানিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশ ও ত্যাগের ক্ষেত্রে বিমানে ওঠার আগেই তার কোম্পানি ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রমাণ চাইবে যাত্রীদের কাছে। হংকংও ঘোষণা দিয়েছে যে সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য ভ্রমণ করিডরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হলে তাদের স্থানীয় জনসাধারণকে পুরোপুরি টিকার ডোজ নিতেই হবে। লাইভ ইভেন্ট আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠান 'টিকিটমাস্টার' জানিয়েছে, তারা এমন আয়োজক খুঁজছেন যারা টিকা নেওয়ার প্রমাণ দেখে শো আয়োজন করতে ইচ্ছুক। এক্ষেত্রে তারা তাদের ডিজিটাল টিকিটে ভ্যাকসিন নেওয়ার রেকর্ড রাখবেন।
৩। দেশগুলোর কি ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রমাণ থাকতে হবে?
যত বেশি মানুষ ভ্যাকসিন নিবে, ততই এই সম্ভাবনা বাড়তে পারে; যদিও ডব্লিউএইচও একে সমর্থন করছে না। অন্যদিকে ডব্লিউএইচও'র দেয়া ভ্রমণ বিধিনিষেধ ব্যাপকভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কারণ বহু দেশই অন্যান্য দেশের উপর কোভিড-সম্পর্কিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী, এর অংশীদার ১৯৬টি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পীতজ্বরে (উষ্ণমন্ডলীয় দেশে ভাইরাজনিত একটি রোগ) আক্রান্ত হলে টিকা নেয়া থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু ডব্লিউএইচও এই তালিকায় কোভিড-১৯ এর নাম সংযুক্ত করতে নারাজ। এর পেছনে তারা দুটি কারণ দেখিয়েছে- প্রথমত, টিকার ডোজ আসলেই কতদিন মানুষকে কতটুকু সুরক্ষা দিতে ও সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম তা এখনো স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, কোভিড ভ্যাকসিনের সরবরাহ কম। গতবছরই তারা অ্যান্টিবডি থাকার ভিত্তিতে 'ইমিউনিটি পাসপোর্ট' চালু করার বিপক্ষে রায় দিয়েছে। কারণ অ্যান্টিবডি থাকলেই যে কেউ আবার করোনা আক্রান্ত হবেনা তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
৪। ভ্যাকসিন সরবরাহের সীমাবদ্ধতার অর্থ কি?
এর অর্থ হচ্ছে এই যে, একটি বিশাল জনসংখ্যা যারা টিকার স্বল্পতার কারণে টিকা নিতে পারেনি, তাদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধির শর্ত মোতাবেক, শুধুমাত্র বৈষম্যহীনভাবে সম্ভব হলেই ডব্লিউএইচও এর নির্দেশাবলীর বাইরে গিয়েও জনস্বাস্থ্যমূলক পদক্ষেপ নেয়া যাবে। কেউ কেউ মনে করছেন, ভ্যাকসিন পাসপোর্ট দ্বারা বিশ্বব্যাপী একটি 'টিকাভুক্ত অভিজাত শ্রেণী' তৈরি হবে। ফলে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মানুষেরা ভ্রমণের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে এবং ব্যাপক বৈষম্য তৈরি হবে। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, ভ্যাকসিন পাসপোর্টের ফলে জাতি-বর্ণবিশেষে ও স্মার্টফোন থাকার দিক থেকেও বৈষম্য তৈরি হবে। কারণ এই পাসপোর্ট থাকার জন্যে একটি স্মার্টফোনও থাকতেই হবে, ফলে ব্যক্তির গোপনীয়তাও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিশ্বের সবাই ই যদি সমানভাবে ভ্যাকসিন পায়, তাহলে এসব সমস্যার আংশিক সমাধান সম্ভব। কিন্তু এই মুহূর্তে সকলের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৫। ভ্যাকসিন পাসপোর্ট কারা বানাবে?
ভ্যাকসিন পাসপোর্ট তৈরির উদ্দেশ্যে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও সরকারও কাজ শুরু করেছে।
'ইনোভেট ইউ কে'র অর্থায়নে প্রযুক্তিগত প্রতিষ্ঠান এমভাইন ও আইপ্রুভ একটি কোভিড-১৯ ইমিউনিটি ও ভ্যাকসিন পাসপোর্ট পরীক্ষার জন্য লাইভ-টেস্টিং শুরু করে দিয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, কমন প্রজেক্টস এবং রকফেলার ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, তারা সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে ৫২টি দেশের ৩৫০ জনেরও বেশি নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা 'কমনপাস' নামক একটি নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন।
গ্রিস ও সাইপ্রাসের মত পর্যটননির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি সার্টিফিকেট তৈরির কাজ করছে। এটি আগামী জুনের মধ্যে অনুমোদন পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্য তাদের বর্তমান জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা অ্যাপের সঙ্গে মিলিয়ে আরো একটি প্রজেক্ট তৈরির চেষ্টা করছে যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য দেশের অনুমোদন পাবে বলে তাদের প্রত্যাশা।
ভ্যাকসিন পাসপোর্ট তৈরির উদ্যোগ নেয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ফ্রান্স। তাদের ইতিমধ্যেই একটি কোভিড চিহ্নিতকারী অ্যাপ রয়েছে যা তারা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কিছু ফ্লাইটে বসিয়েছে। ফ্রান্সের এই কার্যক্রম আগামী মে পর্যন্ত বর্ধিত করার কথা রয়েছে।
ইসরায়েল তাদের টিকা নেওয়া নাগরিকদের 'গ্রিন পাসপোর্ট' দিতে চেয়েছে। এদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও জানিয়েছে, তারা কোভিড পরীক্ষার ফলাফল ও টিকাদান তথ্যাদির ভিত্তিতে স্বাস্থ্য সার্টিফিকেট প্রদান করার ব্যবস্থা নিতে ইচ্ছুক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তাদের বিমানগুলোতে তাদের নিজস্ব কোভিড চিহ্নিতকরণ অ্যাপ বসিয়েছে।
৬। টিকা না নেওয়া ব্যক্তিদের আটকে দেয়া ব্যতীত আর কিভাবে সীমান্তে 'ভ্যাকসিন পাসপোর্ট' কাজে লাগতে পারে?
টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন পাসপোর্ট একটি স্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং তাদেরকে বর্তমানে আরোপিত বিধিনিষেধের জালে পড়তে হবেনা। জানুয়ারির মাঝামাঝিতেই ডজনখানেক দেশের চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, টিকার পূর্ণাঙ্গ ডোজ নেয়া ব্যক্তিদের যেন অন্তত ৬ মাসের জন্য মুক্তভাবে ভ্রমণ করতে দেয়া হয়।
- সূত্র- ব্লুমবার্গ